রান্না নিয়ে

: তুমি কি কখনও খাবার পছন্দসই না হলে, যাঁরা রান্না করেন, তাঁদের ডেকে ডেকে বাজে মন্তব্য করো? কখনও করেছ ওরকম? আমার মনে হয় না, করেছ। তারপরও যদি কখনও করো, তাহলে বলব, প্লিজ, এমনটা কখনও কোরো না। ভীষণ ভীষণ কষ্ট হয় এমন আচরণ সহ্য করতে।


আজকে তোমাকে এ বিষয় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি মোটামুটি একা একাই রান্নার সব কাজ করতে অভ্যস্ত। কাজের মানুষের উপর কখনওই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলাম না আগেও, এখনও নেই। কারণ যেদিন কাজের বুয়া-খালাকে বলব, 'আগামীকাল একটু জলদি আসবেন, কাল বাসায় মেহমান আসবে।' সেদিন হয়তো উনি এলেনই না, নয়তো আমার যখন প্রায় সব ঝামেলার কাজ শেষ হয়ে যায়, কিছু টুকটাক কাজ পড়ে থাকে, তিনি ঠিক তখন এসে হাজির। ওঁর উপর নির্ভর করে থাকার মানেই, নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা! আমি সবসময়ই খাবারের ব্যাপারে খুব কেয়ারফুল থাকি। এমনকি আমার শত্রুও যদি বাসায় আসে, আমি কখনও কোনওভাবেই তাকে না খেয়ে যেতে দিই না। তা ছাড়া আমি নিজেও খেতে পছন্দ করি এবং অন্যকে খাওয়াতে আরও বেশি পছন্দ করি। কিন্তু তার অর্থ এই না যে, আমি খুব ভালো রাঁধুনি।


আমার বাসায় গেস্ট এলে মোটামুটি আমি একাই সব রান্না করি। আমার বাসার একটা নিয়ম, সবাই সকাল ৮টা বাজার সাথে সাথেই খেতে বসে যাবে। আর যদি বাসায় গেস্ট আসে, তবে সেদিন আব্বুরা সবাই পারলে ভোর ৬টায় খেতে বসে যায়। বাসায় গেস্ট এলে একে তো রাতে সব কাজ শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে আমার অনেক দেরি হয়ে যায়, তারও পরে আবার সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়।


আমার বাসার গেস্টদের আবার আরেক সমস্যা। তারা হরেক রকমের নাস্তা করে। কেউ পরোটা, কেউ শুকনো রুটি, কেউ নরম খিচুড়ি, কেউ ঝরঝরে খিচুড়ি, আবার কেউ কেউ নরম ভাত আর আলুভর্তা। এখানেই শেষ নয়, এর সাথে আরও হরেক রকমের ফর্দ থাকে: কেউ ডিম অমলেট খাবে তো কেউ ভাজি, আবার কেউ শুধু পেঁয়াজ দিয়ে ডিমভাজি, কেউ শুধু মরিচ দিয়ে ডিমভাজি, কেউ আবার পেঁয়াজ-মরিচ ছাড়া শুধু লবণ দিয়ে ডিমভাজি। এর সাথে দুই রকমের মাংস, বেগুনভর্তা, কালোজিরা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, কচুর পাতা ভর্তা, লাউপাতা ভর্তা...এরকম হেনতেন নানান আইটেম। তারও পরে কেউ হয়তো কোনও একটা আইটেম খেতে বসে সব আইটেম একটু একটু করে খেয়ে সব কিছু হাবিজাবি করে মিলিয়ে পাতে নেয়, এজন্য আমি সব কিছুই পর্যাপ্ত পরিমাণে রান্না করি।


এটা তো গেল একবেলা। প্রতি বেলায় এসব চলতেই থাকে, কিন্তু এত কিছুর পরেও কেউ চুপ যান না। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করে দেন, কোনটা আরেকটু কেমন হলে বেশি মজা হতো। একে তো একা একা এত কিছু রান্না করে, তার উপর এত ধরনের ফর্দমাফিক রান্না করেও যদি কেউ বাল্যকালে তার আম্মা নয়তো অন্য কেউ কেমন করে রান্না করত, সেটা খেতে কেমন হতো, এটার সেটার পার্থক্য কী কী, সেসব শুনতে হয়, তাহলে সত্যিই আরেক বেলা এসব মানুষকে কিছুই রান্না করে খাওয়াতে একটুও রুচিতে আসে না। তা ছাড়া রান্না জিনিসটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। তুমি যত বেশি কারও রান্নার খুঁত ধরবে, ততই সে সামনের বার আরও বিশ্রী করে রান্না করবে এবং এর বিপরীতটাও সমভাবে প্রযোজ্য।


আমার বাসার মানুষের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে, তারা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এমন রোবোটিক গোছের এক কাজের মেয়ে পেয়ে গেছে, যা সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার! এর ফলে পেট ভরে খেয়ে গাল ভরে কথা শোনাতে কারও কিছুতেই বাধে না। তা ছাড়া আমার তো যাবার কোনও জায়গা নাই, সুতরাং আমাকে ইচ্ছেমতো হেনস্তা করলেও কোনও সমস্যা নাই। আমার বাসার মানুষের শুধু এটাই সমস্যা না, তাদের আরও এক সমস্যা হচ্ছে, রান্নার আগে কোনও ফর্দ দেবে না, রান্না হয়ে গেলে বলবে, এটা তো খেতে চাই নাই, অন্যটা খেতে চেয়েছি, অতএব এটা এখন খাব না। যদি পোলাও রান্না করি, তাহলে বলবে, খিচুড়ি খেতে চেয়েছি; আর যদি খিচুড়ি রান্না করি, তাহলে বলবে, পোলাও খেতে চেয়েছি। যদি ঝরঝরে রান্না করি, তাহলে বলবে, নরম খেতে চেয়েছি; আর যদি নরম রান্না করি, তাহলে বলবে, ঝরঝরেই তো খেতে ভালো লাগে!


এর অর্থ হচ্ছে, আমি যা-ই কিছু করি না কেন, তাতেই সমস্যা। এমন হলে তো চলা যায় না। একজনের উপরে এমন স্টিমরোলার চালানো
আর কত ভালো লাগে, আমি সত্যিই জানি না। এসব ভীষণ বাজে অভ্যাস। কারণ যে রান্না করে, তার একটা অনীহা চলে আসে তাদের উপর, যারা প্রতিনিয়ত এমন করে। তাদের প্রতি বিরক্তি আর প্রবল বিতৃষ্ণা কাজ করে। সেই থেকে সম্পর্কটাও আর স্বাভাবিক হয় না। এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যে চুলার সামনে বসে থাকা কী যে কষ্টকর, সেটা যারা নিয়মিত রান্না করে, তারাই ভালো জানে, বাকিরা তো খেয়েই খালাস! মনে হয়, ইস্‌, এই গরমে চুলার সামনে ধরে এনে এরকম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওদেরকে বসিয়ে রাখতে পারতাম!


এজন্য আজকে আমার মেজাজটা খুব খুব খারাপ। খাবার নিয়ে এমন করা আসলেই উচিত না। সবার একটু বোঝা উচিত, সবার শরীরই শরীর, কারও শরীরই মেশিন না। আর সব কিছু সবাই সারাজীবন সহ্য করে না। এই যে আমার এসব মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে, একটা সময় হয়তো আমি চাইলেও আর তাদের কাছাকাছি থাকব না। আমার মন সেটা হয়তো করতে দেবেই না আমাকে। এইসব ব্যবহার এজন্য সবারই একটু বুঝেশুনে করা উচিত।


: তোমার প্রতিটি কথার সাথে একমত আমি।


দু-একটি কথা।
এক, আমার কখনওই রান্না নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকে না।
দুই, আমি একদম সবই খাই, মানে আমার খাওয়া নিয়ে কোনও বাছাবাছি নাই।
তিন, যে রান্না করে, আমি এই পর্যন্ত তাকে কোনও কিছু নিয়েই বাজে কিছু বলিনি।
চার, রান্না ভালো লাগলে আমি অবশ্যই ডেকে প্রশংসা করি।
পাঁচ, এমনকি সে যদি নিজে কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করে, রান্না কেমন হলো, আমি ভালো না হলেও বলি, হ্যাঁ, রান্না ঠিকঠাক।
ছয়, আমার এমন রেকর্ডও আছে, রান্নায় লবণ হয় নাই, কিন্তু আমি বিনা বাক্যব্যয়ে খাবার খেয়ে উঠে গিয়েছি।


আমার দৃষ্টিতে, রান্না পৃথিবীর মহত্তম শিল্প। যারা রান্না নিয়ে খটমট করে, আমি ওদের পছন্দ করি না।


বাই দ্য ওয়ে, আমি তোমার রান্না খেতে খুবই আগ্রহী।