সন্ধে যখন ভোরের আলোয়: শেষ পর্ব

পৃথিবীটা কেমন গুটিয়ে এসেছে নাতাশার। দুইটা টিউশন করাতো। তা দিয়েই চলত সে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। একদিকে পরিবার, অন্যদিকে সম্পর্কের টানা-পোড়েন। আর-একদিকে গ্রামে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি। যতসব অশ্রাব্য রটনার ছড়াছড়ি।


সব মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে সে। এই মানসিক দোটানার মধ্যে থাকার কারণে টিউশনে ভালো করে পড়াতেও পারছে না। স্টুডেন্টরা পরীক্ষায় খারাপ করছে। একটা টিউশনে মাসের বেতন দিয়ে জানিয়ে দিল সামনের মাস থেকে যেন আর না আসে। ওরা নাকি অন্য টিচার রাখবে। নতুন টিউশনও খুঁজে পাচ্ছে না সে। এদিকে আস্তে আস্তে আর্থিক দুরবস্থাও তাকে ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছে। হিমু ওকে আজ পর্যন্ত আর্থিকভাবে সাহায্য করেনি। আসলে কখনও প্রয়োজনই পড়েনি। এখন তার সাহায্যের প্রয়োজন, কিন্তু হিমুর কাছ থেকে টাকা চাইতে পারে না নাতাশা। একধরনের অদ্ভুত জড়তা কাজ করে। মনে হতে থাকে, যাকে আমিই সব সময়ই টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি, তার কাছেই টাকা চাই কী করে? তা ছাড়া ইদানীং হিমুর ব্যস্ত ব্যস্ত স্বভাবের কারণে এই সমস্যার কথাগুলো হিমুকে সে বলতেও পারছে না।


দুঃখ কখনও জমিয়ে রাখতে নেই। জমিয়ে রাখলে তা উইপোকার মতো বংশবৃদ্ধি করতেই থাকে। বুকের ভেতর জমিয়ে-রাখা দুঃখরা ওম পায় ভালো, তাই হয়তো বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে দুঃখরা পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে দলবেঁধে বুকের ভেতরের কলিজা, অস্থি, এমনকি রক্তও চুষে চুষে খেতে থাকে! রক্ত অস্থি মাংস খাওয়া হয়ে গেলে দুঃখরা একসময় প্রাণটাও খেতে শুরু করে, যা বাইরে থেকে ততটা বোঝা যায় না।


একটা টিউশনে নাতাশার আর চলছে না। চকবাজারের হোস্টেলটা ছেড়ে গাত তিন মাস আগে সে একটা মেসে গিয়ে উঠেছে। একরুমে চারজন। গিজগিজ করে থাকতে হয়। সিটপ্রতি দেড় হাজার করে ভাড়া। আর আছে খাওয়ার ও অন্যন্য খরচ। তিন রুমের একটা বাসা। প্রতি রুমে চারজন করে মোট বারোজন মেয়ে থাকে ওই ঘিঞ্জি বাসাটায়। বারো মেয়ে মানে বারো মতের রাজ্য, যেখানে বারো ধরনের ঝামেলা সারাবছর লেগেই থাকে। এ ওর পিছে, ও এর পিছে লাগে। এর কথা ওকে লাগায়, ওর কথা একে লাগায়। সব মিলিয়ে সারাবছরই বারোমাসি প্যাঁচানো ফ্যাসাদে ভরপুর থাকে সেই বাসা। নাতাশা মূলত খরচ কমাতে মেসে উঠেছে।


আজকাল তার মানসিক অবস্থার পাশাপাশি শারীরিক অবস্থারও অবনতি হচ্ছে। মন ভালো না থাকলে শরীরের যত্ন নেবার ইচ্ছেও আর জাগে না। এর ফলাফলস্বরুপ তার শরীর হচ্ছে হাড্ডিসার। দিন দিন অধঃপতন হচ্ছেই তো হচ্ছে।


হিমুর সাথে এখন দিনে একবার কথা হয় তার। কখনও কখনও দু-তিন দিনও চলে যায়, তবুও তার খবর হয় না। নাতাশা ফোন করলে হাই হ্যালো করার দু-এক মিনিট পর কথা আর তেমন জমে না।


ইদানীং হিমু অস্পষ্ট করে কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু পারে না। শুকিয়ে-যাওয়া নদীর চরের মতো ভালোবাসাহীনতা দেখতে কখনও চশমা লাগে না, লাগে কেবলই অনুভবশক্তি। আজকাল নাতাশাও তা অনুভব করতে পারে।


সেদিন বিকেলে জানলার পাশে বসে বসে ডায়েরি লিখছিল নাতাশা। রুমে কেউ নেই। হিমুকে খুব মনে পড়ছে। দুইটা কবিতা লিখে ডায়েরির উপর মুখ রেখে হাউমাউ করে কাঁদছে নাতাশা। জগতটাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় বিভক্ত মনে হচ্ছে তার কাছে। পারমাণবিক কণার চেয়েও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে হৃদয়ভাঙা টুকরাগুলোকে। কবিতার প্রতি লাইন বিষাদে ভরা, ব্যথায় ডোবা। হিমুর ফোনে সে একটা মেসেজ দিল: missing you, pakhi.


কবিতা লেখার জন্য নাতাশার আলাদা ডায়েরি আছে। আর-একটা ডায়েরিতে সে জমা রাখে জীবনের যত ক্লান্তি আর গ্লানি। আজকাল নাতাশা লেখার হার বাড়িয়েছে। দু-একটা কবিতা ফেইসবুকে পোস্ট করে। সবাই বেশ পছন্দও করে। পৃথিবীর কম-বেশি প্রায় সকল মানুষই, বিষাদগ্রস্ত হতে না চাইলেও, বিষাদ ভালোবাসে, বিষাদের গল্প, গান, কবিতা ভালোবাসে। মানুষ বড়ো আজব প্রাণী।


প্রেমের প্রথম জন্মদিনে হিমু নাতাশাকে একজোড়া চুড়ি দিয়েছিল। বড়ো আদরের চুড়িজোড়া ডায়েরির এককোণে যত্নে লুকিয়ে রেখেছে সে। হিমুকে দেখতে ইচ্ছে করলে ডায়েরি খুলে চুড়িজোড়ায় সে আলতো করে চুমু খায়। এই চুড়িজোড়াই যেন হিমুর গাল, গলা সবই!


আজকেও চুড়িজোড়াতে চুমু খেতে গিয়ে বুকের ভেতর ছারখার লাগছে তার। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের ভিড়ে নাতাশার পাশে কোনও জনমানব নেই। চারিদিকে শুধু ধু ধু মরুভূমি।


হঠাৎ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করেই হ্যালো বলতেই একটা মেয়েকণ্ঠ শুনল সে। উদ্‌গ্রীব কণ্ঠে সে নাতাশাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি নাতাশা?’
‘হ্যাঁ’ জবাব দেবার পর নাতাশা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে? কী চাইছেন?’
এসব কথা বলার সময় অপর পাশ থেকে কেমন একটা ধস্তাধস্তির কাড়াকাড়ির শব্দ। একটা ছেলেকণ্ঠ বার বার বলছে, ‘আরে, ওসব ছাড়ো না! ও আমার বোন, মানে কাজিন হয়। এর বেশি কিছু না। প্লিজ, ঝামেলা বাড়িয়ো না আর।’ ছেলেকণ্ঠটা নাতাশার চেনা চেনা লাগছে।


হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা হিমুরই গলা! নাতাশা এবার পুরোপুরিই চিনতে পেরেছে। বোঝা গেল, মেয়েটা ফোনটা কেড়ে নিয়ে রাগি রাগি গলায় বার বার বলছে, ‘আমি ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই, কে সে! আজ এর একটা বিহিত হোক!’ বলেই সে নাতাশাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ‘আপনি হিমুর কে হন? কী সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে? আপনি ওকে একটু আগে ‘মিসিং ইউ, পাখি।’ লিখে মেসেজ দিয়েছেন। কী সম্পর্ক আপনাদের দুজনের মাঝে?’


এবার নাতাশা আসল ঘটনা বুঝে গেল। বুঝল, হিমুর ফোনে মেসেজটা দেখে ফেলেছে ওই মেয়েটা। তার মানে ওরা একসাথেই ছিল! এই মেয়ে যেহেতু রাগি আর অধিকার খাটিয়ে কথা বলছে, এর মানে, ওদের ভেতর প্রেমের সম্পর্ক চলছে, যা নাতাশা জানত না। নাতাশার চোখ বেয়ে দর দর করে জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দুতে ক্ষয়ে পড়ছে পৃথিবীর চেয়েও বিশাল স্বপ্নের ছাদটা।


নাতাশা নিঃশব্দে কেঁদেই চলছে। তখনও ফোনের ওপাশে ওদের দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি আর তুমুল তর্কাতর্কি চলছে।


এবার মেয়েটা দৃঢ়কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করতে লাগল, ‘হিমু আপনার কে হয়, সত্যি করে বলুন!’
নাতাশা পালটা প্রশ্ন করল, ‘আগে বলুন, ওর সাথে কী সম্পর্ক আপনার?’
মেয়েটা অনেকটা গলা উঁচু করে অধিকার খাটিয়ে জবাব দিল, ‘সে আমার বয়ফ্রেন্ড। গত দেড় বছর ধরে আমরা রিলেশনে আছি।’
নাতাশা খুব কৌশলে নিজেকে কোনওমতে কনট্রোল করে ধীরগলায় বলল, ‘হিমু আমার কাজিন, সে আমার ভাই হয়।’


এবার মেয়েটা অনেকটা শান্ত হয়ে গেল। বোঝা গেল, এতক্ষণ মেয়েটা প্রচণ্ড রেগে ছিল। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে হিমুকে। হয়তো হিমুও…! না না না! আর কিছু ভাবতে পারছে না নাতাশা। মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে যেন পুরো পৃথিবী বলের মতো চারপাশে শাঁ শাঁ করে ঘুরছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও কেমন যেন বিলীন হয়ে গেল তার। নাতাশা দাঁড়ানো থেকে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল।


জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে দেখল, সে বিছানায় শোয়ানো। রুমমেটরা কেউ কেউ ওর মাথায় পানি দিচ্ছে। কেউবা বাতাস করছে। কেউ স্যালাইন বানিয়ে পাশে রেখে জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে। ওর জ্ঞান ফিরতেই সবার মুখ থেকে শঙ্কার রেশটা কেটে চিন্তামুক্তির রেখা ছুঁয়ে গেল সবার ঠোঁটে।


এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল চরম বিষণ্ণতায়।


একদিন। গভীর রাত। সাড়ে তিনটা। ডায়েরি লিখছে নাতাশা। হিমু গত চার দিনে একবারও ফোন করেনি। আজ হঠাৎ খুব মনে পড়ছে হিমুকে। খুব করে ইচ্ছে করছে কথা বলতে, ওর কণ্ঠটা একবার, শুধু একবার একটু করে শুনতে খুব মন চাইছে। নাতাশা হিমুর নম্বরে কল করবে করবে করছে, এমন সময় হিমু কল করল। নাতাশা ফোন রিসিভ করেই কেমন ডুকরে ডুকরে কেঁদে ফেলল। ওপাশ থেকে সাময়িক নীরবতা। ওই নীরবতা অনেক অনেক কথাই অনর্গল বলে যাচ্ছে। হিমু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘নাশু, নিজেকে শান্ত করো। দেখো, আমার দ্বারা সত্যিই সম্ভব না এ সম্পর্কটা চালানো। তুমি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দাও। তুমি একটা বিয়ে করে নাও। আমি রেশমিকে ভালোবাসি। ওর সাথে আমার রিলেশন চলছে। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করো।’


এসব কথা হিমু গড়গড় করে বলে যাচ্ছে, আর নাতাশা অবাক হয়ে ওসব কথা শুনছে। কথা শুনতে শুনতে নাতাশা কেমন জানি কাঁদতেও ভুলে গেছে। এতটাই শকড হয়েছে সে!


এই কয়েকটা লাইন বলেই নাতাশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টুক করে ফোনের লাইন কেটে দিল হিমু।


মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন হয়, তা স্পষ্ট করে কেউই বলতে পারে না। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে নাতাশার কাছে মনে হচ্ছে, মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও শতগুণ বেশি যন্ত্রণার এই অন্তর্দহন। এই দহনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে একটা জলজ্যান্ত মানুষ ও তার ভেতরের পুরোটা। অথচ বাইরে থেকে কেউই তা দেখতে পাচ্ছে না। কিছু বুঝতেও পারছে না।


একে একে নাতাশার অনেক কথাই মনে পড়তে লাগল। সেই প্রথমদেখা, নাতাশাকে একপলক দেখার জন্য ওই রাস্তার মোড়টায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কড়া রোদে হিমুর দাঁড়িয়ে-থাকা। নাতাশার পথ ধরে পিছু পিছু হাঁটতে-থাকা সেই হিমু আজ অন্য পথে। নাতাশাকে ছাড়া মরেই যাবে বলা মানুষটি আজ তাকে জীবনের কোনও ছকেই চায় না। যার কাছে নাতাশা মানেই গোটা একটা জীবনের আদ্যোপান্ত ছিল, সেই মানুষটিই কিনা তাকে আজ তার জীবনের আশেপাশে ঘেঁষতে দিতেই চায় না।


আহারে সময়! সময় উলটে গেলে কত কী-ই না পালটে যায়! মানুষ, মানুষের মন, এমনকি ভালোবাসার ধরনও।


অসহায়ত্বের সাগরে তলিয়ে-পড়া নাতাশার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।


এমন দুঃসময়ে ভয়াবহ একটা খবর এল। ওর ছোটো বোন ফোন করেছে। সে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার জন্য সে স্পষ্ট করে কথাই বলতে পারছে না। ছোটো বোন ফোনে যা বলল, তা শুনে নাতাশা সাথে সাথে সেন্সলেস হয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। বাবা স্ট্রোক করেছে। হাসপাতালে নেবার সময় পথেই মারা গেছে বাবা।


সেন্স ফেরার পর নাতাশা তড়িঘড়ি করে রুমমেটের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হলো, যদিও তার বাড়ি বা গ্রামে যাওয়ায় উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। এসবের পরোয়া না করে সে বাসে উঠে গ্রামে চলে যায়। শেষবার বাবার মুখটা দেখার তীব্র তৃষ্ণায় প্রাণটা যেন বেরিয়ে যাচ্ছে তার। আজ জীবন এক কঠিন সীমান্তে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে নাতাশাকে। বাস ছেড়ে রিকশা নিয়ে বাড়ির রাস্তার দিকে এগোচ্ছে সে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মৃতদেহ খাটিয়ায় করে কবরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নাতাশা তড়িঘড়ি করে সশব্দে কাঁদতে কাঁদতে খাটিয়াধারীদের পা জাপটে ধরে বাবাকে শেষ একবার দেখতে দেবার জন্য অনুরোধ করছে। কয়েক জন এসে ওকে টেনে ধরে রাখছে। খাটিয়াধারীরা দোয়া পড়তে পড়তে চল্লিশ কদম ছাড়িয়ে গেছে। নাতাশা একবার বাবার মুখ দেখার জন্য জ্যান্ত কাটা-কইমাছের মতো তড়পড় করতে করতে বারবার খাটিয়াধারীদের ধরতে চাইছে, কিন্তু অন্যরা তাকে জাপটে ধরে আটকে রেখেছে।


অদূরেই নাতাশার মা এক মহিলার কাঁধে মাথা হেলে দিয়ে পাথরের মতো একদৃষ্টে স্বামীর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলে টমেটোর মতো হয়ে আছে। অনবরত কাঁদতে কাঁদতে মা চোখের সমস্ত জল ফুরিয়ে ফেলেছে। মাকে জড়িয়ে ঢেকুর তুলে তুলে কাঁদছে নাতাশার ছোটো দুই ভাই-বোন। একটা অনিশ্চিত জীবনের গল্প শুরু হলো। জগতের নাট্যমঞ্চে চলছে একটা অন্ধকার জগতের অনুসূচনা।


নাতাশা ধীরপায়ে এগিয়ে মায়ের পা জাপটে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মা অন্য মহিলার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নাতাশাকে উদ্দেশ করে বলতে লাগল, ‘এই নষ্টা, দুশ্চরিত্রা মেয়েটাকে আমার ঘরের ত্রিসীমানা থেকে দূর হতে বলো! ওর পাপের জন্যই আজ এত কিছু হলো! আমার স্বামীর আত্মা কষ্ট পাবে, ওকে দূর হতে বলো!’ বলেই পা থেকে নাতাশাকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছে, কিন্তু নাতাশা বার বার ক্ষমা চাইতে লাগল, আর পা’টাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল।


দু-একজন মহিলা নাতাশাকে মায়ের পা থেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে নিয়ে বলতে লাগল, ‘তোমার বাবা নাকি তোমার চিন্তায় চিন্তায় স্ট্রোক করেছে। তোমার মা তোমাকে দেখতে চাইছে না। তুমি বরং চলেই যাও।’ এ কথা শুনে নাতাশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।


উপায়ান্তর না দেখে নাতাশা ছোটো দুই ভাই-বোনকে বুকে টেনে নিয়ে ওদের কপালে মুখে চুমু খেল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়ের খেয়াল রাখতে বলে চোখ মুছতে মুছতে দ্রুতপায়ে আবার শহরের দিকে রওনা হলো সে। আজ ওর জীবনটা আটকে গেছে সময়ের সবচাইতে কঠিন চোরাবালিটিতে।


বাসে বসে জানলার ওপারে আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সে। বাস ছুটে চলছে স্টেশনের দিকে। চলছে তো চলছেই। কখনও থামছে, যাত্রী উঠছে, আবার কিছু যাত্রী তাদের গন্তব্যে নেমেও যাচ্ছে, বাস আবারও ছুটে চলছে।


কেউ উঠছে, কেউ নামছে। আহারে জীবন!


কিন্তু নাতাশার শেষস্টেশনটা কোথায়, তার জীবন চলছে কোন পথে, তার কোনও হদিস নেই। জীবন চলছে এক কণ্টকময় বন্ধুর পথে। চলার পথে প্রতিটি কদমই আটকে যাচ্ছে অথই চোরাবালিতে। দুঃখের তারকাঁটায় তারকাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বড়ো আদরে গড়া স্বপ্নগুলোর আগা থেকে গোড়া পুরোটাই। কী এক কঠিন দাবানলে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে অন্তর। আহ্‌! ওই অন্তরিক্ষে বসে বসে বিধাতা কেবল তামাশাই দেখে যাচ্ছেন। কী জানি কীসের কলকাঠিটি নাড়ছেন তিনি, কেনই-বা এত তামাশা!


নাতাশা শহরে বাসায় চলে এসেছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না সে। মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছে। ঠিক এই সময়টাতে কেউ যদি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু আদর মেখে তার সাথে কথা বলত, অথবা বুকে টেনে নিয়ে একটু ভালোবেসে দিত, তবে তার বুকটা হয়তো একটু হালকা লাগত। আজ যে সময়টাতে তার একটু ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার দরকার ছিল, সেই সময়টাতে তার পায়ের তলায় মাটিটুকুও নেই। কষ্টগুলো জমতে জমতে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে। না পরিবার আছে, না ভালোবাসার মানুষটি, না আত্মীয়স্বজন, না বন্ধুবান্ধব। কেউই আজ তার পাশে নেই। সে আছে নির্জন কোনও দ্বীপের মতো একটি জায়গায় একা!


দুঃখের সময় কাউকে পাশে কাউকে না-পাওয়াটা দুঃখের চেয়েও অনেক বড়ো দুঃখ। নাতাশারও তা-ই হয়েছে। দুঃখগুলো বলার মতো আজ তার পাশে কেউ নেই। যার সাথে একটু কথা বলে মনটা হালকা করা যায়, এমন কেউ পর্যন্ত নেই। বড়ো নিঃসঙ্গ, একা লাগছে তার।


বাবা মারা যাবার কথা জানতে পারার পরও হিমু ফোন করে একটি বারও জানতে চাইল না, নাতাশা কেমন আছে, কী করছে, সামনে কী করবে। অথচ তার জন্যই আজ নাতাশার জীবনে এত ঝড়তুফানের সৃষ্টি। তার হাত ধরেই সব কিছু ছেড়ে চলে আসা। অথচ সে-ই কিনা আজ অন্য কারও হাত পেয়ে তাকে ছুড়ে ফেলে দিল জীবন থেকে! এমন নিষ্ঠুরও হতে পারে মানুষ!


হিমুর সাথে নাতাশার আজ সামান্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটিও নেই। প্রাক্তনের সাথে সম্পর্কটি আর নেই, এটুক পর্যন্ত মানা হয়তো যায়, কিন্তু তার সাথে বন্ধুত্বও নষ্ট হয়ে গেছে, এটা মেনে নেওয়াটা অনেক কঠিন।


মনে মনে নাতাশা খুব করে চাইছে, হিমু মাত্র একবার ফোন করে মিথ্যে মিথ্যে হলেও বলুক, ‘কেমন আছ, পাখি? কষ্ট পেয়ো না, আমি সাথে আছি।’ না, হিমুর সে সময় বা ইচ্ছে, কোনওটাই হয়নি। নাতাশার যন্ত্রণার তীব্রতাও তাই আর কমেনি।


আজ বাবা মারা যাবার চার দিন। বাবাকে নিয়ে একটা বড়ো চিঠি লিখল নাতাশা। চিঠির প্রতি লাইনে লাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই আদরমাখা শৈশব আর বাবার ভালোবাসা। বাবার হাসি, চোখ, গাল, নাক, ঠোঁট, গালভর্তি দাড়ি সব কিছুই যে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে সে! ডায়েরির পাতা ছুঁলেই যে ছোঁয়া যায় বাবাকে। আজ বাবা নেই। নেই সুখও। নেই জীবনের কোনও মানেও।


নাতাশার হাতে টাকাও শেষ। যে একটা টিউশন ছিল, ওটা থেকেও যেতে মানা করে দিয়েছে। এদিকে মেসের ভাড়া বাকি পড়ে আছে। রুমমেটদের কাছ থেকে দু-একবার ধার করেছে টাকা। সে টাকা শোধ করবে কী করে, সেটা তার জানা নেই। খাওয়ার জন্য কোনও খাবারও নেই রুমে। নাতাশা যে রুমে থাকে, সে রুমের মেয়ে তিনটাই রুমে নেই। ওরা বাড়ি গেছে বেশ কিছুদিন হলো। তাই সে একাই আছে রুমটাতে। সে বেশ রাশভারী, গম্ভীর প্রকৃতির হবার কারণে মেসের কেউ তার সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানতে পারত না তেমন।


এভাবে সে একসময় অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। রুম থেকে বের হয় না। সারা দিন দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে থাকে। কোন দিকে দিন হচ্ছে, কোন দিকে রাত হচ্ছে, সেদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। সারা দিন-রাতই সে উদাস হয়ে জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কারও সাথে কোনও কথা বলে না, তেমন খায়ও না। একেবারেই চুপচাপ। মেসের অন্যরা মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে আসে। তাদেরকে সে বেশ কৌশলে হাসিমুখে ভালো আছে জানায়, এবং সব সময় একা থাকতে চায়। এজন্য ওরা তাকে আর ডিস্টার্ব করতে চায় না। ওরা এটুকুতেই সন্তুষ্ট। ভাবে, হয়তো সে স্বাভাবিক আছে।


এ পৃথিবীতে কে কার মনের ভেতরের খবর জানতে পারে এক নিজে ছাড়া? সবাই-ই তো ব্যস্ত। সবাইকে যার যার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। এত ব্যস্ততার ভিড়ে অন্যের খবর নিতে পারে কয় জনে? কয় জনে দেখতে পায় অনন্ত চিতার আগুনে পুড়তে-থাকা হৃদয়ের ধূসর ধোঁয়া?


দিন দিন তার মানসিক অস্বাভাবিকতা, অস্থিরতা বাড়তে লাগল। ভেতরে ভেতরে সে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে হাতে টাকা শেষ। খাবারও শেষ। যে কয় টাকা আছে, তা দিয়ে চিপস কিনে এনে মাঝে মাঝে খায়। রুম থেকে বের হয় না তেমন একটা।


এরই মধ্যে সে ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।


নাতাশা এই কয়েক দিনে বেশ কয়েকটা কবিতা লিখে ফেলেছে। কিছু ফেইসবুকে পোস্ট করেছে, কিছু রয়ে গেছে ডায়েরিতে। হিমুর সাথে সম্পর্ক হবার পর থেকে তাদের দুজনের সব কথা, স্বপ্ন, ইচ্ছে, যত ভবিতব্য-ভাবনা ছিল, সবই যে ডায়েরিতে লিখত নানান অনুষঙ্গ যোগ করে করে। জীবনে এই লেখালেখি জিনিসটা নাতাশা বড়ো ভালোবাসে। ডায়েরির প্রতিটি পাতাই তার কাছে সন্তানের মতো স্নেহতুল্য, পরম আদরের।


এভাবে আধপেট খেয়ে না খেয়ে তার দিন কাটতে লাগল। আজ বাবার মৃত্যুর সপ্তম দিন। নাতাশা গত দুদিন ধরে কেবল চিপস আর পানি খেয়ে কাটিয়েছে। দশ টাকা দামের চিপস। ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত মোচড়ে মোচড়ে উঠছে। কিন্তু হাতে টাকা নেই। কারও কাছ থেকে ধার নেবে, এমনটাও করতে ইচ্ছে করছে না। ছোটোবেলা থেকে হাতপাতার স্বভাবটা একদমই নেই তার। আত্মসম্মানের জায়গাটা বড়ো শক্ত ধাঁচের নাতাশার। এই আত্মসম্মানের কাছে ক্ষুধা কেন, জীবনটাও বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই তার।


আজকে অনেক দিন পর বাসা থেকে বের হয়ে বিকেলে বাসার সামনে নাতাশা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল এলোমেলো পদক্ষেপে। রাস্তায় সে একটা কুকুরকে দেখল যে খুব ক্ষুধার্ত ছিল। সম্বল বলতে একটা দশটাকার নোটই আছে ওর সাথে। ওটা দিয়ে এক প্যাকেট বিস্কিট কিনে দুইটা নিজে খেল। বাকিগুলো কুকুরটাকে খেতে দিল। বিস্কিট পেয়ে কুকুরটা আনন্দে খুশিতে গদগদ হয়ে গপাগপ খেয়ে নিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে সে ক্ষুধার্ত হয়তো। নাতাশা একদৃষ্টিতে কুকুরটির দিকে তাকিয়ে আছে। কুকুরটার তৃপ্তি দেখে নাতাশার মনে অদ্ভুত রকমের শান্তি লাগছে। আহা, বড়ো সুন্দর সে দৃশ্য! খাওয়া শেষে কুকুরটা কেমন একটা কৃতজ্ঞতার চোখে নাতাশার দিকে মায়া মায়া মুখ নিয়ে একপলক তাকিয়ে দ্রুত কোথায় জানি চলে গেল।


কুকুরটা কথা বলতে জানলে হয়তো মুখ ফুটে ধন্যবাদ বলত। নতুবা সাধ্য থাকলে বুকে টেনে নিত। বোধহয় ঘরে তার ক্ষুধার্ত সন্তান আছে। সে কি দৌড়ে চলে গেল সন্তানকে দুধ খাওয়াতে? আহারে, কৃতজ্ঞতাবোধ শুধু মানুষেরই নেই, এই রাস্তায় অনাদরে বেড়ে-ওঠা প্রাণীগুলোর ভেতরেও আছে। কোন যুক্তিকে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়, তার কোনও সঠিক যুক্তিই সে খুঁজে পাচ্ছে না। অবশ্য, মানুষকে নিয়ে বলা ভালো ভালো সব কথাই তো মানুষেরই মুখ থেকে বেরিয়েছে। সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টির সেরা জীব ঘোষণা করেছে। সে আরও কত কী বলে ফেলে নিজেকে নিয়ে! সত্যিই হাস্যকর!


ভাবতে ভাবতে নাতাশা রাস্তার পাশের গাছ, পাখি, ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত জনমানব দেখে নিচ্ছে প্রাণভরে। মৃদু ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। ভালোই লাগছে তার। কতদিন এভাবে গায়ে বাতাস ছোঁয়ানো হয়নি। কতদিন কোনও খোলারাস্তার মোড় দেখা হয়নি। আজকে কেন জানি নাতাশার কাছে সবকিছুই অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ইস্‌ এখন যদি সাথে হিমু থাকত!


কিছুক্ষণ রাস্তায় হেঁটে নাতাশা বাসার ছাদে উঠেছে। ছাদের মেঝেতে মেঝেতে এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এসেছে। চারদিক থেকে অন্ধকার এসে ভর করছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে। এর আগে কখনও পাখির ওড়াউড়ি মন দিয়ে দেখা হয়নি তার। আজ দেখছে। বাহ্‌! এত সুন্দর করে পাখি ওড়ে! আগে কখনও খেয়াল করেনি কেন সে? কীসের অত ব্যস্ততা ছিল তার? সে ব্যস্ততা কি এই সৌন্দর্যের চেয়েও দামি? সত্যিই?


লোকে যে বলে আকাশ নীল, অথচ আকাশে তো অনেক রংয়ের সমাহার। সাদা, কালো, নীল, ধূসর সব রঙই তো আছে। অথচ ওরা কিনা বলে আকাশের রং নীল। আকাশ যে এত বিশাল, আগে কখনও দেখা হয়নি কেন তার? আজকে সে অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে, যা আগে কখনও খেয়ালই করেনি। আজ সব নতুন নতুন, বড়ো সৌন্দর্যে ঠাসা ঠাসা লাগছে। প্রকৃতি এত সুন্দর, সে আগে দেখেনি কেন?


নাতাশার মনে আজ হঠাৎ কী যেন উদাসীনতা। গাঢ় অন্ধকার সন্ধের মতো জীবনটা ঘন আঁধারে ভরা। কিছুক্ষণ নীরবতা। ফেলে-আসা অনেক কথা মনে এসে যাচ্ছে। স্মৃতিগুলো ফুলকির মতো ঝলক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। মনে হচ্ছে, এই তো গতকালই তো বোধহয় বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। এ সবই তো সেদিনের কথার মতো মনে হচ্ছে। যেন চাইলেই দিনগুলি ছোঁয়া যাবে হাতে, হাত বাড়ালেই বুঝি স্মৃতিগুলি খপ করে ধরে ফেলা যাবে। চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্মৃতিগুলি। আজ নাতাশার বড়ো ক্লান্ত লাগছে। মায়া মায়া লাগছে সব কিছুই। তবুও কেন তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না? এই সুন্দর পৃথিবীটা আরও একটু দেখার লোভেও কি বেঁচে থাকা যায় না? কেন এতটা চলে যাবার তাড়া অনুভব করছে সে?


ছাদ থেকে নেমে রুমে ঢুকেছে নাতাশা। এখন রাত দশটা। বিছানার পাশে একটা চিপসই বাকি। ওটা খেয়ে নিল। এক গ্লাস পানি খেল। ব্যাগে-থাকা আয়নাটা বের করে নিজেকে দেখে নিচ্ছে সে। আজ প্রথম বারের মতো নিজেকে দেখে মুগ্ধতা তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে। তার কপালের বামে একটা কালো তিল আছে। ভ্রূজোড়া সাপের মতো সর্পিলাকার। এসব সে আগে কখনও খেয়াল করেছে কি?


আজ নাতাশা সাজবে নিজের মতো করে। সাজগোজের যত কসমেটিক ছিল, সবই সে বের করেছে। মেকাপ ব্যাপারটা নাতাশার বরাবরই অপছন্দের। কোনও বিয়েবাড়ি কিংবা বড়ো আয়োজন ছাড়া তেমন সাজে না সে। হালকা সাজেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ওভার-মেকাপ তার বরাবরই অপছন্দ।


গাঢ় লাল রংয়ের লিপস্টিক পড়েছে সে। কপালে কালো টিপ। হিমুর কিনে-দেওয়া চুড়িজোড়া হাতে আর মায়ের কিনে-দেওয়া নীল শাড়িটা পরেছে। ছোটোবেলায় বাবা শখ করে তার জন্য পায়েল এনেছিল। তখন ছোটো পায়ে পায়েল দুটো হতো না। যদিও এখন হয়, তবে একটু আঁটসাঁট হয়। পায়েল জোড়া পায়ে সেঁটে নিয়েছে সে। চোখে ঘন করে কাজল টেনে দিয়েছে। হরিণীর মতো টানা টানা চোখ দুটো আরও টানা টানা লাগছে।


বাহ্‌! শ্যামাঙ্গী এই শরীরে এত যে রূপ ছিল, কেউ কখনও খেয়ালই করেনি। সে নিজেও জানত না এটা। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আছে সে আয়নার দিকে। দুচোখ ভরে নিজেকে দেখে নিচ্ছে সে!


নাতাশা খেয়াল করল, তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। জলবিন্দুগুলো হাতের তালুয় জমা হচ্ছে। তবুও আয়না থেকে সে চোখ সরাচ্ছে না। কাঁদলেও মানুষকে এত সুন্দর লাগতে পারে? কিন্তু সে তো কাঁদতে চাইছে না। মন থেকে তো সে আজ কাঁদছে না। তবু কেন চোখের সীমানা গলে জলধারা শাড়ির কিনারা ভিজিয়ে দিচ্ছে? তবে কি তার ভেতরে আরও একজন আছে, যে কিনা তার দুঃখে কেঁদে ফেলে? তা-ই তো মনে হচ্ছে! সে তো একা না, তার ভেতরে আরও এক সত্তা আছে, যে তাকে ভালোবাসে হয়তো! আছেই তো! নইলে কাঁদছেটা কে এই মুহূর্তে?


ডায়েরিটা খুলে কিছুক্ষণ লিখল সে। শব্দহীন চোখের জল ডায়েরির পাতা ভিজিয়ে নরম করে দিচ্ছে। ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস পোস্ট করল।


এখন রাত সাড়ে তিনটা। ফোন বের করে হিমুর নম্বরে কল দিয়েছে। হিমু ওয়েটিং-এ। দশ মিনিট পর সে আবার কল করল। এবার ফোন রিসিভ করে হিমু কেমন জানি নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছ, নাতাশা?’


অনেক দিন পর হিমু এত দরদি কণ্ঠে তার কুশল জিজ্ঞেস করল। বড়ো ভালো লাগছে তার। নাতাশা মৃদু হেসে জবাব দিল, ‘কাল থেকে খুব ভালো থাকব, কথা দিচ্ছি।’


নাতাশার কথার মর্মার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি হিমু। অবশ্য, যে নাতাশাকেই বোঝে না, সে নাতাশার কথার অর্থ বুঝবে কীভাবে?


নাতাশা প্রশ্ন করল, ‘প্রেমিকা তোমায় ভালো রেখেছে তো? ভালো আছ তো?’
হিমু কেমন ইতস্তত করছে। প্রসঙ্গ পালটাতে চাইছে। বোঝা যাচ্ছে, সে তার রিলেশনের ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ। নাতাশাও আর দ্বিতীয় বার কথা বাড়ায় না। কথা বলার কোনও কিছু না পেয়ে হিমু নাতাশার বাবার মৃত্যু নিয়ে একটু শোকপ্রকাশ করল। বলল, সে ব্যস্ততার কারণে দেখতে যেতে পারেনি।


নাতাশা কিছু বলছে না। চুপচাপ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইনটা সে নিজেই কেটে দিল।


হিমু আর কলব্যাক করেনি। হয়তো ভেবেছে, ‘যাক্‌, বাঁচলাম!’ সে যে সত্যি সত্যি বেঁচে যাচ্ছে ‘নাতাশার হাত থেকে’, এটা হিমু মাথায় আনতে পারেনি!


এবার নাতাশা বাড়ির নম্বরে ফোন করেছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে নাতাশার মা হ্যালো শব্দটি বলল। সাথে সাথে নাতাশার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। অনেক দিনের তৃষ্ণার্ত চাতকের একবিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা পাবার সুখের মতো করে সারা শরীর-মন কেমন এক শীতলতায় ভরে গেল। শহর ছাড়ার পর থেকে এই প্রথম মা তার ফোন ধরেছে। অবশ্য ঘুমের ঘোরে বলেই হয়তো। চেতনায় থাকলে নিশ্চয়ই নাতাশার নম্বর রিসিভ করত না।


ওপাশে মা দু-এক বার হ্যালো হ্যালো করছে। এপাশে নাতাশা কোনও কথা কথা না-বলে মায়ের কণ্ঠটা শুনে নিচ্ছে প্রাণ ভরে। কথা বললে কণ্ঠ চিনতে পারলেই মা লাইন কেটে দেবে। তাই সে কোনও শব্দ করছে না। কিন্তু চোখ বেয়ে দরদর করে জল ঝরছে। বলুক না, মা এভাবে আরও দু-এক বার হ্যালো বলুক। বড়ো শান্তি শান্তি লাগছে। অনেকগুলো বছর ধরে এত শান্তি পাওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে লাইন কাটার শব্দ।


রাতের গভীরতায় পৃথিবী যতই নীরব হতে থাকে, মানুষের মনের গভীরের সরবতা ততই বাড়তে থাকে। এখন ভোররাত সাড়ে চারটা। গভীর রাতের শেষে ভোরের আগ মুহূর্ত। দুটো ডায়েরি থেকে কবিতার ডায়েরিটা বিছানার পাশে রেখে দিয়ে বাকি ডায়েরির প্রত্যেকটি পাতা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে দেশলাইয়ের আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে নাতাশা। দাউ দাউ করে এত বছরের পুরনো ডায়েরিটা পুড়ে চোখের সামনে ছাই হয়ে যাচ্ছে, আর নাতাশা একদৃষ্টে পুড়ে-যাওয়া ডায়েরির দিকে তাকিয়ে আছে। পোড়া শেষ হবার পর ছাইগুলো হাতে নিয়ে সে চুমু খেল কয়েকটা।


এবার রুমের চেয়ারটাকে খাটের উপর তুলে ওটাতে দাঁড়িয়ে ফ্যানের সাথে শক্ত করে ওড়না পেঁচালো সে। পেঁচানো ওড়নায় ধরটার ঊর্ধ্বাংশ বেঁধে দিয়ে পায়ের তলার চেয়ারটাকে একলাথিতে খাট থেকে নিচে ফেলে দিল। কিছুক্ষণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে গেল নাতাশা। তার শরীরটা ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে বড়শিতে ঝুলে-থাকা মরা মাছের মতো।


নিথর নিস্তব্ধ নাতাশার শরীর ঝুলে আছে ফ্যানের সাথে আটকানো ওড়নার ফাঁসে।