সাঙ্ক-কস্ট

দৃশ্যপট ১।

গ্লোরিয়া জিন্সে বসে কফির অর্ডার করলেন। কফি এল। আয়েশ করে কয়েক চুমুক দিলেন। আহ্‌, অপূর্ব! হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা বিশ্রী পোকা উড়ে পড়ল কফির মগে। এখন কী করবেন? কফিটা খেয়ে নেবেন? না কি ফেলে দেবেন? ফেলে দিলে তো টাকাটাও জলে গেল। কিন্তু একটা মরা পোকা ভাসছে, পোকার গা থেকে কী সব বেরিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে কফিতে, এরকম কফি তো খাওয়াও যায় না। কী করা যায়? এত দামি কফি! টাকা জলে দেওয়ার কষ্ট অনেক! ভাবছেন তো ভাবছেনই! সময় কেটে যাচ্ছে, তবু কফির দামের মোহ কিছুতেই কাটছে না। একটা চামচ দিয়ে পোকাটা সরিয়ে একগাদা ঘেন্না আর বিরক্তি নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে কফিটা শেষ করলেন। এভাবেই কাটল অনেকটা সময়। ওয়েটার বিল দিয়ে গেল। বিলটা মিটিয়ে মেজাজ খারাপ করে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। আজকে সৃজাকে পড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, আন্টি আজ বেতন দেবেন, তার উপর কালকে ওর ম্যাথ সেকেন্ড পার্ট একজাম। দেরি হয়ে গেছে, মনমেজাজও ভালো না। আজকেও গেলেন না। গত ৩ দিন ধরেই যাচ্ছেন না। আন্টি ফোনে বলেছেন, “বাবা, তুমি না পারলে সৃজার জন্যে একজন ভালো টিচার খুঁজে দাও। সামনেই তো ওর ইন্টার পরীক্ষা।” ভাবতে লাগলেন, “টিউশনিটা এবার আর থাকবে না বোধ হয়। শালার কফি! পুরাই ফ্রুটলেস! পয়সাও গেল, সময়ও গেল। মেজাজ তো খারাপ হলোই। এই বাজারে একটা টিউশনি ম্যানেজ করা যে কী কষ্ট, একে ধরা লাগে, ওকে ধরা লাগে। হাতে ধরে এভাবে কেউ টিউশনি খোয়ায়?! আরেকটু আগে বের হলেই তো টিউশনিটা আর মিস হতো না। নিজের মাথার চুল নিজের হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। থাক, না ছিঁড়ি। চেষ্টা করলে টিউশনি হয়তো আরেকটা ম্যানেজ করা যাবে, কিন্তু চুল তো আর ম্যানেজ করা যাবে না। হেয়ার-প্ল্যান্টেশনে অনেক খরচ! টিউশনির বেতনের ডাবল। সৃজার বাবা অত টাকা দেবেন না। শালা হাড়কিপটে; বেতন বাড়ায়ই না!” এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলেন! ম্যানহোল ছিল, খেয়াল করেননি।

গায়ে নর্দমার ময়লা মাখামাখি। কোনওরকমে বাসায় এলেন। বহুকষ্টে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে কিছুসময় ঘুমিয়ে নিলেন। ঘুম ভেঙেই নিজের ভাগ্যকে গালিগালাজ করে চলছেন সমানে। হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, আপনার সাথে টয়লেটের ডিরেক্ট কানেকশন হয়ে গেছে। রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে বাথরুমে দৌড়োতে হলো সতেরো বার। রাতেও কয়েক বার ঘুম ভাঙল সে অমোঘ ডাকেই। পরদিন ডাক্তারের কাছে গেলেন। ওষুধ কিনে বাসায় এলেন। সেই স্ট্রং-ডিসেন্ট্রি সারতে সময় লাগল তিন দিন। এ তিন দিনে বাথরুম ছাড়া আর কোথাও যেতে পারলেন না। টিউশনিটাও চলে গেছে। সৃজার মায়ের সাফকথা: সে মাসে মাত্র ৭ দিন পড়ানোর জন্য পুরো মাসের বেতন দিতে পারবেন না। ওদের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছেন আপনি। আপনার জন্য সৃজার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে! এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে? মাঝখান থেকে আপনি আগের মাসের বেতনটাও পেলেন না। ওদিকে এর মধ্যেই আপনার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে হাজারখানেক টাকা। মূল্যবান সময় খর্চা হয়েছে পাইকারি দামে! আহা, কফির কী লীলা!

দৃশ্যপট ২।

সোল্ড-আউট! টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, তাই অনেক চেষ্টা করে দ্বিগুণ দাম দিয়ে দুইটা টিকিট কোনওরকমে ম্যানেজ করলেন। আপনার স্ত্রীসহ মুভি দেখবেন। ব্যাপক হিট মুভি! টিকিটই পাওয়া যায় না! ভালো তো হবেই! মুভিটা সম্পর্কে কোনও রিভিউ না দেখেই তাই ২টা কিনে ফেললেন বউকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে! বাসায় ফিরেই নাটকীয়তার সাথে চ্যাঁচামেচি করে বউকে বললেন, চোখ বন্ধ! দেখো দেখো, কী এনেছি! তুমি কালকে সন্ধ্যায় ফ্রি তো? বউ টিকিট দেখেই অগ্নিশর্মা! তোমার রুচিবোধ এই পর্যায়ে নামল কবে থেকে? এসব সস্তা মুভি না দেখলে তোমার হয় না? ছিঃ! আমি যাব না তোমার সাথে। তুমি কোনও সস্তা রুচির মেয়েকে নিয়ে মুভি দেখে আসো গিয়ে। আপনি বুঝিলেন, ইহা অনুরোধ নহে, ইহা থ্রেট। ড্রেস না ছেড়েই তখুনি আইএমডিবি আর রোটেন টম্যাটোজ-এ রিভিউ দেখতে বসে গেলেন। আসলেই মুভিটা আপনার রুচির সাথে যায় না। কিন্তু, কী যুদ্ধটাই না করে টিকিটদুটো ব্ল্যাকারের কাছ থেকে ম্যানেজ করলেন! আচ্ছা, এ মুভি সবাই এত দেখছে কেন? আসলে জনপ্রিয় হলেই সব কিছু ভালো হয় না।

ভাবলেন, ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিই। দেখি, কেউ কিনে কি না। অ্যাট লিস্ট টিকিটের দামটা উঠুক। দিলেন স্ট্যাটাস। আপনার বন্ধুরা আপনাকে পচাতে পচাতে দুর্গন্ধ করে ছেড়ে দিল। কেউ একজন কমেন্টে লিখল, শালা খারুজের বাচ্চা! মুভি আর পাস না। তুই এই টিকিটও পয়সা দিয়া কিনসস! হে হে হে… আবার কস, ডাবল দামে না বেইচ্যা অরিজিনাল দামে বেচবি! হালা ফইন্নির ঘরের ফইন্নি!… দেখলেন, আপনার স্ট্যাটাসে লাইক ২টা, আর ওই কমেন্টে লাইক ১৮টা! বউ দেখে বলল, এই টিকিট বেচার স্ট্যাটাস দিতে তোমার লজ্জাও করল না? ছিঃ! কার সাথে সংসার করছি আমি!… নারিকেল গাছ খুঁজতে লাগলেন, নারিকেল গাছের আগায় উঠে গলা ছেড়ে কাঁদতে পারলে অন্তত একটু শান্তি লাগত। নাহ্‌! একটাও নারিকেল গাছ নাই আশেপাশে, সবকটাই ডাব গাছ। পরের দিন সন্ধ্যায় একবুক সাহস সঞ্চয় করে বউকে অফার করলেন, চলো না, নাহয় দেখেই আসি! বাসায় তো আর তেমন কোনও কাজ নাই। বাসায় রান্না করার দরকার নাই, আজকে আমরা বাইরে ডিনার করব। বউ টিকিটদুটো হাতে নিয়েই ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে বলল, ওয়াও! গ্রেট! চলো, আজকে বাইরে ব্যুফে খাই! প্যাঁচা প্যাঁচা মুখ করে ভাবতে লাগলেন, হে ধরণী! দ্বিধা হও, আমি গাছে উঠি! শালার সিনেমার গুষ্ঠি কিলাই!!

আচ্ছা, একটু ভাবুন তো!

যদি রেস্টুরেন্টে কফিটা ফেলে রেখেই বিলটা দিয়ে উঠে পড়তেন, তাহলে কিন্তু অত ঝামেলা আর হতো না। কফির ৬৭৫ টাকা গেল। ওটার কথা বাদ। ওটা তো যেতই! এর সাথে পোকার জীবাণু আর ঘেন্না মিলে আপনাকে বাসায় আটকে রাখল টানা তিন দিন, ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার গাড়িভাড়া আর ফি গেল ফাও, সে তিন দিনে অন্য কোনও কাজও হলো না, জীবনকে অভিসম্পাত করতে হলো অনর্থকই, বোনাস হিসেবে দুই মাসের বেতন না নিয়েই ভালো টিউশনিটা হারাতে হলো।

এখন মুভির কথায় আসি। টিকিটদুটো জাস্ট জানালা দিয়ে প্রথমেই ছুড়ে ফেলে দিলেই কিন্তু আপনার দুনিয়ার পেইন আর নিতে হতো না, সম্মান আর ব্যুফের খরচ দুইই বাঁচত। টিকিটের টাকার শোকে নিজের বোকামির জন্য আরও কত শোক সামলাতে হলো!

যে টাকাটা জলে গেছে, সেটা তো গেছেই! মানে, জলে ডুবে গেছে। The cost sank. So, it’s a ‘sunk cost’. জলে ডুবে-যাওয়া টাকার জন্যে মন খারাপ করে থাকতে হয় না। যদি সে টাকাতেই মন আটকে থাকে, তবে আরও কিছু টাকা যাবেই যাবে। আমার নিজের গল্প বলি। কোচিং সেন্টার এমন একটা আদরের জিনিস, যা বন্ধ করব করব করেও করা যায় না। কত সময় দিয়েছি এটাকে আজকের অবস্থানে আনতে! কী পরিমাণ কষ্ট করে না খেয়ে না ঘুমিয়ে একার হাতে এত বড়ো একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো! ভাবা যায়! এটাকে ছাড়ব কী করে? অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনও কাজ শুরু করার সবচেয়ে সহজ উপায় একটাই: কাজটা সত্যি সত্যি শুরু করে দেওয়া। একটা কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার একমাত্র উপায়, অত চিন্তাভাবনা ছাড়াই কোচিং সেন্টারটা বন্ধ করে দেওয়া। টিউশনি ছেড়ে কম বেতনের চাকরিতে ঢোকার একটাই উপায়, টিউশনি ছেড়ে দেওয়া। কোনও একটা উৎস থেকে হাতে টাকা আসতে থাকলে অন্য উৎসের দিকে মনটা আর যায় না। যে-কোনও ব্যবসা ছেড়ে দেওয়াটা খুব খুব খুব কঠিন একটা কাজ।

একটা দোকান বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান নিজের সন্তানের মতো। কত যত্ন করে, কত ত্যাগ স্বীকার করে, কত সময় আর টাকা ইনভেস্ট করে, কত মানুষের বাঁকা কথা শুনে, কত নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে হয়! যদি কখনও পরিস্থিতির চাপে সেটা ছেড়েই দিতে হয়, তবে ঠিক ওই মুহূর্তে ছেড়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। দেরি করতে করতে বেটার অপরচুনিটি মিস হয়ে যেতে পারে (এবং যায়)। সুযোগ কেন আপনার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকবে? আপনি এমন কে? আপনি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলেও তো করত না! সে-সময় শেয়ার মার্কেটে আমার লাখ লাখ টাকা জলে গেল, আর আমার চোখের জলে অন্য সব স্বপ্নগুলোও ভেসে গেল। আরও কিছু টুকটাক ব্যবসা করতাম। কত জন থেকে টাকা পাই! অন্তত লাখ সাতেক! জানি, ওরা কেউই আর টাকাটা ফেরত দেবে না। তবুও আমি শুধু মন খারাপ করে থাকি, আর টাকার কথা ভাবতে থাকি। জীবনে যা হতে চেয়েছিলাম, যা হওয়ার জন্যে এতটা পথ এত কষ্ট করে পাড়ি দিলাম, তা হওয়ার আশায় আজকের দিনে অন্য একটা বেটার অপরচুনিটি পেয়েও শুধু নিজেকে এতটা কষ্টে ডুবে যেতে দেবো না ভেবে ট্র্যাক চেইঞ্জ করলাম না, পরে আফসোসে আফসোসেই পুরো জীবনটা কাটল। বাকির আশায় নগদ হারালাম। কী লাভ?

যার সাথে সারাটা জীবন কাটাব ঠিক করেছিলাম, আমার নিজের জীবনটা প্রতিটি মুহূর্ত আমি হিসেব করে নিয়েছিলাম যার মতো করে, যদি কখনও দেখি, ওর হাতে অন্য কারও হাত; সে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে সেই কবেই, আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি এতদিন; তবুও কি নিজেকে ওর প্রতীক্ষাতেই শেষ করে দেবো এজন্য যে, শুধু ওর কারণেই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে? কোনও মানে হয় দুঃখকে পায়ে জড়িয়ে পথ চলার? যদি কখনও দেখি, পেছনে কোথাও আমার পা আটকে গেছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না, সামনের দিকে এগোনো যাচ্ছেই না, অথচ সেখানে আটকে থাকলে মৃত্যু নিশ্চিত, বাঁচতে হলে নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতেই হবে, তখন পায়ের নিচের অংশটা কেটে ফেলে রেখে সেখান থেকে সরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হয়তো পা-টা হারাব, তবু জীবন তো বাঁচবে! এ জীবন সব কিছুর চাইতে বড়ো—দুঃখের চাইতে, যন্ত্রণার চাইতে, কষ্টের চাইতে, অতীতের চাইতে, লোকসানের চাইতে, নিষ্ঠুরতার চাইতে!

যা চলে গেছে, আর ফিরবেই না, যাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে প্রাপ্তি একটাই—কষ্ট, যার জন্য আমার নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, যাকে ছুড়ে ফেলে না দিলে হয়তোবা সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো আসার আগেই একেবারে হারিয়েই যাবে—তা হলো সাঙ্ক-কস্ট। ডুবে-যাওয়া খরচ ডুবেই থাক না; হোক সেটা পার্থিব কিংবা অপার্থিব। শুধু প্রেমিকা বাদে আমি উপরের সব ক্ষেত্রেই প্রচণ্ডভাবে অসফল একজন মানুষ। এ জীবনে প্রেমিকা আসে-ই তো নি, যাবে কীভাবে? ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ’তে ফাইন্যান্সে এমবিএ কোর্সে আমি যা-কিছু শিখেছি, তার মধ্যে আমার কাছে বেস্ট কনসেপ্ট মনে হয়েছে—সাঙ্ক-কস্ট। আমার জীবন থেকে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি অর্থ আর সময় হারিয়ে গেছে, যেটার যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরত দিন-রাত সবসময়ই, সে যন্ত্রণাকে চিরতরে তাড়িয়ে দিতে এত সুন্দর যৌক্তিক দর্শন আমি আর কোথাও পাইনি। পুরনো ব্যথা-ক্ষতি-কষ্ট-হতাশা-দুঃখ সব কিছু ভুলে ছেড়ে ছুড়ে দূরে ফেলে দিয়ে সামনের দিকে চলার জন্যে এই সাঙ্ক-কস্ট কনসেপ্টটার প্রভাব অসামান্য। জীবন এক বার কাঁদাল বলে সারাজীবনই কেঁদে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

‘ফ্রোজেন’ মুভির ‘লেট ইট গো’ গানটা শুনেছেন না? এ গানের মূল দর্শনটাই হচ্ছে, জীবনে যে ক্ষতিটা হয়েই গেছে, সেটাকে বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জীবনে হাঁটতে হয় সামনের দিকে তাকিয়ে, পেছন ফিরে ঠিকমতো সামনে চলা অসম্ভব। গতকালকের কষ্ট আজকেও বয়ে বেড়ানোর অর্থই হলো, আমার জীবনে এখনও গতকালটাই রয়ে গেছে, ফলে কালকের পুরনো যন্ত্রণাগুলি আরও কিছু যন্ত্রণা নিশ্চিতভাবেই জীবনে টেনে নিয়ে আসবে। যন্ত্রণা যন্ত্রণা আনে। কী লাভ? অতীতের কষ্ট অতীতেই থাকুক, তা যেন বর্তমানের পায়ে শেকল না পরায়!