সেরারা কেন সেরা?

আমার গত বছরটা শুরু হয়েছিলো মাস্টারি করে; আমাদের ডিপার্টমেন্টের ট্রেনিং একাডেমিতে ক্লাস নিয়ে। শেষও হচ্ছে মাস্টারি করে। থার্টিফার্স্টে বিজিবি’র অফিসারদের ক্লাস নিতে যাব। কাস্টমস অ্যাক্টের উপর।

বিজিবি ট্রেনিং স্কুলটি বান্দরবানের কাছেই। ইচ্ছে আছে, এবারের থার্টিফার্স্টটা পাহাড়ে কাটাবো। পাহাড়ি বন্ধুদের সাথে। বিকেলে ক্লাস নেয়া শেষ করে সন্ধ্যায় শহরটা ঘুরে দেখবো। শহর পেরিয়ে গ্রামে। পাহাড়ের ওপরে গ্রাম। পাশে পাহাড়ি বাগান। শীতের রাতের পাহাড়ি বাগানে তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পফায়ার করবো। পাহাড়ি রাতের নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে সারারাত চলবে নাচ, গান, রুপোলি গিটারে টান। পাহাড়ের সহজ মানুষদের সাথে আগুনের ফুলকিতে স্নান করতে করতে বছরটাকে গুডবাই জানাবো। কুহেলি চাদরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বারবিকিউ পার্টিতে ঘুমিয়ে-পড়া পাহাড় জাগবে, মাতবে। পাহাড়ের ওপর শীতের ধোঁয়াটে ভোর দেখা আর সোনালি তপ্তরাত কাটানো পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর উপহারগুলোর দুইটি। অদ্ভুত রকমের সুন্দর দৃশ্য! এই দৃশ্যটা ছুঁয়ে দেখা যায়, চোখ দিয়ে, সমস্ত শরীরমন দিয়ে। আগেও আরো ২টা থার্টিফার্স্ট পাহাড়ে কাটিয়েছিলাম। এবারও অপেক্ষায় আছি।

আমার নিজের ডিপার্টমেন্টে এবং অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলোতে প্রায়ই মাস্টারি করতে হয়েছে। বাংলায়, ইংরেজিতে। সাথে ভার্সিটিগুলোতে কিংবা বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বছরজুড়ে ক্যারিয়ার আড্ডা তো ছিলই। এটাও একধরণের মাস্টারি। মাস্টারি করা জগতের অতিআনন্দের কাজগুলোর একটি। পুরোনো অভ্যেস, ছাড়তে পারি না। এখনো যখনই পড়াই, সেই প্রথমদিনের মতোই উত্তেজনাবোধ করি। কিছু মুগ্ধ চোখের তাকিয়ে থাকাটা অনুভব করার লোভ সত্যিই দুর্নিবার। আমি আমাদের ডিপার্টমেন্টে মাস্টারঅফিসার হিসেবে ট্যাগড।

মাস্টারি খুব একটা খারাপ করি না বোধহয়। মাস্টারি করতে গিয়ে অনেক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চেয়েছি, পেরেছিও। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আর আমি তো স্বর্গ পর্যন্ত যাই না। দেশের ভেতরেই থাকি। তাই পড়ানোর সময় মোটিভেশনাল কথা চলেই আসে। আমি এই দেশের কথা বলি, দেশের প্রতি আমাদের ঋণের কথা মনে করিয়ে দেই। যাঁদের ক্লাস নেই, তাঁদের নিজের চাকরি নিয়ে গর্ব করতে শেখাই। উনারা নিজেদের অবস্থান আর মর্যাদা সম্পর্কে ভালো অনুভব করেন। তাই, দোয়া করেন, ভালোবাসেন। আমি সত্যিই জানি না, এই ভালোবাসার কোনো প্রতিদান হয় কিনা! একবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের একটা ক্লাস নিয়েছিলাম। সেই ক্লাসের একটা ফিডব্যাক শেয়ার করছি। ফিডব্যাকটা ছোটভাই নিক্সনের। ও নিজেও একজন বিসিএস ক্যাডার। ওর দুলাভাই আমার সেই ক্লাসে ছিলেন। উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন চৌকস কর্মকর্তা।

এক সন্ধ্যায় দাদা (কাস্টমস কর্মকর্তা) বাসায় এসেই বললেন, আজ দারুণ এক এসি ক্লাস নিল। নাম বলায় চিনলাম। সুশান্ত পাল। রাতে খেতে খেতে বললেন, উনার এক ছেলে সুশান্ত স্যার এর মত হতে হবে, দেশের সেবা করবে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের বাইরে যাবে, সবার এই ধারণা ছিল, উনি নিজেও তা-ই চাইতেন, ক্লাস শেষে উনার মনে হল, না, অন্তত এক ছেলে দেশের জন্যই কিছু করবে। জানতে ইচ্ছে করল, ক্লাসটা কতক্ষণের ছিল? …….. ঘন্টা দেড়েক!!

ওইসময়ে একজন বাবা তাঁর ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন পাল্টালেন!

খুব অবাক লাগেনি, কারণ সুশান্তদা’কে নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা কিছু কম নয়, কেউ কেউ তাঁর প্রোফাইলে লিখেছেন, “জীবনে অন্ধের মত কোন মানুষকে অনুসরণ করলে তিনি সুশান্ত স্যার।”

কেউ কেউ লিখেছেন, “কিছু মানুষের জন্ম হয় জীবন বদলানোর জন্য।” কেউ কেউ লিখেছেন, “দুনিয়া পাল্টানোর জন্য।” কেউ কেউ তাঁকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, “প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা।” উনার ক্যারিয়ার আড্ডাগুলোতে সাফল্যপ্রত্যাশীদের উপচেপড়া ভিড় ঠেলে গিয়ে কেউ কেউ বলেন, “উনি অভিনেতা নন, রাজনীতিবিদও নন, তবু তাঁর কথা শুনব বলে এসেছি।”

আমি যদিও কখনো যাইনি কিন্তু যাঁরা ক্যারিয়ার আড্ডায় গেছেন, প্রায় প্রত্যেকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভেবেছেন, জীবনের একটা আলাদা মানে দাঁড় করিয়েছেন।

আমার কখনো তাঁর সাথে দেখা হয় নি, শুধু ফেসবুকে একবার হাই হ্যালো! তবুও আমার উনাকে ভালো লেগেছে, কাস্টমসের সহকারী কমিশনার হিসেবে নয়, দেখতে ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না টাইপ’ (দুঃখিত দাদা!) অসম্ভব সুন্দর কোন চেহারার জন্য নয়, হাসিমুখে বলতে পারার ক্ষমতার জন্য নয়, দারুণ লিখতে পারার ক্ষমতার জন্য নয়, উনার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ৪৫০০-এর উপরে বই থাকার জন্য নয়, কিংবা কাস্টমসে কোটি কোটি টাকার চোরাই স্বর্ণ ধরার পর টিভিতে লজ্জিত মুখে ‘আমি কিছুই করি নি!’টাইপ বিনয় দেখানোর জন্য নয়, উনাকে আমার ভালো লেগেছে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য, বুকপকেটে ‘জীবনে কিছু করে দেখানোর’ স্বপ্ন নিয়ে হাজার হাজার ছেলে একজন স্বপ্নবাজের কথা শুনতে আসছে, এসে নিজেরা পাল্টাচ্ছে, এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে?

স্বপ্ন দেখানোর এই সাহসী মানুষটাকে যে আমাদের খুব দরকার ছিলো …… ভালো থাকবেন দাদা।

এ-ই পেয়েছি! এভাবেই কেটেছে, কাটছে। বছর ঘুরে বছর আসে। চাকরি চলে, জীবন ঘোরে। হতাশায় ডুবি, আশায় ভাসি, ভাসাই।

আরো কাজ করি। করি মানে, করতে হয়। বলি, কেমন?

লেখালেখি। ডিপার্টমেন্টের স্যুভেনিরগুলোর লেখা ঠিক করে দেয়া, ম্যাগাজিনের শুরুতে যে বাণীগুলো দেয়া থাকে, সেগুলো লিখে দেয়া, সিনিয়রদের বিভিন্ন স্পিচ, প্রেজেন্টেশন রেডি করে দেয়া, ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে চিঠি লেখা (কয়েকটা চিঠি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেছে এবং এর সুফল ডিপার্টমেন্ট পেয়েছে, দেশ পেয়েছে), ম্যাগাজিনে কনট্রিবিউট করা। অনেক ড্রাফট করতে হয়। এরকম আরোকিছু।

উপস্থাপনা। ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন ফর্মাল আর ইনফরমাল প্রোগ্রামে উপস্থাপনার দায়িত্ব থাকে। সাথে স্ক্রিপ্ট লেখা, প্রোগ্রাম সাজানো, গান করা, আবৃত্তি করা। ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলা। এসব কাজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা করতে হয়। আরেকটা কথা। ইয়ে মানে, সাম্প্রতিক সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে খেলার ধারাভাষ্য দেয়া! আসছে ৩ জানুয়ারি আমাদের বার্ষিক বিভাগীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ধারাভাষ্য দিতে হবে। সারাদিনব্যাপী! সকলের দোয়াপ্রার্থী! (উল্লেখ্য, আমি খেলাধূলায় অতিশয় সেইরকম। জীবনে ফুটবলে একটা লাত্থিও মারি নাই। ভাগ্যিস, চাপাবাজি, থুক্কু ধারাভাষ্য করতে খেলতে জানতে হয় না।)

অনেকক্ষণ নিজের ঢোল পিটালাম। এবার একটু আপনার ঢোল পিটাই।

শুধুই চাকরি করতে জানাটা মহাসৌভাগ্যের ব্যাপার। চাকরি মানে, শুধু চাকরিই। আপনি অন্যকিছু করতে না জানলে শুধু চাকরি করাই আপনার চাকরি। আর জানলে, চাকরি করা আর সেসব করা, দুই-ই আপনার চাকরি। মানে, আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে। চাকরিতে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানাটা মস্তো বড় একটা আর্ট। রাখতে না পারলে, আপনাকে ধরে কিছু কাজ ধরিয়ে দেয়া হবে। এর কোনটাতে ভুল করা চলবে না। আপনি অন্যকিছু করতে না জানলে আপনার সুবিধে, আপনি ‘বেঁচে’ গেলেন। যারা করতে জানে, আপনি ওদের ভুল ধরতে পারবেন। আবার আপনি অন্যকাজ করতে জানেন না বলে কারোর বাপের সাধ্য নাই আপনার ভুল ধরার। করেনই না, ভুল করবেন কী? যে করে, সে-ই শুধু ভুল করে। যে করে না, সে মনেমনে সবকিছুই ঠিকভাবে করে। আমরা টিভি’র সামনে বসে বসে ছক্কা-পেটানো জাতি। হায়! এই জগতে ছাগল আর গাধারাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ!

আপনি করতে জানেন, এর মানে, আপনার আশেপাশের সবাই ধরেই নেবে, ওরা কাজটা করলে আপনার চাইতেও ভালোভাবে করতে পারত।

হাজার হাজার লোকের সামনে ষ্টেজে দাঁড়িয়ে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারেন। ওদের একবার দাঁড় করিয়ে দিয়ে দেখুন। মিনিটের পর মিনিট কয়বার বাথরুম পায়, মিনিটে কয়বার হাত-পা কাঁপে, আঞ্চলিক তোতলামো ক্কাহাকে বলে ক্কত প্রকার ও ক্কী ক্কী, কীভাবে চুলে আকস্মিক উকুনের উপদ্রব হয়, হাত কোথায় কোথায় হারিয়ে যায়, ঘাড়কোমরের ড্যান্স কত বিচিত্র মনোহর।

আপনি ভালো লিখতে পারেন। যারা বেশি ফটরফটর করে, ওদের এক লাইন লিখতে দিন। ‘ললাট মোর ভেসে গেল দুই নয়নের জলে,/ মোর পা দু’খানা তখন বাঁধা ছিল ডালিমগাছের ডালে।’ জাতীয় অলেখা প্রসব করে ভরিয়ে ফেলবে। এই গল্পের কাহিনী জানেন তো? আচ্ছা, বলছি। কবিতা লিখতে হলে শান্তি নিকেতন লাগবেই, এমন নয়। মাথায় জিনিস থাকা চাই। শান্ত পাহাড়ের গায়ে-থাকা এক কুটিরে বসে বসে এক উচ্চশিক্ষিত লোক কবিতা লেখা শুরু করল এইভাবে, ললাট মোর ভেসে গেলো দুই নয়নের জলে ……. এরপর ভাবতে লাগলো, চোখের পানিতে কপাল ভেজে! ক্যামনে কী! আবার ওই লাইনটা চেঞ্জ করতেও মন চায় না; কতো অসাধারণ একটা কথা আমার অতিউর্বর মাথা প্রডিউস করল! কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ পর সে ২য় লাইনটা লিখল, মোর পা দু’খানা তখন বাঁধা ছিলো ডালিম গাছের ডালে। ……. বুঝুন অবস্থাটা!!

আমি বিশ্বাস করি, এসব জিনিস সহজাত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধনা করে আর যা-ই হোক, সেরা হওয়া যায় না। কিছু ব্যাপার রক্তে থাকে।

মান্না দে’কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “একজন গ্রেট আর্টিস্ট হতে হলে কী করতে হবে?” উনার উত্তরটা আমার আজীবন মনে থাকবে। উত্তরটা ছিল, “আর্টিস্ট হতে হলে অনেক সাধনা করতে হবে। কিন্তু গ্রেট আর্টিস্ট হতে হলে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা থাকা চাই।”

শ্রীকান্তকে একটা অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করা হয়, “আপনার জীবনে কোনো দুঃখবোধ আছে?” উনার উত্তর ছিল, “দুঃখবোধ নেই, তবে একটা আফসোস আছে। সংগীতে আমি সারাজীবন অশিক্ষিতই রয়ে গেলাম। আমি একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী।” বন্ধুদের জানিয়ে রাখি, উনার গান শেখাটা হয়েছিল শুনে, অনুভব করে। আরেকজন গ্রেট আর্টিস্ট নচিকেতার মতো সেই ছোটোবেলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর নেই। তাঁর বাবা চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে জয়েন করুক। (এটা ভেবে কেমন জানি খুশি খুশি লাগছে।) আমরা যখন জানতে পারি, এক মৃত্যু পথযাত্রী তরুণী ক্লিনিকের বেডে শুয়ে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ ইচ্ছে হিসেবে এটা প্রার্থনা করেন যে শ্রীকান্তের ‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি — তোমাকে দিলাম’ ওর রুমে বাজুক, তখন আমরা আরেকবার ভাবতে থাকি, এরকম একটুআধটু শুনেটুনেও ভালো গাওয়া যায়। কিছু কিছু ছেলে মানুষ না হয়ে লক্ষ্মীছাড়া হোক। সবাই মানুষ হবে কেন? কিছু কিছু পাগল হোক। আমরা চাই, হেমন্তরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে গাইতে আসুক। বিনয় মজুমদাররা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে পড়ুক, এরপর একদিন সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে ধুম করে একখানা ‘ফিরে এসো, চাকা’ লিখতে বসে যাক। এসবকিছু কি সাধনাতে হয়েছিল? শ্রীকান্তের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে একেবারেই ছিল না, তা কিন্তু নয়। দক্ষিণী’তে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন, পরে উস্তাদ আলী আহমদ খানের কাছে তবলাও শেখেন। বুঝলাম। কিন্তু সে তো অনেকেই শেখে! শ্রীকান্ত হয় কয়জন? অতোটা অনুভব করে গাইতে গেলে যে সরস্বতীর কৃপা লাগে!

কুমার শানুকে একবার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “শানুদা, আপনি প্রতিদিন কয় ঘণ্টা করে রেওয়াজ করেন?” কুমার শানু প্রশ্নটা কৌশলে এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। ইন্টারভিউয়ার নাছোড়বান্দা। আবারো একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে শানু বললেন, “আচ্ছা, আপনি আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট কতবারে পেয়েছেন?” উত্তর এল, “তৃতীয়বারে, দাদা।” এরপর শানু বললেন, “তাহলে ভেবে দেখুন আমাকে কতটা ব্যস্ত থাকতে হয়! যতটা ছবিতে সাইন করি তার দ্বিগুণ ছবি ফিরিয়ে দিই। আমার রেওয়াজ করার সময় কোথায়? আমি গত ৮ বছরে রেওয়াজ করার সময়ই তো পাইনি!”

স্ত্রী অ্যানির জন্যে লেখা ‘ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস’ লিখতে জন ডেনভার সময় নিয়েছিলেন ১০ মিনিট। ভদ্রলোক স্কিয়িং ক’রছিলেন, এরই এক ফাঁকে লিখেছেন এই জনপ্রিয়তম গানটি।

হয়তো কথা রাখেনি এমন কারোর কিংবা কারো কারোর ওপর অভিমান করে লেখা ‘কেউ কথা রাখেনি’ লিখতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সময় লেগেছিলো ১৫-২০ মিনিট। পত্রিকার ছাপবার জন্যে কবিতা চাইতে আসা এক ভদ্রলোককে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে ‘আপনি একটু বসুন, আমি কবিতাটা নিয়ে এই আসছি’ বলে ভেতরের রুমে পালিয়ে কবি লিখেছিলেন পরবর্তীতে অসংখ্যবার আবৃত্তি হওয়া এই চমৎকার কবিতাটি।

মাত্র ২২ বছর বয়সে হুমায়ূন আহমেদ নন্দিত নরকে লিখেছিলেন এক রাতে। “আমার মৃত্যুর পরে আমার সাথে তোমরা গীতা দিয়ো না, পুতুলনাচের ইতিকথা’টা দিয়ো।” সন্দীপন তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন। এই উপন্যাস মানিক লিখেছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সে। ২২ বছরের একটা যুবকের কয়টি বই পড়া থাকতে পারে? ২২ বছর বয়সের প্রস্তুতি কতটুকু? আমাকে ২২০ বছর আয়ু দিয়ে ২২ হাজার বই পড়ার সুযোগ করে দিলেও ওরকম একটা নন্দিত নরকে কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথা লিখতে পারব?

করন জোহর তাঁর ‘কাভি খুশি কাভি ঘাম’ মুভিতে ‘সুরুজ হুয়া মাধ্যাম’ গানটি বাদ দেয়ার প্ল্যান করেছিলেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, গানটি দর্শকরা ‘খাবে না’। বন্ধু শাহরুখের পরামর্শে উনি এটা মুভিতে দেয়ার ‘রিস্ক’ নিয়েছিলেন। বাকিটা তো আমরা জানিই। কাল হো না হো মুভিতে শাহরুখকে মেরে ফেলার আইডিয়া করনকে শাহরুখ নিজেই দিয়েছিলেন। উনার পরামর্শেই মুভির স্ক্রিপ্ট বদলে ট্র্যাজিক এন্ডিং দেয়া হয়। মুভিতে শাহরুখের কিছু ডায়লগ আছে, যেগুলো শট নেয়ার সময় শাহরুখ ওই মুহূর্তেই বানিয়ে বলেছিলেন। এই সেন্স কোন ‘সহজ পদ্ধতিতে গ্রেটনেস শিক্ষা’ পড়ে ডেভেলাপ করা সম্ভব?

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা হ্যাপি ফ্যামিলির ছবি এঁকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম যেটা আমার সবচাইতে বেশি ‘লাইক’ পাওয়া স্ট্যাটাসগুলোর একটি। (অন্তত ২০০০+ লাইক ছিল।) কথা সেটা নয়। ওটা পোস্ট করার কয়েক মিনিট পরেই ২০০’র মত লাইক দেখে আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী সিনিয়র ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি কোথায়? কী করছি? কাজটাজ ঠিকভাবে করছি কিনা? এর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের এয়ারপোর্ট টিম প্রায় ১০ কেজি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এখন ফ্যাক্টটা শেয়ার করি। ওটা লিখতে আমার সময় লেগেছিল ১৫ মিনিটের মতো। ওটা আমি লিখেছি আমার আনস্মার্ট ফোনে বাংলায় টাইপ করে ডিউটিতে থাকার সময়েই।

২ ঘণ্টার কাজ করতে সবারই কিন্তু ২ ঘণ্টা লাগে না।

কেউ কেউ ওটা করে ২ ঘণ্টায়।

কেউ কেউ ওটা করে আধা ঘণ্টায়।

কেউ কেউ ওটা করে ৮ ঘণ্টায়।

ভাই, আপনি যদি ফার্স্ট কিংবা থার্ড ক্যাটাগরিতে পড়েন, তবে সেকেন্ড ক্যাটাগরির লোকের বেঁচে-যাওয়া সময়ে একটু আনন্দে জীবন কাটানো দেখলে আপনার গা জ্বলে কেন? গা চুলকায় কেন? বাজারে ইদানীং চুলকানির ভালো ভালো মলম পাওয়া যায়। একটা মলম কিনেন ভাই, কী আছে আর জ্যাবনে? ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে। বুঝতে না পারলে, ইউ হ্যাভ টু মুড়ি খেতে হবে।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫