যে গল্পের শেষ নেই

সুন্দর একটা ছোটোবেলা। থাকতাম মায়ের হাতে গোছানো ছিমছাম একটা ঘরে। ছিলাম বাবার বড়ো মেয়ে আর মায়ের বড়ো ছেলে। সবাই কতো আদর করতো। আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতো দুই নিঃসন্তান দম্পতি। ওদের ভালোবাসাও বোনাস পেয়েছি। কখনও বুঝতে শিখিনি অন্য ধর্ম কী, কেনো, কীভাবে হয়। আমাদের বাসার সবার একটাই ধর্ম ছিল, সেটা হল মনুষ্যত্ব। ভীষণ ডানপিটে ছিলাম। চাইতাম, আমার ছোটো মামার মতো করে সবাই আদর করে বলুক, “ওরকম দুষ্টুমি করতে হয় না, মা।” বাড়ির সব বড়রা ছিল পড়ুয়া। আমাদের বাসায় যে লাইব্রেরি ছিল, সেটাতে বসে সবাই পড়তো। বিচিত্র সব বিষয়ের আড্ডাতে শৈশবের ঝলমলে সন্ধ্যাগুলো বুঁদ হয়ে ছিল। হাজারো মানুষ বাসায় আসতো। ওরা কথা বলতো, বকতো আর বকাতো। ধর্ম, ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানবতা—–এইসবকিছুতে আমার ছোটোবেলা কেটেছে। মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ, বৈষম্য, সংঘাত এইসবকে আপন ভাবতে আমাকে কখনওই শেখানো হয়নি। মনুষ্যত্ববোধকে বিসর্জন দেয়ার দীক্ষা আমি ঘরে পাইনি, বাইরে পেয়েছি। আঘাতটা তাই প্রবলভাবেই এসেছে। কী আঘাত, সেকথায় পরে আসছি। আমার ঘরেবাইরে’র দ্বন্দ্ব আমাকে আস্তেআস্তে মানুষ থেকে মেয়েমানুষ করে দিয়েছে।

প্রথম ধাক্কাটা খাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময়। আমার উচ্চশিক্ষিতা মেজো চাচী বলেন, “তোমাকে আমরা ছেলের মতো করে মানুষ করছি। একটা ছেলে যা পারে, তোমাকেও তা-ই পারতে হবে।” খুব ইচ্ছে করছিল, বলেই ফেলি, “কেন চাচী, আমাকে মেয়ে বললে কি খাতায় কিছু কম লিখে দিয়ে আসবো?” আমি আর কোনওদিনও চাচীকে পরীক্ষার সময় দোয়া চাইতে ফোন করিনি। আমার মেয়েসত্তাটাকে সবাই আমার চাইতে বড় করে দেখতে শিখে নিয়েছিল কীভাবে যেন! মেয়েদের পড়াশোনাটাও যত্ন করতে হয় শুধু নিজেকে প্রমাণ করে দিতে!

একটু আগে ফিরে যাই। আমি কম্বাইন্ড স্কুলে পড়েছি। স্কুলে পড়ার সময় কেউ যদি সামনে এসে বলতো, “অর্চিশা, তোমাকে আমি পছন্দ করি।” আমি কিছুই বলতাম না। শুধু ওর চোখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, হাসতেও মনে থাকতো না, এমনকি লজ্জাও লাগতো না। এতে কেউ-কেউ ভয়ে দৌড় দিতো, আর লজ্জায় সামনেও আসতো না। এদের মধ্যে অতিসাহসী কেউ-কেউ পরেরদিন সকালে স্কুলে এসে ঘোষণা দিতো, “এই শোনো, আজকে থেকে আমি ওর ভাই। ওকে কেউ কিছু বলবে না।” আমি এমন করেই বড় হয়েছি। আমি কাউকে আমাকে ভালোবাসতে দিতাম না, শুধু স্নেহ আর সম্মান নিয়েই সামনের দিকে এগিয়েছি। স্কুলের গণ্ডি এভাবেই পার হয়েছে। এরপর ইন্টার। শেষের দিকে এসে কী যে হলো আমার! দুম করে একটা ভালোবেসে ফেললাম! আমি কাউকে কাঁদতে দেখলে সহ্য করতে পারতাম না। আমি ঠিকমতো ভালো না বাসলে ও ভীষণ কাঁদতো। ও পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। জীবনে প্রথমবার নিজের সাথে নিজে একটা বাজি ধরলাম। সেটা হল, ভালোবাসতে না পারার মতো অতোটা ব্যস্ত আমি কোনওদিনও হবো না। শুধু ওর জন্যে। সে যে কী ভালোবাসা! আমার পৃথিবীটাকে এলোমেলো করে দিলো। আমি ইন্টার পরীক্ষার পর কোচিংয়ে গিয়েছি আর এসেছি। বাসায় একটুও পড়তাম না। কিশোরীমনের অনেক হিসেবেটিসেবে কীভাবে যেন আমার ধারণা জন্মেছিল মেডিকেলে পড়লে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। ভালোবাসার সময় পাবো না। আমরা দুজন মিলে ঠিক করেছিলাম, একটা ফুড়ুৎফাড়ুৎ চড়ুইয়ের জীবন কাটাবো। বিত্ত থাকবে না, তবু মুঠোমুঠো সুখ চারপাশে ছড়ানো থাকবে। সবাই ভাবতো, আমি মেডিকেলে টিকে যাবো। আমি জানতাম, কিছুতেই ওরকম কিছু হবে না। কাউকেই কিছু বলতাম না। নিজেনিজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ওর কথা ভাবতাম, ওকে সময় দিতাম। ও একটা কলেজে অনার্সে পড়তো। আমার সাথে ঘুরতো, আর দুজন মিলে স্বপ্ন দেখতাম। নিজের প্রতি এতো অবহেলা করেও কীভাবে যেন ভার্সিটির একটা পেছনের দিকে সাবজেক্টে চান্সও পেয়ে গেলাম। বাসায় সবাই অনেক মন খারাপ করেছিল; কিন্তু আমাকে কোনও বকাটকা দিতো না—ওটা ছিল আমার জন্য বরং আরও কষ্টের। এরপর শুরু করলাম টিউশনি। বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করে দিলাম। বাবা প্রথমপ্রথম বলতো, “কী দরকার এইসবের? মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, বাবা মনেমনে একটুএকটু খুশিও হতো। আমি যা পেতাম, তার সামান্যটুকু নিজের জন্যে রেখে বাকিটা ওকে দিয়ে দিতাম। বাসায় কখনওকখনও টুকটাক জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতাম। আর কিছু না। আমি নিজেকে মানুষ হিসেবেই বড় হতে দিচ্ছিলাম। শুধু ওর কাছে গেলেই কীভাবে যেন মেয়েমানুষ হয়ে যেতাম। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, ওকে যে করেই হোক দাঁড় করাবো। প্রয়োজনে নিজে হারিয়ে যাবো, কিন্তু কিছুতেই ওকে হারতে দেবো না। এভাবেই সবকিছু চলছিল। ঠিকঠাক। ওকে আমি সাহস দিয়েছি, বিশ্বাস করতে শিখিয়েছি ও পৃথিবীর সবচে’ যোগ্য মানুষ। ও পাস করার পর যখন চাকরির জন্যে পরীক্ষা দিচ্ছিল, তখন ওর খরচ বেড়ে গেলো। আমি আরও একটা টিউশনি করা শুরু করলাম। শরীর ভেঙে আসতো, তবু ওর কথা ভাবলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো। ওইসময়ে শুধু প্ল্যান করতাম আর কাজ করতাম।

এভাবে করে একদিন ওর চাকরি হলো। ও কীভাবে যেন আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল। নিজের প্রতি হঠাৎ করে ওর চাওয়াপাওয়াও বেড়ে গেল। ওর চোখে নতুননতুন রঙ দেখলাম। অনেক লোককে ও কীভাবে যেন পাশে পেয়ে গেল। ওর পরিচিতরা ওর বন্ধু হয়ে যেতে শুরু করলো। আর আমি খুব কাছ থেকে দেখলাম, একই মুদ্রার অপর পিঠটা। একদিনের কথা। সেদিন ওর মুখে প্রথমবার শুনলাম, “তোমার মতো সাজগোজহীন, এলোমেলো মেয়েকে নিয়ে কারওর সামনে যাওয়া যায় না। তুমি ঠিকমতো পড়াশোনাও কর না, বাজে স্টুডেন্ট। তোমাকে নিয়ে কী বলবো আমি সবাইকে? শুধু বড়বড় কথাগুলো জান, আর কিছু না। তোমার মতো জ্ঞানী মেয়ের জ্ঞান ধুয়ে কি আমি পানি খাব? নিজের ফ্যামিলি নিয়ে ভাবো, পড়াশোনায় মন দাও। আমাকে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। তোমার এইসব আটপৌরে বিরক্তিকর ভাবনাগুলো আমার ভালো লাগে না। লাইফ হবে লাইফের মতন। ঘুরবো, ফিরবো, ফুর্তি করবো—-তবেই না জীবন! তোমার ওসব জীবনদর্শনটর্শন নিয়ে ভাববার সময় নেই আমার।” এরকম আরও অনেককিছু। আমি শুধু চুপচাপ শুনতাম। আর ভাবতাম, এসব কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে। কিন্তু কী করবো? ভালোবাসতাম যে! তাই, নিজেকে পাল্টাতে চেষ্টা করা শুরু করলাম। ঢং করে কথা বলতাম, সাজগোজ করতাম, গলার ওড়না তুলে হাঁটার চেষ্টা করতাম, মিথ্যে বলার চেষ্টা করতাম, যে যা শুনতে চায় তা বলার অভ্যেস করতাম। আরও অনেককিছু। তবুও পারতাম না। ও বলতো, “আমি কিছুই পারি না। এ যুগের সাথে বড্ডো বেমানান, সেই দাদীদের আমলের জঞ্জাল একটা!” এরকম আরও কতোকতো কথা! তারপর অনেকদিন কেটে গেছে; ওর উপেক্ষা আর আমার প্রতীক্ষায়। তার নতুন-হওয়া বন্ধুরা তাকে বোঝাতো, “যা পেয়েছিস, তা-ই সত্য, তা-ই আসল। তাকে ছাড়িস না, পাপ হবে। পুরোনো জঞ্জাল আঁকড়ে ধরে রাখলে সামনের দিকে কিছুতেই যাওয়া যায় না।” আর এদিকে আমি নীরবে দেখলাম, কতো সহজে মানুষ বদলে যায়, মানুষ কী করে জানোয়ারেরও অধম হয়। চুপ করেই সব সহ্য করতাম। কিছু ঘটনা এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেল, আমার সব আবেগ-অনুভূতি ছাপিয়ে গেল। আমি অন্ধভাবে ওকে ভালোবাসতাম। ওর চাওয়াগুলো পূর্ণ করবো যেভাবেই হোক, এটা ভাবলাম। এর ফল হলো এই, আমার বাবা রাত ২টায় আমাকে দা দিয়ে কাটতে এল, এর আগে প্রচণ্ড পিটাল লাঠি দিয়ে। বাসায় আমাদের ব্যাপারটা কিছুই জানতো না। যাকে ভালোবাসি, তাকে কিছুতেই ছোটো করতে পারিনি। বাসায় শুধু এইটুকুই বলেছি, একটা ছেলেকে ভালোবাসি, ওকে যেন তারা দেখে, কথা বলে, আমার সাথে বিয়ে দেয়। এটাই ছিল আমার অপরাধ। এর বাইরে কোনও দাবি নয়, কোনও ড্রামা নয়। সেদিন ছোটো মামা আর মায়ের জন্য বেঁচে গেলাম। সবাই বোঝাল। আর আমি ভাবলাম, থাক, সবাই ভালো থাকুক। কাউকে কিছু বলতাম না। পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলাম। ও নতুন কাউকে নিয়ে নতুনভাবে সুখী হয়ে গেল। ওরা ভালো থাকুক, বলতে ইচ্ছে করতো না। তবুও দোয়া করতাম ও সুখে থাকুক। আমার আর কী-ই বা হবে! ছোট্টো একটা জীবন। কেটেই যাবে!

সময় সত্যিই কেটে যায়। এভাবে করে একদিন মাস্টার্স শেষ করলাম। ১০৩ জ্বর নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস পেলাম। আমার ভেতরটা প্রায়ই বেঁকে বসতো—পরিবারের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে-নিয়ে এগিয়ে গেছি। কীভাবে-কীভাবে যেন একটা ছোটোখাটো চাকরিও জুটে গেল। প্রাইভেট ফার্মে। অল্প টাকা বেতন পেতাম। সে টাকায় আমার নিজের খরচ জোটাতে হিমশিম খেতে হতো। তবুও আমি বেঁচে ছিলাম। পার্টিতে যেতাম, আমার ফ্যামিলির আর দশটা মেয়ে যেভাবে চলে সেভাবেই চলতাম। সব নিজের টাকায়। বাবাকে কখনও একটা ফতুয়া কিনে দিতে পারলে মনে হতো, অনেককিছু করে ফেলেছি। মায়ের হাতে আমার কিনে-দেয়া একজোড়া কাঁচের চুড়ি দেখলে কান পেতে পাশের রুম থেকে রিনিঝিনি শব্দ শুনতাম। ওইটুকুই ছিল আমার চাকরির অর্জন, আমার ছোট্টো করে একটুখানি বাঁচা। জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলছিলাম, সময়টা কাটাতে হবে বলে। ওইসময়ে একজন পিতৃতুল্য মানুষকে পেয়েছিলাম, যাঁর কাছ থেকে আমি অনেকদিন পর আবার জানলাম, আমার জীবনের মানে কী। উনি আমাকে বলতেন, আমি চাইলে অনেকদূর যেতে পারি। আমার চোখের মধ্যে পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে। আমার মধ্যে নাকি তাজা বারুদের গন্ধ পাওয়া যায়। একটু ফুলকিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। আমি জানতাম, বুঝতেও পারছিলাম, এসব ফানি কথার দাম অল্প। তবুও কিছু সময়ের জন্যে নিজেকে নতুন করে ভালোবেসেছিলাম। আমি নতুন করে বেঁচে উঠতে চাইতাম মাঝে-মাঝে। উনি আমার বস ছিলেন। এই লোকটার কথা আমি কোনওদিনও ভুলবো না। আমি যখন খুব ডিপ্রেশনের মধ্যে থাকতাম, রাস্তা দিয়ে পার হওয়ার সময়ও গাড়ি খেয়াল করতাম না, উনি আমাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে গাড়িতে তুলে দিতেন। বলতেন, তোমাকে ভালোভাবে বাঁচতে হবে। পরে জেনেছি, আমার বয়েসি উনার ছোটো মেয়ে ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল। একথা কিন্তু উনি আমাকে কোনওদিনই বলেননি। আমি জেনেছিলাম। আমাকে সবসময়ই মোটিভেট করতেন বিভিন্নভাবে। উনার কাছে আমি চিরঋণী থাকবো। দিনগুলি ভালোই কাটছিল। কিন্তু আমার যা স্বভাব! মানুষের বেশি ভালোবাসা সহ্য করতে পারি না। নিজে ভালো থাকলেও কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। ভালোথাকায় অনভ্যস্ত হয়ে গেলে ভালো থাকা বড় দায়। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।

মানুষ লুকিয়ে ঘুরতে যায়, প্রেম করতে যায়। আমি লুকিয়ে পড়তে যেতাম। আমি চাইতাম না কেউ জানুক আমি ভালো কিছু করছি। ওরা আমাকে খারাপ জানুক। বাসায় আমার অস্তিত্ব কিংবা অধিকার, এর কোনওটাই ছিল না। আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পের বই পড়তাম। আমার আশেপাশে সবাই ছিল বিসিএস আঁতেলগোষ্ঠী। ওদের সাথে বিসিএস নিয়ে কথা না বলাই ছিল পাপ—এরকমভাবে ওরা ভাবতো। . . . . . . . একদিন বিকেলে। আমি লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসে আছি। হঠাৎ কোত্থেকে এক ছেলে এসে আমাকে হ্যালো বলে নিজের পরিচয় দিল। খুব ভদ্রভাবে আমার সাথে গল্প জমাবার চেষ্টা করল। আমার থেকে একটু দূরে করে সিঁড়িতে বসল। কয়েক মিনিট পর যখন বুঝতে পারল, আমি ঠিক যেকোনও মানুষের সাথে গল্প জমানোর মতো মেয়ে না, তখন সে সুর বদলাল। বলল, “আমরা তো ভালো বন্ধু হতে পারি। আপনি বিসিএস দিচ্ছেন না কেন?” এটা বলেই সে আমাকে বিসিএস নিয়ে তার নিজের অনেক স্বপ্নের কথা বললো। বললো, সে অনেক স্বপ্ন নিয়ে সিভিল সার্ভিসে এসেছে। চাইলে আমিও পারবো ওর মতো হতে। যখন দেখলো, আমি কিছুই বলছি না, তখন ওর একটা কার্ড দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ও চলে যাওয়ার পর আমি ভাবতে শুরু করলাম। বিসিএস’এর পোকাটা অনেক আগে থেকেই মাথায় ছিল। ও এসে যেন ওটাকে একটু নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি ভাবতে থাকি। ভাবলাম, দেখি না একটু চেষ্টা করে। ওটা হয়ে গেলে তো অন্তত এই কুৎসিত শহর থেকে একটু দূরে কোথাও পোস্টিং পেয়ে চলে যেতে পারবো। বাসায় গিয়ে বললাম। ওরা সবাই সায় দিল। ওদের সবার ধারণা, আমি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী একটা মেয়ে। নিজের দমে চলি সবসময়ই। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়তে পারি। স্রোতের বিপরীতে চলি। এসব শুনে খুব খুশি হয়ে উঠলাম। এর দুএকদিন পর কী মনে করে যেন সেই ছেলেকে ফোন দিলাম। ছেলেটা ওইসময়ে অফিসে ব্যস্ত ছিল, ঘণ্টাখানেক পর সে নিজেই ফোন দিল। বিসিএস নিয়ে আমার আগ্রহের কথা শুনে বললো, সেও পরীক্ষা দেবে, ক্যাডার চেঞ্জ করবে। প্রিপারেশন নেয়ার জন্যে সে শেমুষী-তে ক্লাস করে। আমি যেন এসে একবার ওই কোচিং-এর পান্থপথ শাখায় ঘুরে যাই। আমি এরপর একদিন ওকে ফোন করে গেলাম। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল ওর কাজিন বলে। ডিসকাউন্টে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিল। আমার সাথে টাকা ছিল না। ও সেটা দিয়ে দিল। আমি পরে অনেকটা জোর করে ওকে টাকাটা ফেরত দিয়েছিলাম। ক্লাসে যাওয়াআসা শুরু করলাম। ও অন্য ব্যাচে ক্লাস করতো। আমাকে মাঝেমাঝে রাতে ফোন করে খবর নিত। ঠিকমতো পড়াশোনা করতে বলতো। ওর সাথে কথা বলতে-বলতে জানলাম, ও বড় অসহায়। ছোটোবেলায় মা মারা গেছে। ওর সব থেকেও কিছু নেই। ওর জন্যে একটুএকটু মায়া জন্মালো। আমি কয়েকটা মডেল টেস্টে ভালো মার্কস পাওয়ার পর সবার কাছে মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেলাম। সবাই আমার সাথে কথা বলতো, আমিও হাসিমুখে সবার সাথে মিশতাম। আমার পুরনো কষ্টগুলোকে একটুএকটু করে ভুলে যেতে শুরু করলাম। ওর প্রতি একটুএকটু কৃতজ্ঞতাও অনুভব করলাম নিজের মধ্যে। একদিন ও বললো, আমি যেন সকালের ব্যাচ থেকে শিফট করে সন্ধ্যার ব্যাচে চলে যাই। ওর সাথে ক্লাস শেষে ফিরতে পারবো। আমি ব্যাচ শিফট করলাম। ওর সাথে নিয়মিত দেখা হতো। ওর চোখগুলো দেখে ওর জন্যে ভেতর থেকে একটা টান অনুভব করতাম। ওকে ‘না’ বলতে পারতাম না। এই যেমন, একদিন হয়তো বলল, “আপু, আমার খুব খিদে পেয়েছে, নিচে খেতে যাবো। একটু আসবেন আমার সাথে?” আমি সাথে যেতাম। ও সরাসরি কিছু বলতে সাহস পেতো না। আমার চারপাশের মানুষ আমাকে কোনও বিচিত্র এক কারণে ভয় পায়। সরাসরি কিছু বলতে পারে না। ও আমাকে বলতো, “আপু, আপনাকে মানুষ হিসেবে আমার খুব পছন্দ।” আমিও চুপ করে শুনতাম, কিছুই বলতাম না। ভাবতাম, ও একটু পাগলাটে কিন্তু মানুষ ভালোই।

একদিন ও আমাকে কোচিং শেষে বাসায় ফেরার সময় বলল, “আপু, আপনাকে সত্যি কথাটা বলি। আমি আসলে মনেমনে আপনার মতোই একজনকে খুঁজছিলাম। আপনি আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ মানুষ।” এরপর সেই বস্তাপচা সব ডায়লগ। আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি, আপনাকে না দেখলে অস্থির লাগে, অফিসের কাজে মন বসাতে পারি না, ব্লা ব্লা ব্লা। আমি ওকে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বুঝলও। দুএকদিন পরে আবার যে, সে-ই। একটাসময়ে আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এরপর একটা বুদ্ধি বের করলাম। আমার এক পুরনো বন্ধু আমাদের সাথে পড়তো। ও আমাকে মাঝেমধ্যে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসতো। ও আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, যাতে আমি সবাইকে বলি, ও আমার বয়ফ্রেন্ড। আমি ওই পাগলাটাকে বললাম, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু ও কিছুতেই মানতে চাইলো না যে ও আমার বয়ফ্রেন্ড। বরং আমাকে বলল, “ওর জায়গায় ও থাকুক। আমি তোমাকে চাই।” এরপর ওর একটা ফ্রেন্ডের কাছ থেকে হেল্প চাইলাম। ওই ফ্রেন্ডসহ আমরা তিনজন একদিন বিকেলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বসলাম ধানমন্ডি লেকের ধারে। আমার জীবনের পুরনো সব কথা খুলে বললাম। এরপর সে ওই ফ্রেন্ডের সামনেই বলল, আর কখনও আমাকে জ্বালাবে না। আর আমাকে অনেকবার সরি বললো। আমি ওর অনুতপ্ত ব্যবহারে ওর আগের সবকিছু ভুলে গেলাম। মনে হলো, ও আসলেই অনেক ভালো। ও বললো, “আপু, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আপনাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।” আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ওর সাথে রিকশায় উঠলাম। আমি সেদিন রোজা ছিলাম। সারাদিন কিছুই খাইনি। একটুপর দেখি, মাথা কেমন যেন ঝিম মেরে আসছে। ও খেয়াল করে বললো, “আপু, আপনি অসুস্থবোধ করলে আসেন একটু কোথাও বসি। ইফতারি করেন, এরপর বাসায় যান।” আমি রিকশায় বসে থাকতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরছিল। রিকশা থামিয়ে আমরা নামলাম। ও আমাকে ধরে একটা দোকানে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কোত্থেকে একটা মোটররিকশা এসে আমাদের ধাক্কা দেয়। আমরা রাস্তায় ছিটকে পড়ে গেলাম। আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমি ওর বন্ধুর বাসায় খাটে শুয়ে আছি। বন্ধুর স্ত্রী আমাকে শরবত আর আপেল এনে দিল। উনার কাছ থেকে জানলাম, আমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর ও একটা সিএনজি নিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। উনি বাসায় ছিলেন না, বাচ্চাকে প্রাইভেট পড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর একটু সুস্থবোধ করলে ও আমাকে বাসায় দিয়ে আসলো। আমি আবার আগের মতোই ক্লাস করতে থাকি। দেখলাম, ও একটুএকটু করে কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। কোচিংয়ে নিয়মিত আসতো না। আগের চাইতেও বেপরোয়াভাবে আমার সাথে কথা বলতে চাইতো। আমি বোঝালে শুনতে চাইতো না। ক্লাস করতো না, কিন্তু কোচিং ছুটির সময়ে বিল্ডিংয়ের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন আমি খুব রেগে গেলে, ও আমাকে ‘তুমি তুমি’ শুরু করে। বলে, “চুপ! একদম চুপ! সেইদিন তুমি তো ফেইন্ট হয়ে গিয়েছিলে। আমি তোমাকে আমার বন্ধুর বাসায় নিয়ে যাই। ওখানে ওর বউ ছিল না। তুমি এটা ভাবলে ভুল করবে যে আমি তোমাকে কিছুই করিনি। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। বেশি উল্টাপাল্টা করলে সব ফাঁস করে দেবো। তোমার এসব ক্লাসট্লাস করার দরকার নাই। আমি যা বলি, তা-ই করবে। আমার কথা না শুনলে আমি সব ছেলেকে তোমার নাম্বার দিয়ে দিবো। প্রমাণসহ তোমার সবকিছু ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিবো। আমার কাছে ছেলেরা তোমার নাম্বার চায় কেন? তোমাকে এতো ছেলে পছন্দ করতে পারবে না। তুমি আমাকে বিয়ে করে ফেল। তুমি শুধু আমার হবে। তোমার যা লাগে, আমি সব দিবো। তুমি শুধু আমাকে খুশি রাখবে।” আমি ওর কথা শুনে ওকে আর কিছুই বললাম না। বাসায় এসে সেদিনের কথা ভাবতে লাগলাম। কিন্তু আমি ফেইন্ট হয়ে যাওয়ার পরের কিছুই যে আমি জানি না। আমি কী করবো? দুইদিন বাসা থেকে বের হলাম না। ফোন বন্ধ করে রাখলাম। শুধুই ভাবতে লাগলাম, ওইদিন মরে গেলাম না কেন, ওইদিন মরে গেলাম না কেন!

ভাবলাম, ভাবলাম আর ভাবলাম। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝালাম, জীবনে তো আর কম সহ্য করিনি। আল্লাহ অনেক পরীক্ষা করেছেন। এবারও না হয় একটু ধৈর্য্য ধরে দেখি। কেন হেরে যাবো? কিছুতেই হারবো না। কিছুতেই না। অনেক কষ্ট করে আবারো বের হলাম, ক্লাসে গেলাম, সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম, সেও ক্লাস করা শুরু করলো। আমাকে সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখে। ছেলেদের সাথে দূরে থাক, মেয়েদের সাথেও মিশতে দেয় না। হুট করে এসে পাশে বসে কথা বলতে শুরু করে। ছায়ার মতো আমাকে ঘিরে রাখে। বলে, সে নাকি আসলে খুব ভালো ছেলে। যা করেছে, সবই করেছে আমাকে পাওয়ার জন্যে। এখন আমি যা চাই, যেভাবে চাই, তা-ই হবে। সে সবকিছু মোবাইল থেকে মুছে দিয়েছে। আমি যেন ভালো করে নিজের যত্ন নিই। আমার সাথে খুব ভদ্র ব্যবহার করা শুরু করে দিল। আমি বুঝতে চাইলাম, আসলে কী ঘটছে। ওর সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। ওর সাথে কোনও রাগারাগি করি না, কোনও কথা বের করার চেষ্টা করি না। কিন্তু আস্তেআস্তে বুঝতে পারছিলাম, ছেলেটা একটু সাইকো টাইপের। কয়েকদিন ও ভালো থাকে। এরপর আবার ক্রেজি হয়ে ওঠে, পাগলের মতো করতে থাকে। বলে সবকিছু নেটে ছেড়ে দেবে। আমার সব আত্মীয়স্বজনকে বলে দেবে, আমি নষ্ট মেয়ে। ওর সব কথা শুনতে হবে। আমাকে জোর করে ওর বাসায় নিয়ে যেতে চায়। আমাকে বলে শপিংয়ে যেতে। একগাদা গিফট নিয়ে আসে আমার জন্যে। ওর কামনা মেটাতে চায়। পারে না বলে আরও খেপে ওঠে। আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। রাত ৩টার পরেও টানা ফোন করতে থাকে। রিসিভ না করলে হুমকি দেয় আমার বাবাকে ওইসময়ে ফোন করবে। আমি বুঝলাম, এ ছেলে স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ নয়। একে এর তাল দিয়েই বোঝাতে হবে। ওর এই রূপটা বাইরের কেউই বুঝতে পারতো না। আমি এইসব ভাবতে-ভাবতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকি।

এরপর আবার বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিই। ও আমাকে সমানে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে। আমি ওকে বলি, ও এরকম করলে আমি সবাইকে ওর এই রূপের কথা জানিয়ে দিবো। কোচিংয়ের স্যারদেরকে সবকিছু বলে দিবো। ও আমাকে বলে, “তোমার মতো মেয়েকে পেলে স্যাররা কী করবে, জানো? এখানের স্যাররা কেমন, তা তো জান না। কোচিংয়ের স্যারদেরকে ওরকম পীর ভাবার কোনও কারণই নেই।” এরপর সে বানিয়ে-বানিয়ে জঘন্য সব কথাবার্তা বলতো কোচিংয়ের স্যারদের নিয়ে। ওকে সবাই খুব ভালো জানতো। কোচিংয়ের স্যাররাও। বাইরের দুনিয়ার কাছে ও ছিল সবচেয়ে ভালো মানুষদের একজন। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। শুধু ভাবতাম আর ভাবতে থাকতাম। একদিন ওকে বললাম, “আচ্ছা, তুমি যদি ভালো করে পড়াশোনা কর তাহলে কিন্তু তোমার ফরেনে হয়ে যাবে। আমি অনেক খুশি হব। এরপর আমার বাসায় তোমার বাসা থেকে প্রস্তাব পাঠাও। আমি তোমাকে বিয়ে করবো।” সে বললো, “না, আমি তোমাকে দশদিন সময় দিলাম। এর মধ্যেই আমাকে বিয়ে করতে হবে। কারওর বাসায় কেউই জানবে না। পরে একসময় আমরা বাসায় জানাব।” আমি বললাম, “আমরা চুরি করে কেন বিয়ে করবো? আমরা কি চোর? ভালোবাসি বল, আবার ব্ল্যাকমেইলও কর। এ তোমার কেমন ভালোবাসা? ভালোই যদি বাস, তবে স্বীকৃতি দিতে কীসের এতো ভয়? আমাকে বাসায় নেবে না কেনো?” শুনে সে আক্রোশে ফেটে পড়লো। চিৎকার করতে-করতে বললো, “সে এখনো পুরোপুরি সেটলড হয়নি, তাই বাসায় বলবে না। আমি যাতে হাতছাড়া হয়ে না যাই, সেজন্যে বিয়ে করে রাখবে। এতে সে আমাকে যখন যেভাবে চায়, তখন সেভাবেই পাবে।” সে আরও বলে, “আমি নাকি ঠিক তার কল্পনার মেয়ের মতো। আমাকে বিয়ে করলে সে সারাজীবনের জন্যে সবার চোখে জিতে যাবে।” আমি এতে রাজি না হলে সে বলে, “আমি নাকি যেরকম দেখাই, আসলে সেরকম না। আমি প্রচণ্ডরকমের বুদ্ধি রাখি। আমি শক্ত নার্ভের মেয়ে। এতোটাই শক্ত যে আমি ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুনও করতে পারি। ওর কাছে যা আছে সব ফাঁস করে দিলে আমি এরপর মজা টের পাবো।” আমি সেদিন আর কিছু বলিনি। ক’দিন পরে ওকে বললাম, “তুমি যা ইচ্ছে করতে পার। আমি পরোয়া করি না। ইজ্জত গেলে যাবে। তবু তোমার কাছে এরকম ক্রীতদাসের মতো করে বাঁচতে পারবো না। নিজের জীবনের প্রতি এখন আর এক চিমটিও আগ্রহ আমার নেই। আমি চাইলে এখুনি তোমার মাথায় পিস্তল ধরে বুলেট দিয়ে তোমার জীবনখেলা সাঙ্গ করে দিতে পারি। আমি তোমাকে শেষবারের মতো সুযোগ দিচ্ছি। নিজের জীবনের কথা ভাব। তুমি মেধাবী। তোমার জন্যে অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।”

এতে সে ভীষণ ঘাবড়ে গেলো। কয়েকদিন ঠিক ছিল। কিন্তু কুকুরের লেজ তো আর কখনও সোজা হয় না। এরপর সে অন্যপথ ধরলো। যারতার সাথে আমাকে জড়িয়ে আজেবাজে কথাবার্তা ছড়াতে শুরু করে দিল। আমাকে হুমকি দিল, “শোনো, আমার কথায় রাজি হয়ে যাও। নাহলে আমি পলিটিকাল ছেলেপেলে দিয়ে তোমাকে তুলে নিয়ে আসবো। এরপর কয়েকদিন ফুর্তি করে বাসায় রেখে আসবো। বুঝতে পেরেছো? কী করতে পারবে তুমি? তুমি চাইলেও তো বাসায় এসব বলতে পারবে না। তার চেয়ে আমাকে খুশি রাখ।” আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। ওর মাথা ঠিক নেই। যা বলছে তা করে বসতেও পারে। যদিও বাসার লোকজনের কাছে মানুষ হিসেবে আমার কোনও মর্যাদা কিংবা অস্তিত্ব নেই, তবু অনেক আশা নিয়ে আমার এক ফুপুকে শুধু এইটুকু বললাম যে, একটা ছেলে আমাকে খুব ডিস্টার্ব করে, রাস্তায় দেখলে উত্যক্ত করে, বিয়ে করতে চায়। ফুপু আমার মাকে শান্তভাবে বুঝিয়ে বললো ব্যাপারটা। এরপর দেখলাম মা আমাকে ডেকে জানতে চাইলো, কী হয়েছে। আমি খুব হালকাভাবে ব্যাপারটা বললাম, যাতে এটা নিয়ে বাসায় আগেরবারের মতো আবার হইচই শুরু না হয়। ওকে কোচিংয়ের স্যাররা সবাই খুব ভালো বলে জানতেন। ওর এক প্রিয় স্যারের সাথে যোগাযোগ করে হেল্প চাইলাম। উনি সময় দিলেন না। বরং আমার অসহায়ত্বের কথা জেনে বললেন, আমি চাইলে একাকীত্ব কাটাতে উনার সাথে মাঝেমাঝে সময় কাটাতে পারি। আমার মানুষের প্রতি ঘেন্না ধরে গেল।

এর মধ্যে একদিন ওই বদমাশটা হঠাৎ করে আমাদের বাসায় এল। আমার মাকে যা নয় তা ইচ্ছেমতো বলে গেল। আমি নাকি অনেক ছেলের সাথে ঘুরি, কোচিংয়ের নাম করে বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সময় কাটাই। আমাকে যেন বাসা থেকে বের হতে না দেয়। এরকম আরও অনেক কিছু। আমি বাসায় ফিরলে আমার মা আমাকে ইচ্ছেমতো বকলো। অবশ্য আমার মারও ধারণা হল, ছেলেটা অ্যাবনর্মাল। আমার বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। এর দুএকদিন পর সে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন করে বললো, “তুমি যদি আমাকে খুশি কর, তাহলে তুমি অন্য জায়গায় বিয়ে করলেও আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এটা না কর, তাহলে আমি তোমার মানসম্মান সবকিছু নষ্ট করে দিবো। ছেলেরা অনেককিছুই করতে পারে আর সমাজও তাদেরকে হাত বাড়িয়ে হেল্প করে।” তার আসল উদ্দেশ্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি তার কথার প্রত্যুত্তর দেয়া বন্ধ করে দিলাম। এরপর সে নতুন ফন্দি করলো। আমার বাবার অফিসে গিয়ে বাবার সাথে দেখা করে বললো, সে নাকি আমার কাছে ৪৮ হাজার টাকা পায়। আমি নাকি কোন ছেলের সাথে কী একটা বাজে কাজ করে করে সেটা ঢাকা দেয়ার জন্যে ওর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছি। আমার বাবা বাসায় ফিরে আমাকে গালাগালি শুরু করে দিল। বললো, “তুই আর কতো নিচে নামবি? এইটুকুই শুধু বাকি ছিল! আমার ইজ্জত নষ্ট করতে তোকে বড় করেছি?” এরপর শুরু হল মার। সেদিন বাসায় প্রচণ্ড মার খেয়েছিলাম। আমার মা পর্যন্ত ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছিল। এমনকি ওইদিনের ওর কথাগুলোও বিশ্বাস করলো। আমি সেদিন বাসায় কিছুই বলিনি। চুপ করে মেয়ে হয়ে জন্মানোর শাস্তিটুকু নিয়েছি। আমার আগের বয়ফ্রেন্ড যেখানে আমাকে একটা চকলেট পর্যন্ত গিফট করার সাহসও পেতো না, সেখানে সে আমাকে এত বড় অপবাদ দিল? আমি কখনও কোনও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও কোনও গিফট নিয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলাম, “হে আল্লাহ! আমাকে মেয়েমানুষ করেই যদি বানালে, তবে মেয়ে ছাড়াও আমি যে মানুষও এই বোধটা দিলে কেন?” আমি এরপর দুইরাত ঘুমাতে পারিনি। কেঁদেছি, শুধুই কেঁদেছি।

বাসা থেকে আমার সবকিছুর উপরেই অবরোধ বসলো। আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিল, পিসি ইউজ করা বন্ধ, কারওর সাথে দেখা করা যাবে না, বের হওয়া যাবে না। এরপর একসময় আস্তেআস্তে বাসায় বুঝতে পারল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। আমি রাগ করে জিজ্ঞেস করলাম, “মা, কই আমার প্রেমিকরা তো কেউ আসে না কোনও দাবি নিয়ে! আর কেউ তো এসে বলে না যে আমার কাছ থেকে টাকা পায়!” তবে নিজের উপর রাগ হতো এই ভেবে যে আমি মরতে পারতাম না শুধু ৩জন মানুষের কথা ভেবেঃ আমার মা, বাবা আর ওই বদমাশটা। আমার ভাবলেও নিজের উপর ঘেন্না হয় আমি ওকে এতকিছুর পরেও ভালোবাসতাম। আমি কি তবে স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম নিজের অজান্তেই?

এরপর সে একদিন ফোন করলো। ও হয়তো ভালো হয়ে গেছে এই আশায় আমি পাগলের মতো ওর ফোনটা রিসিভ করলাম। কোথায় কী! সে আমাকে বললো, “আমি জানি আমার কথা তোমার বাসায় আর বিশ্বাস করবে না। আমি কোচিং থেকে তোমার বাসায় ফোন করাবো। স্যাররা তোমার নামে বলবে। সেটা কি ভালো হবে? এর চাইতে আমি যা বলি, তা শোনো। আমাকে খুশি রাখ। প্রতিষ্ঠিত হও, বিয়ে কর, শান্তিতে থাক। কেউ কিছু জানবেও না।” আমি বলি, “তুমি আমার সাথে যা করেছো, আমি চাইলে তোমার নামে মামলা করতে পারি। কিন্তু আমি করবো না। আমি চাই না, আমার কারণে তোমার বিন্দুমাত্রও কোনও ক্ষতি হোক। এখনো সময় আছে। তুমি ঠিকমতো পড়াশোনায় মন দাও।” ওর একটাই কথা, “আমি ওকে ভুল বুঝছি, ও আসলে অনেক ভালো একটা ছেলে। আমি ওর কথামতো চললে ও পড়াশোনায় মন দেবে।” আমি আমার সাধ্যমতো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে তো বুঝলোই না, বরং এর পরেরদিন আরেক বন্ধুকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এসে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে আমার মাকে টাকার জন্যে যাচ্ছেতাই অপমান করে। আমি পাশে ছিলাম। আমি এক পর্যায়ে বললাম, “আমিই বরং তোমার কাছ ৮ হাজার টাকা পাই। ওটা ফেরত দাও।” (ওর বোন একবার অসুস্থ হয়েছিল। তখন আমি ওকে কিছু টাকা দিয়ে হেল্প করেছিলাম। কেন দিয়েছিলাম? মায়ার কারণে। এই মায়া ভীষণ বাজে জিনিস। এটা একবার কারওর প্রতি মায়া বাড়ালে বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। নিজেকেই তখন অসহ্য লাগে। নিজেকেই অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করে। আমার জীবনের সব দুর্ভাগ্যের মূলে ওই মায়াই।) সে এটা বলার পর আমার মার সামনেই বলে, আমি ছোটলোক, আমার বাসার সবাই ছোটলোক। আরও অনেক আজেবাজে কথা। তবে এই ঘটনার পর আমার যে লাভটা হয়েছিল, সেটা হল, আমার বাসার সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল যে ছেলেটা অ্যাবনর্মাল। আমি অনেকদিন কোচিংয়ে যাইনি। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমার এক কাজিন ওকে ফোন করে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে ও বলে, আমি নাকি কোচিংয়ের নাম করে অনেক ছেলের সাথে ঘুরি। আমাকে যেন চোখে-চোখে রাখে।

তারপর সবার মাথা একটু ঠাণ্ডা হলে আমি আবার কোচিংয়ে যাওয়া শুরু করলাম, টিউশনিতে যাওয়া শুরু করলাম। আমি নিজেকে এটা বোঝালাম, ওর মতো জানোয়ার যদি প্রথমবারেই ক্যাডার হয়, আমি কেন পারবো না? ও যদি সত্যিসত্যি এবারে ফরেন পেয়ে যায়, মানুষ হিসেবে আমি নিজের কাছেই হেরে যাবো। তখন তো আমার আত্মহত্যাও করার রাস্তা থাকবে না, কারণ সেটা হবে জীবন থেকে পালিয়ে একেবারে বেঁচে যাওয়া। আমি পালাবো কেন? জীবন থেকে পালাতে চাইলে তো কবেই সেটা করতে পারতাম! আমি কোচিংয়ে আমার প্রিয় এক স্যারকে কৌশলে বললাম যে ও আমাকে ডিস্টার্ব করে, আমাকে যেন অন্য ব্রাঞ্চে ক্লাস করার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর আমি নীলক্ষেতে শিফট করলাম। বাসা থেকে টিউশনিতে, কোচিংয়ে হেঁটে যেতাম, হেঁটে আসতাম। প্রতিদিন অন্তত ৫-৬ মাইল হাঁটতাম। খুব কষ্ট হতো, তবুও। নিজেকে আরও বিভিন্ন উপায়ে শাস্তি দিতাম। এসবকিছু জেনে সে আমার মাকে আবার ফোন করে বললো, আমি নাকি কোন এক স্যারের সাথে একান্তে সময় কাটানোর জন্যে পান্থপথ থেকে শিফট করে নীলক্ষেতে চলে গেছি। আরও অনেক বাজে কথা বললো। আমি এরপর ওর সাথে অনেকটা জোর করেই আবারো দেখা করলাম। দেখলাম, ও কীভাবে আহত বাঘের মতো লাফাচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়ানোতে ওর শক্তি কীভাবে যেন শেষ হয়ে গেছে। আমি ওই মুহূর্তেই ঠিক করে ফেললাম, ওকে আঘাত করবো। ব্যাগের চেইন খুলে কলম বের করে বললাম, “এই দেখ, যদি আর কোনওদিনও আমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা করিস, কলমের নিব দিয়ে নিজের হাতের সবক’টা রগ উপড়ে ফেলবো। এর জন্যে তোকে দায়ী করবো। তার চেয়ে তুইও শান্তিতে থাক, আমিও শান্তিতে থাকি।” আরও বললাম, “দেখ, এতোকিছুর পরও আমি তোর ভালো চাই। ভেবে দেখ, তুই ফেঁসে যাবি। দুনিয়ার কাছে না হলেও নিজের বিবেকের কাছে ফেঁসে যাবি।” ও বললো, “আমি তোকে শান্তিতে থাকতে দিবো না। তুই আমি যা বলি তা শুনবি। আমি শুধু তোকে না, তোর পুরো পরিবারকে শেষ করে দিতে পারি।” আমি বুঝলাম, এ পাগল ঠিক হওয়ার না। ওকে আর কিছু না বলে বাসায় ফিরে আসি।

এর কিছুদিন পরে সে অ্যাক্সিডেন্ট করে। বন্ধুর বাইকে চড়ে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে কনস্ট্রাকশনের রডে লেগে বাঁহাঁটুর নিচ থেকে পুরো দুমড়েমুচড়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন, পাটা নিচ থেকে কেটে ফেলে দিতে হবে। ও ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট করায়নি বলে পায়ে পচন ধরেছে। নাহলে পা’টা হয়তো বাঁচানো যেত। এ অবস্থাতেও সে আমাকে ফোন করে জ্বালায়। বলে, ওর অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে আমিই নাকি দায়ী। আমাকে নাকি ও সুস্থ হলে দেখে নিবে, ফোন করে আমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলে। বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করে। বলে, ফেসবুকে বসা যাবে না, টেনশন করা যাবে না, ওকে সবসময় ফোন করতে হবে, কারওর সাথে মেশা যাবে না, কোনও বই পড়া যাবে না, রোদে বের হওয়া যাবে না। আমার বিসিএস দেয়ারও দরকার নেই, ও বিসিএস দিতে পারছে না বলে নাকি আমি পড়াশোনায় আরও বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছি, আমি একটা প্রতারক, আমি ছেলেদের সাথে বাজে কাজ করি, এরকম আরও হাজারো কিছু।

আমি আর পারছি না। আমি ক্লান্ত। ক্লান্তিতে আমার উন্মাদ হতেও আর ইচ্ছে করে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকতে-ঠেকতে এখন দেয়ালে আমার পিঠ বিঁধে গেছে। বন্ধুরা আমাকে বলে, “তুই আবার উঠে দাঁড়া। তুই পারবি, আমরা আছি তোর পাশে।” আমি বলি, “এই লড়াইটা আমার একার। হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ভেতরেবাইরে ক্ষতবিক্ষত আমি। বাঁচার আশা নেই। মরে যাওয়ার মতো হতাশাও নেই। আমি যে বেঁচে-বেঁচে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি বাঁচবো। বেঁচে দেখব বেঁচে থাকলে কী হয়। শেষ নিঃশ্বাসটা যেন বুকের ভেতর কোনওরকমে আটকে আছে। আমি ওটা নিয়েই আরেকবার ঝাঁপিয়ে পড়বো, শেষ চেষ্টাটা করে দেখবো।” জানোয়ারটা এখনো প্রতিরাতে ফোন করে। আমি ধরি না। যদিও বা কখনও ধরি, আমাকে উত্তেজিত করে বাসা থেকে বের করার চেষ্টা করে। ওর বাসায় যেতে বলে। বলে, আমার উপর ওর অভিশাপ আছে। আমি জীবনেও কিছু করতে পারবো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাকে শাস্তি দেবেন। আমি ইদানীং আর কাউকেই কিছু বলি না। বাসায় থাকি, পড়াশোনা করি, মা-বাবা’র সেবা করি, নামাজ পড়ি আর ওই জানোয়ারটার জন্যে দোয়া করি।