শাসন-দূষণ

সেদিন এক কলিগের বাসায় গিয়ে এটাসেটা নিয়ে গল্প করছি। আপুর একটা কিউট বাবু আছে; বয়স ৫-৬ হবে, ক্লাস ওয়ানে পড়ে। খুব আদুরে দেখতে; চোখদুটো ভাসাভাসা, ওর হাতদুটোকে ঠোঁটেমুখে ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে আদর করতে কী যে ভীষণ ভাল লাগে! কোলে নিয়ে বসে থাকলে শুধু দুনিয়ার গল্পো বলতে থাকে। অমুক টিচার কী করেছে, ওর ফ্রেন্ডরা কে কী বলে, ওর খেলনা কয়টা, কে কোনটা কিনে দিয়েছে, কে কে যেন কোনটা-কোনটা ভেঙে ফেলেছে ….. আরও কত কী! নরোম-নরোম গালদুটো টেনে-টেনে শুধু চুমু খেতে ইচ্ছে করে। লম্বা-লম্বা চুলগুলো রেশমি সুতোর মতন কোমল। ছড়িয়ে-ছড়িয়ে হাতের আঙুলে নিয়ে খেলতে খুউব আরাম লাগে। আমি বরাবরই খুব সহজে বাচ্চাদের খুব কাছে চলে যেতে পারি।

“যাও এখান থেকে! আঙ্কেলকে ডিস্টার্ব করবে না!”

“থাক না আপু! ও তো বিরক্ত করছে না।”

“আরে না, আপনি জানেন না, খুব দুষ্টু। পড়াশোনা নাই, সারাদিন শুধু দুষ্টুমি।”

“পড়বে, পড়বে। ছোটো তো এখনও।”

“হুঁ, আমি তো ছোটো!” (পিচ্চিটা আমার কোলে আরও গুটিসুটি মেরে বসে বলল।)

“চুপ! পড়াশোনা নাই, খালি বাঁদরামি, তুমি ছোটো, না?”

“আম্মু, আঙ্কেলকে চকলেট দিই? চকলেটগুলা কই?”

“চকলেট খাওয়ার বুদ্ধি, না? কিচ্ছু দিতে হবে না। যাও এখান থেকে!”

ও আমার কোল থেকে নেমে ওর আম্মুর হাত ধরে টানতে-টানতে বায়না শুরু করলো, “আম্মু দাও না, আম্মু দাও না। আঙ্কেল চকলেট খাবে তো!”

“যাও এখান থেকে! হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল।”

“না, আমি যাব না। চকলেট দাও, আমি সত্যি-সত্যি খাব না, শুধু আঙ্কেলকে দিব।”

“মাইর খাবা, যাও!”

“না, আমাকে চকলেট দাও, দিতে হবে!” বলে আবারও ওর আম্মুর কামিজের কোণা ধরে টানতে লাগল।

আমার কলিগ হঠাৎ রেগে উঠে খুব জোরে উনার ওইটুকুন ছেলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। “যাও এখান থেকে!!!”

ওর ছোট্ট ফর্সা নাদুসনুদুস গালে আক্ষরিকভাবেই পাঁচ আঙুলের লাল দাগ বসে গেল। গোলগাল হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে-মুছতে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমি কোলে নিতে চাইলে আপু বাধা দিয়ে বললেন, “প্লিজ, আস্কারা দেবেন না ভাইয়া, ছোটবেলা থেকে শাসন না করলে একেবারে মাথায় উঠবে।”

“কী বলেন আপু! ও কী বোঝে? এখনও ছোট তো!”

“আরে ভাই, বিয়ে তো করেন নাই এখনও, আপনি বুঝবেন না। এরা সব বোঝে।”

“আপু, প্লিজ এভাবে করে মারবেন না। আমার বলা ঠিক কিনা জানি না, তবুও বলছি। কিছু মনে করবেন না।”

“না ভাই, শাসন করা দরকার। পড়াশোনা কিচ্ছু করে না। গত টার্মে ১০-এর বাইরে চলে গেছে।”

“আস্তে-আস্তে হবে আপু। ছোটো তো এখনও।”

“হাহাহা……..ভাল, ভাল। আচ্ছা চলেন, বের হই। জাহিদ ভাইয়ের বাসা কাছেই, হেঁটে যেতে ৫ মিনিট লাগে।”

আমরা বের হবো-হবো করছি, ঠিক ওইসময়ে আপুর বাবুটাকে দেখলাম, কোত্থেকে জানি দৌড়ে এসে ওর আম্মুর স্যান্ডেলজোড়া মুছে এনে ওর আম্মুর পায়ের সামনে রেখে মাথা নিচু করে একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

ওরকম ঘটনার পর এমন একটা দৃশ্য সহ্য করাও কঠিন। চোখের পানি আড়াল করে কলিগকে বললাম, “আপু, ওকে নেবেন না?”

“আরে নাহ! ও হাউসমেইডের সাথে থাকবে। …………. এই পারুল! ওকে নিয়ে যা! তোর ভাইয়া আসলে নাস্তা বানিয়ে দিস।”

এবার আর অবাধ্য না হয়ে থাকতে পারলাম না। ওকে টেনে কোলে নিয়ে বললাম, “আপু, চলেন যাই।”

নিচে গিয়ে দোকান থেকে ওর মায়ের রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওকে দুটো ক্যাডবেরি কিনে দিলাম। প্রচণ্ড ভয়ে-ভয়ে চকলেটদুটো ওর হাফপ্যান্টের পকেটে রেখে দিতে-দিতে ওর আম্মুর দিকে ফ্যাকাসেমুখে তাকিয়ে রইলো। “আম্মু কিচ্ছু বলবে না সোনা। তুমি বাসায় গিয়ে আম্মুসহ এগুলো খেয়ো।” এরপর থেকে শুরু করে আমরা দাওয়াত শেষ করে ওকে ওর আম্মুর কোলে ফিরিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ দেখেছি। হয়তোবা বাসায় ওর জন্য খুব ভয়ের কিছু অপেক্ষা করছে।

খুব কড়া মায়েদের কিছু প্রশ্ন করছি:

আপনি ছোটবেলায় বায়না ধরতেন না?

কখনও-কখনও দুএকবার আবদার রাখলে আপনার বাবুটা বখে যাবে?

ছোটবেলায় কারওর সামনে বকা দিলে কিংবা চড়থাপ্পড় দিলে আপনার কেমন লাগতো? ছোটদের আত্মসম্মানবোধ কিন্তু খুব প্রখর হয়।

ছোটবেলায় আপনি কি স্কুলে সবসময়ই ফার্স্টসেকেন্ড হতেন? শিওর?? পৃথিবীর সেরা মানুষগুলো কেউই কিন্তু স্কুলে ফার্স্টসেকেন্ড হতেন না। ওদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করে দেখুন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওদের শেখার জগতটা ছিল অন্যকোথাও।

পিটিয়ে-পিটিয়ে ছেলে মানুষ করার বুদ্ধি আপনাকে কে দিয়েছে? ছোট্ট-ছোট্ট আবদার রাখার সময়ে তো কিছু কন্ডিশন জুড়ে দিতে পারেন। এই যেমন, তোমাকে সব হোমওয়ার্ক করে ফেলতে হবে, নিজের ব্যাগটা কালকের মতো গুছিয়ে ফেলতে হবে, দুধ পুরোটা খেয়ে ফেলতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

ও যখন ভালোবাসা দেখায়, তখনও ওর প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে থাকতে হবে?

কী ছেলে কী বুড়ো, আদর পেতে চায় না কে? সবাই তো একটু আদরের জন্যই বাঁচে। আপনার ছোট্ট বাবুটা আদর না পেলে বড় হবে কী করে?

ছেলে মানুষ করার কিছু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী বই পাওয়া যায়, নেটেও অনেককিছু পাবেন। একটু দেখুন না পড়ে! শুধু বেতে হয়তো ও বেড়ে উঠবে ঠিকই, কিন্তু বড় হবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।

অনেক মাসীর দরদ দেখিয়ে ফেললাম। সরি, ক্ষমা করবেন। এবেলা মায়েদের জন্য একটা ভাল বইয়ের নাম বলে যাই। বাচ্চারা রাজ্যের হাজারো প্রশ্ন করে না? অনেকের সাথে কথা বলে বলে এমন অদ্ভুতসব প্রশ্ন জড়ো করে সেসবের উত্তর খুঁজেছেন সাংবাদিক-লেখক অদ্রীশ বর্ধন উনার ৩ খণ্ডের বই ‘আমার মা সব জানে’তে। এই অসাধারণ কাজটার জন্য উনাকে স্যালুট করি। অনেক কষ্ট করেছেন এই দারুণ বইটা লিখতে। কলকাতার আনন্দ-এর বই, খুব চমৎকার ঝকঝকে ছাপা, পেইজ ভাল, বাঁধাইও বেশ ভাল। আমি এই বইটা বাচ্চাদের জন্মদিনে উপহার দিতে পছন্দ করি। সন্তানের জন্মদিনের উপহার মাদেরকেও দেয়া যাবে না কেন? মায়ের জন্মই তো যেদিন তাঁর সন্তান হল, সেদিন।