শাস্তির আবাদ

 এক।
ষোড়শী, শোনো, ছুঁয়ো না আমায়,
ঝরো জোছনায় উঠোনে আমার,
ওড়ো দিগন্তে, মেঘের মুলুকে দারুণ ছোটো--ক্ষতি নেই,
তবু ছুঁয়ো না আমায়।
দাবানল বুঝি ঢের ভাল গো--
তোমায় ছুঁয়ে মরার চেয়ে!
তাই ষোড়শী, করছি মিনতি, ছুঁয়ো না আমায়।
 
দুই।
গোলাপি আস্তিনে তোমার
ফিকে হয়ে এলে আতরের ঘ্রাণ
ছুঁড়ে ফেল সুবাস-স্মৃতি--পরিত্যক্ত প্রেয়সীকে যেমনি করে
বাসনার শেষ অক্ষরটিও ছোঁয়া হয়ে গেলে শেষবারের মত,
তৃপ্ত পঙক্তি বাগিয়ে সবকিছু ভুলেচুকিয়ে চলে যাও দূরে।
অভিশপ্ত মনে হয় নিজেরই বুকের জমিন!
হে যুবক! প্রথম যৌবনে চেয়েছিলে যারে
স্ফীত যৌবনে ভেসে যায় সে মুখ,
কত জোড়া চোখ আর হাজারো মুখের ভিড়ে
তোমার স্ফূর্তি রুধিরের জ্বালা মুছে দেয় যেন!
ক্রমেই তুমি অচেনা হয়ে ওঠো কীসের মোহে!
একান্ত প্রেমিক থেকে উটকো অন্য কেউ--
সে যাত্রায় হাঁটতে বাধে না তোমার একটুখানিও!
কী সহজেই যায় ভোলা! ভুলে যাওয়া সহজ বলে ভুলে যেতেই হবে কেন?
 
তিন।
দেখো তো বন্ধু, চেনা যায় কি না আর?
আমি...আমি অতি নগণ্য প্রেয়সী সেই--
শত সহস্র বর্ষ ধরি প্রমত্তা পদ্মার মত উথলে মরি,
তুমি আসবে বলে থাকি জেগে--ঘুম আসে না।
তুমি ফিরবে বলেই ঘুমাইনি আমি কয়েক জন্ম ধরে।
তবু কেন ফিরলে না, ওগো?
কেন ফিরিয়ে দিলে সেই দুটি চোখ?
একটিবারের মত, দেখো ফিরে সুদূর অতীতে
প্রথম চুম্বনে মিশে ছিল যে তৃষা
প্রথম দীর্ঘশ্বাস কাঁদাল যেমনি করে
প্রথম স্পর্শ যতো সুখ দিল আচমকাতেই--
হয়তো সে ক্রন্দন
সে তৃষা, সে হাসি, সে খুশি
এনেছে বয়ে অচিন মানুষ--
সে মানুষেই সঁপেছি আমি দুর্লভ হৃদয় প্রথম প্রেমেই।
 
চার।
বুকের এই বাম দিকটায় হাড় থাকে না,
কী থাকে তবে, জানো?
মন থাকে গো, সাথে যন্ত্রণা!
ঈশ্বরের পুত্রের মত
জানি, ও ফিরবেই!
একদিন ফিরে আসবেই--
আমার অশ্রুতে, নিঃশ্বাসে, প্রতি বিশ্বাসে
যেমনি করে ফিরেফিরে আসে
কষ্টক্ষণের দল--কী নির্ভুল আর নিশ্চিত!
যেদিন আমি মুক্ত হবো, সেদিন আমায় জানাবে অভ্যর্থনা
স্বর্গদ্বারে ওই।
আনত হবো অনাগ্রহে অনিচ্ছাতে--অবাধ্য কৃতজ্ঞতায়!
তবু...তবু এ জীবনে পাবো না তারে,
তাই শুধু ক্ষমাটুকু যাচি--
ও আমায় একবার ক্ষমা করেনি বলেই
সারাটি জীবন ধরে করেছি রক্তে শাস্তির আবাদ!
 
পাঁচ।
বারেবারে অগ্রাহ্য করে যাই, তবু কেন ডাকে?
খুব ডাকে, শুধু ডেকে যায়--কেন ডাকে এমন করে?
কতদিন হল, আকাশ দেখি না আর।
আকাশে তাকাই, অমনিই দেখি, দুহাত বাড়িয়ে আমায় ডাকে, টেনে নিতে চায়!
আমার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে, সব ছেড়েছুঁড়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
এই যে দেখো, বিশ-বিশটি বছর ঘুরল,
নাহয় কিছুটা কম--ঘড়ির কাঁটায়,
এ যৌবনের প্রতিপ্রতিটি ক্ষণ, গুনেগুনে দম,
কুমারিত্বে বন্দি রেখেছি তোমারই জন্য,
ঊর্ধ্বশ্বাসের বেয়াড়া ঘোড়ার লাগাম টেনেছি নিম্নচাপে,
উপকূল ছেড়ে ধেয়েআসা ঢেউ শান্ত করেছি, ফিরিয়ে নিয়েছি কীসের জোরে?
বারো মাস ধরে বুনেছি ফাগুন বুকের ঘরে,
কুহেলি রাতের প্রহর গুনেছি তোমারই জন্য।
সমস্ত তাপে কিংবা বাসনায় আগুন জ্বেলে
সতীত্বের আগুনে দিয়েছি আহুতি কত শতবার!
হে দেবতা! নৈবেদ্যটুকু ফিরিয়ে দিয়ো না,
গ্রহণ করো, ঘৃতপ্রদীপের বেদনা জ্বেলে আপন করে।