মুহাফিজ (১৯৯৩)

(স্পয়লার আছে।)

একজন মানুষের অস্তিত্ব এবং মূল্যায়ন, এই দুইয়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে অনিতা দেশাইয়ের উপন্যাস ‘ইন কাস্টডি (১৯৮৪)’, সে উপন্যাস ইসমাইল মার্চেন্টের লেন্সে আমাদের সামনে এসেছে ‘মুহাফিজ (১৯৯৩)’ নামে। জীবনের অর্থ একেকজনের কাছে একেকরকম। তার কোনোটা ভুল কিংবা কোনোটা ঠিক, এমন রায় দিয়ে দেয়া যায় না। একটা মানুষ তার জীবনটা যেভাবে কাটায়, তার কাছে সেটাই ঠিক, তা নিয়ে অন্য কারো কিছু বলার নেই। বাইরে থেকে দেখে কারো জীবনের যা কিছু নিরর্থক মনে হয়, তা কিছুর অর্থ খুঁজতে হলে তার জীবনে বেঁচে দেখতে হবে, যা সম্ভব নয়। বিশেষত, প্রতিভাবান কারো সম্পর্কে বোঝা প্রায় অসম্ভব, তিনি সারাজীবনই এক অবোধ্য সত্তায় বাঁচেন, আমৃত্যু ওরকম অবোধ্যই থেকে যান। পরিবারের বাইরে তাঁর আশেপাশে যারা থাকেন, তারা হয় তাঁর অনুরাগী, নতুবা স্তাবক। সেই সাধারণ মানুষগুলি তাঁর সৃষ্টিতে মুগ্ধ, সে সৃষ্টির কিছুটা হয়তো ওরা বুঝতেও পারে, তবে মানুষটিকে বোঝা সবসময়ই তাদের সাধ্যাতীত থেকে যায়। তাঁকে বোঝেন, তাঁর সৃষ্টির যথাযথ মূল্যায়ন করেন, এমন কাউকে পেলে তিনি সানন্দেই তাঁর সৃষ্টির পথেপথে ছড়ানো যে পর্ণকুটির, তাকে সেগুলির দৌবারিক করে দেন।

নূর একজন উর্দু ভাষার কবি, তিনি উত্তর ভারতের ভোপালে থাকেন। এই অপূর্ব ভাষায় তেমন কেউ এখন আর লেখে না, সবাই কেবল উর্দু শের-শায়েরি শুনতেই ভালোবাসে। নতুন কিছু হচ্ছে না, পুরনো সৃষ্টিরই কদর হচ্ছে ঘুরেফিরে। উর্দু ভাষায় লিখেছেন বা লিখছেন, নূর বাদে তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ এখন আর জীবিত নেই। উর্দুকে কৌশলে ভারত থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে। উর্দু পাকিস্তানের ভাষা, অতএব ভারতে এর জায়গা নেই। ভাষার ব্যাপারে এমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সে ভাষার যে সৃষ্টিঐশ্বর্য, সেটিকে ধীরেধীরে কোনো একটা জেনারেশনের পর আর টিকে থাকতে দেয় না। কোনো একটা ভাষা জানেন, এমন কাউকে বিশেষ এক সম্প্রদায় পছন্দ করবে, নিজেদের লোক ভাববে, আরেকটা সম্প্রদায় উনাকে তাদের বিরোধীশিবিরে রাখবে, এমন অবস্থা সে ভাষার জন্য হতাশাজনক। বিশ্বের অনেক মহৎ সৃষ্টি বিলুপ্ত ও বিস্মৃত হয়ে গেছে এমন অবিমৃষ্যকারিতার কারণে। কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর উর্দু পড়ানো হচ্ছে না, একটা সময় আসবে যখন কেউ আর উর্দু পড়তেই পারবে না, হয়তো অনুবাদে পড়বে। অনুবাদে সাহিত্যের সৌন্দর্য কতটুকুই-বা অক্ষত থাকে? এসব নিয়ে নূরের অনেক দুঃখ। তিনি উর্দু ভালোবাসেন, উর্দুতে কবিতা লেখেন, উর্দু তাঁর কাছে সন্তানের মতো। সে সন্তানের অনাদরে তিনি কষ্ট পান। তাঁর আশেপাশে অনেক ভক্ত, স্তাবক, অনুরাগী। তবে তাদের কেউই এমন নয়, যে ভালোবেসে আর বুঝে উর্দু কবিতা পড়ে। ওরা একেবারেই সাধারণ মানুষ, যারা মুহূর্তের হুজুগে চলে, ওদের নিজস্ব কোনো মতামত নেই, কাব্য অনুভব করার ক্ষমতা ওদের নেই। প্রতিভাবান কাউকে বুঝতে হলে নিজেরও কিছু প্রতিভা, নিদেনপক্ষে মেধা থাকা চাই। নূর সাহেব বড়ো কবি, তাঁর বাড়িতে গেলে বিনামূল্যে বিরিয়ানি আর শরাব মেলে, তিনি ওদের সময় দেন, ওদের চাটুকারিতায় বিগলিত হন, তাই ওরা নূরের পাশে আছে। অমন কিছু অপদার্থ স্তাবক থাকলেও যা, না থাকলেও তা। ওদের কারো হাতেই তাঁর সৃষ্টি সুরক্ষিত নয়।

মিরপুরের স্থানীয় এক কলেজের লেকচারার দেবেন। উনি উর্দু ভালোবাসেন, টুকটাক লেখালেখি করেন, উর্দুতে যাঁরা লেখেন, তাঁদের খুব শ্রদ্ধা করেন। উর্দুর প্রতি তাঁর এই অনুরাগ তিনি পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। কলেজে তিনি হিন্দি পড়ান, কারণ হিন্দির চাহিদা ভাল, তাঁকে ফ্যামিলি চালাতে হবে, শিক্ষকরা তো আর চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচেন না! তবে তাঁর ধ্যান, ভালোবাসা, ভাবনা সবই উর্দুকে ঘিরেই। হিন্দি ভাষার শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে তিনি খুব একটা সফল, তা বলা যায় না। স্থানীয় এক পত্রিকা নূরের সাক্ষাৎকার ছাপবে। সম্পাদক সাহেব তা সংগ্রহ করার দায়িত্ব দিলেন দেবেনকেই। দেবেন যেন ‘হিন্দির কারাগার’ পালানোর একটা পথ পেলেন, তিনি কিছুদিন তাঁর ভালোবাসার উর্দুর সাথে সময় কাটাতে পারবেন। দেবেন নূরের বাড়ি গিয়ে দেখলেন, নূর একজন বিশালদেহী মানুষ, শরীরের ভারে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়। খ্যাতিমুগ্ধ স্তাবকের দল সারাক্ষণই তাঁকে ঘিরে আছে, উঠতি কবিরা আশেপাশে গিজগিজ করছে, কবির দুই স্ত্রী—ওদের কেউই কবিকে বোঝে বা যথার্থ সম্মান দেখায় বলে মনে হয় না, বাড়িতে সারাক্ষণই স্বার্থপর ও লোভী মানুষের ঢল। নূরের সাথে একটু সময় নিয়ে কথা বলবেন কিংবা একান্তে আলাপ করে তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে জানবেন, বাড়িতে সে সুযোগ নেই।

কবির প্রথম স্ত্রী সাফিয়া বেগম বয়স্কা, একটু খিটখিটে স্বভাবের, তবে সরল প্রকৃতির। দ্বিতীয় স্ত্রী ইমতিয়াজ বেগম বেশ ধূর্ত, উর্দুতে কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। তিনি কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব, তবে তাঁর মধ্যে কোনো কাব্যপ্রতিভা নেই। অনেক চেষ্টায়ও কোনো লাইন মাথা থেকে বের হয় না, বাহবার মোহে তিনি স্বামীর কবিতাকে নিজের কবিতা বলে চালিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরেই। কবিরা অনেক কিছুই লিখে রাখতে পারেন না, সেসব সৃষ্টি তাঁদের মাথার মধ্যেই থেকে যায়, কখনোবা কথাচ্ছলে সেগুলি থেকে কিছু বেরিয়ে আসে। নূরের ছোট স্ত্রী সেসব কিছু যত্ন করে সংগ্রহ করেন, এবং নিজের কবিতা বলে চালিয়ে দেন। মজার ব্যাপার হল, তিনি তাঁর কবি-স্বামীকে ঈর্ষা করেন, সে ঈর্ষার আগুনে পুড়ে তিনি স্বামীর কবিতাগুলি ছুঁড়ে ফেলে দেন, কবুতরগুলিকে খোপ থেকে মুক্ত করে দেন। এ ক্রোধ অক্ষমের ক্রোধ, নূর যা লিখে রেখেছেন, তা নষ্ট করে ফেলা যাবে, কিন্তু যে ঐশ্বর্য তাঁর মাথায় আছে, সেটি তো আর কোনোভাবেই নষ্ট করে ফেলা যাবে না। আসল রত্ন তো দৃষ্টির অগোচরে, নির্বোধ স্ত্রী সেটা বোঝেন না, ভাবেন, চোখের সামনে যা দেখা যায়, তা শেষ করে দিলেই সব শেষ। বাড়িতে ওরকম মানুষের ভিড়ে নূরের সাক্ষাৎকার নেয়াটা প্রায় অসম্ভব, তাই দেবেন কলেজের টাকায় একটা পুরনো টেপরেকর্ডার কিনে সাফিয়াকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়ে নূরকে কৌশলে বাড়ি থেকে বের করে আনেন। একজন টেকনিশিয়ান সহ তিনি নূরকে এক সপ্তাহের জন্য একটা গণিকালয়ে নিয়ে যান। সেখানে একটা রুম ভাড়া করে নূরের ইন্টার্ভিউ নিতে থাকেন। রেকর্ডার পুরনো, তাই নানান সমস্যা, ওদিকে টেকনিশিয়ান ছেলেটা এই ইন্টার্ভিউর গুরুত্ব স্বাভাবিকভাবেই অতোটা বুঝতে পারে না, তাই কখন যে রেকর্ডারের কানেকশন ছুটে যায়, সেদিকে সে খেয়ালই করতে পারে না। নূরের কথা ও কবিতার কানাকড়ি দামও তার কাছে নেই, সে বরং নূর সাহেবের চাটুকারদের স্থূল রসিকতায় মজা খুঁজে নেয়। নূর যা বলে যান, তার সামান্য অংশই রেকর্ডারে নেয়া হয়। পরে দেখা যায়, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেটিও ঠিকভাবে আসে না। গ্রেটনেসকে কখনো রেকর্ড করা যায় না!

যেখানে উর্দুকেই তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, সেখানে উর্দু কবিতার অস্তিত্ব থাকে কীকরে? উর্দুর দিন ফুরিয়ে গেছে। আমরা এখন যা দেখছি, তা হচ্ছে কেবল উর্দুর লাশ। নূর একজন অসুস্থ বৃদ্ধ কবি। উর্দু ভাষার শেষ উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর মৃত্যু সমাগত। তাঁর মধ্য দিয়ে সিনেমায় উর্দুর মুমূর্ষু অবস্থা বোঝানো হয়েছে। তাঁর স্তাবকের দল উর্দু কবিতা যতটা অনুভব করতে পারে, তার চাইতে বেশি মুখে বলে, তাদের আসল নজর ফ্রিতে দামি খাওয়াদাওয়া আর অফুরন্ত মদের সরবরাহের দিকে, কবুতর পোষা-সহ কবির নানান বিলাসযাপনের প্রতি। ওরা নিজেরা দাবি করে, ওরাই নূরের সৃষ্টি ও মননের যোগ্য উত্তরসূরি, অথচ ওদের সে প্রতিভাই নেই। রাস্তায় এক লোককে সবাই ধরে মারছে। স্তাবকের দল নূরের সামনে থেকে দৌড়ে বারান্দায় এসে রাস্তার সে দৃশ্য দেখে মজা লুটে, হাসাহাসি করে, হয়তো নূর যদি কখনো বিপদে পড়ে যান, ওরা ঠিক তেমনি করেই দূর থেকে বিপন্ন নূরকে দেখে হাসবে, মজা নেবে, অন্যদের সাথে সুর মিলিয়ে তালি দেবে। অন্যকে অপমানিত ও আহত হতে দেখে যারা আনন্দ পায়, ওরা আর যা-ই হোক, সৃষ্টিশীল কিংবা প্রতিভাবান মানুষ কিছুতেই নয়।

নূর তবু ওদের স্থান দেন, আশকারা দেন। হয়তো এ বয়সে এসে তাঁর এমন কিছু মানুষ দরকার, যারা সারাক্ষণই বুঝে না বুঝে তাঁর গুণকীর্তন করে যাবে। মানুষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বীকৃতি শুনতে ভালোবাসে, সেজন্য যতটুকু ত্যাগ করা দরকার, যথাসাধ্য করে। এইসব অহেতুক সস্তা স্তাবকের দল দেবেনকে ব্যথিত করে। তাঁর কাছে নূরের সাহচর্য স্বপ্নের মতো একটা ব্যাপার, কারণ তিনি নিজেও উর্দুতে লেখার চেষ্টা করেন, এবং উর্দুকে ভালোবাসেন। দেবেনের এমন ব্যথা মূলত যেন নূরেরই ব্যথা, চোখের সামনে কিছু অথর্বের হাতে উর্দুর সৌন্দর্যের মৃত্যুঘণ্টা শোনার ব্যথা। দেবেনের সম্পাদক বন্ধু মুরাদ দেবেনকে চাপের মধ্যে রেখেছেন ইন্টার্ভিউটা দ্রুত শেষ করার জন্য। এদিকে দেবেন নূরের মুখ থেকে শোনা উর্দু কবিতার প্রেমে বুঁদ হয়ে আছেন, তিনি চাইছেন এ নেশাঘেরা যাত্রা অনন্ত হোক, তবু স্বপ্ন ও দায়িত্বের মধ্যকার এমন সংঘাত তাঁকে কিছুটা হলেও বিহ্বল করে রাখে। মুরাদের পত্রিকার নাম ‘আওয়াজ’, সে পত্রিকা নূরের সাক্ষাৎকার ছাপতে চায়। এই নামটা রূপক, কেননা যখন আশেপাশের কেউই উর্দু শিখতে চাইছে না, তখন মৃতপ্রায় উর্দুভাষা ঠিকই নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতি জানিয়ে দেবে সেই ‘আওয়াজ’-এর মধ্য দিয়ে। দেবেন যখন প্রথম নূরের বাড়িতে গেলেন, তখন দেখলেন, বাড়িটা পুরনো, জরাজীর্ণ, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়, তাছাড়া নূরের শোয়ার কক্ষটি ছিল অন্ধকার, বিবর্ণ, মলিন, ফ্যাকাসে। দেবেন ভাবতেই পারেননি যে তাঁর স্বপ্নের নায়ক এমন একটা ভগ্নবাড়িতে থাকেন। তাঁর কল্পনায় ছিল কবিরা হয়তো কোনো প্রেমময় কোনো শান্তির নীড়ে বাস করেন। কবির কথা বলার ধরন কিংবা চালচলন, কোনোটাই কবিসুলভ নয়, বরং একেবারেই গড়পড়তা।

ওদিকে দুই স্ত্রীও কবির দিকে তেমন একটা খেয়াল রাখেন না, প্রাপ্য সম্মানটা দেন না। নানান কটু বাক্যবাণে কবিকে বিদ্ধ করে চলেন। কবির অসুস্থতার দিকেও ওদের তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁরা নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণই ঝগড়া করে চলেছেন। কবির প্রতি তাঁদের অভিযোগের কোনো শেষ নেই! যেন ওদের করুণায় কবি বেঁচেবর্তে আছেন! এতো খ্যাতিমান একজন মানুষ পারিবারিক জীবনে কত অসুখী! এমন একজন কবির প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন তাঁর স্ত্রীই করেন না। যেন সেসব আবহ দেবেনকে জানিয়ে দিচ্ছে উর্দুর ম্রিয়মাণ নিয়তির কথা।

দেবেনের কলেজে উর্দু পড়ান সিদ্দিকি। তিনিই রেজিস্ট্রারকে বলে দেবেনকে একটা পুরনো টেপরেকর্ডার কেনার টাকা যোগাড় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে দেবেন নূরের ইন্টার্ভিউটা কলেজের উর্দু বিভাগে সংরক্ষিত রাখবেন, যদিও সে রাখা না রাখা নিয়ে সিদ্দিকির তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। উর্দুর নয়, বরং দেবেনের সাথে সুসম্পর্কের দাবিতে তিনি টাকাটা যোগাড় করে দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে নূর মৃত্যু নিয়ে লেখা তাঁর কিছু কবিতা দেবেনের ‘কাস্টডি’তে পাঠান, সম্ভব হলে সেগুলি ছাপতে অনুরোধ করেন। দেবেন যখন সে কথা সিদ্দিকিকে বলছিলেন, তখন সেদিকে খেয়াল না করে তাঁর পুরনো বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে, দেবেনকে সেটা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি যে বাড়িতে থাকেন, সে বাড়িটা খুবই জরাজীর্ণ—তাঁর পড়ানোর বিষয় উর্দুর মতোই, সেটা ভেঙে একটা ডেভেলাপার কোম্পানি মার্কেট, সিনেমাহল, আবাসিক ভবন তুলবে—আটপৌরে উর্দুর জায়গায় কেতাদুরস্ত হিন্দি আসছে। উর্দু কবিতার চেয়ে ওটাই সিদ্দিকির কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কলেজে উর্দু পড়ান উর্দুর প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়, নেহায়েত বাধ্য হয়ে, অন্য উপায় নেই বলে। দেবেনের কাছে যা ছিল মহামূল্যবান, সেটির কোনো দামই সিদ্দিকির কাছে ছিল না, কারণ উর্দু কবিতার প্রতি সিদ্দিকির কোনো টানই কাজ করে না। যে যেটাতে ভালোবাসে, তার কাছে সেটার যা দাম, তা কেবল তার কাছেই, অন্যদের কাছে সেটার দাম ফুটো পয়সাও নয়।

এ সিনেমায় নারীদের দেখানো হয়েছে উচ্চাভিলাষী হিসেবে। দেবেনের তেমন একটা আর্থিক সচ্ছলতা নেই, এটা নিয়ে সরলা দেবেনের উপর বিরক্ত। দেবেন ছেলের নতুন জুতো কিনে দিতে না পারায় সরলার বাবা তা কিনে দিয়েছেন, এবং এটা নিয়ে দেবেনকে কথা শুনতে হয়েছে। দেবেনের আয় কম, তাই একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারছে না বলে সরলার অনেক দুঃখ। ওদিকে নূরের প্রথম স্ত্রী ঘুষের বিনিময়ে দেবেনকে নূরের ইন্টার্ভিউ নেয়ার সুযোগ করে দেন। দ্বিতীয় স্ত্রী ইমতিয়াজ বাইজি পরিবারের মেয়ে। তিনি নূরের লেখা চুরি করে নিজের বলে চালান, নূরকে সারাক্ষণই কটু কথা বলেন, অহেতুকুই চেঁচামেচি জুড়ে দিয়ে অপমান করেন, স্ত্রীর সাথে তুচ্ছ ঝামেলায় জড়িয়ে শক্তির অপচয় না করে নূর চুপ করে সব সহ্য করেন। দেবেনকে বারবার চাপ প্রয়োগ করেন যেন তাঁর ইন্টার্ভিউ পত্রিকায় ছাপা হয়, লোকের কাছে তিনি কবি হিসেবে পরিচিতি পান। তাঁর ধারণা দেবেন এসেছেন নূরের সব লেখা চুরি করে নিয়ে যেতে, নূরের সৃষ্টিকে নিজের সৃষ্টি বলে চালিয়ে দিতে। এখানে লক্ষণীয়, ইমতিয়াজ বেগম এবং সরলা তাঁদের স্বামীদের কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে অশ্রদ্ধাশীল ও উদাসীন, কখনোবা চরম বিরক্ত। এর একটাই কারণ, স্বামীরা সংসারের নানান প্রয়োজন মেটাতে পারেন না, ঠিকভাবে ঘরের খরচ চালাতে পারেন না। নিজের চাহিদার কথা নিজের মুখে বলতে পারার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয়। ঘরের কথা পরে জানলে যদি ঘরের সমস্যার সমাধান মিলে, তবে তা পরে জানাই শ্রেয়। নারীর এমন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর এ সিনেমায় শোনা যায়। এখানে নারীরা পুরুষের ইচ্ছেকে মুখবুজে মেনে নেয়নি, বরং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। সে চেষ্টা সৃষ্টিশীলতার পথে অন্তরায়, জিনিয়াসদের জীবনে প্রথম বাধাই তো আসে ঘর থেকে। জিনিয়াস কাউকে বিয়ে করে জীবনে সুখী হওয়া প্রায় অসম্ভব। লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা আর সরস্বতীর আরাধনা, দুটোই একসাথে? দেখা যায় না, তা নয়, তবে খুব কম।

পুরো সিনেমায় কবিতা আর গজল ছড়িয়ে আছে। সাথে আছে শের ও শায়েরি। একটা মধুর আবেশ নিয়ে একবসাতেই সিনেমাটি দেখে শেষ করে ফেলা যায়। শেষ দৃশ্যে নূরের মৃত্যু যেন উর্দুর মৃত্যুর প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত। তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সবাই সেদিকে তাকিয়ে আছে, সবার কষ্ট হচ্ছে, অথচ কারুরই কিছুই করার নেই। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল তাঁর জীবনের শেষদিনগুলি মক্কায় কাটাবেন, তাও হল না। জীবন পূর্ণতার গন্তব্য নয়, অপূর্ণতার যাত্রা। সেইদিনগুলিতে এ মহান কবির স্মৃতিতে ছিল কাছের মানুষের অবহেলা, চাটুকারদের মিথ্যে স্তুতি, সত্যিকারের ভালোবাসার ঘাটতি। এমন ধূসর বিবর্ণ স্মৃতি নিয়েই তাঁকে কবরে যেতে হয়েছে।