শেষ-ডায়েরি

আমি অলিভিয়া। ছোটোবেলায় দেখতে নাকি বিদেশি শিশুদের মতন ছিলাম, তাই আমার এমন নাম রেখেছেন আমার বাবা।


আমি যখন সিক্সে, তখন থেকেই আমার ডায়েরি-লেখার অভ্যেস। এটা সেটা, গাঁদাফুল, বেলিফুল, গাছের পাতাদের কথা, চিড়িয়াখানার জিরাফ, মায়ের বকুনি, বাবার আদর সব কিছুই নিখুঁতভাবে লিখে রাখতাম আমি। একদিন আমার একটা ডায়েরি মায়ের হাতে পড়ল। মা কী বুঝলেন জানি না, আমার লেখা সব ডায়েরিই মা পেছনের পুকুরে ফেলে দিলেন, আর আমার সাথে কথাবলা বন্ধ করে দিলেন। বারো দিনের মাথায় আমি আর থাকতে না পেরে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলাম অনেকক্ষণ ধরে, আর প্রমিজ করলাম, আমি আর ডায়েরি লিখব না কখনও।


যেই কথা সেই কাজ। এভাবে দিন কাটতে লাগল। জেএসসি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে, বাবার একজন বন্ধু আমাকে দুটো ডায়েরি গিফট করেছিলেন। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে কী যেন মনে হলো, কয়েক পাতা লিখে ফেললাম, আর অনেক দিন বাদে আগের মতো ঝরঝরে অনুভব করতে লাগলাম। নয় দিনে ডায়েরির প্রায় অর্ধেকটা লিখে ফেলেছিলাম, নানান রংয়ের কালি দিয়ে মনের সব কথাই ধীরে ধীরে ডায়েরিকে জানিয়ে দিচ্ছিলাম।


একদিন ব্যাগের মধ্য থেকে সেই ডায়েরির সোনালি মলাটের খানিকটা বেরিয়ে থাকায় আমার বেস্টফ্রেন্ড মিতালি ওটা দেখে ফেলেছিল। সেদিন ও বলেছিল, ‘অলিভিয়া, এইটুকু বয়সে ডায়েরি লিখতে হয় না, মনের কথা ডায়েরিতে লিখে লিখে জমালে মানুষ খারাপ হয়ে যায়।’ সেদিন ওর কথা শুনে খুব কেঁদেছিলাম। বেস্টফ্রেন্ডরা কি কখনও অমন করে বলে? তার কয়েক দিন পরে মিতালিকে ডায়েরিটা দিয়ে বললাম, ‘তুই এটা ফেলে দিস কোথাও, আমার মায়া হয় ফেলতে।’ ও বলল, ‘না না, ফেলব না, আমাদের মাটির চুলোয় দিয়ে দেবো, ঝামেলা শেষ!’


এর পরে আর ওসবের ধারে কাছেও কখনও যাইনি। ক্লাস নাইনে আর টেনে খুব ভালো করে পড়েছি, তবুও কেন জানি না, রেজাল্টটা ভালো হলো না। তারপর অনেক দুঃখ পেয়ে আনমনেই সেই ডায়েরি নামক বন্ধুর হাতটা আবারও ধরলাম। সারাদিন ডায়েরি লিখেই কাটাতাম ছুটির সময়গুলো। আমার বড়ো ভাই একদিন দেখে বললেন, ‘হা হা, রেজাল্ট খারাপ করে আজকাল এই কাজ হচ্ছে? বাহ্‌, ভালো। করে যাও!’ সেদিন আবারও বুকে ব্যথা পেলাম। আমার প্রাণপ্রিয় ভাই আমাকে এমনভাবে বললেন যেন আমি বিশাল কোনও অন্যায় করে ফেলেছি। সেবার নিজের কাছেই শপথ করলাম, জীবনে এই ভুল আর কখনও করব না।


এরপর বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেল। তখন আমি মাস্টার্সে পড়ি। হুট করেই আমার বিয়ে হয়ে গেল কোনও এক মাঘের শীতে। আমার স্বামী বিশাল এক ব্যবসায়ী। নাওয়া-খাওয়ার সময়ই পান না তিনি। মাথায় এক ব্যবসা বাদে আর কিছুই নেই যেন! আমাদের টোনাটুনির সংসার। আমারও সময় কাটে না, তাই আবারও কীভাবে যেন ডায়েরি-লেখা শুরু করে দিলাম। কিছুদিন পরে মনে পড়ল, আরে, আমার শপথ? যাক, শপথ ভেঙেই ফেলেছি যখন, তখন কী আর করা? লিখতে থাকলাম, আর লিখতেই থাকলাম। থামাতে পারলেই তো থামাব! আমি তখন টুকটাক কবিতা লিখতাম, মানে ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করতাম, আর টুকটাক প্রেমের গল্প লিখতাম। আমার সবটা আবেগ ছড়িয়ে দিতাম নায়ক-নায়িকার মনে।


তো আমার উনি সবসময় ব্যস্ত থাকতেন বলে আমার অনেক কিছুই তাঁর চোখে পড়ত না, আমাকেই তো চোখে পড়ত না ঠিকমতো। এরকমই ভাবতাম। একদিন খুব ভোরবেলায় দেখি, আমার আম্মা এসে হাজির। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই অবস্থা কেন? উত্তর পাবার আগেই আমার স্বামীরত্নটির গলা পেলাম, ‘আম্মা, আপনি ভেতরে আসেন।’


তার মানে উনি কি আগেই জানতেন যে আমার আম্মা আসবেন? আমরা সবাই ভেতরে গেলাম। দেখি, উনি আমার ডায়েরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমার আম্মাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আপনার মেয়ে একইসাথে অন্য অনেক ছেলের সাথে প্রেম করে। এই যে, তার প্রমাণ, দেখেন।’ উনি আম্মাকে আমার সব হাবিজাবি রোমান্টিক গল্পের ডায়লগ পড়ে শোনালেন, আর স্পষ্টগলায় বলে দিলেন, ‘এক বাজে চরিত্রের মেয়ের সাথে আমি সংসার করেছি বহুদিন। একে নিয়ে যান, আমি একে আর আমার বাড়িতে দেখতে চাই না।’


এদিকে, এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত শুনে আমার প্রথমেই খুব হাসি পেল। সামান্য ডায়েরিতে কী-না-কী লিখেছি, তা নিয়েও এত বড়ো ঘটনা! আমি যখনই কিছু বলার জন্য মুখ খুলব, তখনি মনে পড়ল, আরে, আমার কুসংস্কারে ঠাসা, আর চুলের গোড়ায় গোড়ায় অবধি গোঁড়ামি নিয়ে বেড়ে-ওঠা স্বামীকে আমি কিছুই বোঝাতে পারব না। যে ধরেই নিয়েছে, সে যা বোঝে, তা-ই ঠিক, তাকে বোঝাতে যাওয়ার মানেই হলো সময়ের অপচয় করা। আমার স্বামীটিও ওরকম। উনি যা বোঝেন, তা-ই ঠিক; যা বোঝেন না, তা-ও ঠিক। তাঁর সত্যও সত্য, মিথ্যাও সত্য---অন্তত এই ফ্যামিলিতে।


এসব কথা শোনার সাথে সাথেই আম্মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমাকে স্বামীর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হলো। চাইতেই তো হবে, যে বিশাল অপরাধ আমি করেছি! আর আমার স্বামীও ভীষণ উদার মানুষ, ক্ষমা করেই দিলেন। সেই যাত্রায় ওঁর ক্ষমায় আমার সংসারটা টিকে গেল। সংসার করলাম, ছেলেপুলে হলো, তাদেরও ছেলেপুলে হলো।


দুই ছেলের মা হলাম, তার নয় বছর পরে বিধবাও হলাম। ছেলেদের পরে একটা মেয়েও হয়েছিল আমার, আড়াই মাস বয়সে মারা যায়, নিউমোনিয়ায়। কীভাবে দিন কেটে গেল ওদের বড়ো করতে করতে, আর নিজেকে বুড়ি হতে দেখতে দেখতে, আমি তার কিছুই টের পাইনি।


এখন সব টের পাই, ভালো করেই পাই। এখন বুঝি, একাকিনী এই আমার একাকিত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই। অনেক প্রশ্ন আসে মনে। সেসবের উত্তর নিজেই দিই, বয়স হলে আরও কত কিছু যে একা একাই করতে হয়! ভাবি, এত কাজ, এত ছুটে চলা, এত ভুল, এত ঠিক, এত ভুল-ঠিকের গোলমেলে জীবন, এসব এত কিছু আসলে কেন করলাম যখন শেষবেলায়ও আমার সাথে কথা বলারও কেউ নেই? মানুষ কি তবে আজীবনই ছুটতে ছুটতে শেষবেলাতে এসে একা হয়ে যায়? যাদের জন্য সে ছুটে চলল সারাটি জীবন, তাদের কাউকেও পাশে পায় না সে? এখন কীভাবে কাটাই আমি এই চব্বিশটা ঘণ্টা! আমার সাথে কথা বলারও যে কেউ নেই! আচ্ছা, আগেও কি দিন চব্বিশ ঘণ্টারই ছিল? আগে যেমনি দিন ফুরিয়ে গেলে ভয় করত, এখন তেমনি দিন ফুরোয় না বলে ভয় করে। রাতে ঘুমটা পর্যন্ত ঠিকমতো হয় না। নাতি-নাতনিরা সঙ্গ দেয়, কিন্তু কতক্ষণই-বা? ওদেরও তো কত কাজ!


ছেলেরা তো সময় আরও পায় না। আমি প্রায়ই ছেলে, ছেলেবউ, নাতি-নাতনিদের ডেকে একটা কথা বলি, ‘তোমরা এত কেন ছুটে বেড়াও সারাদিন? আমাকে দেখছ না? আমার দিকে তাকাও আর শেখো, এটাই তোমাদের ভবিষ্যৎ! যত বড়োই হও, আর যত বড়োলোকই হও, শেষজীবনে এটাই তোমাদের নিয়তি। পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে একটা সময় পরে গিয়ে দেখবে, পাশে ওদের কাউকেই পাচ্ছ না, যাদের জন্য তোমাদের এই ছুটে-চলা! এই যে এতগুলি পায়ের জন্য নিজের দু-পা’কে এমন করে ছোটাচ্ছ, তার বদলে পুরস্কারস্বরূপ পাবে তোমারই তৃতীয় পা’টি---একটা লাঠি।’ ওরা সবাই আমার কথা শুনে হাসে। প্রতিবছরই ওরা সবাই মিলে আমার জন্মদিন পালন করে যেন আমি ছোট্ট কোনও শিশু! হা হা হা…।


আমার উনসত্তরতম জন্মদিনে বড়ো ছেলে একটা চকলেট কালারের ডায়েরি আর সাথে কিছু চকলেট উপহার দিয়েছে। আমি একসময় চকলেট ভালোবাসতাম, বাসি এখনও। কিন্তু ডায়াবেটিস হবার পর থেকে আর খেতে পারি না। আমি ডায়েরিটা হাতে নিলাম, আহা, কী সুন্দর দেখতে! ডায়েরিটা হাতে নেবার সাথে সাথে আমার পুরো জীবনের ডায়েরিটা হঠাৎ একবার যেন চোখের সামনে খুলে গেল!


খুব জোরে জোরে হাসলাম, হাসতে হাসতে কান্না পেল খুব। সারাজীবনই অন্যেরা আমার ডায়েরি ফেলে দিয়েছে, সামান্য ডায়েরি লেখার দায়ে আমি সবার কাছেই ঘুরে ফিরে বিনা কারণে বার বার অপরাধী হয়েছি, এবার সেই ডায়েরিটা আমি নিজহাতেই ছুড়ে ফেলে দিলাম! এই জীবনে প্রত্যেক বারই আমার কাছ থেকে এই ‘আপদ’টাকে সবাই মিলে সরিয়েছেন, এবার আমিই নিজহাতেই আমার ডায়েরিটা ফেলে দিলাম।


যে আমি আজকে সামান্য সিগনেচার করতে গেলে কাঁপতে কাঁপতে ওই পৃষ্ঠায় প্রায় একটা ছবিই এঁকে ফেলি রীতিমতো, সেই আমি আজকে ডায়েরিতে আর কী-ইবা লিখব? আজ আমার সাধ না ফুরোলেও সাধ্য ফুরিয়ে গেছে।