রূপার সোনালি গাথা

আহা! মেয়েরা কেন তাদের মহামূল্যবান ভালোবাসা জানোয়ারকে দিয়ে ফেলে? ভালোবাসা দিতেই হবে কেন? না দিলে কী হয়? দিলে অপাত্রে কেন? মেয়েরা কি ওটা বোঝে না? নাকি, বুঝতেই চায় না? প্রেমে পড়লে অন্ধ হতেই হবে, একথা কোন আইনে আছে? ছেলেরা কেন একটা মেয়ের ভালোবাসার দাম দিতে জানে না? কেন মেয়েটির নিখাদ ভালোবাসাও ছেলেটাকে ভালো’র দিকে ফেরাতে পারে না? কেন একবার মেয়েটিকে ‘হাতে পেয়ে গেলে’ আর কোনও চিন্তা নেই ভেবে নিজের স্বরূপেই ফিরে যায় ছেলেগুলি? বিয়ের আগে কেন ভালোবাসা উপচে-উপচে পড়ে? সেই ভালোবাসা কেন বিয়ে হতে না হতেই একেবারেই উবে যায়? কেন মেয়েরা যাকে একবার ভালোবেসে ফেলে, তার জঘন্যতম মিথ্যেগুলিকেও সত্যি ধরে জীবন কাটানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে? কেন একটা সময়ে যাকে প্রতিমার মতন দেখতে লাগত, তাকেই বিসর্জন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেগুলি? কেন মেয়েরা অসহায় হয়েই বেঁচে থাকার জন্যই জন্মায়? কেন ওরা মানুষ নয়, শুধুই মেয়েমানুষ? কেন কেন কেন???

আজ হতে ৫ বছর আগে। না, ভুল হল। আরও সাড়ে ৩ বছর আগে। একটি ছেলে একটি মেয়েকে বলেছিল, “ভালোবাসি।” মেয়েটি বলেছিল, “তো?” “তুমি বাসো না?” “ভাবিনি। বাসি না বোধ হয়।” “বাসতে হবে।” “মানে?” “মানে হল, আমি যা চাইছি, তা-ই হতে হবে।” “না হলে?” “তুমি ভালো থাকতে পারবে না।” “কী বলতে চান?” “যা তুমি বুঝতে চাইছো না, তা-ই।” “আপনি যা বলতে চান, সরাসরি বলুন।” “বলেছি।” “আমি আগেও আপনাকে বলেছি ওটা সম্ভব নয়।” “কেন?” “আপনাকে আমার ভালো লাগে না।” “তো, অপুকে লাগে, এইতো? দেখ, আমি ওর কী করি!” “প্লিজ, আপনি এভাবে বলবেন না। ও খুব ভালো ছেলে।” “আমি কি খারাপ?” “তা নয়। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসার কথা আমার মন থেকে আসে না। আমি চেষ্টা করে দেখেছি অনেকবার।” “ও তা-ই, না? তুমি অপুর সাথে কীভাবে ক্যাম্পাসে হাঁট, আমি দেখে নেবো।” “আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। তাছাড়া আপনি রাজনীতি করেন, এই ব্যাপারটা আমার বাসায় কেউ পছন্দ করবে না।” “পছন্দ করার দরকার নেই। তুমি হয় আমাকে ভালোবাসবে, নতুবা এই ভার্সিটি ছেড়ে অন্য কোথাও ভর্তি হবে। এটাই ফাইনাল। বাসায় জানিয়ে দাও।” “যদি না হই?” “ভার্সিটির ক্যাম্পাস আমার। এখানে আমার নিয়ম চলে। আমি যা বলবো, তা-ই হবে। পড়া দূরে থাক, ক্যাম্পাসে তুমি হাঁটতেও পারবে না। আমি কী করতে পারি, দেখ।” “আমি প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবো!” “তোমার পার্সোনাল ব্যাপার। আমি আমারটা জানিয়ে রাখলাম।” বলেই বাইকে বিশ্রী রকমের ভোঁভোঁ শব্দ তুলে অনিক চলে গেল। রূপা বুঝতে পারছিল না, কী করা উচিত। থার্ড ইয়ারে উঠে ভার্সিটি চেঞ্জ করার প্রশ্নই আসে না। এর মধ্যে অনিকরা অপুকে কোনও কারণ ছাড়াই দুই দফায় মেরেছে। আর্টস ফ্যাকাল্টির ৫তলার বারান্দার রেলিংয়ের বাইরে অপুর শরীরের অর্ধেকটা বের করে ফেলে দেয়ার ভয় দেখিয়েছে। পলিটিকাল ছেলেদের প্রতি ঘৃণায় ও একদলা থুতু ছুঁড়ে মারল মাটিতে! পড়াশোনা নেই, শুধু আলতুফালতু কাজ করে বেড়ানো। ওর হঠাৎ মনে হল, আহা! হলে মারামারির সময়ে গুলিটা অনিকের বুকে এসে লাগে না কেন? রূপা মনে-মনে প্রার্থনা করলো, যাতে পরেরবার ক্যাম্পাসে গোলাগুলির ঘটনার পর ও ‘সুসংবাদটা’ শুনতে পায়। এর এক সপ্তাহ পর। একদিন সন্ধ্যায় টিউশনি থেকে ফেরার পথে অনিকরা রূপাকে তুলে নিয়ে গেল। কোথায় যেন নিয়ে আটকে রাখল টানা ৩ দিন। ওকে বলা হল, কাউকে কিছু বললে ওরা অপুকে মেরে পঙ্গু করে দেবে। অপুকে মারধরের ভিডিও রূপাকে দেখাল অনিক। পলিটিকাল ছেলেরা সাধারণত ছ্যাঁচড়া ধরনের হয়। ওরা সেটা করতেও পারে। ওদের সব জোরই বাহুতে। যার মাথার জোর যত কম, তার বাহুর জোর তত বেশি। ভয়ে রূপা কাউকেই কিছু বলেনি। ওদিকে অনিক অপুর সাথে দেখা করে মোবাইলে ভিডিও-করা কিছু ক্লিপ দেখিয়ে কলার ধরে আবারও চড়ঘুষি মেরে ভয় দেখাল, যদি ও রূপাকে অ্যাভয়েড না করে তবে ওকে হলে থাকতে দেবে না, আর রূপার ক্লিপগুলি নেটে ছেড়ে দেবে। অপুর ভয়ার্ত মুখ দেখে অনিকদের চোখ চকচক করতে লাগল। অপুর গাল টেনে-টেনে অনিক শব্দ করে হাসতে লাগল। আহা! ক্যাম্পাসে পলিটিকাল ছেলে হওয়ার মজাই আলাদা!

অপু কীরকম যেন বদলে গেল এরপর। রূপার ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিল। ক্লাস থেকে বেরিয়েই দ্রুত চলে যেত টিউশনিতে, রূপা ফোন দিলে ধরত না। রূপা একদিন ওকে সামনাসামনি পেয়ে ওর হাত ধরে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে চিৎকার করে বলল, “এই! সমস্যাটা কী তোমার? তুমি আমাকে অ্যাভয়েড করছ কেন?” “আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না।” “মানে?” “যা বলছি, তা-ই। তুমি তোমার মতন করে থাক, আমি আমার মতন করে থাকব।” “আমার কোনও অন্যায়?” “তোমার সাথে রিলেশন কন্টিনিউ করা আর সম্ভব নয়, রূপা। আমি এখন অন্যকাউকে ভালোবাসি।” “অপু, তুমি কী বলছ এইসব?” “যা সত্যি, তা-ই বলছি। তোমার কোনওকিছুই এখন আর আমার ভালো লাগে না।” “তোমার কী হয়েছে, অপু?” “কিছুই হয়নি। আমি কাঞ্চিকে ভালোবাসি। আমরা গত পরশু বিয়ে করে ফেলেছি। সরি! তুমি তোমার পথে হাঁট। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না, প্লিজ!” এইটুকু বলেই অপু হনহন করে হেঁটে চলে গেল। রূপা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না, কীসব হয়ে গেল! হঠাৎ চোখের সামনে কেমন জানি অন্ধকার দেখে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে আবিষ্কার করলো ভার্সিটির মেডিক্যাল সেন্টারের বেডে। সামনের চেয়ারে অনিক বসে আছে, সাথে কুকুরের চাইতে বিশ্বস্ত কিছু পলিটিকাল ছেলে। রূপা মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর অনিকই ওকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। ওর বাসায় খবর দেয়া হয়েছে। রূপা অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখল, অনিক চোখ মুছছে। বোধহয় এতক্ষণ কেঁদেছেও। “রূপা, এখন কেমন লাগছে?” “ভালো। আপনি এখানে কেন?” “তুমি শহীদ মিনারের সামনে নিচে পড়ে ছিলে। আমরা এখানে নিয়ে এসেছি। কী হয়েছিল?” রূপার মধ্যে হঠাৎ করেই গত ১ বছরে প্রথমবারের মতো অনিকের জন্য মায়া লাগতে শুরু করলো। এমন তো হওয়ার কথা নয়। তবে কেন হচ্ছে এমন? মাথা ঝিম ধরে আছে, তাই? এর ব্যাখ্যা খুঁজতে যাবে, এইসময়েই ওর বাবা এসে অস্থির কণ্ঠে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, “আমার রূপার কী হয়েছে? ও এখানে কেন? …… মা, তোর কী হয়েছে? তুই এখানে কেন?” “আমি ঠিক আছি, বাবা। তুমি কেমন আছ?” সবকিছু শুনেটুনে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে রূপার বাবা ওকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ওর এখন রেস্ট দরকার। বাসায় রূপা এক সপ্তাহ ছিল। এই সাত দিনে অনিক প্রতি মুহূর্তেই ফোন করে করে রূপার খবর নিয়েছে। ও খাওয়াদাওয়া করছে কি না ঠিকমতো, ঘুমাচ্ছে কি না, কেমন অনুভব করছে, শরীর দুর্বল লাগে কি না, সব! রূপার মধ্যে আস্তে-আস্তে অনিকের জন্য একটা কোমল জায়গা তৈরি হল। সে জায়গা ভালোবাসার, সে জায়গা নির্ভরতার, সে জায়গা মায়ার। গল্প-সিনেমার মতন করে ওদের প্রেম হয়ে গেল। এবারের প্রথম বলাটা রূপার মুখ দিয়েই: “অনিক, তুমি থাকবে তো আমার পাশে সবসময়, সারাজীবন?”

ক্যাম্পাসে প্রায় এক বছর ধরে অনিক আর রূপার প্রেম চলল। সবাই ওদের এই জুটির কথা জানত। অনিক রূপার কথায় একটাসময়ে সিগ্রেট ছেড়ে দিল। রূপার ভালো লাগে, এমন সবকিছুই করার চেষ্টা করতো অনিক। রূপা যাতে খুশি থাকে, এটাই ছিল ওর সবসময়ের ভাবনা। রূপা ক্লাস থেকে বের হয়ে দেখত ওর জন্য রিকশা রেডি। ওর নোট, শিট ফটোকপি করতে দোকান পর্যন্ত যেতে হতো না। দুপুরে অনিক রূপার জন্য খাবার এনে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। বৃষ্টি নামল, আর অমনিই রূপার জন্য রাজ্যের কদমফুল হাজির! অনিকের বাইকে রূপা পুরো শহর ঘুরে বেড়াত। রূপার মনখারাপ, আর সাথে সাথেই গিটারটিটার নিয়ে অনিকের পলিটিকাল বন্ধুরা ভার্সিটির খোলা মাঠে। রূপার বাবার অ্যাক্সিডেন্টের পর অনিকরা রাতের পর রাত হসপিটালে কাটিয়েছে, সেবা করেছে। রূপা যখন থার্ড ইয়ারের শেষের দিকে, তখন বাসার সবার অমতে ও অনিককে বিয়ে করে ফেলল। অনেক চেষ্টা করেও বাসায় কোনওভাবেই অনিককে মেনে নিতে রাজি করাতে পারেনি। রূপার সাথে বাসার সব যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ। রূপা ফোর্থ ইয়ারে, ওদিকে অনিক পাস করে চাকরির জন্য পলিটিকাল নেতাদের দরোজায়-দরোজায় কড়া নাড়ছে। ওরা বলেছিল, “পলিটিকাল ছেলেদের পায়ে ধরে-ধরে কোম্পানিগুলি চাকরি দেবে।” ওরা যা-ই বলতো, অনিক তা-ই বিশ্বাস করতো। ওই বয়সটা ছিল নেতাদের ফাঁকা বুলি বিশ্বাস করার বয়স। যাদের প্রভাবে আর ছত্রছায়ায় অনিক একটা সময়ে ভার্সিটির দাপিয়ে বেড়িয়েছে, যাকে ইচ্ছে তাকে ধরে মারধর করেছে, হলের যে মেয়েটাকে পছন্দ, সে মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে, যা ইচ্ছে তা-ই করেছে, বড় নেতাদের প্রটোকল দেয়ার সময় মনে করেছে, “সেও উনার সমপর্যায়ের নেতা”, যাদের প্রশ্রয়ে পড়াশোনা না করেও স্যারদের সামনেই বই খোলা রেখে পরীক্ষা দিয়েছে, হল দখলের মারামারিতে ত্রাস সৃষ্টি করেছে, তারাই এখন ফোন করলে ধরে না, কেটে দেয়। ১৪টা চাকরির পরীক্ষায় বসেও একটাতেও ভাইভাতে ডাক পেলো না। পাবে কোত্থেকে? মাথায়ই যে কিছু নেই। অনার্স তো পুরোটাই কাটিয়েছে ডার্টি পলিটিক্স করে। এখন ভার্সিটি লাইফ শেষ, কেউ আর ওকে এক পয়সারও গোনে না। গোনার জন্য ভার্সিটিতে নতুন পলিটিকাল ছেলেরা আছে। ভার্সিটির ক্যান্টিনে চা দিত যে নয়ন, সেদিন সে পর্যন্ত রাস্তায় অনিককে দেখে সালাম দেয়নি! একদিন চাকরির ফরম জমা দিতে রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, এমনসময় ওর মোবাইলে একটা ফোন এল। “হ্যালো! অনিক ভাই? স্লামালিকুম। কেমন আছেন? আমি অরূপ। চিনতে পারছেন? ওই যে সিগ্রেট এনে দিইনি বলে ভার্সিটিতে আমাকে আপনারা সবাই মিলে মজা করে পিটিয়েছিলেন। মনে আছে ভাইয়া?” “হ্যাঁ, বল। কী খবর?” “এইতো ভাই, ভালো আছি আপনার দোয়ায়।” “এতদিন পর? হঠাৎ?” “না ভাইয়া, আপনাকে একটা সুখবর দেয়ার জন্য ফোন করেছি। আমি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো’তে চাকরি পেয়েছি। আপনি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, তাই ভাবলাম, সবার আগে আপনাকেই খবরটা দিই। আমার ভালো’র জন্য আপনি আমাকে কত চড় মেরেছেন ক্যাম্পাসে। আমার পোস্টিং ঝিনাইদহে। বেড়াতে আসবেন ভাইয়া। আর কিছু দিতে পারি আর না পারি, ফ্রিতে সিগ্রেট দিতে পারবো। হাহাহা……. আপনি এখন কোথায় জয়েন করেছেন?” অনিকের মনে হল, কেউ যেন ওর গালে ঠাসঠাস করে কষে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়েছে। ও কোনও কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিল। কথা বলার মতো শক্তিও ওর গলায় নেই। হঠাৎ ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। ফরম জমা না দিয়েই লাইন থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠে একটা গাঁজা ধরাল। চরম হতাশা আর বিষণ্ণতা থেকে কিছুদিন হল অনিক গাঁজা ধরেছে, প্রায়ই ড্রাগ নেয়। রূপা এসব জানে না।

এর মধ্যে রূপা পাস করে বের হল। অনিকের জমানো সব টাকাও প্রায় শেষের দিকে। গ্রামের বাবা-মা’র কাছে টাকা পাঠায় না অনেকদিন। ছোটবোনটা টাকার অভাবে প্রাইভেটে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে ফোন আসলে অনিক আর ধরে না। রূপার টিউশনির টাকায় ওরা দুইজন মিলে একটু মফস্বলের দিকে একটা এক রুমের বাসা ভাড়া নিল। রূপা টিউশনি আরও ৩টা বাড়িয়ে দিল। অনিক চাকরির জন্য ছোটে আর রূপা সারাদিন বাসায়-বাসায় গিয়ে স্টুডেন্ট পড়ায়। এভাবেই চলছিল। অনিকের বন্ধুদের অনেকেই যে যার মতন করে বিভিন্ন চাকরি জুটিয়ে ফেলল। সবাই ওকে নানান কথা শোনাত। “বউয়ের টাকায় চলিস, তোর লজ্জাও করে না?” “কীরে? তোর লিডার তোকে চাকরিটাকরি দেয় না?” এরকম আরও অনেককিছু। যে ছেলেটি একটাসময়ে সবার উপরেই খবরদারি করে বেড়াত, সে ছেলেটি হঠাৎ পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে চড়থাপ্পড় খেতে লাগল। যে আগে চড় দেয়, সে পরে লাথি খায়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। Just wait & see. অনিকের ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। ওর লাথি খাওয়ার সময় এসে গেছে, এখন তা-ই খাচ্ছে। ও এখন ট্রাকের নিচে কুকুর-বেড়ালের মতন মরে রাস্তার উপর পড়ে থাকলে ওর জন্য শুধু ৪জন মানুষ কাঁদবে: ওর বাবা, ওর মা, ওর ছোটবোন, আর রূপা। ওর চাইতে জুনিয়র-জুনিয়র ছেলেরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে আর ও একটা চাকরির জন্য ভিখারির মতন সবার দরোজায়-দরোজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরকম অবস্থায় মানুষের ভেতরের দ্রোহটা জেগে ওঠে। সে দ্রোহে যাদের কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা আছে, তারা ঘুরে দাঁড়ায়, আর যাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই, তারা নিজের জীবনের প্রতি বিরক্ত, ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে।

অনিক হঠাৎ করেই দ্রুত বদলে যেতে লাগল। নেশায় জড়িয়ে গেল আরও বেশি করে। রূপার টিউশনির সব টাকা নেশার পেছনে উড়াতে লাগল। রূপা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে টাকা দিতে রাজি না হলে অনিকের সব পৌরুষ আর আক্রোশ গিয়ে পড়ত রূপার ওপর। যে পুরুষ ঘরের বাইরে লাথি খায়, সে পুরুষ ঘরে ফিরে বউ পেটায়। পৃথিবীর সব ভদ্রলোকই স্ত্রীকে ভয় করেন। অনিক ওদের দলে কোনওকালেই ছিল না। রূপার ওপর শুরু হল অমানুষিক অত্যাচার। চোখে-মুখে-পিঠে-পেটে-গলায় সহ শরীরের সবখানে এলোপাথাড়ি কিল, লাথি, ঘুষি এসব ছিল অনিকের রূপার সাথে যোগাযোগের প্রতিদিনের ভাষা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলত এই অসহনীয় অত্যাচার। চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে মাথা থেঁৎলে-দেয়া, মাটিতে ফেলে গায়ের উপর দাঁড়িয়ে বেত দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো থেকে শুরু করে এমনকিছু নেই, যা রূপাকে সহ্য করতে হয়নি। রূপা বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত, এই ভয়ে যে, যদি আশেপাশের কেউ শুনে ফেলে! বেকার অসহায় অনিকের ভার্সিটি লাইফের ক্যাডার প্রেতাত্মা ভর করতো প্রায় প্রতিদিনই। এতে সে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পেত। একদিন মারতে-মারতে রূপার গলা টিপে ধরল। রূপা অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অনিকের দুই পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে-কেঁদে বলল, “অনিক, তুমি এমন করছ কেন? তুমি এমন করছ কেন? তুমি না আমাকে ভালোবাসো? প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও, আমি অনেক ব্যথা পাচ্ছি। প্লিজ অনিক, প্লিজ।” এরপর অনিক অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে-করতে ঘুষি মেরে রূপার নাকফুল ভেঙে ফেলল, জোরে থাপ্পড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল, হাতের কাঁচের চুড়িগুলি ভেঙে রূপার হাত বেয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল। তাতেও ক্ষান্ত হল না অনিক। মদের বোতল থেকে ঢকঢক করে আরও কিছু মদ গিলে রূপার তলপেটে সমানে লাথি মারতে লাগল। যে গর্ভ থেকে সে নিজেও এই পৃথিবীতে এসেছে, সে গর্ভেই লাথি মেরে ওর যত সুখ! এই না হলে ভার্সিটির এক্স-লিডার!

রূপা সেসময় প্রেগন্যান্ট। প্রচণ্ড মার খেয়ে ওর শরীর থেকে অনেক ব্লিডিং হচ্ছিলো। হুঁশ ফিরলে ভয় পেয়ে অনিক ওকে ক্লিনিকে নিয়ে গেল। সারা শরীরে কালচে আর নীলচে দাগে ফর্সা একটা শরীর নিথর শক্তিহীন হয়ে বেডে পড়ে আছে। ডাক্তার জানালেন, গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে সুস্থ করে তুলতে অনেক টাকা লাগবে। এসব দেখেশুনে অনিক পালিয়ে গেল, ক্লিনিকের সাথে আর কোনও যোগাযোগই রাখল না। পরবর্তীতে রূপার এক স্টুডেন্টের মা ওর চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করেন। সুস্থ হয়ে রূপা একটু-একটু করে সে টাকা পুরোটাই শোধ করে দেয়। রূপা এখন একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। ওদের মাঝে ওর হারিয়ে-যাওয়া বাবুটাকে খুঁজে পায়। ৫ বছর হয়ে গেল। একটা মেয়ের একা থাকার জন্য দীর্ঘ সময়। ওরই এক কলিগের সাথে একটা দুই রুমের বাসা ভাড়া করে থাকে। ওর বাবা-মা ওকে অনেক করে বলেছে ঘরে ফিরে যেতে। কী এক অভিমানে সে কিছুতেই রাজি হয়নি। শুধু মাঝেমাঝে ফোনে যোগাযোগ করে, দুই ঈদে বাবা-মা’কে পোশাক কিনে পাঠায়। ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড-হওয়ার অনার্সের সার্টিফিকেটটি রূপা মাঝেমধ্যে খুলে দেখে আর ভাবে, ভালোবাসা সবকিছুকেই কী নিপুণভাবে নষ্ট করে দেয়। শরীর, মন, অর্জন, সম্মান, সময়, অস্তিত্ব, সম্পর্ক, একেবারে সব! সে এখন তার চারপাশের সমাজটাকে থোড়াই কেয়ার করে চলতে শিখে গেছে। ও এখন ভালো আছে শুধুই নিজের জন্য। শুধু নিজের জন্যই বাঁচার ঐশ্বর্যের খোঁজ এখন সে জানে। কষ্টকে কীভাবে করে শক্তিতে রূপান্তরিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়, সে এখন খুব ভালোভাবে জানে। ওর চলার পথে আর কাউকেই দরকার নেই। একটাসময় ছিল যখন ও একা ছিল না, কিন্তু অসহায় ছিল। এখন ও একা, কিন্তু পৃথিবীতে ওর চাইতে শক্তিশালী আর কেউই নেই।

রূপারা ভালো থাকুক। ওদের জন্য আমাদের সকল শুভ কামনা।