মুক্তির পাণ্ডুলিপি

মা, কেমন আছো?
আমি ভালো নেই।
এই শহরের অলিগলিতে জীবনটা ঠায় থমকে গেছে।
জং-ধরা একটা পুরনো চাকার মতন ঠেলে ঠেলে জীবন চলছে।
এই ইট-পাথরের শহরের কোথাও ভালোবাসার কোনও হদিসই নেই!


জানো মা, প্রতিটি গভীর রাতে ঘুম ভেঙে
আমি তোমার উষ্ণ বুকের ঘ্রাণ খুঁজি। আধোঘুমেও তোমায় হাতড়ে বেড়াই।
বুকের ভেতর হু হু করে কে যেন প্রতিমধ্যরাতেই গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে!
এ কেমন জীবন, মা?
বেঁচে আছি কি নেই, তা-ও যেন ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না!


আচ্ছা মা, বাবার কথা মনে আছে তোমার?
সেই দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তুমি একা একা সংসারের ঘানি টেনেই যাচ্ছ!
বাবা ছাড়া কেমন লাগে তোমার? খুউব একা? নিঃস্ব লাগে?
ছোটোবেলায় বুঝতাম, তুমি ভীষণ একাকিত্বে ভুগছ।
মা, এখন আমিও ভীষণ একাকিত্বে ভুগি।
আমার কিছুই ভালো লাগে না। কাউকেই ভালো লাগে না।
কেমন একটা নিস্তরঙ্গ অবসাদ, নিদারুণ বিষণ্ণতা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রতিমুহূর্তেই!


তুমি পাশে থাকলে বোধহয় ভালো থাকতাম।
তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতাম নির্ভাবনায়,
আর তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বাবার কথা বলতে,
---ঠিক যেমনটা করতে ছোটোবেলায়।
এখন খুব দুঃখ হয়…কেন যে বড়ো হয়ে গেলাম!
যত বড়ো হয়েছি, দিনে দিনে তত বেশি একা হয়েছি।
যতই দিন বাড়ছে, এই একাকিত্বটা ততই বাড়ছে।
পৃথিবীর সবাই কেন তোমার মতন হয় না, মা?
কেন একটা মানুষও, চোখ দেখেই বুঝতে পারে না চোখের ভেতরের হাহাকারটুকু?


সেই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার পর থেকে রীতিমতো মৃত্যু হয়ে চলেছে আমার!
ঘৃণার স্তূপটা বেড়েছে দিন দিন। সাথে ফুঁসেছে নিঃসঙ্গতার বেপরোয়া ঢল।
তার চেয়ে তো ঢের ভালো ছিল…
গ্রামে সাদাসিধে কোনও গৃহবধূ হয়ে সংসারী হওয়া, সুখী হওয়া,
কয়েক ডজন বাচ্চাকাচ্চা পালা। তখন সময়টা বেশ কেটে যেত!
কেন যে সভ্য হতে এসে এত অ-সুখের আয়োজন করলাম নিজহাতেই!
মা, আজ বুঝি, সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না,
বরং বেশি কিছু জীবনে আসার মানেই সুখকে ক্রমেই বিদেয় করা!
ছোট্ট একটা জীবন, সেটাও কিনা পার করে দিচ্ছি সুখ খুঁজতে খুঁজতে!
যতই খুঁজেছি, ততই বুঝেছি…এই পৃথিবীতে ‘আরও সুখ’ বলে কিছু নেই।
বাড়তি সুখের আয়োজনের অর্থই হলো, নগদ সুখের বিসর্জন…সুপ্ত দুঃখের আবাহন!
আমি সংসার করিনি অসুখী হবার ভয়ে, কিন্তু না করেও-বা কতটুক সুখী হয়েছি?


জানো মা, একটা সময় বাঁচতে খুব ইচ্ছে করত, এখন আর তা-ও ইচ্ছে করে না।
আমার খুউব মরে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি বেঁচে না থাকলে বোধহয়
এতদিনে সত্যি সত্যিই মরে গিয়ে বেঁচে যেতাম বাবার মতো!
আসলে, আমিও বাবার মতো বেঁচে যেতে চাই।
আমার সবকিছুই অসহ্য লাগে। সবকিছুই অকারণ অনর্থক লাগে।


আচ্ছা মা, বাবা চলে যাবার পর, তুমি তো আমরা ছিলাম বলেই
বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েছিলে, তাই না?
আমিও, তুমি আছো বলেই বাধ্য হয়ে বাঁচি।
আমার কাছে, এর বাইরে, তেমন স্বচ্ছ একটাও কারণ নেই বাঁচার।
উচ্ছ্বাস নেই, উল্লাস নেই। নেই কোনও অভিপ্রায় কিংবা পিছুটান।


এখন বুঝি, তোমারও আমার মতোই
তীব্র বিতৃষ্ণা ছিল জীবনের প্রতি, একপৃথিবী ঘৃণা জমে ছিল পুরো পৃথিবীর প্রতি।
আমরা না থাকলে তুমি যেমনি অনেক আগেই মরে যেতে,
ঠিক তেমনি তুমি না থাকলে আমিও অনেক আগেই মরে যেতাম
…স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে, সুস্থমস্তিষ্কে।


তুমিই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ, মা!
আমার মৃত্যু তোমার সহ্যের বাইরে বলেই এখনও বেঁচে থাকতে বাধ্য হই!
নইলে সেই কবেই পৃথিবীর মুখে একদলা থুতু ছুড়ে দৌড়ে পালাতাম!
আমি ভীষণ করে চাই, তুমি খুব দ্রুতই মরে গিয়ে এই কষ্ট থেকে বেঁচে যাও!
আমিও মরে গিয়ে বাঁচতে চাই বাবার মতো করে।
আমি, তুমি আর বাবা। আমরা তিন জন পাশাপাশি তিনটা কবরে শুয়ে থাকব একটা সুখী পরিবারের মতন। ওপারে গিয়ে সবই পেয়ে নেবো, হয়নি যা-কিছু এপারে পাওয়া।
আমি ওপারে তোমাকে আর বাবাকে সুখী দেখতে চাই, মা!
বাবা নিশ্চয়ই আমাকে আদর করতে না পারার কষ্টটা বুকে পুষে রেখে আজও অনেক কাঁদে, মা!
একবার, শুধু একবার হলেও সুখী হতে চাই…আমিও…তোমাদের দুজনকে নিয়ে!
এপারে আমার ঘৃণা আর বিতৃষ্ণার ভার গোটা পৃথিবীর চেয়েও ভারী হয়ে গেছে!


আমি বাঁচতে চাই, মা, আমি বাঁচতে চাই!
আমি মরে গিয়ে বাঁচতে চাই। আমি বাবার মতো বাঁচতে চাই।
এখন বুঝি, মরে গিয়ে বাবা ভালোই করেছে!


আমার কিছুই ভালো লাগছে না, মা।
এই শহরের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে দেয়াল, পলকে পলকে দেয়াল। ইট, পাথর, ধুলো, ধোঁয়া।
নির্লিপ্ততা, নির্দয়তা। এই শহরে আর কিছুই নেই!
এই শহরে মানুষ নেই, মা! এই শহরে কেবলই জনসংখ্যা আছে।
এই শহর মরে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে আমি মরে যাবারও বহু বহু আগেই!
এই শহরে কেউ কারও নয়, মা!


নিজেকে আজকাল বড্ড নিঃস্ব লাগছে।
কেন এতগুলি অপ্রয়োজনীয় বছর বাঁচতে হয় মানুষকে?
কী হয় কিছু মানুষের গড় আয়ু স্রেফ দশ বা বারো বছরে থেমে গেলে?
পঁচিশ ত্রিশ বছর পর্যন্ত বাঁচাটাকে ইদানীং খুবই অনর্থক অহেতুক মনে হয়।
এই যে বিনা হেতুতে কতগুলো বছর বেঁচে আছি, এর কোনও মানে হয়?
সুযোগ থাকলে আমি একসেকেন্ডেই মরে বেঁচে যেতাম, মা!


ইদানীং তোমাকে মিস করছি ভীষণভাবে!
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, মা! ইচ্ছে করে,
তোমার গলা জড়িয়ে চুমু খাই, বুকে জড়িয়ে নিয়ে বুকের সাথে লেপটে, চেপে ধরে রাখি অনন্তক্ষণ!


মা, এই শহরটা মৃত।
বাড়ি গেলে তুমি যেমনি সন্ধে হলেই টেবিলে চায়ের মগটা এনে রাখো,
আমাকে উঠোন থেকে ধরে এনে এটা ওটা খেতে বলো,
ওসব এখানে কেউ বলে না। আমি আছি কি নেই, সে খোঁজ এক আমার কাছেই থাকে।
এখানে নিয়ম---খেলে খাও, না-খেলে মরে পচে গলে যাও!
পচে গেলে লাশটা টেনে হিঁচড়ে বড়োজোর ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবে, তা-ও দুর্গন্ধের দায়ে পড়ে!
মা, তোমার যত্নআত্তির বাড়াবাড়িতে প্রতিমুহূর্তে বিরক্ত হয়ে থাকাকে খুব মিস করি…খুউব!


এই শহর বড়োই কঠিন!
আমার আর ভালো লাগে না! আমিও বাঁচতে চাই বাবার মতো।
তোমার মতো নিতান্তই বাধ্য হয়ে এই জঘন্য পৃথিবীতে বাঁচতে আমি চাই না।
তুমি যে ভুলটা করেছ, সে ভুল আমি করিনি। করবও না আর কোনও দিনই।
তোমার মতো কোনও পিছুটান, দায় কিংবা কর্তব্য, এর কোনও কিছুই আমি রাখিনি।
আমি শুধুই তোমার অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষায় আছি তুমি কখন…!


আজকাল নিজেকে এক বিস্তীর্ণ শূন্য মরুতে বসবাস-করা একমাত্র মানুষটি মনে হয়।
মনে হয়, এই পুরো মরুভূমিতে মাইলের পর মাইল জুড়ে একমাত্র আমিই আছি,
কোথাও আর কেউ নেই, কিছুই নেই!
বলো তো মা, এ পৃথিবীতে কে কবে অসুখবিসুখে মরেছে…বলো?
অসুখে মরার বহু আগেই তো মানুষ মরে যায় সুখের অভাবে!


আজকাল আমার কেবলই তোমাকে মনে পড়ছে, আর বাবাকে।
আমার মাথাভর্তি শুধু তোমরা দুজন আর…অনিবার্য মুক্তির দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা!
সকালে ঘুম ভাঙে তোমার চেহারা ভেবে,
চোখ খুলি বাবার ছবি দেখে, আর চোখ বন্ধ করি
তোমাদের দুজনকে একসাথে কল্পনা করতে করতে।


মা, দেখো, পরকাল সত্য হলে
আমি, তুমি আর বাবা একবার বাঁচব। একটা জীবনসংসার আমাদেরও হবে।
আমি সে সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকি অনন্ত সময় ধরে…।
কবে ঘুম আসবে? কবে রাত পোহাবে? কবে আমরা বাঁচব একসাথে?


ঘড়ির কাঁটার অবিশ্রান্ত শব্দ। টিক টিক…টিক টিক…টিক টিক...!
চলছে চলুক ঘড়ি! একদিন ঠিক সময়ে ঠিক সময়টা দরজায় এসে ঠিকই হাজির হবে!
মা, সেদিন আমরাও সমস্ত জীর্ণতা ঠেলে নির্ভার চিত্তে মানুষ হয়ে বাঁচব একবার!