সমান্তরালে

- এভাবে কাজ করলে কাল থেকে আর আসার দরকার নেই, আমিনের মা। তুমি চলে যাবার পর তোমার কাজগুলো আবার আমাকেই দেখতে হয়। কাপড় ধুলে পরিষ্কার হয় না, প্লেটে ময়লা থেকেই যায়। সেদিন ওর বাবার সাদা শার্টটা বেশি গরম পানিতে ভিজিয়ে কী অবস্থা করেছ দেখো, নিজের চোখেই দেখো।


এই কথা শুনে শেফালির মাথায় যেন বাজ পড়ল। এরকম একটা ভয়ংকর সময়ে, যখন সব জায়গায়ই তার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ কাজে ডাকে না, তখন এই বাসা থেকে বিদেয় করে দিলে সে বাঁচবে কী করে!


এই তো সেদিন সামিহাদের বাসার গেটের কাছে সে প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল। বলেছিল, ‘আফা, আমি মুখ ঢাইক্কাই কাম করমু, হাত ধুমু একটু পরে পরেই। আপনার মাইয়াডার কাছেও যামু না। আফা, আমারে অর্ধেক ট্যাকা দিলেই চলব।’
কেউ গেইটটাও খোলেনি।
বাইরে থেকে বাজার করে ফেরার সময় সামিহার বাবা শেফালিকে দেখে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই এই, কী করিস এখানে? আসতে নিষেধ করিনি?’ এই বলে কিছু খুচরো টাকা ওর দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘যা বেরিয়ে যা, এক্ষুনি বের হ!’


- আফা, ও আফা, আফা গো…হুনেন, এইরহম কইরেন না, ট্যাকার চিন্তায় আর পোলাপানের চিন্তায় আমার মন চইলা যায় এদিক সেদিক। তাই…এরপর থিকা আর এইরহম হইব না, আফা।
- এত কথা শুনতে চাই না। তুমি কাল থেকে আর এসো না।
- আফা, আমার পোলাপাইনগুলা না খাইয়া মরব। আমি আপনার পায়ে ধরি! আফা, ও আফা…
- উঁহু উঁহু…পা ধরতে আসবে না, দূরে দাঁড়াও!


পাশের বাসা থেকে এই চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছিল নয়ন। সে মেসে থাকে। ওর ছোটো দুটো ভাই-বোন স্কুলে পড়ে। বাবা অসুস্থ, কিছু করেন না এখন, চোখেও ছানি পড়েছে, অপারেশন করাতে হবে। তিনি ঠিকমতো দেখতে পান না। মা কী করে সংসার সামলাচ্ছেন, কে জানে! এই সময়ে বাড়িতে ফোন করারও সাহস হয় না নয়নের। ও একাই মেসে আছে, রুমমেটরা সব বাড়ি চলে গেছে। ওদের বাড়িওয়ালা খুব ভালো মানুষ, তাই ওঁকে তার ফ্যামিলির কন্ডিশন বুঝিয়ে বলে নয়ন সেখানে থেকে গেছে।


ভালো রেজাল্ট করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে নয়ন, তা না হলে ঢাকা শহরে আসার কথা সে কল্পনাও করেনি কখনও। আসার পর থেকে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালায়, বাসায়ও কিছু টাকা পাঠায়। সে অনেক খাটেও সারা দিন। খালা আসে না মেসে, নিজের রান্না নিজেই করে নেয়। এসময় ওর এইচএসসি পরীক্ষাটাও আটকে গেছে, কবে হবে কেউ জানে না। নাদিয়াই একমাত্র স্টুডেন্ট, যাকে এখনও সে পড়াতে পারছে। ওর মা অনেক সিরিয়াস ওর পড়াশোনার ব্যাপারে।


সেদিন মেসে ফিরে শুয়ে শুয়ে নয়ন ভাবছিল নাদিয়ার আম্মুর গতকালের কথাগুলো। রমজান মাস, ইফতারের পর শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগে। তার মধ্যে নয়ন সেহেরি আর ইফতার দুই সময়েই শুধু চিড়ে ভিজিয়ে খায়।


ইদানীং নাদিয়াকে পড়াতে যেতে একটু দেরি হয় তাই। ইফতারের পর শরীরটা আর চলেই না যেন।
নাদিয়ার আম্মু বলছিলেন, ‘এত দেরিতে এসে কী লাভ, বাবা? তুমি দেরি করে পড়িয়ে গেলে তোমার যাবার পরে নাদিয়া আর পড়তেই চায় না। আর এরকম সময়ে তোমার আসতেও কষ্ট হয়, বুঝি। বাবা, বলি কী, তার চেয়ে বরং…’


কথাটা শেষ হবার আগেই ফোন বেজে ওঠায় ওপাশের রুমে চলে যান নাদিয়ার মা। নয়ন ঠিকই বুঝতে পারে ওই টেনে টেনে সুর করে কথা বলার মানেটা!


তিনহাজার টাকা বেতন। আর যাতায়াত বাবদ দুইশ টাকা, যদিও সে হেঁটেই যায়। পনেরোশো টাকা বাড়িতে পাঠাতে হয়। যদি টিউশনিটা চলে যায়, সেও কি আমিনের মায়ের মতন করে নাদিয়ার মায়ের পায়ে পড়তে পারবে? বলতে পারবে, ‘কাল থেকে আর দেরি হবে না। আমাকে বাদ দিয়েন না। আমার বাবা, মা ছোটো ভাই-বোনগুলো না খেয়ে…’?