সাঁকো ভাঙার পর

 
বছরগুলি চলে গেছে তেমন কোনও চিহ্ন না রেখেই,
সাথে চলে গেছ তুমি, আর ফিরে আসছ না।
একজন মানুষ মারা গেলে অন্যজনের জন্ম হয়,
সূর্য ওঠে, অস্ত যায়। সবকিছুই চলছে আগের মতই।
আমি তোমাকে মিস করছি, আমার রাত আর দিন-গুলিতে তোমাকে খুঁজছি।


তোমার সেই চোখ, সেই হাসি কোথায় হারিয়ে গেলো?
যখন প্রথম হেসেছিলে, মনে পড়ে, খুব খুশি হয়ে উঠেছিলাম।
কষ্ট পেলে যেদিন, খুব কান্না পেয়েছিল, দেখাইনি যদিও।
ভালোবাসার মানুষের সামনে কাঁদতে অনেক শক্তি লাগে,
সেইদিন বুঝেছিলাম। আজ বুঝি,
আমি ভালোবাসা বুঝেছি, তোমাকে বুঝিনি।


তুমি যখন আমার সাথে ছিলে, খুব ভাল থাকতাম,
আমি মানুষ, প্রাণী, পৃথিবী ভালোবাসতাম……
তুমি হয়ে উঠেছিলে এইসবের বাইরে চতুর্থ এক সত্তা,
আমি যখনই আমার দিকে তাকাতাম, কেবল তোমাকেই দেখতে পেতাম।
সত্যি করে বলোতো, আমায় ছুঁলে তোমায় টের পেতে? আমি তো পেতাম!


তোমাকে ভীষণ মিস করছি, আমার আনন্দ ফুরিয়ে বিষাদ এসেছে,
শুধুই তোমার কথা মনে পড়ে আর নীরবে কাঁদি। জলের গ্লাসটা হাতে নিয়েও
মনে হতে থাকে, এই বুঝি তুমি জল খাইয়ে দেবে! ভাতের প্লেট সামনে রেখে
অনন্তকাল বসে থাকলেও কেউ মেখে খাইয়ে দেবে না। অবোধ হয়ে দেখানো যায়,
এমন কেউ আর নেই। এইসব মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে!


আমি এখনো তোমাকে ভেবেই উষ্ণশ্বাস হাওয়ায় মিশিয়ে দিই,
অনেক কথা লিখেও ঠিক বোঝাতে পারব না, তুমি আমার কাছে কী ছিলে,
আছ, এবং থেকে যাবে। যদি তুমি আর কখনও ফিরে না আস,
এ জীবন কাটিয়ে দেওয়া আমার কাছে কঠিন এক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে।


ধোঁয়াটে কফিবারে গেলে তোমাকে মনে পড়ে।
সেখানে আমি এবং আমার বন্ধুরা, সবাই আছি,
তুমিই শুধু নেই। এটা ভাবলে আমার চশমা মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে যায়।
যখন কেউ খুব মাতাল হয়ে পড়ে, তখন
সে তার ভদ্র ও নির্বোধ কৈশোর ভুলে যায়।
সন্ধে নামলেই রাস্তায় নেমে সোজা কফিবারের দিকে চলে যাই,
স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই, সেখানে কৈশোর আসে না, যৌবন এবং সাথে
অবধারিতভাবেই তুমি চলে আসো। আমারই-বা কী দোষ, বলো,
আমার স্বপ্নই তো আমাকে মাতাল করে রেখেছে!


তুমি আসার আগে আমার কাছে এ বিচক্ষণ ও পুরানো
পৃথিবীটা নতুন ছিল, অচেনা ছিল। বড়ো হয়ে ওঠার সুবাদে
আমরা যান্ত্রিকতা ও ইতিহাস শিখে ফেলি খুব সহজেই,
সাহিত্য, সংগীত, শিল্প……এইসব শেখাও শক্ত কিছু নয়,
এবং অ্যালকোহলের সাথেবিরোধ না করেও দারুণ বেঁচে থাকা যায়,
কীভাবে জানি এটাও মাথায় সেট হয়ে যায় একসময়। জীবনের মানে মূলত
চিৎকার, মারধর এবং লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন। ইউরোপে অবিশ্বাস
রাখা ফ্যাশনের অপরিহার্য অঙ্গ, এমন ভাবনা মাথায় রেখে জীবনের
পূর্বভাগ কাটানো লোকেরা একসময় তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইয়োরোপে চলে যায়।
………লোকে এইসব দেখে বড়ো হয়।


সকল সংস্কার ও সংস্কারক সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে বিব্রত
হচ্ছি, পৃথিবীর সমস্ত বিশৃঙ্খলার সাথে বচসা করছি,
নীরস, দুঃখী ও শুকনো কফিবারে ক্লান্ত ও বুড়ো হচ্ছি, এমন সময়েই
তুমি এসেছিলে। এই ছোট, সস্তা কফিবারে জীবনের
সেরা কফির স্বাদটি পেয়েছিলাম। জানো, বৃদ্ধার কণ্ঠে গান করতো যে মেয়েটি,
সেও প্রতিদিন নিয়ম করে আসে, শুধু তোমাকেই
দেখি না আর। গত রোববারের পর অনেক যুগ পেরিয়ে গেছে যেন……


তুমি নেই। সন্ধেয় আকাশ আজও আগের মতোই জ্বলে ওঠে,
রাস্তা শেষ হয়ে গেলে ভ্রমণের উচ্ছ্বাস মৃত হয়ে যায় বুঝি,
তাইতো তুমি চুপচাপ বসে আমাকে কাঁদতে দেখো! জানি, ভালই আছ!
কি হৃদয়, কি বোধ, কি স্মৃতি, কি প্রেম, কোনোকিছুকেই পরোয়া না করে
ভাল থাকতে জানার আর্টটা নতুন শিখতে হয়নি তো, তাই না?


আমার চোখে তোমার চোখ আগের মতোই নীল,
আহা, সে চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল
গোধূলির বাঁকানো আলোয় হেসেছিল,
এবং কিছু মিঠেকড়া রৌদ্রপার্কে আমাদের চুপিকথা কানপেতেশুনেছিল।
তুমি কি আমাকে কখনোসখনো মনে কর?
……এর উত্তর আমি জানি না, শুধু এইটুকু জানি,
আমি কোনোভাবেই একদিনও তোমাকে ভুলে থাকতে পারি না।


নিঃশব্দে বিরক্তিকর দিনগুলি কেটে যাচ্ছে, তবু……
তোমাকে মনে না করেও যে বেঁচে থাকা যায়,
আমি নিজেই একসময় ওরকম করেই বেঁচে ছিলাম,
এখনো আমি তোমাকে মনে না এনেও দিব্যি বাঁচতে পারি,
মানুষ চাইলে করতে পারে না, এমন কিছু নেই………
এইসব চিরন্তন প্রবোধে বিশ্বাস আনতে আমার খুব কষ্ট হয়।


আচ্ছা, বলে দাও না, আমি আজকের জ্যোৎস্নায় কার হাত ধরে হাঁটব?
জানোই তো, আমি বেশিরভাগ লোকের চেয়ে আলাদা, তাই
আমাকে সহ্য না করাই অধিক সঙ্গত, এটাই সবার ধারণা।
তবে আমি এখন কার সাথে কথা বলব?
চলার পথ ধূসর হয়ে এলে কোথায় এসে থামব?
দুঃখে ও যন্ত্রণায় কিংবা খুব কান্না পেলে
কার কাছে গিয়ে বাঁচার চেষ্টা করব?
আমার জীবনে এখন আর সূর্য ওঠে না,
যৌবন মধুর, নিজের প্রতি খুব যত্ন নিয়েও এটা মাথায় আনতে পারি না।


আমার সবকটা দিনই নীরবতার ও বেদনার।
কতটা ভয়ানক এই অন্তহীন নীরবতা, তা তুমি ভাবতেও পারবে না!
আমার স্বচ্ছ শার্ট ভেদ করে ঠাণ্ডা কুয়াশা ঢুকে পড়ে,
ভরাট বাতাসকে হঠাৎ খালি করে দেয় নৈঃশব্দ্যের তীব্র চিৎকার,
জীবনের উদাত্ত আহ্বান শুনলেই আঁকাবাঁকা ও অর্থহীন পথে ছুটে যাই,
অন্ধকার দিন ফুরোলে প্রতি সন্ধ্যায় একশো সূর্য নির্দয়ভাবে জ্বলে ওঠে,
মাতাল হয়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরে আমি গাইতে থাকি পুরানো সেইসব গান,
যেইসব গান আমাদের সন্ধেগুলিকে মসৃণ পথে রাতের অনন্ত আলোয় নিয়ে যেত।