যাদুকরের মৃত্যুতে

স্যার, আপনি কি গান গাইতে জানেন?

না।

গান বোঝেন?

না।

রাগ বিষয়ে জ্ঞান আছে?

না।

মীড়, গমক, মূর্ছনা—এইসব কী?

জানি না, কী।

তাহলে ক্ষুদে গানরাজের প্রথম বিচারক হলেন কী জন্য?

এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, “ভুল হয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে ভুল করার অধিকার আমার আছে।” মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার শিশুদের কবিতা আবৃত্তির বিচারক হয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স কুস্তি প্রতিযোগিতার বিচারক হয়েছিলেন।

~ হুমায়ূন আহমেদ

এই ছোট্টো জীবনটাকে কীভাবে কাটাতে হবে, এই জাতীয় কোনও ব্যবহারবিধি ছাড়াই আমাদের হুট্ করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ইউজার ম্যানুয়েল ছাড়া কোনও কিছুকে কতটুকুই বা একেবারে প্রথম থেকেই ঠিক ঠিকভাবে ব্যবহার করে-করে শেখা যায়? পারে কেউ? কেউ-কেউ পারে হয়তো। আমি পারি না। জীবনকে ইচ্ছে মত ঠিকভাবে এবং ভুলভাবে ব্যবহার করার পুরো অধিকার আমার আছে। একটা কফিশপ খোলার আগে অন্তত কয়েক হাজার টাকার কফি এক্সপেরিমেন্টে খরচ করতে হয়। এটা বাজে খরচ নয় মোটেও।

মাঝে-মাঝে ভাবি, কী অদ্ভুত আমাদের মনস্তত্ত্ব! আমরা মানী লোকদের অসম্মান করে কী যে স্বর্গীয় সুখ পাই! আমিও করি, সুযোগ পেলেই। নিজে বড় মানুষ হওয়ার সুযোগ তৈরী করতে পারি বা না পারি, আমি খেয়াল করে দেখেছি, ওদের অপমান করার সুযোগ কীভাবে যেন আমার হয়েই যায়। প্রায়ই। এবং সে সুযোগ আমি হাতছাড়া করি না। বড় মানুষদের আমার মতোই সাধারণ ভাবতে আনন্দ পাই। ওদের দোষগুলো বলে বেড়াই, নিজেরগুলো ভুলে গিয়ে। আমার নিজের দোষগুলো অনেক বেশি নিরাপদ, নিরুদ্বিগ্ন। ওগুলো নিয়ে কেউ কোনও দিন মাথা ঘামাবে না। আমাকে চেনেই বা কে, যে ঘামাবে!

কোন সুন্দরী গণিকার জন্যে ভ্যান গঘ তাঁর কান কেটে ফেলেছিলেন, সেটা মনে রাখতে খুব ভালো লাগে। পল গঁগ্যা কেনো, কীভাবে যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, সেটা ভেবে এক অসুস্থ তৃপ্তি পাই। ব্যোদলেয়ারের নারীসঙ্গের বাছবিচারহীনতা আমাকে কী যে এক গোপন সুড়সুড়ি দ্যায়! ওঁর সৃষ্টি দ্যায় কি অত? সারাদিন বসে ভেবেও রবি ঠাকুরের এক লাইন দূরে থাক্, একটা শব্দও মাথায় আসে না, অথচ কী অবলীলায় আমি এই নমস্যকে কল্লোল যুগীয় কায়দায় ব্যবচ্ছেদ করি, অনধিকারীর মূঢ় স্পর্ধায়! রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে রবিকে খাটে তুলি, মাটিতে নামাই। শরৎচন্দ্রকে গণিকাবাড়ি পাঠাই যখন খুশি! অবলীলায় প্রেম করিয়ে দিই মৃত্যু পথযাত্রী অসহায়া বারাঙ্গনার সাথে। পিকাসোর ছবি কটা, সে হিসেব রাখি না; আর প্রেমিকা কটা, সে হিসেব ঠোঁটস্থ! হুমায়ূনকে সমানে গালাগালি করি, ব্যাটা কেন বুড়ো বয়সে শাওনকে বিয়ে করল! কেন বোকা-বোকা মিষ্টি সুন্দরীদের প্রথম প্রেম হুমায়ূন! আমাদের দুঃখ, আমিও তো ফিল্ডে আছি, আমার দিকে কেন প্রেমময় চোখে তাকায় না? আমার দিকে তাকানোর কী এমন আছে, সে প্রশ্ন কিন্তু কখনও মাথায় আসে না।

হেডোনিস্ট সোসাইটির রিপ্রেজেন্টিটিভ ইরোটিক ড্রামা ফিল্ম Eyes Wide Shut একটা সফট পর্নোগ্রাফি ছাড়া আর কিছু নয়—এইটুকু রায় আপনি দর্শক হিসেবে দিতেই পারেন; তবে যদি একই সাথে বলেন, স্ট্যানলি কুবরিক এটা বানাবে না তো কে বানাবে? ওই শালা তো একটা চরিত্রহীন, বিয়ে করেছে ৩টা, প্রেম করেছে অসংখ্য, ও এ জিনিস বানাবে না তো কে বানাবে? সিক পারভার্ট! ব্লা ব্লা ব্লা…….তবে আমার আপত্তি আছে। আমি বলি কী, থামেন ভাইজান! বহুত কইয়া ফালাইসেন! উনার যা সৃষ্টি, তা নিয়ে ভাববার মত যোগ্যতাও তো আপনার নেই। আমি বলছি না, কুবরিকের ফিল্মের সমালোচনা করতে হলে আপনাকেও ফিল্ম বানিয়ে দেখাতে হবে। আমি বলছি, আপনি উনার ফিল্ম নিয়ে সমালোচনা করুন, কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু যখন একই সাথে উনার ব্যক্তিজীবন নিয়েও কথা বলতে শুরু করেন, তখন তা আপনার অসুস্থ মানসিকতাই তুলে ধরে। সৃষ্টির সমালোচনা আর স্রষ্টাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ তো এক হল না, তাই না? সৃষ্টি নিয়ে কথা বলুন, স্রষ্টা নিয়ে কেন? একজন স্রষ্টার সব সৃষ্টিই আপনার ভালো লাগতেই হবে কেন? আপনার মত মূর্খ গর্দভ অজ্ঞ উনার মুভি না দেখলেই বরং উনার আত্মা শান্তি পাবে। যা আপনার ভালো লাগে না, তা ইগনোর করুন। সিম্পল! এই চরিত্রহীন মানুষটি পৃথিবীকে যা দিয়ে গেছেন, আপনার মত এক কোটি চরিত্রবান মানুষ মিলে পৃথিবীকে কি তার সামান্যতমও কখনও দিতে পেরেছে? একজন স্ট্যানলি কুবরিক অনুপ্রাণিত করেছেন অসংখ্য Martin Scorsese, Steven Spielberg, James Cameron, Woody Allen, Christopher Nolan, David Lynch, Tim Burton, Gaspar Noé-কে। পরবর্তীতে তাঁদের কাছ থেকে আমরা উপহার পেয়েছি বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়ে যাচ্ছেন এসব মহান স্রষ্টারা। আপনার উন্নত চরিত্রে এ পৃথিবীর কোন লাভটা হয়েছে, শুনি? এ পৃথিবীর ইতিহাস প্রতিভাবানরা রচনা করেছেন, চরিত্রবানরা নয়।

আসলে অন্যের কলঙ্কের পরিসংখ্যান মাথায় রাখার বেলায় আমরা একটু বেশিই সাবলীল। ‘অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা।’ আমরা কত নির্ভার! সৃষ্টিতে নেই, সমালোচনায় আছি। একটা কুকুর দৌড়ে পুকুর পাড়ি দিলেও আমরা বলি, কুকুরটা তো সাঁতারই জানে না! মহানদের বড় ভাবতে যে মানসিক পরিপক্বতা প্রয়োজন, সেটা আমাদের হয়ইনি এখনও! নিজের দুর্বলতার প্রতি বিনীত হতে পারি না বলেই সবল হওয়ার অহংকার আমাদের ভাগ্যে জোটে না। দুর্বিনয় আর অজ্ঞতা তো হাত ধরেই চলে। বড়ো মানুষদের ছোট ব্যাপারগুলোকে নিজের হৃদয়ে সহজ প্রবেশাধিকার দিয়েছি বলেই ওঁদের বড় দিকগুলোকে আপন করে পাওয়ার মোহ অতটা তীব্রভাবে তাড়া করে ফেরে না আমাদের। একটুখানি মোহ যদিও বা জাগে কখনো হঠাৎ, নিজের অক্ষমতাকে জিইয়ে রাখার লোভটা আর সামলাতে ইচ্ছে করে না। ওঁদের দেখি আর ভাবি, তুমি আর এমন কী? তুমি তো আমার মতই সাধারণ!

এ দুর্ভাগা দেশে বড় মানুষদের অপমান করার জন্য ছোটলোকের কখনও অভাব হয়নি। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের চাইতে জনপ্রিয় লেখক আর জন্মাননি। উনার সাহিত্য বাঙালি পাঠকদের যতটা বুঁদ করে রেখেছে, তার কাছাকাছিও পেরেছে আর কোন লেখকের কাজ? বাংলাদেশের টিভি নাটককে উনার চাইতে জনপ্রিয় আর কোনও কথা সাহিত্যিক কখনওই করতে পারেননি। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, বহুব্রীহি, অয়োময়, নক্ষত্রের রাত সহ এমন অনেক অমর নাট্যসৃষ্টি বাংলাদেশের দর্শকদের মনোজগতের সযত্ন পরিচর্যা করেছে বছরের পর বছর। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্রই তো নির্মিত হয়েছে। আগুনের পরশমণি’র মত এতটা গ্রহণযোগ্যতা আর কোনটা পেয়েছে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, হুমায়ূন আহমেদের মত জনপ্রিয়তা পাওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গের কোনও লেখক মাথাতেই আনতেই পারেন না। ছোটগল্পের হুমায়ূনও বড় সুস্বাদু! হুমায়ূন আহমেদ যদি শুধু গল্পই লিখতেন, তাও তিনি তাঁর অসামান্য গল্পগুলির জন্য অমর হয়ে থাকতেন। যিনি আমাদের এতটা দিলেন, আমরা তাঁকেই আহত করে চলেছি দিনের পর দিন নির্লজ্জ, অকৃতজ্ঞ, কপট, মূর্খের মত। আমাদের মত অন্যের ব্যাপারে নাক-গলানো ভণ্ড বেকার জাজমেন্টাল জাতি আর কই আছে?

উফফফ্…….হুমায়ূন আহমেদ!! যাঁর লেখায়, একই উপাদান—হাসাতেও পারে, কাঁদাতেও পারে……মাঝে-মাঝে হাসতে ইচ্ছে করে, কখনও-কখনও, কাঁদতেও। যে দিনটাকে আমরা ধরেই নিই, আর দশটা দিনের মতই কেটে যাবে, সেই দিনটাতে যদি বাড়তি কিছু সুখপ্রাপ্তি হয়েই যায়, তবে সেই ছোট্ট সুখের রূপকার নিশ্চয়ই বাড়তি কিছু ভালোবাসার দাবি রাখেন৷ এই ছোটছোট সুখের অনুভূতি নিয়েই তো জীবন! সুখই সুন্দর! সেইসব সহজ সুন্দরের যাদুকরদের একজন হুমায়ূন আহমেদ৷ শব্দের এই ইন্দ্রজালস্রষ্টা আজকের দিনে চলে গেছেন নৈঃশব্দের অন্তরালে৷ সহজ ও সুন্দরের যাদুকর চলে গেছেন। মন ভালো করে দেয়ার মানুষটি চলে গেছেন। প্রিয় হুমায়ূন, তোমার সৃষ্টি ভালো থাকবে৷ ভালো থেকো তুমিও৷ মৃত্যুই একমাত্র সত্য, যার কোনও ব্যত্যয় নেই। তবু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন যাঁরা মৃত্যুকেও জন ডানের মত দুঃসাহসে বলে ফেলতে পারেন, And death shall be no more; Death, thou shalt die. অমর হতে যাঁদেরকে মরতে হয় না, হুমায়ূন আহমেদ হলেন সে অসামান্য মানুষদের একজন।

হুমায়ূন আহমেদের বই পড়লে মনে হয়, দুনিয়ার সব মেয়েই মায়াবী হয়। উনার ভাষায়, দুনিয়ার সব মেয়েরা অসম্ভব রূপবতীও হয়। আসলে তো তা না। এটাই উনার লেখার সবচে বড় সমস্যা। হাহাহাহা…….হুমায়ূন আহমেদের নরোম-নরোম সফট্-সফট্ প্রেম-প্রেম জাগানিয়া লেখা পড়লেই বেকার ছেলেটিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে—তার প্রেমিকা জীবনের মোহে জীবিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার গলায় দুগ্‌গা-দুগ্‌গা বলে ঝুলে পড়বে! প্রকৃত ঘটনা তো প্রায়ই উল্টো হয়! বেকার ছেলেটি আর মেয়েটির বর হতে পারে না, এক সময় মেয়েটির সন্তানের মামা হয়। মেয়েরা ভালোবাসার ক্ষমতা দেখে প্রেম করে, আর ভরণপোষণের ক্ষমতা দেখে বিয়ে করে। জীবন কল্পনার মত নয়, জীবন জীবনেরই মত। তবু হুমায়ূন আহমেদ আমাদের হাত ধরে সে আরামের রাজ্যে নিয়ে যান, যে রাজ্যে আমরা বেঁচে আছি, কিংবা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। আমরা হুমায়ূন আহমেদের গল্পের চরিত্রের মত করে নিজেদের ভাবি, অন্যদের ভাবতে চাই। হুমায়ূনের দেখিয়ে দেয়া পথে হেঁটে বেড়াতে চাই প্রিয় মানুষটির হাত ধরে। কিছুতেই মনে আনতে চাই না, হোসেনমিয়ার ময়নাদ্বীপ তো কেবল গল্পেই থাকে। কঠোর বাস্তবতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? অতএব, হুমায়ূনই প্রথম ও শেষ আশ্রয়!

তরুণীদের মিষ্টি গলায় আমি সচরাচর বিভ্রান্ত হই না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মিষ্টি গলার তরুণীরা সাধারণত মৈনাক পর্বতের মতো বিশাল হয়। যে যত মোটা, তার গলা তত চিকণ। ~ হুমায়ূন আহমেদ

সো ট্রু, বস!

ঐরাবত গোত্রের ছাড়াও মিষ্টি গলার তরুণীরা আরো দুই শ্রেণীর হন। এক। বাচ্চা মেয়ে। দুই। প্রৌঢ়া মহিলা। অতএব, সাধু, সাবধান!

বেশিরভাগ সুন্দরীরই গলা মিষ্টি নয়। মজার-মজার গল্প বলতে পারা বেশিরভাগ মেয়েই সুন্দরী নয়। গলা শুনিয়া কেউ লাফাস নে আর, আড়ালে তার বাংলার পাঁচ হাসে। আরেকটা কথা। কোনও মেয়েই অন্য কোনও ছেলের সাথে রাত বারোটার পর কথা বলার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে আপনার সাথে প্রথম দিনেই ওই বিশেষ সময়টাতে কথা বলতে রাজি হবে না।

ছেলেদের ক্ষেত্রেও এই কথাগুলো প্রযোজ্য।

বি প্র্যাকটিক্যাল, ফ্রেন্ডস। জীবনটা হঠাৎ বৃষ্টি ফিল্মের মতো ফিল্মি নয়। আরে ভাই, প্রযোজককে তো টাকাটা উঠাতে হবে, তাই না? কিন্তু জীবনের কথা ভিন্ন। এখানে পর্বতের সাথে মূষিকের কিংবা বিস্টের সাথে বিউটির দেখা হয়ে গেলে কারোরই ইনভেস্টমেন্টের বারোটা বাজবে না।

আমার কোনও এক জন্মদিনে নিচের উপহারগুলি পেয়ে আরও নিচের কথাগুলি লিখেছিলাম:

লুঙ্গিঃ রাজদূত ব্র্যান্ড। মূল্য ৪২৫ টাকা (‘প্লাস ভ্যাট’ কথাটা লিখা নাই।)

গেঞ্জিঃ ঘোড়ার ছবিওয়ালা টিয়াপাখি ব্র্যান্ড। মূল্য ৩২০ টাকা + ভ্যাট

গিফট প্যাকেটঃ মেইড ইন চায়না ব্র্যান্ড। মূল্য ১৬০ টাকা + ভ্যাট

একজোড়া কাফলিং + টাইপিন + কলমঃ মনেক্স ব্র্যান্ড (দাম লিখা নাই। তবে যে হারে গেঞ্জিলুঙ্গির আজাইরা দাম নিসে, আমার ধারণা, গাধীটার কাছ থেকে এইটারও পয়সা কম খসায় নাই।)

গামছাঃ ব্র্যান্ডের নাম লিখা নাই। (আমার ধারণা, গাধীটারে এইটা ফ্রি ধরাইয়া দিয়া খুশি কইরা দিসে।)

জ্বি, এইগুলা বার্থডে গিফট। এইগুলা সুন্দরবন ক্যুরিয়ারে আমার বাসায় আসছে আমার বার্থডের ১ সপ্তাহ আগে। এই লুঙ্গিওয়ালা (পড়েন, লুঙ্গিযুক্ত) গিফট আমারে সরাসরি দেয়ার সাহস উপহারদাত্রীর নাই। এই জিনিস কেউ আমারে সামনাসামনি দিলে আমি ওরে অ্যাট লিস্ট আড়াইবার তুইল্যা আছাড় মারতাম। প্যাকেটের ভিতরে লুঙ্গি দেইখ্যা আমার মেজাজ এতোই খারাপ হইসিল যে আমি প্যাকেটটা সেই দিন পুরা খুলিই নাই। আজকে সকালে কেন জানি খুললাম, দেখলাম, অনেকক্ষণ হাসলাম। উপহারদাত্রীর কৈফিয়ত এই, “তুই যে ফেসবুকে মাইনষ্যেরে লুঙ্গি গিফট করার কুবুদ্ধি দ্যাস, আমি সেইটা তোর উপরে অ্যাপ্লাই করলাম।” আপ্নেরাই কন, এরকম একটা অতি ফাজিল বন্ধু থাকলে শত্রুর আর কী দরকার?

আমার বন্ধু হারানোর রেকর্ড মোটামুটি কিংবদন্তীতুল্য। আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা জগতের সবচেয়ে মহৎ আর নিষ্কাম কাজগুলার একটা। আমার এই বন্ধুর সাথে এখনও আমার বন্ধুত্ব টিকে আছে কয়েকটা কারণেঃ

১। ও আমার সকল স্ট্যাটাস আমারে ওয়ার্ড ফাইলে কপি করে দেয়। কথা সেইটা না। কথা হল, কপি করার পর ও আমারে সেই ফাইল ইনবক্স করে সেটা কালেক্ট করতে বলার পর আমি রীতিমতো দুর্ব্যবহার করে বলসি, খবরদার! পেইন দিবি না। তোরে স্ট্যাটাস কপি করতে হবে না। দূর হ! (এইসব ব্যাপারে আমার উদাসীনতা সেই লেভেলের!) কিন্তু এরপরেও ও এখনও কাজটা করে যাচ্ছে। এবং শুধু তা-ই না, ও আমার কিছু লেখা ছাপানোর সব ব্যবস্থাও করে ফেলসে। (মজার ব্যাপার হল, এটা করার জন্য ওকে আমার কাছ থেকে অনেক গালি আর অবহেলা সহ্য করতে হইসে। এমনকি আমি প্রথমে লেখার টাইটেল ঠিক করে দিই নাই, লেখক পরিচিতি লিখে দিই নাই। এরপর ও যে বুদ্ধিটা করসে সেটা হল, আমার সম্পর্কে ফুলিয়েফাঁপিয়ে লিখে আমারে থ্রেট মারসে আমি লিখে না দিলে ওইটাই লেখক পরিচিতি হিসেবে চলে যাবে। আপ্নেরাই বলেন, ধইরা মাইর লাগাইতে ইচ্ছা করে না? এমনকি আমার লেখার শিরোনাম লিখে দিই নাই বলে ও নিজের মত করে লিখে আমাকে পাঠায়ে দিসে। অনেকটা কাউকে গান গাইতে বারবার রিকোয়েস্ট করার পরেও ও গান না গাইলে, এখন কিন্তু আমিই গাইতে শুরু করে দিব! টাইপের থ্রেট। পরে আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে তিন লাইনের লেখক পরিচিতি আর লেখাগুলার শিরোনাম লিখে দিসি। ওটা একটা সংকলন। ওখানে আরও অনেকের লেখাই আছে। এবং ওখানে আমিই একমাত্র লেখক(!) যে লেখা পাঠায় নাই, যার লেখা সংগ্রহ করা হইসে। আমার লেখা ছাপাবে বলে ওকে আমি যে পরিমাণ বিরক্তি দেখাইসি আর গালি দিসি, সেটা রীতিমতো প্রেস্টিজ ফালুদাকর এবং হাস্যকর! তা সত্ত্বেও ও কাজটা করসে, এই যুক্তিতে যে ওর ধারণা আমি একটা ডট দিলেও সেটা অনেক ওয়েট ক্যারি করে! তাই এটা ছাপানো দরকার!)

২। ও এক কোটিবার ফোন করলে আমি হঠাৎ-হঠাৎ দুএকবার রিসিভ করি এবং ওকে ঝাড়ি মারি। (আমার ফোন রিসিভ না করার বদভ্যাস আছে।) ও তাতেও বিরক্ত হয় না। এটা অতীব বিস্ময়কর!

৩। এই যে এই গিফটটা পাওয়ার এতোদিন পর আমি এটা খুলে দেখে ওকে প্রকাশ্যে পচাচ্ছি, ও মাস্ট ধরে নিবে, এই পচানির মধ্যেও একটা শিল্পিত ব্যাপার আছে! (পবিত্র গরু!)

৪। ও নিজেও লেখালেখি করে। এক লেখক আরেক লেখককে (ওর ভাষায়, আমি লেখক) এই লেভেলের প্রমোট করে, আমি এই জিনিসটা গুরু আহমদ ছফার (পণ্ডিত সলিমুল্লাহ খান ছফাকে বলেন, মহামতি ছফা। উনার ‘ছফা সঞ্জীবনী’ পড়ে দেখতে পারেন।) পর আর কাউরে করতে দেখি নাই। যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি। হুমায়ূন আহমেদ হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠার পেছনে ছফার অনেক বড় অবদান আছে। ছফা রীতিমতো লোকজনকে ধরে-ধরে হুমায়ূনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ছাপা হওয়ার পেছনে সবচাইতে বড় অবদান এই আহমদ ছফার। হুমায়ূনের কষ্টের সময়ে ছফা সবসময়ই পাশে ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ ছফাকে গুরু মানতেন।

উফফ! বন্ধুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জলিল চাচ্চুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার চাইতেও ডেঞ্জারাস!! What is love?

ওপার বাংলার উপন্যাস পড়ার শৃঙ্খল থেকে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের অনেকটাই অবমুক্ত করেছেন৷ অবশ্য আমি নিজে পুরোপুরি মুক্ত হতে পেরেছি অনেক পরে, বিশ্ববীক্ষণের ব্যর্থ পর্যুদস্ত প্রয়াসের ফাঁদে পড়ে অনেকদিন আমি হুমায়ূন আহমেদ বিমুখ হয়ে ছিলাম। উনার লেখা পড়া শুরু করেছি মূলত উনার মৃত্যুর পর। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরের একুশে বইমেলায় ‘দেয়াল’ বেরিয়েছিল। ‘অন্যপ্রকাশ’ স্টলের সামনে গিয়ে একজন মহান মৃতের স্বচ্ছন্দ্-বিস্ময়কর শাসনে জীবিতদের অসহায় অবস্থা দেখে অভিভূত হয়েছি! উনি নেই, তবু উনার বই কেনার জন্য স্টলের সামনে যে ভিড়, সে ভিড় সামলানোর জন্য দোকানের স্টাফদের হিমশিম খেতে হয়! সত্যিই কিছু-কিছু মৃত ঈর্ষার ঊর্দ্ধে নন৷

আমি ফেসবুকে ‘ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা’ নাম দিয়ে একটা ভাবনা-সিরিজ লিখি। সে সিরিজের ভাবনা: ১৩৮ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা। আগ্রহীদের জন্য লেখাটি শেয়ার করলাম—

“হুমায়ূন আহমেদ একদিন স্কিন স্পেশালিস্টের কাছে গেছেন। উনার কথাতেই সেদিনের কথাটা বলি:

গোটা পঞ্চাশেক রোগী বসে আছেন। আমার নম্বর হল একান্ন। বসে আছি তো বসেই আছি। একটু লজ্জা লজ্জাও লাগছে। কারণ ডাক্তারের বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা—চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, সবাই বোধ হয় আমাকে শেষের রোগের রুগী বলেই ভাবছে।

ভাই, বলেন তো, এই জিনিস হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কে লিখতে পারতেন? আমাদের দেশে আর কে কবে লিখতে পেরেছেন, আমাকে একটু দেখান। যারা লেখক হুমায়ূনের পরিচয় ভুলে শাওনের স্বামী হুমায়ূনকে নিয়ে নাচানাচি করতে বেশি পছন্দ করেন, তাদের বলছি, বেশি চুলকানি হলে হয় জায়গামত পেভিসোন লাগান, কিংবা হুমায়ূন ১ রাতে যে নন্দিত নরকে লিখেছেন, সেরকম একটা নন্দিত নরকে লিখতে আপনাকে সহস্র এক আরব্য রজনী দেয়া হল। পারলে লিখেন দেখি এক লাইন! ফাজিল চুলকানিগোষ্ঠী!

আগে একটাসময়ে বাংলাদেশের লোকে শুধু পশ্চিমবঙ্গের সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু পড়তো। হুমায়ূন ঘরের পাঠক ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন। হুমায়ূন বাংলাদেশে পাঠকের সংখ্যা বাড়িয়েছেন, এই কথার উত্তরে উনি মজা করে বলেছেন—

আরেকটা ভুল কথা আমার সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আমি নাকি বইয়ের পাঠক বাড়িয়েছি। আমি কিন্তু পাঠক বাড়াইনি। পাঠক বাড়লে তো সবার বই-ই বেশি বিক্রি হতো। আমি শুধু নিজের পাঠকই বাড়িয়েছি। পাঠক যদি বাড়াতাম, তাহলে তো সব বইয়ের বিক্রি বাড়ত।

সত্যিই তো! আমাদের পাঠক যতোটা না বই পড়ে, তার চেয়ে বেশি হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে। জাপানি লোকজন যতোটা না বই পড়ে, তার চেয়ে বেশি হারুকি মুরাকামির বই পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ সস্তা বাজারি লেখক, এক লেখকের এই কথার প্রতিক্রিয়ায় এক প্রকাশককে আমি টকশো’তে বলতে শুনেছি, “ভাই, হুমায়ূন আহমেদের বই ছাপাই বলেই তো আপনাদের মতো কিছু লেখকের বই ছাপিয়ে যে লসটা হয়, সেটা পুষিয়ে উঠতে পারি। নাহলে তো আপনাদের মতো লেখকদের বই ছাপানোর সাহসই করতাম না।” আমিও বলি, আমরা অনেকদিনই যতোটা না বাংলাদেশের খেলা দেখেছি, তার চেয়ে বেশি সাকিবের খেলা দেখেছি। আমাদের সৌভাগ্য, সাকিব আমাদের দেশের সন্তান।

আমাদের এই মুহূর্তে হুমায়ূনের মতো অন্তত একজন ফাজিল লেখক আর সাকিবের মতো আরো কিছু বেয়াদব প্লেয়ার বড্ডো বেশি দরকার।

পুরোনো কথাতেই ফিরে আসি, যা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি:

যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়,

তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।

এই দুই লাইন খুব বিখ্যাত। আহমেদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ তো অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু লাইন দুটি আসলে কার লেখা? আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে:

‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়/ তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়’। দু’লাইন উদ্ধৃত করে ‘উত্তরশুঁড়িদের’ উৎসর্গ করা হয়েছে সেই পুরাণটি। লেখক গোরা রায়। আপাত অপরিচিত এই ভবঘুরে লেখক সুরা নিয়ে গভীর তত্ত্বালোচনা খেলাচ্ছলে লুফে নিয়েছেন তাঁর দেশ-বিদেশের হরেক গল্পে। বোতল নিয়ে সেই আশ্চর্য বইয়ের নাম বোতল নয়, পাঁইট পুরাণ(বিভাব)। মুখবন্ধ-এ নিজের কথা লিখছেন লেখক, ‘গোরা রায়ের জন্ম ত্রেতাযুগে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে নানান বিষয়ে জ্ঞান আহরণ এবং বিনামূল্যে বিতরণই তার জীবনের উদ্দেশ্য।… ভূ-পর্যটক গোরা প্রমাণ করতে চান পৃথিবীর তিনভাগই জল।’ আর তা প্রমাণ করতে এক আশ্চর্য জলজ-দর্পণ রচনা করেছেন গোরা। পরিশেষে ওয়াইশবিয়ার থেকে স্কটিশ এল-সহ নানা পানীয় এবং চাট-তথ্য টীকাকারে। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলবাবু-র যোগ্য উত্তরশুঁড়ি কি তবে এই বার বোতলমুক্ত হলেন? সঙ্গে বইটির প্রচ্ছদ। স্পেনের আলিকান্তের একটি শুঁড়িখানার ছাদের ফ্রেস্কো এবং বিভিন্ন বিয়ার কোম্পানির লেবেল, বিজ্ঞাপন ও বিয়ার-সংক্রান্ত কার্টুন ব্যবহার করে প্রচ্ছদটি নির্মাণ করেছেন সৌম্যেন পাল।

শ্রীম কথিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত-এর চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ ‘পিতা ধর্মঃ পিতা স্বর্গঃ পিতাহি পরমন্তপঃ’-তে পাই—

[গুরুকে ইষ্টবোধে পূজা — অসচ্চরিত্র হলেও গুরুত্যাগ নিষেধ]

গিরীন্দ্র — মহাশয়! বাপ-মা যদি কোন গুরুতর অপরাধ করে থাকেন, কোন ভয়ানক পাপ করে থাকেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তা হোক। মা দ্বিচারিণী হলেও ত্যাগ করবে না। অমুক বাবুদের গুরুপত্নীর চরিত্র নষ্ট হওয়াতে তারা বললে যে ওঁর ছেলেকে গুরু করা যাক। আমি বললুম, সে কি গো! ওলকে ছেড়ে ওলের মুখী নেবে? নষ্ট হল তো কি? তুমি তাঁকে ইষ্ট বলে জেনো। ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।’

অর্থাৎ, লাইন দুটো শ্রীরামকৃষ্ণের। পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে। অসচ্চরিত্র হলেও গুরুত্যাগ নিষেধ—বড় দামি কথা! তাইতো দেখি, মদ্যপ গুরু কমলকুমার মজুমদারের পায়ের কাছে একজন শিষ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কীভাবে দিনের পর দিন পড়ে থাকেন। সৎ চরিত্রের মূর্খ অপেক্ষা অসৎ চরিত্রের পণ্ডিতের সাহচর্য উত্তম।

একটা ক্যুইজ দিয়ে শেষ করি: কেউ কি বলতে পারবেন টকশো’র ওই নাকউঁচা লেখকের নাম কী?”

মানুষের প্রিয় হয়ে চলে যেতে নেই। কিংবা, কারও প্রিয় হতে নেই……. খুব অন্যায়…..খুউউব…….

প্রিয় হুমায়ূন, আজ তুমি নেই। বড় কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে। আমাদের কত ভালো রেখেছ তোমার সৃষ্টির আনন্দে!…….তুমিও আনন্দে বেঁচো।