শর্তহীন দুঃখ

 
এই জীবনে তুমি আসার আগে ভাবতাম,
অন্য আট-দশটা মানুষের মতো অনেকগুলো বছর বেঁচে থাকার
সঠিক একটাও কারণ আমার নেই।
ভাবতাম, যদি কখনও তেমন কোনও কারণ খুঁজে না পাই,
তবে নির্দ্বিধায় মরে যাব।


সেসময় আমার মনে হতো, বেঁচে থাকার গ্রহণযোগ্য কারণটা
আমি বোধ হয় কখনও খুঁজে পাব না।
শুনলে হয়তো অবাক হবে, এই কারণেই আমি বিয়ে করিনি।
ভালো ভালো প্রস্তাব বলতে সবাই যা বোঝে,
ওরকম অনেক প্রস্তাবই বাড়িতে আসত।
আমি বরাবরই ‘না’ করে দিয়েছি।


এভাবেই জীবন থেকে পালিয়ে বেরিয়েছি একসময়।
ভাবতাম, বিয়ে করলে যদি আমার একটা সন্তান হয়,
তখন ওর জন্যে হলেও তো আমাকে বেঁচে থাকতে হবে!
আমি কখনও বাধ্য হয়ে বাঁচতে চাইনি,
আমি সব সময়ই চেয়েছি ভালোবাসায় বাঁচতে।


আবার এ-ও ভাবতাম,
যদি সত্যি কখনও একটা কারণ পেয়ে যাই বেঁচেথাকার,
তবে বাড়তি আরও দু-চার বছর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখব।
...তা-ও একসময় ঠিকই মুক্তি নেব।


যদি এমন একটা মানুষ পাই,
যার হাত ধরে দ্বিতীয়বার না ভেবেই বৃদ্ধ হওয়া যায়,
তবে নিজেকে একটা সুযোগ দিয়েই দেবো...বুড়ো হবার!
আমার ভেতরের মানুষটাকে
আরও কয়েক দশক নতুন মানুষের সাথে হাসিমুখে থাকতে দেবো।


একদিন। হঠাৎ তোমার সাথে দেখা!
মনে হলো, পৃথিবীতে আরও কয়েকটা বছর দিব্যি বেঁচে থাকা যায়।
ধীরে ধীরে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম, অনুভব করলাম,
এই পৃথিবীতে আরও দুই-চার বছর বেঁচে থাকবার একটা কারণ আমারও আছে।


তখন। দিন যাচ্ছে। ভালোই আছি। ভালো থাকার সময়েই একদিন আবিষ্কার করলাম,
আমি কয়েকটা বছর বেঁচেথাকার কারণ পেলেও,
একদিন না একদিন তো মরে যেতেই হবে!
আমি খুব সম্ভবত একটা ছায়াকে গোটাজীবন ভেবে বসে আছি,
যে ছায়াটি সূর্য ডুবে গেলে হারিয়ে যাবে একপলকেই!


আমার নিঃসঙ্গ লাগছে।
রাতের আকাশে জ্বলতে-থাকা চাঁদটির মতো আমিও নিঃসঙ্গ।
দূর থেকে দেখলে মনে হয়, আমি আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছি,
কিন্তু আমি জানি, সত্যিই আমার আশেপাশে কেউ নেই।


আমার জানালা থেকে যে চাঁদটা দেখা যায়, সে চাঁদটা আসলে…
সকাল হলেই অন্য কোনও প্রান্তের জোছনা,
পূর্ণিমায় ফুরোলেই তার শরীরটা নিকষকালো।
আমি আসলে সারাটাজীবনই মরীচিকার পেছনে ছুটে মরেছি!
আমার নিজের বলতে কখনওই কিছু ছিল না, নেই, আর হবেও না।


আমি ভাবলাম, আমি কি তবে তোমার সাথে জোর করে আছি?
মন ধমক দিয়ে বলল, জোর করে আছিস, সে আবার কী রে?
জোর করে মানুষ বিয়েতে থাকে, প্রেমে নয়!


আসলে কী হয়, আমি কখনও কারও কাছে
নিজেকে প্রমাণ কিংবা প্রকাশ, কোনওটাই করি না।
এ কারণেই আমাকে ঠিক বুঝে বা চিনে উঠতে কেউই পারে না! একটুও পারে না!


সত্যি বলছি, আমার কখনও কখনও নিজেকে ভয়ংকর রকমের নিঃসঙ্গ মনে হয়।
মনে হয়, আমার পায়ের তলায় মাটি নেই, মাথার উপর ছাদটিও নেই।
আমি কোনও অথই সমুদ্রের জলে ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছি,
যে-কোনও সময়ই টুপ্‌ করে জলফুঁড়ে তলিয়ে যাব অনেক অতলে…


আমার আসলেই অনেক কিছু নেই।
অনেক অনেক কিছু! অন্য কিছুর কথা বাদ দিই…
একটা বিছানা পর্যন্ত নেই, যে বিছানায় রাতবিরাতেও শুয়ে পড়া যায়।


আমার জীবনে কোনও শর্তও নেই।
শর্ত দিয়ে আমার জীবনের এক লাইনও চলেনি কখনও!
তাই আমার কেবলই দুঃখ আছে। সে দুঃখ শর্তহীন দুঃখ।