সিনস ফ্রম অ্যা ম্যারেজ (১৯৭৩)

কোন আশ্চর্য যাদুর বলে বিয়ের মতো জটিল একটা সম্পর্ক টিকে থাকে? দাম্পত্যজীবনে কী কী উপাদান থাকতেই হয়? এর কোনো গ্রামার আছে? এই যে দুইজন মানুষ পাশাপাশি থাকছে দিনের পর দিন, কেন তারা পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে? কেন থাকে না? কখন, কোন কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়? কীভাবে হয়? ধীরেধীরে? নাকি হুট করেই?

আধুনিক মানুষ হিসেবে বেঁচেথাকার যে যন্ত্রণা, বার্গম্যানের প্রায় ফিল্মেই তা বারবার উঠে এসেছে। তাঁর সিনেমায় যতটা গল্প থাকে, তার চাইতে অনেক বেশি থাকে সিনেমা—মানুষের আবেগের গতিপ্রকৃতি, বেপরোয়া আকাঙ্ক্ষা এবং তা পূরণ করতে পারার আর না-পারার বিপত্তি, মনস্তত্ত্বের নানান মাত্রিক সংকট।

জোহান-ম্যারিয়্যান দম্পতি আদর্শ সুখী দম্পতি। ‘সিনস ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’ মুভিটা শুরু হয় একটা ইন্টার্ভিউ দিয়ে। সেখানে আমরা জানতে পারি, সাইকোলজির প্রফেসর জোহান ও ডিভোর্স এক্সপার্ট লইয়ার ম্যারিয়্যান তাঁদের দুই মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখে আছেন। আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক সব দিক বিবেচনায়ই তাঁরা সফল। পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং ভালোবাসার আবরণে গড়া সে দাম্পত্য সম্পর্কে দুইটি মানুষ একসাথে থাকতে যা যা লাগে, তার সবই আছে: নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, সন্তুষ্টি, বিশ্বস্ততা। সবাই তাঁদের জানে নিখুঁত দম্পতি হিসেবে। ওরা একে অন্যকে ছাড়া চলতেই পারে না। কোনো ঝামেলা নেই, কোনো সমস্যা নেই।………দাম্পত্য জীবনযাপনে, নো প্রবলেম ইজ দ্য বিগেস্ট প্রবলেম!

ইন্টার্ভিউর মাত্র কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন জোহান জানায়, সে আরেকটা মেয়ের সাথে প্রেম করছে। সে মেয়েকে নিয়ে পরদিনই সে প্যারিসে চলে যাবে।……….মেয়েটা সুন্দরী, ফিগার দারুণ, বয়স খুব অল্প, বিছানায়ও চমৎকার। সম্প্রতি কোন এক ছেলে মেয়েটাকে দুঃখ দিয়েছে, সেসময় জোহান তার নির্ভরতার হাতটা বাড়িয়েছে। সে হাত মেয়েটি আর ছাড়তে চায় না, হাত ছাড়াতে জোহানও চায় না। স্বামীর কথার প্রতিক্রিয়ায় ম্যারিয়্যানের ভূমিকায় লিভ উলম্যানের অভিনয় সংবেদনশীল দর্শকমাত্রই দীর্ঘদিন মনে রাখবেন। সত্যিই অসাধারণ! বাস্তবের চাইতেও বাস্তব! বার্গম্যানের ফিল্মে লিভ বরাবরই এক অমূল্য সম্পদ।

বলে নিচ্ছি, জোহান ম্যারিয়্যানের হাত থেকে ‘মুক্তি’ পেতে চাইছিল প্রায় ৪ বছর ধরে! ভাবা যায়! এ কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছে কখনো? এখন কথা হল, কেন চাইছিল? মুভিতে জোহানের বয়ানে আমরা কিছু কারণ জানতে পারি। তবে সে কারণগুলি নেহায়েতই ঠুনকো। মানুষ আসলে জানে না সে কী চায়। শুধু জানে, কিছু একটা দরকার। কী যে দরকার, তা ঠিকমতো সে নিজেও বের করতে পারে না। সুখী দাম্পত্যজীবনেও……….কী যেন নেই, কী যেন নেই………এই আফসোস দুইজনকেই তাড়া করে বেড়ায়। সুখ কোথায়? এখানে নয়, অন্য কোনোখানে। কোনখানে? কেউ জানে না। তবে সবাই এইটুকু জানে, সে যেমন অবস্থায় আছে, সেখানে সুখ নেই। মানুষ অতৃপ্তিপ্রিয় প্রাণী। কীসে যে সে তৃপ্ত হবে, তা সে নিশ্চিতভাবে জানে না।

মুভিতে আমরা দেখি, এমন নয় যে জোহান ম্যারিয়্যানকে ভালোবাসে না। তবু সে ম্যারিয়্যানের সাথে থাকতে চায় না। কিংবা অনেকদিন ধরেই ম্যরিয়্যানের মধ্যে সে এমন কিছু খুঁজছে, যা সে পাচ্ছিল না। মুখেও তা বলতে পারছিল না, বোঝাতে পারছিল না। (যদি বাড়তি ঝামেলা এসে হাজির হয়……সে ভয়ে নাকি? কী দরকার বাপু ঝামেলা বাড়ানোর!) আমাদের আশেপাশে অনেক জোহান আছে, যারা একই সাথে একাধিক জনকে ভালোবাসে। তবে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে তা প্রকাশ করতে পারে না।

হ্যাঁ, একটা মানুষ একাধিক মানুষের প্রেমে পড়তেই পারে। এতে দোষ নেই। প্রেমে কোনো প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় নেই, প্রতিটি প্রেমই তো প্রথম প্রেম। মনকে তো আর বেঁধে রাখা যায় না। বিবাহিত মানুষের অন্য কারো প্রতি এই যে দুর্নিবার আকর্ষণ, এর কারণ এ নয় যে উনি বিবাহিত জীবনে অসুখী, কিংবা পার্টনারকে ভালোবাসেন না, কিংবা মন ও শরীরের চাহিদাপূরণে অতৃপ্ত। ডিভোর্সের সোশাল কস্ট অতোটা বেশি না হলে এদেশেও মুড়িমুড়কির মতো ডিভোর্স হতো।

বিয়ের আগে অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক থাকলেও বিয়ের পর এই দশ বছর ম্যারিয়্যান জোহানের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বস্ত থেকেছে। আর কারো কথা কখনোই মনে প্রশ্রয় দেয়নি। তবু সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোহান যে তাকে আর তাদের দুই কন্যাকে ছেড়ে চলে গেল, এখন কী হবে?

যে বিছানায় সে জোহানের বাহুবন্ধনে ঘুমাতে অভ্যস্ত, সেখানে সে একা কীকরে ঘুমাবে?

যে স্বপ্নটা সে একা কখনো দেখেনি, সে স্বপ্নটা নিয়ে সে কীকরে বাঁচবে?

নিজের সেরাটুকু সে জোহানকে দিয়ে এসেছে সবসময়ই, এ ত্যাগের কী দাম পেল সে?

জীবনের যা কিছু সৌন্দর্য, সবই তো হারিয়ে গেল, এই বিধ্বস্ত হৃদয়ে সে কীকরে সবকিছু নতুন করে সাজাবে?

যে মানুষ কখনো একা থাকেনি, সে মানুষ একাকীত্ব নিয়ে আদৌ কি বাঁচতে পারে? ম্যারিয়্যান ভেবেছিল, যেদিন জোহান তাকে ছেড়ে গেল, সেদিনই বুঝি তার জীবনের শেষ। সে জানতোই না যে প্রকৃতপক্ষে সেদিনই ছিল তার জীবনের শুরু। জোহানের জন্য তার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে, কিংবা জোহানের প্রতি তার ঘৃণা জন্মে গেছে, এরকম কিছু হয়নি। জোহান চলে যাওয়ার পর দশ বছরে যা হয়েছে, তা হল, সে জোহানকে ছাড়াই একা বাঁচতে শিখে গেছে। সে বুঝতে শিখেছে, এ পৃথিবীতে কেউই কারো জন্য অপরিহার্য নয়। কারো জন্য নিজের জীবনকে থামিয়ে রাখার কোনো মানে নেই। পুরনোকে যদি শত চেষ্টাতেও আটকে রাখা না যায়, তবে নতুনকে জায়গা দেয়াই বাঁচার রহস্য। জোহানের সাথে বন্ধুত্ব রাখা চলে, তবে নতুন করে দাম্পত্য সম্পর্ক? নৈব নৈব চ!

সিনেমার যাদুকর ইংমার বার্গম্যানের পাঁচটি সেরা সৃষ্টির একটি ‘সিনস ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’-এ ম্যারিয়্যানের এই দারুণ কামব্যাকটা কেলি ক্লার্কসনের ‘হোয়াট ডাজন্ট কিল ইউ’ গানটার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়।