লেখক

 
আমি পালকি সমাদ্দার। আমার পরিচয়, আমি লিখি। একটু ভুল হলো, শুধরে দিই। আমি আসলে লিখি না, ভালো লিখি। হ্যাঁ, সবাই তা-ই বলে। আমি নিজে কী বলি? এর জবাবে শুধু এইটুকু বলব, আমি জানি না, আমি কেমন লিখি। তবে যে মুহূর্তে আমি লিখি, সে মুহূর্তে আমার কাছে মনে হয়, ‘আমার চাইতে ভালো এই পৃথিবীতে আর কেউ লিখতে পারে না। যদি এর চাইতে ভালো কিছু লিখতে হয়, সে লেখাটাও আমাকেই লিখতে হবে।’ এমন একটা ভাবনা আমাকে কোনও কিছু লিখতে সাহায্য করে। পরে সে লেখাটাই আমার পাঠকদের কাছে ‘ভালো লেখা’ হয়ে যায়। আমার দুই-একটা অক্ষরও যদি কিছু মানুষকে ভালো রাখে, আমাকে ভালো রাখে, তবে এর চাইতে বড়ো পাওয়া একটা মানুষের জীবনে আর কী আছে? আমি এরকম করেই ভাবি। এই ভাবনাই আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে।


পৃথিবীর সকল সৃষ্টিশীল মানুষকেই লোকে ভুল বোঝে। এটাই হয়ে আসছে। আমার বেলায় কী হয়, বলি। মানুষ আমাকে বোঝে অল্প, আমার সম্পর্কে বলে বেড়ায় কিংবা মন্তব্য করে তার চাইতে অনেক বেশি। এককথায়, মানুষ আমাকে খুব ভুল বোঝে। ওরা আমাকে বোঝে না, এতে আমার কোনও দুঃখ নেই; ভুল বোঝে, দুঃখ এটাই। আমাকে না বুঝেই জাজ করতে থাকে খুব অনায়াসেই, রীতিমতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে! অন্যকে অর্ধেক বুঝে, না বুঝে, অনুমানের ভিত্তিতে জাজ করার ক্ষেত্রে বাঙালিরা অতুলনীয়। বাঙালি জ্ঞানে নয়, অনুমানে বিশ্বাসী।


আমি আমার রান্নাঘরটা ঝকঝকে রাখি, নিজের পোশাকআশাক ধবধবে রাখি, নিজের লেখাকে চকচকে রাখি। সবাইকে বোঝাই, আমি ভালো আছি, সুখে আছি। লেখক হিসেবে এটা আমার অনেক বড়ো একটা পাওয়া। আমাকে কেউ লেখক হবার সার্থকতা জিজ্ঞেস করলে আমি হাসিমুখে বলে দিই, ‘আমি একজন সুখী মানুষ। আমার জীবনে কোনও অপ্রাপ্তি নেই।’ মনে মনে বলি, ‘আমার সম্পর্কে এইটুকুই জেনে রাখো তোমরা। এর চাইতে বেশি জানার অধিকার তোমাদের নেই। থাকেও যদি, তোমাদের অত কিছু জানাবার ইচ্ছে আমার নেই। আমার হাতে সময় খুব কম, আমাকে লিখতে হয়, পুরো ঘর একহাতে সামলাতে হয়।’ লেখকদের সবচাইতে বড়ো দারিদ্র্য হচ্ছে, ওদের হাতে সময় নেই। লেখকরা সময়ের দিক দিয়ে অনেক অনেক দরিদ্র।


যাদের লিখতে হয় না, মানে যাদের মন যাদের লিখতে বাধ্য করে রাখে না, তারা এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারবে না। লেখকদের এমন এমন লোকের তির্যক মন্তব্য হজম করতে হয়, যাদের হয়তো একটা লেখা পড়ে বোঝার ন্যূনতম যোগ্যতাটুকুই নেই। আসলে, লেখকরা হচ্ছে খুবই অসহায় একটা জাতি। ওরা এমন একটা পথে হাঁটে, যে পথে কীভাবে হাঁটতে হয়, তা ওরা নিজেরাই জানে না। শুধু জানে, হাঁটতে হবে। অন্যরা যখন বিশ্রামে, তখনও ওরা হেঁটে যায়। ওদের হাঁটতেই হয়, না হাঁটলে ওরা প্রতিমুহূর্তে একবার করে মরে। লোকে এসব বোঝে না। বোঝার কথাও নয়। ওরা না বুঝেই অনেক কিছু বলে এবং বলতেই থাকে। মানুষ নিজের জুতোর মাপে অন্যের জুতো মাপতে পছন্দ করে। অথচ যার জুতো মাপছে, কখনও দেখা গেল, সেই বেচারার জুতোই নেই।


এবার ব্যক্তিজীবনের আমাকে একটু চেনাই। আমার বর একটি নামকরা পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিতে আছে। ওর নাম অনিরুদ্ধ চৌধুরী। আমি অনি বলে ডাকি। এটা ওর ডাকনাম নয়, এটা আমার দেওয়া নাম। ওর প্রকৃত ডাকনাম বাপ্পা, ওই নামে আমি ওকে কখনওই ডাকি না। আমাদের দুই মেয়ে। খুব সুখের সংসার আমাদের।---আমাদের দেখলে এটাই আপনি ভাববেন। সবাই এটাই ভাবে। আমি কিংবা অনি কাউকেই এই ধারণা থেকে সরিয়ে দিই না। ভাবি, কী দরকার! কে ভাবে কার কথা!


হ্যাঁ, সংসারটা সুখেরই হতো, যদি আমার বর আমাকে একফোঁটাও বিশ্বাস করত কোনও দিন। একদিন অন্তত আমাকে সন্দেহ না করে নিজেকে আর আমাকে শান্তি দিত। অবশ্য, ওর ভাষায়, এটা সন্দেহ নয়, এটা পজেসিভনেস। এসব পজেসিভনেস তখনই ভালো লাগত, যখন ইন্টারে পড়াকালীন ওর সাথে প্রেম করতাম। এমন পজেসিভনেস ছাড়া তো আমি বাঁচতেই পারতাম না তখন। মনে হতো, এর নামই বুঝি ভালোবাসা। এই বয়সে এসে এটা আর ভালো লাগে না। এটাকে একধরনের মানসিক নির্যাতনই মনে হয় এখন। অনি আর একটা কারণে আমার উপর বিরক্ত, তা হলো, আমি কেন আমার নামের পর সমাদ্দার লিখি? চৌধুরীর সাথে বিয়ে হলো, এখনও কেন বিয়ের আগের পদবি রেখে দিলাম?


এসব আমি কাউকেই বলি না, কখনওই না। ব্যক্তিজীবন কেন মানুষের সামনে আসবে, এটাই আমার মাথায় ধরে না। এরপরেও যদি কেউ কোনওভাবে বুঝেই ফেলে যে আমার বর আমাকে সন্দেহ করে, তখনই আমি চটজলদি ভালোবাসার চাদর দিয়ে ওই ব্যক্তিকে ঢেকে ফেলি। এই জাদুর চাদরে কতকিছুই যে ঢাকা পড়ল কত মানুষের! আহারে! এটাই ভালো। লোকে অন্যের ব্যক্তিজীবনের দুঃখ নিয়ে মজা নিতেই বেশি পছন্দ করে। আমি আমার পাঠকদের আমার ঘরের দরজার বাইরে রাখতেই বেশি পছন্দ করি। ওদের জায়গা পালকি সমাদ্দারের লেখা পর্যন্তই, এর বেশি কিছুতেই নয়। যার জায়গা যেখানে!


আমি যখন আমার প্রথমমেয়ের মা হলাম, তখন ভেবেছি, আমার বর এবার নিশ্চয়ই বাবা হবার পর পালটে যাবে। বুঝতে পারবে মেয়েদের জীবন সম্পর্কে, একটু হলেও। অনির কোনও বোন নেই, ওরা চার ভাই। আর ও পড়াশোনাও করেছে ক্যাডেট কলেজে, এর আগে বয়েজ স্কুলে। যেহেতু ও সব সময়ই মেয়েদের কাছ থেকে দূরে দূরে থেকে বড়ো হয়েছে, সেহেতু ও মেয়েদের বোঝে না, এটাই আমার নিজেকে দেখানো অজুহাতটা ছিল। অবশ্য, অজুহাত না বলে এটাকে আপনি সান্ত্বনাও বলতে পারেন।


মেয়ের বাবা হিসেবে অনি সত্যিই অসাধারণ, অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তবে আমার জন্য সে থেকে গেল একদম আগেরই মতো, বরং কড়াকড়ি আরও একটু বেড়ে গেল, কেননা আমি এখন মেয়ের মা। আমার বেলাতেই অনি সব নিয়মকানুনের ফর্দ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। এরপর দ্বিতীয় মেয়ের বাবা হবার পর বাবা হিসেবে অসাধারণত্বের সকল সীমানাই অনি অতিক্রম করে ফেলল। অনির চাইতে দারুণ বাবা আর হয় না। নিজের সন্তানের প্রতি দায়িত্বপালনে একটুও গাফিলতি করতে অনিকে আমি কখনওই দেখিনি।


আমাদের বয়স বাড়ল, মেয়েরাও দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে যাচ্ছিল। অনি মেয়েদের ভালো বন্ধু হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে লাগল, শুধু আমার বেলায় অনি দিনদিন আরও কঠোর হতে আরম্ভ করল। তার কথা, মেয়ের মাকে হতে হবে, ঈগলের মতোই সতর্ক ও নির্ভুল। আমি বুঝি না, মেয়ের মাকে ঈগল হতে গেলে কি নিজের স্বকীয়তা একেবারেই ছেড়ে দিতে হবে? এটাই ঈগল হওয়ার নিয়ম? আর ঈগল তো সারাজীবন ঠুকরে ঠুকরেই কাটিয়ে দেয়, ওকে ভালো কিছু করতে কে কবে দেখেছে?


লেখক হিসেবে যে ভালোবাসাটা আমি পাই, সেটাকে অনি ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু ভালো চোখে দেখে না। সে নিজেও চায়, আমি সম্মাননা পাই; কিন্তু সেই সম্মাননাকে অনি ঠিক সম্মান করতে পারে বা সহজভাবে নিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। এদিকে ঘরের সব কাজ সামলানোর পাশাপাশি আমাকে লেখালেখিতেও ব্যস্ত থাকতে হওয়ার কারণে আমার আর অনির বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয়স্বজনকে যে আমি সময়ই দিতে পারি না, এই ব্যাপারটা অনির সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। সে ভাবে, আমি কেন এমন অসামাজিক ধরনের? আমি কোন উদ্দেশ্যে খাতা-কলম নিয়ে ওরকম রাত জেগে বসে থাকি? আমি কেন সারাদিনই ঘরে থাকি? (আমি ঘরের বাইরে থাকলেও সে একই সন্দেহ করত---আমি কেন ঘরের বাইরে যাই? কার সাথে কী করি? ইত্যাদি ইত্যাদি...আমি জানি।) সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের সন্দেহ করতে তেমন কোনও কারণ লাগে না। অনির চোখের দিকে তাকালেই কোনও কারণ ছাড়াই আমার নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হতো। কথা বলতে গেলেই আতঙ্কে থাকতাম, এই বুঝি জেরা শুরু হবে! ওর প্রতি আমার ভালোবাসার বদলে তীব্র ভয়ই বেশি কাজ করত।


কোনও পত্রিকার সম্পাদক, বইয়ের প্রকাশক কিংবা আমার কোনও পাঠকের সাথে ফোনে কিংবা সাক্ষাতে কথা বলছি জানলে অনির চেহারা ভয়ংকর হয়ে উঠত। সে কী ক্রোধ, সে কী বিতৃষ্ণা! ওর চেহারার দিকে আমি ভয়েই তাকাতে পারতাম না। মনে হতো, এখুনিই বুঝি সে আমাকে খুন করে ফেলবে! সে বলত, ‘আমি কোনও পুরুষকে তোমার আশেপাশে মেনে নিতে পারি না। তবে তুমি লেখক, এটা ভেবে স্বামী হিসেবে আমার অনেক গর্ব হয়। আমি তোমার কাজ ভালোবাসি, কিন্তু মানতে পারি না।’ আমি খুব ভালো করেই জানি, অনির এই বক্তব্যের একাধিক অংশ অসত্য; কোন কোন অংশ, সে বিষয়ে অবশ্য আমি নিশ্চিত নই।


যা-ই হোক, এরপরেও আমি নানান ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও লিখে গেছি। আমার লেখা নয়টা বই বেরিয়েছিল, আর চারটার কাজ ছিল মাঝামাঝি পর্যায়ে। অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ঘর ভরে গিয়েছিল আমার, সেগুলিকে আমার কাছে নিজের পরিবারের সদস্যদের মতোই মনে হতো। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু সংসারের অশান্তির সাথে পাল্লা দিয়ে আমি আর পেরে উঠছিলাম না কিছুতেই। সারাক্ষণই অনির সাথে অশান্তি লেগেই থাকত। আমাদের সম্পর্কটা টিকে ছিল কোনওমতে জোড়াতালি দিয়ে দিয়ে। একদিন অনি আমাকে সরাসরি বলে দিল, পালকি, হয় লেখালেখি, নয় সংসার। এই দুইয়ের মধ্যে যে-কোনও একটা বেছে নাও। এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।


ততদিনে আমাদের তৃতীয় সন্তান, মানে আমাদের ছেলের জন্ম হয়েছে। আমি তখন তিন সন্তানের মা। আমি কি সংসার ছাড়তে পারি? একজন মা কি চাইলেই সব করতে পারে? এদিকে লেখালেখিও যে আমার সন্তানেরই মতো, সেটা আর অনিকে বোঝাতে পারিনি। অনি বুঝবেই-বা কী করে! লেখার জন্ম দিতে তো আর তাকে লাগে না! সে তো আর আমার লেখাগুলির বাবা না। ওদের বাবা, মা…দুইই তো আমি। আমার তিন ছেলে-মেয়ের দেখাশোনার কোনও ব্যাঘাত না ঘটিয়েই আমি লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, যা আমি অনিকে অনেক চেষ্টা করেও বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। যাক, আমি আমাদের সন্তানদের জন্য আমার সন্তানকে পুরোপুরিই পরিত্যাগ করলাম।


আমার এই ত্যাগে অনি মহাখুশি! আমি বুঝলাম, আমার সৃষ্টির প্রতি আমার জীবনসঙ্গীরও কোনও মমতা নেই! বলে রাখি, অনি কিন্তু ভালোই একজন বইপড়ুয়া মানুষ। আমাদের বাসায় পারিবারিক লাইব্রেরিও আছে, যা অনির উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে। তবুও সে কেন আমাকে লিখতে দেয়নি, তা আজও আমি স্পষ্ট করে বুঝতে পারি না। সে কি নিজের স্ত্রীকে লেখক হিসেবে মানতে পারেনি? না কি আমার লেখকখ্যাতিকে সে সহ্য করতে পারত না? না কি যেহেতু সে চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারত না, সেহেতু সে আমাকে আসলে ঈর্ষা করত? না কি সে চেয়েছে আমি একজন গৃহিণী ও মা হয়েই বাকি জীবনটা কাটাই? না কি সে ভেবেছে আমি লেখালেখি চালিয়ে গেলে সন্তানদের দিকে আমি খেয়াল রাখতে পারব না? না কি অন্য কোনও কারণ, যা আমার মাথায় আসছে না?


অনেক দিন কেটে গেল। আমি ভালো আছি। আমাদের সুখের ঘর। আমি একজন ভালো মা, ভালো স্ত্রী, ভালো গৃহিণী। অনি একজন ভালো বাবা, ভালো স্বামী, ভালো গৃহকর্তা। বাচ্চারা আজ বড়ো হয়ে গেছে অনেক। আমার বড়ো মেয়েও লেখক হয়েছে। অনেক নামি একজন লেখক। জয়ন্তিকা চৌধুরী নামে লেখে, চিনেছেন নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, আমি আপনাদের জয়ন্তিকা চৌধুরীর মা। বাসায় আমরা ওকে বেলা নামে ডাকি।


বেলা যখন অনেক ছোট, তখন থেকেই এই লেখালেখির প্রতি ওর অনেক ঝোঁক। সব সময়ই কিছু না কিছু গল্প ওর মাথায় থাকতই। দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। ওর বাবা বলত, পালকি, দ্যাখো দ্যাখো, মেয়ের লেখা ছাপা হয়েছে পেপারে। বেলা তখন মাত্র ক্লাস ফাইভে। মেয়ের লেখা পেপারে দেখে বাবার সে কী খুশি! অনি বলত, ‘দরকার হলে আমার মেয়েকে কখনও বিয়েই দেবো না। যদি সংসার করতে গিয়ে ওর লেখালেখিতে কোনও বাধা আসে!’ আমি শুনতাম, বলতাম না কিছুই। কী দরকার কিছু বলার! আজ সময়ই তো সব বলিয়ে নিচ্ছে! সামনে আরও নেবে…


এভাবে লিখতে লিখতে মেয়েটা সত্যি সত্যিই একদিন এত বড়ো লেখক হবে, ভাবিনি। আমার অবাক হবার পালা মাত্র শুরু হয়েছিল আসলে। আমার ছোট মেয়েটাও টুকটাক লেখালেখি করত, এইটুকু আগেই জানতাম। তবে ও খুব বেশি চুপচাপ স্বভাবের বলে ওর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি অনেক পরে। ওকে আমরা অরু নামে ডাকি। অরু যদিও দিদির মতো অত ভালো লেখক হয়নি, তা-ও সে বেশ ভালোই লিখে। অরু মূলত কবি। বিনোদিনী সমাদ্দার ছদ্মনামে তার লেখা অনেক লিটলম্যাগে ছাপা হয়, আমরা তার কিছুই জানতাম না। বিনোদিনী সমাদ্দারের ঝুলিতেও এটা সেটা নানান পুরস্কার আছে, জানলাম। ওকে জিজ্ঞেস করার পর ও লজ্জা পেয়ে তেমন কিছুই দেখি বলে না। আমি ওকে আর ঘাঁটাইনি। মেয়েদের কথা ভেবে অনির মুখটা চোখের সামনে ভেসে এল। কেন, জানি না।


দুই বোন লেখালেখির ব্যাপারে কোথাও আটকে গেলে কিংবা কোনও লেখা কোথাও ছাপানোর আগে ঠিক আছে কি না দেখাতে প্রথমেই বাবার কাছে ছুটে যেত। ওরা ভাবত, বাবা দেশের সব নামকরা সব প্রতিষ্ঠানে পড়েছে, এসব হয়ত বাবাই জানবে। আসলে ওদের বাবা জানত না। অনির ওসব নিয়ে আগ্রহ থাকলেও লেখালেখির কলকবজা সম্পর্কে ধারণা তো আর তার ছিল না। অগত্যা সে মেয়েদের পাঠিয়ে দিত আমার কাছে। মেয়েদের লেখালেখি নিয়ে অনির উৎসাহ ছিল অনেক বেশি।


আমি আবার লেখায় কোনও ধরনের ভুল সহ্য করতে পারতাম না, মানে যতটুকু আমার জানার ও সাধ্যের মধ্যে ছিল আরকি। আমার কাছে যা ঠিক মনে হতো, ওদের বলে দিতাম। মেয়েরা অবাক হতো। ওরা ভাবতেই পারত না বোধহয় যে কোনওমতে ডিগ্রি পাস-করা তাদের মা লেখা বোঝেটা কী করে? বাবা কেন এসব বোঝে না? ওরা তো ছোট, তাই ওদের মাথায় আসত না, লেখক হতে হলে খুব ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা লাগে না। ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছু ব্যাপার থাকতে হয়। সাথে লাগে লেখার প্রতি নিবিড় আন্তরিকতা, অসীম ধৈর্য। নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ, একাগ্রতা ও অধ্যবসায়। থাকতে হয় নতুন কিছু সৃষ্টি করার দুর্নিবার ক্ষুধা। আর নিজেকে শুদ্ধ ও জাতলেখক হিসেবে তৈরি করার জন্য ঐকান্তিক সাধনা।


আমার দুই মেয়েই ডাক্তার। ও আচ্ছা, ছেলের কথা তো বলছি না। আমাদের ছেলেটা সাংবাদিক। সে-ও বেশ ভালোই নামডাক করে ফেলেছে এর মধ্যে। ডেইলি স্টার পত্রিকার ডাকসাইটে ক্রাইম রিপোর্টার অনিকেত চৌধুরীকে চেনেন তো, না? হ্যাঁ, সে আমার ছেলে। বাসায় ওর নাম বাবু।


সেদিন শুনলাম, আমার সন্তানরা নাকী রত্নগর্ভা নারীদের নিবন্ধনতালিকায় আমার নামটা সাবমিট করেছে। শুনে আমি খুবই বিব্রত! অরু আমাকে বলল, ‘মা, তুমি আমাদের পাশে না থাকলে আমরা কখনওই আমরা হতে পারতাম না। আর যা-ই হোক, তোমার মেয়ে না হলে আমি আর দিদি লেখক অন্তত হতাম না।’ চশমার ফাঁক দিয়ে আমি অনির দিকে তাকালাম। অনি যেন কিছুই শুনতে পায়নি। সে পেপার-পড়ায় মগ্ন। অরু তখন বাবুকে বলল, ‘বাবু, তুই মাঝেমধ্যে তোর রিপোর্টগুলি মাকে দেখিয়ে নিস। মা ঠিক করে দেবে।’ বাবু উত্তর দিল, ‘দেখাই তো, দিদি।’ অনি তখনও পেপারে মুখ গুঁজে আছে। আজকের পেপারটাতে অনেক জরুরি কিছু লেখা আছে। সেসব খবর অনিকে মন দিয়ে গিলতে হচ্ছে।


তিন ভাই-বোন মিলে ক্যারম খেলার সময় বলছিল এসব। আমি কিছুই বলিনি। শুধু হ্যাঁ, হুঁ, হুম, আচ্ছা করে গেছি। আমি লিখতে ভালোবাসি, বলতে আমার ভালো লাগে না। জীবন তো কাটিয়েই দিলাম চুপ থেকে থেকে। যারা বলার, ওরা বলুক। ওরা বলে মুখে, আমি বলি কলমে…মানে, বলতাম আরকি। হঠাৎ অনি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই তো! পালকিই তো এবারের পুরস্কারের যোগ্য দাবীদার। অনির এই কথাটাও আমি শুনলাম শুধু। কিছুই বলিনি।


অবশেষে, রত্নগর্ভা মা হিসেবে আমি সত্যিই পুরস্কার পেলাম। স্টেজে আমার নাম ধরে ডাকা হলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে স্টেজের দিকে যাওয়ার সময় আমার নিজের লেখকজীবনের কথা এক এক করে মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল আমার মায়ের কথা। আমিই ছিলাম আমার বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এই পুরস্কারটা আমার জন্য আমার মা পেলেও পেতে পারত। কেমন লাগত তখন আমার? এই মুহূর্তে আমার তিন সন্তানের যেমন লাগছে তাদের মাকে দেখে, আমারও নিশ্চয় তেমনই লাগত। এইসব ভাবতে ভাবতে স্টেজে পৌঁছলাম পুরস্কার নিতে। ওরা আমাকে পুরস্কারটি হাতে রেখে কিছু বলতে বলল। বুঝতে পারছিলাম না, কী বলব। আমি তো বলতে অভ্যস্ত নই।


মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘আজ আমাকে এখানে ডাকার জন্য আপনাদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার ছেলেমেয়েরা যা-কিছুই করতে পেরেছে, সব কিছুরই কৃতিত্ব ওদের বাবার একার। ওদের বাবাই সব সময় ওদের উৎসাহ দিয়েছে, পাশে থেকেছে। এই পুরস্কারটা আসলে ওদের বাবারই প্রাপ্য। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ বাবা আমার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার অনিরুদ্ধ চৌধুরী। আমি আপনাদের কাছে ওর জন্য, আমার সন্তানদের জন্য আশীর্বাদ চাইছি।’ আমি যখন এই কথাগুলি বলছিলাম, অনি তখন কেমন বোকা বোকা চোখে আমার দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিল। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে করে চোখ মুছছিল, আমি দেখেছি।


পুরস্কার নিয়ে স্টেজ থেকে নামছিলাম যখন, তখন কেউ কেউ আমার সাথে ছবি তোলার জন্য এগিয়ে আসছিল। ওদের মধ্য থেকে কেউ একজন হঠাৎ একটু চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আপনি সেই পালকি সমাদ্দার না?…‘সমর্পণ’ উপন্যাসের রাইটার!’ আমার সেই পাঠকের কথা শুনে আমার চারিদিকে লোকজনের একটা ছোটোখাটো জটলা বেধে গেল। আমি লেখালেখি ছেড়েছি প্রায় পঁচিশ বছর আগে। এখনও মানুষ আমাকে মনে রেখেছে! এটা কীভাবে সম্ভব! আমাকে অনেক অটোগ্রাফ দিতে হলো, ছবি তুলতে হলো---শুধু একজন রত্নগর্ভা মা হিসেবে নয়, একসময়ের লেখক পালকি সমাদ্দার হিসেবেও।


সেদিন অনি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। চুপচাপ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমি অনির দিকে একটা মৃদুহাসি ছুড়ে দিলাম। সে হাসিতে অব্যক্ত কিছু কথা ছিল---একজন লেখক হওয়া যতটা কঠিন, একজন লেখককে মুছেফেলা তার চাইতেও কঠিন। বোঝাতে পেরেছি তো, অনি?