শীর্ষেন্দু বলিলেন..……

এই মাটিতে আমার পূর্বপুরুষের দেহাবশেষ মিশে আছে। এইখানে আমার জন্ম, এই বায়ুতে আমি প্রথম শ্বাসগ্রহণ করেছি। তাই এই পথটা আমার ঘরের পথ মনে হয়। এই মাটিতে ফিরে আসাটা বড়ো আনন্দের। আমার বাড়ির সামনেই নদী ছিল, পাশে ফসলের মাঠ। নদীর ঘ্রাণ এখনও আমায় ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায়। সেসবকিছু মনে হলে মনে হয়, আহা! কী যেন ফেলে গেছি! কী যেন ফেলে গেছি! তাই ফিরে আসতে বড়ো আনন্দ হয়।

বাসে কোনওরকমে একটু ধরেটরে ঝুলেঝুলে বাড়িতে ফিরছি; পড়ে যাবোযাবো এরকম করে। হঠাৎ বাসটা ব্রেক চাপলো, আবার চাপলো না, আমি নেমে যাচ্ছি, মানে নামার চেষ্টা করছি, বাসটা পুরোপুরি থেমে যায়নি, আবার ছুটছেও না, ওরকম অবস্থায়। পড়ে গেলাম, বাসটা ঠিক ওইসময়েই থামলো। থামলো, তাই বেঁচে গেলাম। নাহলে, সেদিনই চাকার নিচে পড়ে যেতাম। আজকের দিনটা পর্যন্ত এই গল্পটা বলার জন্যে বেঁচে থাকাও হতো না। ওইসময়ে কেউকেউ বলে উঠলো, মশায়, আপনার তো মরাই উচিত। এভাবে বাসে উঠেছেন কেনো? আমি ওকথা শুনে একটুও রাগ করিনি। শুধু ভাবছিলাম, মানুষের তো এতোটা অনাদরে থাকার কথা ছিল না। মানুষ বাড়ছে, সাথে মানুষের অনাদরও বাড়ছে। কিন্তু এরকম হওয়ার তো কথা ছিল না। মৃত্যুও কতো সহজে চাওয়ার মতো অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। এর শেষ কবে?

আপনারা আমার জীবনের কথা শুনতে এসেছেন। আমি বলবো। অবশ্য আমার জীবন এমন সাংঘাতিক কিছু নয় যে ওটার কথা শুনতেই হবে। যে কাজটা করতে ভাল লাগতো না সেটা আমি করতাম না। এরকম একটা কাজ ছিল পড়াশোনা। মনোযোগ ছিল অন্যদিকে, সিলেবাসের বইয়ে নয়। পড়তাম বটে, ক্লাসের বইগুলো না। এতে করে যে ব্যাপারটা ঘটছিল, সেটা হলো, আমার ক্যারিয়ার বলে কিছু হচ্ছিল না। অর্থহীন জীবন, নিরর্থক দিনযাপন। আমি প্রেম করতেও ভয় পেতাম। ভাবতাম, আমি কে যে আমাকে কেউ ভালোবাসবে? ফিরিয়ে দেবে, এই ভয়ে ভালোবাসতাম না। তবে একটা বয়সের পর এক মহিলা দয়াপরবশ হয়ে ভুল করে আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলেন। পরে তিনি সেটা বুঝতেও পারলেন, কিন্তু ততোদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। সেই অল্প বয়সের ভুলের মাশুল তিনি এখনও হাসিমুখে দিয়ে যাচ্ছেন।

একটা সময়ে আমি স্বভাবগতভাবেই অবসাদগ্রস্ত ছিলাম। কিছু দার্শনিক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফিরতো। আমি বড্ডো বেশি ভাবতে থাকতাম কী কেনো কীভাবে হচ্ছে। এইসবকিছু কেমনভাবে যেনো আমার ভেতরবাইরে সবকিছু ফাঁকা করে দিয়ে যেতো। সেইসময় বেঁচে থাকাটা কী ভীষণ নিরানন্দের মনে হতো। একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আমাকে ছেয়ে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কোনও আত্মপরিচয় নেই। আমি মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে ফিরতাম। এই অবস্থা আমার জীবনে কয়েকবার এসেছে। এই চরম কষ্টের মুহূর্তে আমি একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আমি এই পৃথিবীতে আর থাকবো না। এই সিদ্ধান্ত আমাকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছিল। মৃত্যুর ভাবনা মানুষকে খুব তৃপ্তি দেয়, শান্তি দেয় যখন সে জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না। ক্রিকেট খেলায় যখন কেউ আহত হয়ে খেলা শেষ না করেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যায়, তখন তার যে অবস্থা, আমার অবস্থাও তা-ই। জীবনের খেলা সাঙ্গ না করেই জীবন থেকে বেরিয়ে যাবো ভাবছি। তখন আমার ঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের সাথে দেখা। উনি যেন আমাকে পুনর্জন্ম দিলেন। শেখালেন, জীবনের ব্যথা-বেদনা-কষ্ট এসব নিয়েই চলতে হবে। বললেন, যাও, তোমার কিছুই হয়নি। আবার খেলো। Go, and see the light again. উনি আমাকে বিশ্বাস করালেন, ঠিক আছে, আমি যদি অক্ষমও হই, তবে এই পৃথিবীতে আর পাঁচজন উজ্জ্বল মানুষের মতো না হলেও একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়ে একটু বেঁচে থেকেই দেখি না কী হয়! এরকম করেই বেঁচে থাকলাম। লিখলাম, মানে লেখালেখি শুরু করলাম। সেই ২২ বছর বয়সে। প্রথম গল্পটা দেশ পত্রিকা ছাপলো না। ভাবলাম, আরেকটা পাঠিয়ে দেখি। যদি এটাও না ছাপে, তবে ধরে নেবো, আমার লেখালেখির অধিকার নেই। আমার আর লিখে লাভ হবে না। পরেরটা ওরা দয়া করে ছাপলো। সম্পাদকের ওই প্রশ্রয়েই আমার শুরু। এরপর থেকে চলছে। প্রথমদিকে আমার লেখা কেউ অতোটা পড়তো না। আমি যা লিখতাম, তা ছিল আমার মনের নির্মাণ। মানুষ আর চারপাশটাকে ভেঙ্গেচুরে টুকরো-টুকরো করে ফেলতাম, এরপর আমার নিজের মতো করে জোড়া লাগাতাম। কেউ ওটাকে নিতো না, তাই আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ বিক্রিও হচ্ছিল না, সব কপি পড়ে থাকলো। কেউ পড়ছে না, অথবা পড়ে বুঝতে পারছে না। কেউ প্রশংসাও করছে না, নিন্দেও করছে না। যখন ‘দূরবীন’ লিখি, তখনও ধরে নিয়েছিলাম, এটাও কেউ পড়বে না। এটা আরেকটা ঘুণপোকা হতে যাচ্ছে। আমি কখনওই লেখার পর বুঝতে পারি না, আমি কী লিখেছি, কেমন হলো। এভাবে লিখে গেছি, লিখে যাচ্ছি। যা পেয়েছি, তা যতোটা অর্জন, তার চেয়ে বেশি প্রশ্রয়। বেশিরভাগ সময় মনেই থাকে না, আমি লিখি, আমি লেখক। এই যে আপনারা আমার জন্য দয়া করে অপেক্ষা করে আছেন, তা দেখে আমার মনে পড়ে যায়, আমাকে লিখতে হবে, আমি তো লিখি!

আমাকে ঠাকুরের কাজ করতে প্রায়ই গ্রামে-গ্রামে ছুটতে হয়। আমি যাদের কাছে ছুটে যাই, তারা কেউ পড়াশোনা জানে না। ওরা আমায় লেখক বলে চেনে না। লেখক কী, সেটাও হয়তো জানে না। সেবার ভারতের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে গেছি। সকালের জলখাবার খাবো বলে একটা দোকানে গিয়ে বসলাম। সেখানে কুলি-মজুর-ড্রাইভাররা খায়। আমি ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। আমিই ছিলাম একটু ভদ্র পোশাক পরা, যা একটু অন্যভাবে চোখে পড়ছিল। দোকানটা চালায় যে, সে ৪০-৪৫ বছর বয়সের এক গ্রাম্য অশিক্ষিতা মহিলা। সারাক্ষণই হিন্দিতে একেওকে অশ্রাব্য গালাগাল করছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ঠায় বসে আছি, ও আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমার পরে অনেকে এসে খেয়ে চলে গেলো, আমি কিছুই খেতে পেলাম না। এদিকে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কী করি, কী করি ভাবছি, এইসময় আমার ঠাকুর অনুকূলের একটা কথা মনে পড়ে গেলো। ঠাকুর বলতেন, সব মেয়েই মা। মেয়েদের উনি মা বলে ডাকতে বলতেন। কিন্তু ওই মহিলার মুখের ভাষা, পরনের পোশাক, ব্যবহার কোনওকিছু দেখেই উনাকে কিছুতেই মা ডাকতে ইচ্ছে করে না। কেনো জানি না, ভাবলাম, ডেকেই দেখি না! উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, মা বড্ডো খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দেবে? এরপর যা ঘটলো, তা রীতিমতো ম্যাজিকের মতো! সেই মহিলা নিজের হাতে প্লেটে গরমগরম রুটি আর তরকারি সাজিয়ে এনে আমার সামনে বসে বলতে লাগলেন, খা ব্যাটা, খা। তুই পয়সা পুরো দিস না, অর্ধেক দিস। আমি কিছুতেই তাকে পুরো পয়সা দিতে পারলাম না। কোথায় তার দুর্ব্যবহার, কোথায় তার অবহেলা! আসলে, কে যে কোন ক্ষুধায় কাতর থাকে তা আমরা কখনওই জানতে পারি না। এই মহিলার মধ্যেও যে মায়ের স্নেহ দেয়ার চিরন্তন ক্ষুধা লুকিয়ে ছিল, তা কে কীভাবেই বা জানবে?

শীর্ষেন্দু গত ৩০ তারিখের বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলোর মধ্য থেকে ওপরের কথাগুলো কিছুটা আমার নিজের মতো করে লিখলাম। ওপরের কথাগুলো আমার নিজের জীবনের সাথে বেশি মিলে বলেই হয়তো শুধু ওগুলোই লিখে ফেলতে পেরেছি, বাকিগুলো অতো মনে নেই। ২ নভেম্বর জন্ম-নেয়া মানুষগুলো যদি হুট করে সবাই বলে বসে, স্রেফ বেঁচে থেকেও ওরা অনেককিছুই পেয়ে গেছে — অতোটাই, যতোটা পাওয়ার কথা ওদের কিছুতেই ছিল না; যারা ধরেই নিয়েছিল, এভাবেই দিনটিন কেটে যাবে আর কি, পরে দেখেছে, দিনগুলো স্রেফ কাটবার জন্যেই কাটছে না; এতে আমি অন্তত একটুও অবাক হবো না।

সেদিন বাতিঘরে শান্তনুদা (উনি গান করেন) বলছিলেন, এই মানুষটা নিজে এতকিছু করেটরে শেষ পর্যন্ত কিনা সব কৃতিত্ব দিয়ে দেন অনুকূলবাবুকে! আমি বলেছিলাম, আর কাউকে সব কৃতিত্ব দিয়েও যদি এতোটা কৃতী হওয়া যায়, তবে তা-ই হোক না, দাদা! আমার মাও ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দীক্ষা নিয়েছেন। মাও ভাবেন এবং বিশ্বাস করেন, জীবনের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তগুলোতে অনুকূলই তাঁকে কূল দিয়েছেন। বেঁচে থাকাটাই তো অনেক বড়োকিছু! সেই বেঁচে থাকার সময়টাতে যদি এতো মানুষেরও বেঁচে থাকার সময়টাতে সাথে মিশে থাকা যায়, তবে ওইটুকু বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু এসে যায় না, দাদা।

পূর্বকথা: এই শনিবার সন্ধ্যায় বাতিঘরে আসছেন শীর্ষেন্দু। এর আগে এসেছিলেন সমরেশ। তারও আগে, আরও অনেকেই।

সেইবার ছিলাম। আগেও থেকেছি। এইবারও থাকবো।

বাবার কাছ থেকে শিখেছি, শিক্ষকদের আর বড়ো-বড়ো মানুষদের কাছ থেকে শিখতে হয় তাঁদের পায়ের কাছে বসে। নিজের সবটুকু আমিত্ব ঝেড়ে ফেলে মাথা নত করে শিখতে হয়। ওরা শেখাবেন না; অতো সময় ওদের নেইও। থাকলেও, কেনোই বা দেবেন? এই তুচ্ছ আমাকে? আমি কে? আমাকে সময় দিতে হবেই বা কেনো? তবুও শিখে নিতে হয়।

শীর্ষেন্দু আর আমার জন্ম একই দিনে, ২ নভেম্বরে। শেক্সপিয়ার জুলিয়েটকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছেন, নামে কী হয়? এটা প্রশ্ন নয়, স্বগতোক্তি। অনেকেই একই ভাবেই জিজ্ঞেস করে বসবেন, জন্মদিনে কী হয়? আমি বলবো, কিছুই হয় না। তবু, জন্মদিনের এই মিলে যাওয়া নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ কাজ করে। অনেক দামি আনন্দ, টাকার চেয়েও দামি। শাহরুখের অভিনয় ভালো লাগে, উনিও ‘দয়া করে’ জন্মেছেন ওই দিনে। আমার নিজেকে ভাল-লাগানোর জন্যে, যদি ওরকমভাবে বলেই ফেলি, তাতে কার কী এসে যায়! এই ভাল-লাগার ব্যাপারটা কাজ করার কোনও কারণই নেই; তবুও। প্রিয় মানুষের সাথে নিজেকে যতোটুকু মিলিয়ে নেয়া যায় আর কি! শীর্ষেন্দু জন্মেছেন বাংলাদেশে, আমিও। উনি জীবনে খুব বিপন্ন অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন; আমিও। ওরকম বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে না গেলে সাঁতারু ও জলকন্যা’র মতো উপন্যাস কেউ লিখতে পারে? খুব ছোট একটা উপন্যাস, অথচ সে কী ভারি! আকারে ছোটো অনেককিছুই কিন্তু মাপে ছোটো নয়। “For sale: baby shoes, never worn” হেমিংওয়ের এই ছয় শব্দের কথাকে উপন্যাসের মর্যাদা দেয়া হয়েছে! ভাবা যায়! আমাকে ৬ শতাব্দীর আয়ু দিলেও ওরকম করে লিখতে পারতাম কখনও? এমনকি শত জন্মের বেদনা নিয়েও অতোটা বেদনাভরা কথা লিখে ফেলা যায় না। ভাল লেখকরা আমাদের কষ্টের সমান বড়। এই ছয়টা শব্দ অনেক অলেখকের ১০ শেলফ বইয়ের চাইতেও দামি। আকারে কী হয়? বাংলা সাহিত্যের খুব ছোটো অথচ জীবনদর্শনে বড়ো উপন্যাসের তালিকা করলে শীর্ষেন্দুর সাঁতারু ও জলকন্যা প্রথমদিকেই থাকার কথা। এই বইটার দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১৮ টাকা। বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে, শুধু এই বইটাও জীবন নিয়ে ভাবতে শেখাতে পারে। জীবনটাকে ‘না’ কিংবা ‘গুডবাই’ বলে দেয়ার আগে একবার হলেও এটা মেনে বেঁচে থাকা যায়, “শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়।” এই কথাটা শীর্ষেন্দুর। এই কথাটা বলে-দিতে-পারা মানুষটাকে দূর থেকে অন্তত এক মুহূর্তের চোখের দেখা দেখতেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে স্বচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়।

তাই যাচ্ছি; রাতের গাড়িতে।

Dipankarদা, যে বাতিটা জ্বেলেছেন, জ্বেলে যাচ্ছেন, সেই বাতিটা নেভাবেন না কখনওই, প্লিজ। এভাবেই থাকবেন সবসময়ই, আমাদের একেবারে ভেতরে মিশে থেকে। দাদা, আপনাকে ধন্যবাদ।