লা স্ট্রাডা (১৯৫৪)

ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর দ্য ৪০০ ব্লোস (এই মুভিটা দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই যে এটা পরিচালকের প্রথম কাজ।), ভিত্তোরিও ডি সিকোর বাইসাইকেল থিভস (আমাদের সত্যজিত এই মুভি দেখে ঠিক করেছিলেন, উনিও মুভি বানাবেন।), মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অভ হেভেন, ওয়াল্টার সালেসের দ্য মোটরসাইকেল ডায়রিস, ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক, সত্যাজিত রায়ের অপু ট্রিলজি এইসব ছবির পর আমার ঝুলিতে গতরাতে আরও একটা নিউরিয়ালিস্ট ঘরানার গল্পের ছবি জমল।Why was I born? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই যারা সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয় স্রেফ মৃত্যু এখনও আসেনি বলে, যাদের জন্য জীবনযাপন মানেই মৃত্যুকে কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে চলা, ওরকম ২ জন প্রান্তিকশ্রেণীর নরনারীর প্রেম আখ্যান ‘লা স্ট্রাডা’। জাম্পানো রাস্তায়-রাস্তায় খেলা দেখায়, রাস্তাতেই ঘুরে বেড়ায়; সাথে থাকত রোসা। রোসা মারা গেলে তার ছোট বোন গেলসোমিনাকে মাত্র ১০ হাজার লিরা’র বিনিময়ে গরীব মায়ের কাছ থেকে কিনে নেয় জাম্পানো। জাম্পানো জীবিকার প্রয়োজনে গেলসোমিনাকে সাথে রাখে। লা স্ট্রাডা শব্দের অর্থ হল দ্য রোড বা পথ। গেলসোমিনার মায়াবী মুখ, সাবলীল অভিব্যক্তি, প্রেমময় অভিমান, সরল ভালোবাসা; এই সবকিছুকে ছাপিয়ে এই ছবিতে বড় হয়ে উঠেছে রাস্তার আখ্যান। যে নারী চোখের ইশারায় সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, তার ভালোবাসি, আপাতত ভালোবাসছি না, রেগে আছি, কষ্ট পেয়েছি—এইসব মুখে না বললেও চলে। আমাদের সুচিত্রা সেনের মতই এই ছবির নায়িকা জিউলিয়েতা ম্যাসিনা ছবির চরিত্রের সারল্য, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, অভিমান সবকিছুই চোখ আর মুখের নিপুণ এক্সপ্রেশনে ফুটিয়ে তুলেছেন। মুভি না দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না, কতটা নিখুঁতভাবে উনি কাজটি করেছেন!মেয়েরা যাকে পছন্দ করে, যদি কোনও ভাবে জানতে পারে, সেই ছেলেটা অন্য কোনও মেয়েকে কোনও এক সময়ে পছন্দ করত, কিংবা এখনও করে, তাহলে জিজ্ঞেস করতেই থাকে করতেই থাকে, ওই মেয়েটা এরকম করত কি না, ওরকম করত কি না—যা কিছু সে করে কিংবা করে না কিংবা করতে পারে না; ওই মেয়েটার কথা সে কী ভাবছে—সেই ছেলে ওর কথা আদৌ ভাবুক আর নাই বা ভাবুক, মেয়েটার কী কী ওর চেয়ে সুন্দর কিংবা অসুন্দর; এইরকম আরও অনেক কিছু। এই সব প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটা যতই ‘না’ বলুক, যতই এড়িয়ে যাক, ওতে কোনও কাজই হয় না; বরং এভাবে করে মেয়েটা নিজের অজান্তেই ছেলেটাকে আরও বেশি করে যেন ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয়, এমনকি সে যদি ওর কথা ভুলেও যায়, তবুও! এই ছবিতেও আমরা ফিমেল সাইকোলজির এই খেলাটা দেখি, যখন গেলসোমিনা প্রায়ই জাম্পানোকে জিজ্ঞেস করে, রোসা এটা করত কি না, ওটা বলত কি না, এই কাজটা কীভাবে করত, জাম্পানো রোসার সাথে কী করত, কী করত না, কীভাবে করত—সব কিছুই। মেয়েদের এই কৌতূহলগুলোই যেন মেয়েদের মেয়ে করে রাখে, আর তখন ওদের ভালো না বেসে কিছুতেই পারা যায় না। ভালোবাসায় তো ন্যাগিং থাকবেই, যদিও এই ন্যাগিং ছেলেদের মধ্যে ততটা প্রকট নয়। তবে কি একেবারে সব কিছু দিয়ে নিজের মত করে ভালোবাসার ক্ষেত্রে ছেলেরা পিছিয়ে? এটা কি ঔদাসীন্য? নাকি, নির্লিপ্ততা? নাকি, নিঃস্পৃহতা? নাকি, অশরীরী প্ল্যাটোনিক ভালোবাসার প্রতি সহজাত পুরুষসুলভ অনাগ্রহ? থাক, সে আলোচনা এখানে নয়।এই ছবিতেও আমরা তা-ই দেখি। জাম্পানো আর গেলসোমিনা যে সার্কাসে কাজ করত, সেখানের আরেক কর্মী ইল মাত্তো, যে জাম্পানোকে প্রায়ই কোনও না কোনও ছুতোয় খেপিয়ে দিতো, ওকে একদিন রাগের মাথায় খুন করে রগচটা জাম্পানো। আইরনি হল, যখন জাম্পানোর দুর্ব্যবহার, পরনারীতে আসক্তি, শারীরিক আঘাত, ঔদাসীন্য সহ আরও অনেক ব্যাপারে বিরক্ত-হতাশ হয়ে গেলসোমিনা ঠিক করেছিল, সে জাম্পানোকে ছেড়ে যাবে, তখন এই ইল মাত্তোই গেলসোমিনাকে বলেছিল, পৃথিবীতে কোনোকিছুই কারণ ছাড়া ঘটে না, জাম্পানোর সাথে সে রয়েছে, থাকুক; সে যেন জাম্পানোকে কখনও ছেড়ে না যায়; যদিও সে নিজেই গেলসোমিনাকে ভালোবাসত এবং ভালোবাসার স্যুভেনির হিসেবে সে তার নিজের গলা থেকে চেইন খুলে গেলসোমিনার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। ইল মাত্তোর হেসেখেলে সহজভাবে জীবন কাটানোর ধরন ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটে-চলা মানুষদের পর্যন্ত ভাল লাগবে। লাইফ ইজ বিউটিফুল, বাইসাইকেল থিভস, চিল্ড্রেন অভ হেভেন, অ্যামিলি, ইকিরু এবং এমন আরও কিছু মুভিতেও আফসোস ছাড়া সহজভাবে জীবনকে কাটানোর ব্যাপারগুলো মুগ্ধভাবে খেয়াল করার মত। ওই খেয়ালী খুন গেলসোমিনার মনে তীব্র আঘাত দেয়। সে কিছুতেই এই ব্যাপারটাকে ভুলতে পারছিল না, ফিরেফিরে ইল মাত্তোর কথাই বলছিল নিজের অজান্তেই। জাম্পানো এই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আহত নারীকে রাস্তার পাশে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে যায়। সে আবারও বোহেমিয়ান জীবন কাটাতে থাকে। কয়েক বছর পর এক অপরিচিতাকে সে একটা গান গাইতে শোনে, যেটার সুর সে গেলসোমিনাকে শিখিয়েছিল। সে ওই নারীর সাথে কথা বলে জানতে পারে, সে ফেলে আসার পর কিছুদিনের জন্যে অসহায় গেলসোমিনার ঠিকানা হয়েছিল ওদের বাড়িতে, পরে সে মারা যায়। সে ওই গান শিখেছে গেলসোমিনার কাছ থেকে। এই কথা জাম্পানোর বুকে পুরনো সুর পুরনো স্মৃতি জাগিয়ে দেয় যেন! ওয়ার্ডসওয়ার্থের সলিটারি রিপারের সুরও কি এভাবে করেই কবিকে বিহ্বল করেছিল?গেলসোমিনার সকল আবেগ-অনুভূতি-অভিব্যক্তি-ভাবালুতার প্রতি জাম্পানোর নিঃস্পৃহতা-ঔদাসীন্য-বিরক্তি যে গেলসোমিনাকে একদিন এটা ভাবতে বাধ্য করেছিল যে সে জাম্পানোকে ছেড়ে যাবে, সেই গেলসোমিনাকেই যখন জাম্পানো বাড়ি রেখে আসতে চায়, তত দিনে সে জাম্পানোকে ভালোবেসে ফেলেছে; এতটাই যে, সে ভাবে, যদি সে জাম্পানোকে ছেড়ে যায়, তবে মানুষটা কাকে নিয়ে বাঁচবে? (If I don’t live with you, who will?) নারীর এই চিরন্তন ভালোবাসার কাছে পরাজিত পুরুষের বৈষয়িক বুদ্ধির প্রতি আমাদের প্রচণ্ড ধিক্কার জন্মে যখন দেখি, অভ্যস্ত জীবনকে পেছনে ফেলে রেখে অনভ্যস্ত আপাতমুক্ত জীবনের মোহ জাম্পানোকে কুন্দেরার উপন্যাসের মত ভাবায়, জীবন হয়তো অন্য কোথাও। আমাদের বারবার মনে হতে থাকে, জীবিকার কাছে জীবনের কী নির্মম পরাজয়! মুভির শেষ দৃশ্যে দেখি, নায়ক অ্যান্টনি কুইন জীবনের সকল সুর হারিয়ে মুখ থুবড়ে কাঁদতে থাকে সাগরপাড়ে; সামনে পড়ে থাকে স্বচ্ছল অর্থহীন দুর্ভার একটা জীবন। পরিচালক কি এখানে অতি ক্যারিয়ারিস্ট মনোবৃত্তি মাঝেমাঝে জীবনকে কতটা নিষ্প্রাণ ট্র্যাজিক করে তোলে তার প্রতি কোনও ইঙ্গিত দিয়েছেন?পাদটীকা। সার্বিয়ান ব্যান্ড তাদের দলের নাম ‘লা স্ট্রাডা’ নির্বাচন করেছে এই ছবি থেকেই। বব ডিলান তাঁর বিখ্যাত মিস্টার টাম্বুরিন ম্যান গানটি তৈরি করেছেন এই ছবির প্রভাবেই। এ মুভির অসাধারণ নায়িকা জিউলিয়েতা ম্যাসিনা পরিচালক ফেলিনির স্ত্রী।