হাতি হাঁটে, কুত্তা চেঁচায়

ক্লাস ফোরে পড়ার সময় টিনাকে বলেছিলাম, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।” (যতদূর মনে পড়ে, এর আগের দিন বিটিভি’তে রাত পৌনে ৯টার নাটকে নায়ক নায়িকাকে ওই কথাটি বলেছিল। কথাটি শুনে নায়িকা আনন্দে অভিভূত হয়ে নায়কের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিল। নাটকের ওই অংশটি দেখে আমার ভীষণ ভালো লেগে যায়, এবং আমি নায়কের ভূমিকাটি খুবই নির্ভুলভাবে পরেরদিন ক্লাসে আমার ভালোলাগার মেয়েটির সাথে পালন করেছিলাম।) আমার ভালোবাসার প্রস্তাবের জবাবে টিনা আমাকে আচ্ছামতো কাঠের স্কেল দিয়ে সবার সামনে পিটিয়েছিল। পিটানোর সময় ক্রমাগত বলে যাচ্ছিলো, “বেয়াদব ছেলে কোথাকার! বল, আর কোনোদিন ভালোবাসবে, বল?” এর সাথে বোনাসস্বরূপ ওর বান্ধবী আমাকে দুটো ঘুসিও মেরে দিয়েছিল। ওর আরেক স্বাস্থ্যবতী বান্ধবী আমার শার্টের ইন তুলে দেয়, এবং আমার প্যান্ট ধরে টানাটানি করে সেটা খুলে ফেলার খুব চেষ্টা করে। ওই সময়ে আমি আমার পিতৃপ্রদত্ত ইজ্জত বাঁচাতে প্যান্টটা ধরে রাখার কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম বলে টিনা আমার শার্টের কলার ধরে কী কী যেন বলে ঝাঁকাচ্ছিল, খেয়াল করিনি। আর আমার ওই কাহিল অবস্থা দেখে ক্লাসের সবাই সে কী হাসাহাসিটাই না করলো! দেখে মনে হচ্ছিলো, ক্লাসে সেদিন পিকনিক হচ্ছে। আজো কানে বাজে বিদ্রূপের সেই সরব মঞ্চায়ন। আমি সেই ছোট বয়সে বুঝে গিয়েছিলাম, কোনো মেয়েকে ‘ভালোবাসি’ বলা যাবে না। বললে, মার খেতে হবে, বকা শুনতে হবে, এমনকি শ্লীলতাহানির শিকারও হতে পারি! সবার ইনস্ট্যান্ট রিঅ্যাকশনে আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো, নাটক সিনেমা ছাড়া আর অন্য কোথাও ভালোবাসলে কেউ বুকে মাথা রাখে না, বরং প্যান্ট খুলে দেয়। ভয়ংকর অবস্থা! অতএব, ভালোবাসাটাসা সারাজীবনের জন্য বাদ! কোনো মেয়েকে ভালোবাসার চাইতে গাছকে ভালোবাসাও ভালো। এর বিনিময়ে ভালোবাসা পাই না পাই, ইজ্জত তো অন্তত বাঁচবে!

আপনার ২ হাজার পুরুষ আগের পুরুষটি কেমন ছিলেন? আপনার ওই পূর্বপুরুষটি বয়সে যীশু খ্রিস্টেরও হাজার পঞ্চাশেক বড়। তিনি তখন বাস করতেন কোনো একটা ছোট আদিম জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে। সেসময় তিনি কোনো গোষ্ঠীর একজন সদস্য, এর মানে হল, তিনি খাদ্য এবং আশ্রয় এ দুটোর ব্যাপারে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত। তাকে সবসময়ই গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের মন রক্ষা করে চলতে হতো। কারণ, যদি গোষ্ঠীর অন্যান্যরা তাকে কোনো কারণে অপছন্দ করে, কিংবা ভাবে, তাকে গোষ্ঠীতে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, তাহলেই সাড়ে সর্বনাশ! হয় তাকে গোষ্ঠী থেকে বিতাড়িত হতে হবে, নতুবা গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের হাতে তার মৃত্যু অবধারিত। যদি আপনার সে পরম আত্মীয়টি সে গোষ্ঠীভুক্ত কোনো মেয়ের প্রেমে পড়ে, আর সে মেয়েটি তাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্য মেয়েদের ব্যাপারটা বলে দেয়, তবে হয়তো সে বেচারার ভাগ্যে আর কখনোই কোনো মেয়ের প্রেম জুটবে না। এটাই ছিল নিয়ম। প্রত্যাখ্যাত হওয়া যাবে না, সবাই যেন ভালো বলে এমনকিছুই করতে হবে; এক কথায়, সবাইকে খুশি করে চলাই ছিল সেসময়ের রীতি। এই রীতিটা মাথায় রেখে মানুষ মানবসভ্যতার বয়স আস্তে-আস্তে বাড়াতে লাগল। অন্যরা কী ভাববে, কীকরে অন্যদের খুশি করে চলতে হবে, কীভাবে অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে ভাবতে হবে, কেউ যাতে অপছন্দ না করে এমন কিছুই করার বা দেখানোর জন্য সদাব্যস্ত হয়ে থাকা, অন্যের স্বীকৃতি আর প্রশংসা পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করা—এসব বিশ্বাস সাথে নিয়ে আদিমানব নানান চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আজকের অবস্থানে এল। এর ফলে মানুষের মাথায় একটা সহজ নিয়ম গেঁথে গেলো: এমনকিছু ভাবা যাবে না, বলা যাবে না, করা যাবে না, যাতে অন্যরা কিছু মনে করে। সবসময়ই সমাজের সব ধরনের (ন্যায়সঙ্গত হোক না হোক) আচরণ এবং প্রতিক্রিয়া সহ্য করে যে করেই হোক সমাজেই টিকে থাকতে হবে। সমাজের অন্য ১০টা মানুষের মন যুগিয়ে চলতে পারলেই ভালো থাকা যাবে। সভ্যতার যেমনই পরিবর্তন হোক না কেন, আমরা এখনো আমাদের শ্রদ্ধেয় ৫২,০১৭ বছর বয়সি পূর্বপুরুষের প্রতি সমানভাবে অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে চলেছি। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে এসে আমরা ৫০,০০০ খ্রিস্টপূর্ব আগের সামাজিক প্রথাটি অতি যত্নে আঁকড়ে ধরে আছি। রীতির প্রতি এমন বশ্যতার নামই সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য হওয়া’।

কোথাও বের হচ্ছেন। বের হওয়ার আগে ৬টা পোশাক পরে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলেন, আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে, অথচ কিছুতেই শিওর হতে পারছেন না, কোন পোশাকটায় আপনাকে সবচাইতে ভালো মানাবে! মানাবে মানে, অন্যরা আপনাকে দেখে আপনার রুচির তারিফ করবে, আপনাকে স্মার্ট হিসেবে রায় দেবে। আমরা ড্রেস পরার সময়ও অন্যের রুচিমাফিক পরি! আমাদের দাদাজান টু দ্য পাওয়ার টু থাউজেন্ডের সাথে আমাদের পার্থক্যটা আর রইলো কোথায়? রেস্তোরাঁয় একা খেতে বসলে, একা-একা মুভি থিয়েটারে গেলে, পার্কে একা-একা হাঁটতে-হাঁটতে চিনেবাদামের ঠোঙা সাবাড় করলে কে কী ভাববে! নিজের ছেলেমেয়েকে ডাক্তার না বানিয়ে তার পছন্দের বিষয় সাহিত্য নিয়ে পড়ার অনুমতি দিলে সোসাইটি কী ভাববে! প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে তো! প্রেস্টিজের সংজ্ঞা আর প্রেস্টিজ পাংচারের সংজ্ঞা, দুটোই সমাজের বানানো। কার জীবন কেমন, সেটা সমাজ জানবে কীকরে? বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সুবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া করে ব্যবসা করে ‘জীবনটা নষ্ট করে দিলে’ লোকে কী বলবে! সমাজ ‘বিয়ের বয়স’ নামক একটা বেড়াজাল বানিয়েছে। বিয়ে করার মতো সামর্থ্য বা ইচ্ছে তৈরি হোক না হোক, যাকে বিয়ে করছি তাকে আমার পছন্দ হোক না হোক, সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; সেই মায়াজালে ‘ঠিক সময়ে’ ধরা না দিলে সমাজে মুখ দেখাবো কীভাবে! করলাম সবই! এরপর কী? মুক্তি? খোলা হাওয়ায় মনের খুশিমতো শ্বাস নেয়ার পাসপোর্টটা পেয়ে গেলাম? মোটেও না! এরপর নতুন-নতুন আরো যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে। ওসব যন্ত্রণা চুপচাপ মেনে নেয়ার নামই সমাজে ‘গ্রহণযোগ্য হওয়া’!

মনমেজাজ ভালো থাক খারাপ থাক—হাসিমুখে ফেসবুকে সেলফি দিতে হবে! বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলে সেটাও ফেসবুকে সবাইকে জানাতে হবে—এর জন্য পরবর্তীতে যতোই আফসোস হোক না কেন! রেস্টুরেন্টে গেলাম, অথচ কেউ জানলো না, তাহলে রেস্টুরেন্টে গিয়েই বা কী লাভ হল? ফেসবুক না থাকলে লোকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিত কিনা, কে জানে? নিজের স্বপ্নের পেছনে না ছুটে চাকরির পেছনে ছুটতে হবে, কারণ আমার স্বপ্ন যা-ই হোক না কেন, আমার চাকরিটা যে অন্য অনেকেরই স্বপ্ন, ওরা এটাকে ভালো বলে, কিংবা ওরা এটার উপর নির্ভরশীল। আমি যা করে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে দিব্যি চালিয়ে নিতে পারি, আমি তা করতে পারবো না, কারণ সমাজ হয়তো ওটাকে ঠিক ‘প্রেস্টিজিয়াস’ মনে করে না। যাক না জীবন জাহান্নামে কেটে কম্প্রোমাইজ করতে-করতে, তাও সমাজের ১০জনের মনের মতো করে বাঁচতে হবে। আমাদের যা ভালো লাগে, আমাদের তা ভালো লাগে না; আমরা ভালো লাগাই তা-ই, যা আমাদের ভালো লাগা উচিত বলে সবাই মনে করে। আমরা আধুনিক হয়েছি বাইরে, ভেতরে-ভেতরে আমরা সেই ৫০ হাজার খ্রিস্টপূর্বেই সুখবাস করছি। আমরা যতোটা না মানুষ হচ্ছি, তার চাইতে ঢের বেশি পাপেট হচ্ছি। পাপেটের মতোই আমরা অবিরত নেচে চলেছি আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কিংবা সমাজের হর্তাকর্তা কারো ইশারায়। ওরা যেমন চাইবে, আমরা ঠিক তেমনিভাবেই নাচ দেখাবো। কখনো-কখনো আমরা এমন কাউকে অনুসরণ করছি, যাকে আমরা চিনিই না, যে হয়তো অনেক বড় সেলিব্রিটি কিংবা অনেকেরই রোলমডেল। আমি জানিই না যে উনাকে অনুসরণ করলে আমার নিজের কোনো লাভ হবে কিনা, তবুও আমি অনুসরণ করে যাচ্ছি, কারণ আমি অন্ধ হয়ে বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যেকোনো কাজ করার সময়ই আমরা ভয়ে থাকি, যদি কেউ আমাকে পাগল বলে! কিছুতেই আমাদের মনে থাকে না—একসময়ের পাগল, আজকের রাজা! পাগল হওয়া ছাড়া দুনিয়াতে কে-ই বা কী করতে পেরেছে? আমাদের মতামত প্রকৃতপক্ষে আমাদের মতামত নয়। আমরা কাউকে না কাউকে খুশি করার নিয়তে ভাবতে ও কাজ করতে শিখে নিয়েছি, ওতে আমরা নিজেরা খুশি অখুশি যা-ই হই না কেন, সেটা বড় কথা নয়। অন্য সবাইকে জায়গা দিতে গিয়ে আমাদের জীবনে আমাদেরই আর কোনো থাকার জায়গা নেই। আমাদের ঘরে বসত করে আমরা বাদে পুরো দুনিয়া। আমাদের ঘর, আমাদের দুয়ার, আর আমরা থাকি বাইরে। কী আইরনি!

অথচ, আমরা আসলে কী চাই, কী আমাদের ভালো লাগে, কেমন করে বাঁচলে আমরা কম আফসোস নিয়ে বাঁচতে পারবো, এসব খবর আমাদের ভেতরের ‘আমি’র চাইতে ভালো করে আর কেউই জানে না। কত টাকা হলে আমার চলবে, আমি কেমন পরিবার চাই, আমি কেমন লোকের সাথে মিশতে চাই, কী আমার করতে ভালো লাগে, কীসে আমি আনন্দ পাই না, কোন ধরনের কাজে আমার আগ্রহ সবচাইতে বেশি, কোন কাজটা আমি অন্য সবার চাইতে ভালোভাবে করতে পারি, এসবের উত্তর একমাত্র আমার ভেতরের ‘আমি’র কাছেই আছে। আমরা ওর কথা শুনি না, শুনি পৃথিবীসুদ্ধ মানুষের কথা, ফলে খুশিমনে বেঁচেথাকাটা আর হয়ে ওঠে না। আমার নিজের জীবনটা কেমন হবে, সে সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, যে যেমনই রায় দিক না কেন, একমাত্র ভেতরের ‘আমি’টাই কেমন করে যেন বুঝে ফেলে, কোনটা আমার জন্য ভালো হবে, কোন পথে জীবন কাটালে আফসোস কম থাকবে। জীবনে ভালো থাকতে হলে ভেতর আমি’র ভালো কথা, ভালো পরামর্শ শুনতে হয়। আমরা সবার সব কথাই শুনবো কিন্তু গ্রহণ করবো সেটাই যেটা আমাদের মন করতে বলে। তবে হ্যাঁ, আমাদের খুব ভালো করে জানতে হবে, বুঝতে হবে আমরা কী, আমাদের দৌড় কতদূর, আমরা আসলে কী চাই, কেন চাই, কীভাবে চাই। খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের স্বপ্নের ভোরটাতে যাতে অন্য কারো দুঃস্বপ্নের সন্ধে নেমে না আসে। এসব বিষয় যারা যতো কম বোঝে, তারা ততো বেশি অন্যের মতামতের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, জীবনকে সামনের দিকে টেনে নিতে-নিতে ভাবে, দিব্যি এক জীবন কাটাচ্ছি! অন্যদের প্রশংসা বা নিন্দা তাদের সুখ বা দুঃখের নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।

কেউ-কেউ আছে, যারা সবার সব মতামতকেই গুরুত্ব দিয়ে জীবন কাটায়। কেউ-কেউ কাউকেই পরোয়া না করে নিজের মতো করে একটা বেপরোয়া জীবন কাটিয়ে দেয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষ এই দুই প্রান্তিক অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান করি। আমাদের ভেতরের ‘আমি’টা নীরবে সবার সব কথাই শুনে যায়, সেসব কথার ততটুকুই নিজের মতো করে গ্রহণ করে, পালন করে, যতটুকু যেভাবে করলে কেউ আমাদের ব্যাপারে অখুশি হবে না। এখন কথা হচ্ছে, কোন উপায়ে আমরা সবকিছু মোটামুটি ম্যানেজট্যানেজ করে ভালো থাকতে পারি? এটা নিয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত ভাবনাগুলি এখানে শেয়ার করছি:

প্রথমত। প্রথমেই দেখতে হবে, আমরা আসলে কী চাই। আমরা কত লোকের সাথেই তো সময় কাটাই। কখনো কি ভেবে দেখেছি, তাদের মধ্যে কাদের সঙ্গ আমাদের সবচাইতে বেশি আনন্দ দেয়? আমাদের অবসর মুহূর্তগুলি আমরা কীভাবে কাটাতে ভালোবাসি? এমনকিছু কি আছে যেটার পেছনে আমরা নিয়মিত পয়সা আর সময় খরচ করে যাচ্ছি, অথচ যেটা আমাদের ভালোই লাগে না? আমরা আমাদের চাকরি এবং রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটাকে কীভাবে দেখছি? রাজনীতি সম্পর্কে আমরা কী ভাবি? নাকি, আদৌ ভাবিই না? আমাদের একটুও ভালো লাগে না, কিন্তু লোকদেখানোর জন্য সেগুলি নিয়ে ভাবার আর পছন্দ করার অভিনয় করে যাই, এরকম কী কী আছে? আমরা মনে-মনে এমন কী কী ভাবি, যেগুলি আমরা প্রকাশ্যে বলতে পারি না, কারণ সেগুলি শুনলে লোকে ক্ষেপে যাবে, কিংবা আমাদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য ছুঁড়ে দেবে? এই সবকটিই হল নিজেকে খোঁজা বা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার কিছু উপায়। এর পেছনে সত্যিই সময় দেয়া প্রয়োজন। আমরা এখন যা করছি, হয়তো আমরা তা করতে চাই না, কারণ আমরা এর চাইতে আরো ভালো কিছু করতে পারতাম, কিংবা এমনকিছু করতে পারতাম, যা আমরা খুব করে করতে চাই। নিজেকে চেনার চেষ্টা না করলে বর্তমান অবস্থানের পরিবর্তন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত। বেশিরভাগ সময়ই, আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না যে ‘কিছু একটা’ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই ‘কিছু একটা’কে চেনার একটা সহজ উপায় হচ্ছে, ভেবে দেখা, আমাদের ভয়টা আসলে কীসে? কোন ব্যাপারটায় আমরা বিব্রত হই কিংবা লজ্জিত হই? আমাদের জীবনের কোন দিকটা আমরা কখনোই কারো সামনে আসতে দিই না, সবসময়ই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখি? কোন-কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার ভয় আমাদের সবচাইতে বেশি তাড়া করে? এমন কী আছে যা আমরা বেশ ভালো পারি, কিন্তু প্রকাশ্যে করতে ভয় পাই? যদি আমাদেরকে আমাদের জীবনের কোনো একটা অংশ আমাদের ইচ্ছেমাফিক পরিবর্তন করার সুযোগ দেয়া হয়, তবে আমরা কোন অংশটাকে বেছে নেবো? কেন নেবো? কীভাবে সেটাকে পরিবর্তন করার কথা ভাববো?

ওই ‘কিছু একটা’কে চেনার আরেকটা উপায় আছে। কীরকম? আমাদের আশেপাশের সবাই আমাদের দেখে বলছে, আমরা ভালো আছি, অতএব, আমরা ভালো আছি। আমরা যারা এরকম করে ভাবি, তারা নিজেদের কয়েকটা প্রশ্ন করে দেখিতো: আমাদের চাকরিতে, ব্যবসায় বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের কি সবসময়ই মনরক্ষা করে চলতে হয়? কেবল বাবা-মা’কে খুশি করার জন্যই কি আমরা তাদের পছন্দের কাজগুলি করে যাচ্ছি, যেগুলি করতে আমরা নিজেরা মোটেই পছন্দ করি না? সমাজের চোখে যাকিছু ‘প্রেস্টিজ সিম্বল’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য, আমরা কি সেসবকিছুর পেছনেই ছুটে চলছি? আমাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার মানদণ্ডগুলি কার ঠিক করে দেয়া? যতোটা অহংকার আমাদের করা উচিত, আমরা কি তার চাইতে বেশি অহংকার করে ফেলছি?

এখন আসি ‘কিছু একটা’কে চেনার শেষ উপায়টিতে। আমরা যখনই কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাই, তখনই ভেবে দেখি, আমি সে সিদ্ধান্তটা নিলে অন্য সবাই সেটাকে ভালো বলবে কিনা। সিদ্ধান্তটা সঠিক হোক, ভুল হোক, অন্য ১০জন যদি সেটাকে ভালো বলে, তাহলে আমি সেটা গ্রহণ করি; অন্য ১০জন যদি সেটাকে খারাপ বলে, তাহলে আমি সেটা আর গ্রহণ করি না। আমরা আসলেই এরকম করি কিনা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে নিজেদের কিছু প্রশ্ন করা যাক: অন্য কেউ কোনো একটা মতামতকে সমর্থন করে বিধায় আমিও কি সেটাকে সমর্থন করছি? নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে যখন নিজের পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, তখন তাকে আমার পরিবার সাদরে গ্রহণ করলে কি ভালোবাসা বেড়ে যায়? কিংবা প্রত্যাখ্যান করলে কি ভালোবাসা কমতে শুরু করে? আমার জীবনে এমন কেউ কি আছে, যার কথায় আমি অন্ধভাবে পাপেটের মতো নাচি? নাচলে, কেন নাচি? সে এমন বিশেষ কে, যার কথা আমাকে শুনতেই হচ্ছে?

তৃতীয়ত। আমাদের ঠিক করতে হবে, জীবনের কোন-কোন ক্ষেত্রে আমরা কারো মতামত বা পছন্দ-অপছন্দ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা চাইলেই আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিজের মর্জিমাফিক চলতে পারি না, এতদিনের অভ্যাস আর বিশ্বাস থেকে চট্‌ করে বেরিয়ে আসাটা সহজ নয়, তবে আমরা ক্ষেত্রগুলিকে কিছুটা কমিয়ে আনতে পারি। জীবনের কিছু-কিছু সিদ্ধান্ত আছে যেগুলি নেয়ার সময় অন্য কারো মতামতের উপর নির্ভর করলে সাড়া জীবনই আফসোস করে কাটিয়ে দিতে হতে পারে। যেমন, আপনি কাকে বিয়ে করবেন, আপনি কোন ক্যারিয়ারটা বেছে নেবেন, নিজের সন্তানদের কীভাবে মানুষ করবেন, এরকম নিতান্ত ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নিজের কাছে যা ভালো মনে হয়, তা-ই করা ভালো। নিজের বুদ্ধিতে যদি ভুল কোনো সিদ্ধান্তও নেয়া হয়ে যায়, তাও ততোটা দুঃখ হয় না, যতোটা হয় অন্য কারো বুদ্ধিতে সে একই ভুল সিদ্ধান্তটি নিলে। নিজের বুদ্ধিতে ভুল করলে সে ভুল থেকে বেরিয়ে আসার যতোটা চেষ্টা লোকে করে, অন্যের বুদ্ধিতে ভুল করলে সে ভুল থেকে বেরিয়ে আসার ততোটা লোকে করে না, কারণ সে ভুলের জন্য সে নিজেকে খুব সহজেই ক্ষমা করে দিতে পারে।

চতুর্থত। কে কী ভাবছে, এমন চিন্তাভাবনা আর সংস্কার, যেগুলি আপনাকে আপনার মতো থাকতে দেয় না, সেগুলি নিয়ে একটু ভাবা যাক।

১। আমরা ধরেই নিই, আমরা কী করছি, কেন করছি, কীভাবে করছি, এসব নিয়ে ভাবার জন্য আমাদের আশেপাশের সবাই হাঁ করে বসে আছে। আসলে কি তা-ই? লোকের কি খেয়েদেয়ে কাজের এতো অভাব পড়েছে যে আমাকে নিয়েই ভাবতে থাকবে? নাকি, আমি এমন কেউ হয়ে গেছি যে আমাকে নিয়ে না ভেবে লোকে পারে না? সত্যিটা হচ্ছে এই, আমাকে নিয়ে ভাববার মতো সময়ই কারো নেই!

২। আমি ভাবছি, খুব চেষ্টা করলে হয়তো আমি সবাইকেই খুশি করে চলতে পারবো! হ্যাঁ আমি যা ভাবছি, ঠিকই ভাবছি। আমার ৫০ হাজার জেনারেশন আগের পূর্বপুরুষটি পারলে আমি কেন পারবো না? কিন্তু আমি কি একবারও ভাবছি যে সেসময় একটা গোষ্ঠীতে হয়তো মাত্র ৪০ জন থাকত, যাদেরকে খুশি করাটা খুব অসম্ভব কিছু ছিল না। আর আজকের দুনিয়ায়, আমি অতি নিখুঁতভাবে যতো ভালো কাজই করি না কেন, সবসময়ই একদল লোক থাকবেই, যারা আমার কাজটি কোনোমতেই পছন্দ করবে না। তাই, আমি যদি এমন কোন দলকে খুশি করতে কাজ করি যে দলটির কাজকর্ম আমার নিজেরই অপছন্দ, তবে সেটা স্রেফ নিজেকে ধোঁকা দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি যখন সে দলের মধ্যে নিজেকে ভিড়িয়ে ফেলছি, ঠিক সে মুহূর্তে হয়তো আমার পছন্দের মানুষগুলি অন্য কোনো দলে নিজেদের ভিড়িয়ে নেবেন, আর আমি তাদের সঙ্গ থেকে নিজের অজান্তেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে দিচ্ছি।

৩। একটু খেয়াল করে দেখা যাক। যারা আমাকে পছন্দ করে না, আমার সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেয় না, আমার সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে, তাদের ৯৯.৭%ই এমনকিছু মানুষ, যাদের সাথে আমার জীবনের কোনোকিছুই মিলে না। যদি তা-ই হয়, তবে আমি তাদের কথা মানলাম কী মানলাম না, তাতে আমার ভবিষ্যৎ জীবনে কী এমন প্রভাব পড়বে? জীবনে চলার পথে তাদের সাথে তো আমাকে চলতেই হবে না। তবে কেন অনর্থক তাদের ভাবনার মতো করে আমার চলার পথটা ঠিক করছি?

৪। কিছু লোক থাকেই যারা নিজেরা তেমন কিছু করতে পারে না, কিন্তু অন্যের সমালোচনায় সবসময় নিজেদের ব্যস্ত রাখে। এ ধরনের লোকের বন্ধুত্ব হয় ওদের মতো আরো কিছু লোকের সাথে; এমনকি, ওদের প্রেমও হয় ওদের মতোই কিছু আজাইরা টাইপের মানুষের সাথে, যাদের কোনো কাজ নেই, যারা একত্র হলেই এমন লোকের গীবত করা শুরু করে দেয়, যে লোকটি ওইসময়ে ওখানে নেই। একজন আজাইরা মানুষ সবসময়ই আরেকজন আজাইরা মানুষের প্রেমে পড়ে। আমি আমার জীবনে বহু আজাইরা যুগলকে দেখেছি যারা নিজেদের মতো করে বেশ ভালো আছে, এবং তাদের আশেপাশের লোকজনকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। তারা সাধারণত কিছু ঈর্ষাপরায়ণ লোক যারা অন্যের ভালোকিছু দেখলে সহ্য করতে পারে না, কারণ তাদের নিজেদের ওরকম কিছু করার ক্ষমতা নেই। যে নিজে কোনোকিছু সৃষ্টি করতে পারে না, সে অন্যের সৃষ্টির সমালোচনা করার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায়। সৃষ্টি ভালো কী মন্দ, সেটা মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হল, সেটা নিয়ে যদি এমন কেউ কথা বলে, যে জীবনে কেবল বাজে কথাই বলতে শিখেছে, তবে সে সৃষ্টি নিয়ে বাজে কথাই বলবে। এমন লোকের প্রশংসা কিংবা নিন্দায় সত্যিই কিছু এসে যায় না, কারণ সত্যিকার অর্থে, এদের কারো উপকার বা অপকার, কোনটাই করার মতো ঘিলু নেই। ওদের কথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো বোকামি আর হয় না।

৫। যারা আমাদের ভালোবাসে, আমাদের আজকের অবস্থানের জন্য যাদের অবদান আছে, তারা যদি আমাদের কাজে হতাশ হয়, কিংবা বিরক্ত হয়, তখন? এরকম ভাবনা আমাদের মাথায় প্রায়ই আসে। আসলে যারা আমাদের ভালোবাসে, তারা নিশ্চয়ই আমাদের এমন কাজে বিরক্ত হবেন না, হতাশ হবেন না, যে কাজটি করলে আমরা ভালো থাকি। যদি ওরকম হনও, তবে নিশ্চিতভাবেই তাদের মধ্যে এমন কোনো ভয় বা আশংকা কাজ করছে যে, আমরা ওই কাজটি করলে অন্যরা কী ভাববে? যেহেতু, অন্যরা কী ভাবছে, সেটাকে অতো গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই, সেহেতু আমাদের সিদ্ধান্ত থেকে আমাদের সরে আসার কোনো দরকারই নেই। প্রকৃতপক্ষে, চরম বিপদের সময়ও পাশে পাওয়া যাবে, আমাদের জীবনে এমন লোকের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। তাই জীবনে চলতে গেলে সবার সব কথাকেই পরোয়া করে চলার সত্যিই কিছু নেই।

পঞ্চমত। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র যে ভয়টা, সেটার শক্তি আমাদের ভেতরের আমি’র শক্তির চাইতে অনেক কম। কেন? আমি মন থেকে যা করতে চাই, তা নিঃসন্দেহে আমার কাছে মজার বলেই আমি তা করতে চাই। আর অন্যদের খুশি করতে আমাকে যা করতে হয়, তা করাটা আমার জন্য মজার কিছু নয়, বরং বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর। আমি যা করতে চাই, তা করলেই আমি ভালো থাকব। একমাত্র আমরাই জানি, কোন কাজটা আমাদের জীবনকে আনন্দ দেবে, যা পৃথিবীর অন্য কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। যদি অন্য কারো কথা শুনে নিজের জীবন সাজাই, তাহলে জীবনের যে কয়টি রঙ অবশিষ্ট আছে, হয়তো সে কয়টিও চিরতরে হারিয়ে যাবে। কী দরকার এমন ঝুঁকি নেয়ার? মানুষ তাকেই সম্মান করে যে জীবনে এমনকিছু করতে পারে, যে কাজটা সে উপভোগ করে। কারণ ওরকম করতে পারলে ক্রমাগত সাধনার মাধ্যমে সে কাজটা অন্য যে কারো চাইতে দারুণভাবে সে করে দেখাতে পারে, কারণ সে কাজটা সে সবচাইতে ভালোভাবে পারে। এক্ষেত্রে লোকের কথায় নিজের কাজের ধরন নির্ধারণ করলে, ওরকম সম্মান পাওয়া সম্ভব নয়।

ষষ্ঠত। অন্যরা কী ভাবছে, কী বলছে, কী চাইছে, সেসব নিজের জীবনে গ্রহণ করে আমার কী লাভ হবে? আমি যেরকম, দিনের শেষে তো আমাকে সেই আমি’টাকে নিয়েই থাকতে হবে। অন্যের পৃথিবীর ‘আমি’ হওয়ার চাইতে নিজের পৃথিবীর ‘আমি’ হওয়াটাই বেশি গৌরবের, হোক সে পৃথিবীটা খুব ছোট, নিতান্তই নগণ্য, তাও তো সে পৃথিবী আমাকে থাকার জায়গা দিয়ে আসছে অনেকদিন ধরেই, পরম বিশ্বস্ততায়। নিজের মনের মতো হওয়ার জন্য সৎসাহস লাগে, যোগ্যতা লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে। সত্যি বলতে কী, আমরা যাকিছুর ভয় করে কোনো একটা কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি, খুব কম ক্ষেত্রেই তাকিছুর বাস্তব অস্তিত্ব থাকে, কিংবা থাকলেও সেসবকিছু ততোটা ভয়ের নয়, যতোটা ভয়ের আমরা সেগুলিকে মনে করি। নিজের ভাবনা আর নিজের স্বপ্নের উপর ভর করে এগিয়ে যেতে হবে, এর জন্য যদি কোনোকিছু বদলাতেও হয়, হোক সেটা অভ্যাস, দৃষ্টিভঙ্গি বা কাজের ধরন, তাও বদলাতে হবে।

যতো বেশি অন্যের ভাবনার সাথে মিল রেখে-রেখে জীবন কাটাবেন, আপনি ততো বেশি অন্যের ভাবনার দাস হয়ে পড়বেন। সবাইই অন্যের মুখে নিজের সম্পর্কে ভালো-ভালো কথা শুনতে চায়, এটা ঠিক, কিন্তু এর প্রকৃত প্রভাব কতটুকু? অনেকেই তো আছে, যারা স্বার্থ হাসিল করার জন্য আপনার সম্পর্কে ভালো-ভালো কথা বলে, আবার স্বার্থ ফুরোলেই ঠিক এর বিপরীত আচরণটাই করে। প্রশংসাকে সবসময়ই বিনয়ের সাথে গ্রহণ করুন, কিন্তু এর সাথে প্রশংসাকারীকে গ্রহণ না করলেই ভালো। বেশিরভাগ সময়ই, আপনার বুকে প্রথম ছুরিটা চালায় প্রশংসাকারীই, কারণ সে প্রশংসা করে-করে এর মধ্যেই আপনার কাছে নিজেকে বিশ্বস্ত করে ফেলেছে। এমনকি প্রশংসাটুকু গ্রহণ না করলেও জীবনে তেমন কোনোকিছুর হেরফের হয় না। কে আপনার সম্পর্কে কী ভাবল, তাতে আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না, আপনি যেমন ছিলেন, তেমনই থেকে যাবেন। আপনি ভালো থাকলেও সমালোচকদের কিছু এসে যায় না, আপনি খারাপ থাকলেও সমালোচকদের কিছু এসে যায় না। ওরা আপনার অবস্থা বা প্রকৃত ঘটনা বুঝে রায় দেয় না, ওরা সে রায়টাই দেয়, যে রায়টা দিলে ওদের ভালো লাগে, ওরা ভালো থাকে। কী দরকার ওদের কথায় নিজেকে বিচার করার? ওরা অনেকসময় অন্যদের কথা শুনেও নাচতে থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখুনতো, ওরা যা নিয়ে নাচানাচি করছে, তা নিয়ে ওরা ভালোভাবে কতটা জানে? আপনি যে আসলে কী, সেটা একমাত্র আপনি নিজে জানেন। অন্যরা বড়োজোর আপনার সম্পর্কে কোনো একটা অনুমান নির্ভর মন্তব্য করতে পারে। ওদের জন্য যা ঠিক, তা ওদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া, সে একই ঠিক ব্যাপারটি আপনার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। অনেকেই আছেন, যারা নিজেরা যে স্বপ্নটা পূরণ করতে পারেন না, তারা ধরেই নেন, আপনিও সে স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবেন না। তাদের নিজেদের সামর্থ্য সীমিত, তারা ধরেই নেয়, আপনার সামর্থ্যও ওরকম সীমিত। ওদের মন্তব্যে প্রভাবিত হয়ে আপনার নিজের স্বপ্নের পথ থেকে সরে আসার তো কোনো মানেই হয় না।

যখন কেউ আপনাকে বলে, অমুক শেয়ারে বিনিয়োগ কর, তখন আপনার উচিত, ভালো করে ভেবে নেয়া সে শেয়ারটিতে আদৌ আপনার বিনিয়োগ করা উচিত কিনা। কারণ, যদি সে শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করে আপনার লস হয়, তবে সে লসের বোঝা বহন করার জন্য উনাকে আর পাশে পাবেন না। নিজেকে আপনার সৌভাগ্যের ভাগীদার দাবি করতে চায়, এমন অনেককেই হয়তো আপনি পাবেন, কিন্তু আপনার সকল দুর্ভাগ্যের একমাত্র ভাগীদার এবং স্রষ্টা আপনি নিজে। দুর্ভাগ্য ভাগাভাগি করে নিতে কাউকেই পাশে পাবেন না। জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রেই এ কথাটি খাটে। সময়ের সাথে-সাথে বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলায়। যে আপনাকে আজ পূজা করছে, কাল সেই আপনাকেই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে তার দুই মিনিটও সময় লাগবে না। যে লোকের চিন্তাভাবনা এভাবে বদলায়, তাকে বা তার বিচারক্ষমতাকে এতো সিরিয়াসলি নেয়ার কী আছে? একটু ভাবুনতো, আপনি যার কথা ধরে এতোটা কষ্ট পাচ্ছেন, আজ থেকে এক বছর পর তার সাথে আদৌ আর দেখা হবে কিনা? অথচ এমনও তো হতে পারে, তার কথা অনুযায়ী চললে আজকে থেকে দশ বছর পরও কষ্ট পেতে হবে। আপনি যতো বেশি ভুল মানুষকে কেয়ার করে চলবেন, নতুন-নতুন ভুল মানুষ ততো বেশি আপনার জীবনে নাক গলাতে আসবে। কী দরকার সেধে-সেধে জীবনে যন্ত্রণা বাড়ানোর?

কীভাবে বুঝবেন, আপনাকে নিয়ে কে কী ভাবছে, এটা নিয়ে আপনি বেশ উদ্বিগ্ন? ওরকম হলে আপনি কোন ধরনের সমস্যায় পড়তে পারেন? আমার ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণ বলছি:

১। জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলির একটি হচ্ছে ‘না’ বলা শেখাটা। কে কী ভাববে, এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করে যারা, তারা লোকজনকে সহজে ‘না’ বলতে পারে না, সে ‘না’ বলতে না পারার কারণে তাদের যতো কষ্টই হোক না কেন!

২। আপনার লাইফে যদি আপনি সবাইকেই স্পেস দিতে শুরু করেন, তখন দেখবেন, সবাই ধরে নেবে আপনার লাইফের যেকোনো ব্যাপারে যেকোনো মন্তব্য করার অধিকারটা তারা পেয়ে গেছে।

৩। আপনাকে নিয়ে কে কোথায় কী বলল, আপনি যতো বেশি সেটা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়বেন, ততো বেশি লোকজনের নানান বিরূপ উদ্ভট চিন্তাভাবনা আপনাকে সহ্য করতে হবে।

৪। একটা কথা খুব সত্যি। আপনার ব্যক্তিগত দুঃখ বা আবেগের কোনো দামই কারো কাছে নেই। এটা মেনে নিন। নিজের কষ্টকে মার্কেটিং করার চাইতে বড় বোকামি আর হয় না। কারো সামনে কাঁদবেন না। কারো সামনে কাঁদলে ওরা খুব সহজেই বুঝে যাবে, কোন ব্যাপারটা নিয়ে আপনি সংবেদনশীল বা দুর্বল। আপনার চোখের জল দেখে কিছু লোক বিরক্ত হবে, কিছু লোক ফায়দা লুটতে চাইবে। যতো বেশি নিজের যন্ত্রণার কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলবেন, ততো বেশি লোকের উটকো পোদ্দারি সহ্য করতে হবে।

৫। আপনি নিজে কষ্ট পেলেন কী খুশি হলেন, সেটা না ভেবে অন্যরা খুশি হলো কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে শুরু করলে আপনার মধ্যে সবসময়ই আফসোস, অস্বস্তি আর অশান্তি কাজ করবে। কারণ, সবাইকেই খুশি করে চলা পৃথিবীর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

৬। আপনি যদি সবসময়ই আপনার আশেপাশের সবার মনোযোগ চান, তবে আপনার কাজকর্ম বা চিন্তার ধরন পুরোপুরিই অন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। এতে করে আপনার কাজের মান হ্রাস পাবে। এরকম অ্যাটেনশন-সিকাররা কখনো স্বস্তিতে থাকতে পারে না। লাইকের চাইতে লাইফের দাম অনেক বেশি।

৭। আপনি প্রায়ই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন। কারণ, অন্যরা কী বলবে, তার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হবে।

৮। আপনার জীবনটা যদি অন্যের সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়, তবে আপনার মনোবল আস্তে-আস্তে কমতে থাকবে। আপনার মধ্যে সবসময়ই এই ধারণাটা কাজ করবে যে, একটা কাজকে সঠিকভাবে করার জন্য অন্যকেউ যে উপায়টা বলবে, সেটা আপনার নিজের উপায়ের চাইতে ভালো।

৯। আপনি দেখবেন, আপনি এমনকিছু বলতে চাইছেন না, যা কাউকে আহত করতে পারে; আপনি এমনকিছু করতে চাইছেন না, যেটা কেউ অপছন্দ করতে পারে। আপনি ক্রমেই নিজেকে একটা গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলছেন। একসময় আপনার কাজের ইচ্ছে এবং গতি দুইই স্তিমিত হয়ে পড়বে।

১০। আপনি নিজেকে অন্যদের চাইতে স্মার্ট ভাবতে শুরু করবেন। আপনি যা বলবেন, তা যেন সবাই শোনে। আপনি যা করবেন, তা দেখে যেন সবাই তালি দেয়। সবাই যেন আপনার প্রশংসা করতে থাকে। এরকম করতে থাকলে একসময় আপনি হতাশায় এবং হীনমন্যতায় ডুবে যাবেন। অন্যের প্রশংসার ক্রীতদাস হয়ে জীবন কাটানো মৃত্যুর সমান।

কারো মতামতের প্রকৃত গুরুত্ব আসলে কতটুকু? ততটুকুই যতটুকু আপনি গ্রহণ করছেন। যেকেউ এসে যেকোনো কিছু আপনার সামনে বলে গেলে আপনি নিশ্চয়ই সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, সাধারণত আপনার বন্ধু, পরিজন বা পরিবারের কোনো ব্যক্তিকেই খুশি করার জন্য আপনি বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যের ভিন্ন মতকে শুনবেন, সেটাকে সম্মান করবেন, যতটুকু আপনার নিজের জীবনের সাথে যায়, ততটুকু গ্রহণও করবেন, কিন্তু তা যেন আপনাকে উদ্বিগ্ন করে না তোলে। আপনার সম্পর্কে কে কী বলে, কেন বলে, এসবকিছু আপনার নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে, কিন্তু আপনি কতটুকু গ্রহণ করবেন বা করবেন না, এর নিয়ন্ত্রণ কিন্তু পুরোপুরি আপনার নিজের হাতে। যতজন ব্যক্তির সাথে আপনার ভাবনা বা কাজ সম্পর্কে কথা বলবেন, আপনি ততটা (এমনকি তার চাইতে বেশি!) ভিন্ন মত হয়তো পাবেন। সবার কথাই শুনুন, এরপর নিজের বিবেক বুদ্ধি স্বজ্ঞা যা করতে বলে, তা-ই করুন। যদি সবাইকেই খুশি করতে চান, তাহলে তো সবার মতামতকেই গ্রহণ করতে হবে আর বারবার আপনার সিদ্ধান্ত বদলাতে হবে। হয়তোবা ওই সিদ্ধান্তটি উনার জীবনে খাটে, আপনি তো আপনার নিজের জীবনেই বাঁচছেন, উনার জীবনের জন্য যা খাটে, আপনি আপনার জীবনে কেন সেটা গ্রহণ করতে যাবেন? জীবনের অভিজ্ঞতা এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একেকজনের একেকরকম। পাছে-লোকে-কিছু-বলে’র একটা অদ্ভুত মধুর সমস্যা আছে। কীরকম? বেশিরভাগ সময়ই আমরা যখন মাথায় আনি, লোকে কী বলবে, তখন প্রকৃত ঘটনা এই যে, লোকে আসলে কিছুই বলবে না, লোকের অনেক কাজ আছে, আমি এমন কেউ নই যে আমাকে নিয়ে চিন্তা করে-করে লোকের ঘুম হারাম হয়ে যাবে! আমি তো আর কারো মন পড়তে পারি না, তাই, অন্যের মনে কী আসতে পারে কী আসতে পারে না, এসব নিয়ে যা কিছু ভয়, তার উৎপত্তি এবং বিকাশ দুটোই আমার নিজের মনের ভেতরে। তাছাড়া, আপনাকে কে কীভাবে নিচ্ছে, সেটা তাদের ব্যাপার, আপনার নয়। দেখবেন, আপনার সম্পর্কে এমন-এমন লোকও মন্তব্য করে বসে, যার সাথে আপনার কখনো দেখাই হয়নি, যে আপনাকে চেনেই না। যদি আপনার সম্পর্কে না জেনে কেউ কোনো মন্তব্য করেই বসে, সে লোক নিশ্চয়ই গুরুত্ব পাওয়ার মতো দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন কেউ নয়। কি দরকার তার কথাকে পাত্তা দিয়ে তাকে জাতে তোলার? পুরো বিষয় না জেনেই যে মন্তব্য করে, সে তো পাত্তা পাওয়ারই তো যোগ্য নয়। হোক, সে সামাজিকভাবে অনেক উঁচু অবস্থানের কেউ, লোকে তাকে সম্মান করে। আপনার কী তাতে? আপনার কাছে ও একটা ফালতু লোক, এটাই তার একমাত্র পরিচয়।

সবসময়ই এমন লোকের সাথে মিশুন, যারা আপনার খারাপটা দেখার পাশাপাশি ভালোটাও দেখতে পায়। যারা শুধু আপনার খারাপটাই দেখে, আর আপনি ভালোকিছু করতে গেলে বিভিন্ন কথা আর কাজের মাধ্যমে আপনাকে বাধা দেয়, তাদেরকে আপনার জীবন থেকে বাইরে রাখুন। প্রয়োজনে আপনি নিজেই সরে আসুন তাদের জীবন থেকে। থাকুক না তারা তাদের নিয়মে ভালো! তাদেরকে ভালো রাখুন, আপনার নিজেকেও ভালো রাখুন। যখন কেউ চায় আপনাকে কোনো একটা কাজ করা থেকে দমিয়ে রাখতে, একটু ভেবে দেখুনতো, আপনি কি এমনকিছু করতে পারছেন, যা তারাও করতে চায়, কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে করতে পারে না? আপনি কিছু মানুষের কাছ থেকে গুরুত্ব পাচ্ছেন, যা সে অনেক চেষ্টা করেও পাচ্ছে না? যদি ওরকমই হয়, তবে সে আপনাকে যেকোনোভাবে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আপনি যা, তা-ই দেখান পৃথিবীকে। ফেসবুকে যখন কোনো তথ্য দেবেন, কোনোকিছু শেয়ার করবেন, তখন হয় এমনকিছু শেয়ার করবেন, যা শেয়ার করার সময় আপনাকে কোনো সত্যই আংশিক বা পুরোপুরি আড়াল করতে হয় না, অথবা যদি আড়াল করতেই হয়, সেটা শেয়ার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। অকপটভাবে সৎসাহস নিয়ে চললে, কোনো ভুল তথ্য না দিলে, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো চারিত্রিক মনোবল থাকলে অন্যদের কথাকে ততোটা পরোয়া না করেও চলা যায়। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি সফল ব্যক্তিরা কখনোই অন্যদের বা সমালোচকদের পাত্তা দিয়ে চলেন না। ওরা খুব ভালো করেই জানে, সমালোচকরা সফল হতে পারেনি বলেই সমালোচনা করার অফুরন্ত সময় পায়।

যে আপনাকে খাওয়ায়ও না পরায়ও না, যদি তার কথাকে কেয়ার করে চলাটা আপনার চাকরি বা ব্যবসার জন্য অপরিহার্য না হয়, তবে কেন আপনাকে তার কথা মাথায় রেখে চলতে হবে? আপনি ভালো থাকলেও আপনার নিজের যোগ্যতায় থাকবেন, খারাপ থাকলেও আপনার অযোগ্যতা বা দুর্ভাগ্যের কারণে থাকবেন। সেখানে অন্য কারো কথা কেন শুনতে হবে? আপনি কীসে অনুপ্রাণিত হন, কীসে ভালো অনুভব করেন, কীসে আপনার কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়, তা তো কেবল আপনিই জানেন। অন্যকেউ যদি আপনাকে জাজ্‌ করে, তবে সেটা হবে স্রেফ অনুমাননির্ভর একটা মতামত। আপনি কী চান, তা আপনার মনের মধ্যে লিখে রাখুন। সেটা পেতে হলে আপনার কী কী করা উচিত, কীভাবে করা উচিত, কেন করা উচিত—একটা নোটবুকে লিখতে থাকুন, এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। যদি আপনি এটা সত্যিই করতে পারেন, তবে নিশ্চিত থাকুন, আপনি ঠিক পথেই আছেন। কে কী বলল, সেটার সাথে আপনাকে লক্ষ্যের কীসের সম্পর্ক? বরং সবার কথাই গুরুত্ব দিতে গেলে আপনি আপনার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারেন। পৃথিবীতে শুধু একজন ব্যক্তিই আপনাকে সুখী রাখতে পারে, এবং সে ব্যক্তিটি আপনি নিজে। আর কেউই আপনাকে সুখী করতে পারবে না। আপনি নিজে না চাইলে পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যা আপনাকে ভালো রাখতে পারে। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব যতো বেশি অন্য কারো হাতে দিয়ে দেবেন, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত যতো বেশি অন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে ফেলবেন, আপনি ততো বেশি বিমর্ষ হয়ে থাকবেন, অন্যের ইচ্ছাঅনিচ্ছার ক্রীতদাস হয়ে পড়বেন।

আপনার জীবনযাত্রার মান আপনার সামাজিক অবস্থান, রুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী আপনি নিজে ঠিক করবেন। অন্য কারো মতামত এক্ষেত্রে সত্যিই অর্থহীন। এক সমুদ্র জল মিলেও একটা সামান্য জাহাজকে ডোবাতে পারে না, যদি না জাহাজে জল ঢুকতে পারে। ঠিক একইভাবে পৃথিবীসুদ্ধ মানুষের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বা মতামত আপনার ভাবনা বা কাজকে প্রভাবিত করতে পারবে না, যদি না আপনি নিজে তা গ্রহণ করেন। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এমনিতেই অনেক ভারি-ভারি বোঝা বহন করে চলতে হয়। তার উপর যদি আমরা আবার অন্য লোকের ভাবনা আর মতামত নিজের মধ্যে নিয়ে নিজেকে আরো ভারি করে ফেলি, তাহলে তো বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়বে! অন্যের মাথা আর মুখকে নিজের মাথায় না নিয়ে চলতে জানাটা মস্তো বড় একটা আর্ট। একবার এই আর্ট রপ্ত করে ফেলতে পারলে দেখবেন, আপনার পুরো পৃথিবীটাই বদলে গেছে। সত্যিটা হল এই, কেউ আসলে আপনি কী করলেন, কী করলেন না, এটা কেয়ার করে না। তারা স্রেফ জাজ্‌ করে। সব জায়গাতেই থাকে কিছু লোক, যারা নিজেরা কী করে কী করে না, তার ঠিক নেই, অথচ আপনি কী করলেন কী করলেন না, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে দারুণ উৎসাহী। দরকার কী তাদেরকে এক পয়সারও দাম দেয়ার? আপনার ভালোথাকা বা মন্দথাকায় অন্য লোকের মতামতের ভূমিকা ঠিক ততটুকুই, যতটুকু আপনি উনার সে মতামতকে গ্রহণ বা বর্জন করছেন। অন্য লোক কী ভাববে, এটাকে যতো বেশি মাথায় রেখে চলবেন, আপনার স্বাভাবিক কাজকর্ম ততো বেশি ব্যাহত হবে। লোকের স্বভাবই হচ্ছে কোন বিষয়ে কথা বলতে হবে, কখন বলতে হবে, কাকে বলতে হবে, কীভাবে বলতে হবে, এসবকিছু না জেনে না বুঝেই ফস্‌ করে কিছু একটা বলে ফেলে। ওর মাথায় কিছু একটা এসেছে যা ওর বলতে খুব ইচ্ছে করছে এবং সেটা সে বলে ফেলতে পেরেছে, এইটুকুতেই সে মহাখুশি। লোকের সব কথাকেই ধরে জীবন কাটালে কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটানো সম্ভব নয়।

হ্যাঁ, আমাদের লোকের কথায় কিছুটা কান দিতেই হয়। তবে যেন সেটা কোনোভাবেই আমাদের স্বকীয়তাকে নষ্ট করে না দেয়, আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে না দেয়, আমাদের মানসিক শান্তির বিঘ্ন না ঘটায়। হাসানের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। হাসানের ইচ্ছে ছিল গায়ক হবে। গাইতও বেশ দারুণ, কিন্তু গান গেয়ে জীবন কাটিয়ে দিলে লোকে কী ভাববে, সেটা ভেবে অল্প বয়সে হাসান তার পারিবারিক ব্যবসায় ঢুকে গিয়েছিলো, এবং আফসোস করেই জীবনের আরো ২২টা বসন্ত কাটিয়ে দিল। তার আফসোস একটাই: আহা! আমার গলা কত ভালো ছিল! এই ২২ বছর গানের পেছনে লেগে থাকলে অনেক বিখ্যাত গায়ক হয়ে যেতে পারতাম! জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। অথচ, ততদিনে হাসান বেশ ভালো একজন ব্যবসায়ী। কিন্তু ওই যে তার অধরা স্বপ্নটা! সে অন্য যা-ই কিছু করুক না কেন, সে স্বপ্নটা তাকে কিছুতেই ভাবতে দেয় না যে সে জীবনে কিছু করতে পেরেছে। স্বপ্নের কাজটি যারা করতে পারে না, তাদের সারাজীবনই এমন মনে হতে থাকে। যার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, কিন্তু হতে পারেনি, তার হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী এনে দিলেও সে ভাববে, জীবনে সে কিছুই পেলো না। হাসানের কিন্তু গানটা একেবারে ছেড়ে দেয়ার কোনো দরকার ছিল না। ব্যবসায়ে একটু কম সময় দিয়ে গানটা ধরে রাখতে পারতো। হয়তো ব্যবসাটা আকারে একটু ছোট হতো, কিন্তু এমন আফসোস নিয়ে তো বাঁচতে হতো না, জীবনটাকে অনর্থক অপচয় মনে হতো না। ব্যবসা বা চাকরির আকারটাকে একটু ছোট করে জীবনটাকে একটু বড় করে নিলে ক্ষতি কী? ওতে যোগবিয়োগে লাভের অংকটাই তো বাড়ে। লোকে ওকে দেখলে কী বলছে, ওর সম্পর্কে কী ভাবছে, ও রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ওর পেছনে কী বলছে, ওর পোশাকটা নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করছে কিনা, এসব ভাবনা হাসানের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ও কিন্তু জানে, আসলে এসবের কিছুই কেউ করছে না, অথচ ওর মনে এসব বিষয় সারাক্ষণই খচ্‌খচ্‌ করতে থাকে। হাসান এখনো জানে না, কী পেলে ওর ভালো লাগবে। ওর খুব ইচ্ছে, স্ত্রী সন্তানসহ কানাডায় গিয়ে ছোটোখাটো একটা ব্যবসা শুরু করে। এই কাজটা করার জন্য পর্যাপ্ত টাকাও তার কাছে আছে। কিন্তু কেন জানি, সে এটা করতে পারে না। বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, দেশ ছেড়ে যাওয়ার মতো ততো কম বয়সও তার নয়, এমন সময়ে নতুন করে জীবন শুরু করলে লোকে কী ভাববে? কিন্তু, কোন লোকে? হাসান নিজেও সেটা জানে না। শুধু জানে, কেউ কিছু ভাববে। হাসান কীভাবে যেন জেনে গেছে, সে যা পছন্দ করে, সেটা একমাত্র সে একাই পছন্দ করে। অন্যদের পছন্দ আর যা-ই হোক, ওর পছন্দের মতো নয়। সবাই ওকে, ওর কাজকে অপছন্দ করে। এটা কি আসলেই সম্ভব? কেউ-কেউ ওকে পছন্দ করবে, কেউ-কেউ ওকে দেখে বলবে, “না ঠিক আছে, চলে আরকি!” কেউ-কেউ বলবে, “হাসান এমন কেন?” কেউ-কেউ বলবে, “ধ্যত্‌! কী বিরক্তিকর আর বাজে একটা লোক!” ঠিকই তো আছে। সবাই কেন হাসানকে ভালো বলবে? কিন্তু কেন জানি, হাসান এই সত্যটা মেনে নিতে পারে না। পারে না বলেই, কেউ ওর সম্পর্কে কিছু বলুক আর না বলুক, ওর সবসময়ই মনে হতে থাকে যে, সবাই ওকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলছে! বনের বাঘ আসুক না আসুক, মনের বাঘের ভয়ে হাসান অস্থির হয়ে থাকে সবসময়ই!

যদি আমরা সত্যিই জানতাম, অন্যরা আমাদের নিয়ে আসলেই কত কম ভাবে, তাহলে আমরা ‘কে কী ভাববে’ ভাবনায় নিজেদেরকে সবসময় এমন উদ্বিগ্ন করে রাখতাম না। আমার নিজের কথা বলি। আমি যখন প্রথমদিকে অনেক লোকের উদ্দেশ্যে কথা বলতাম, তখন শুধুই মাথায় আসত, আমার দাঁড়ানোটা ঠিক হচ্ছে তো? কেউ আমার কথা শুনে হাসছে নাতো? আমার কথাগুলি এতোটা বিরক্তিকর শোনাচ্ছে নাতো যে কেউ হয়তো এখুনিই ঘুমিয়ে পড়বে? আমার উচ্চারণে কোনো জড়তা কাজ করছে নাতো? আমার ড্রেসআপটা ঠিক আছে তো? (এমনকি প্রায়ই মনে হতো, আমার প্যান্টের জিপার খুলে গেছে। স্টেজে ওঠার আগেই জিপার চেক করে নিতাম, তাও মনে হতো, যদি কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে জিপার খুলে যায়, তখন কী হবে?) আমি খুব করে চাইতাম যাতে আমি যা যা বলছি, লোকে সে কথাগুলি খুব পছন্দ করে। আমি যা-ই বলবো, লোকে তা-ই পছন্দ করবে! ভাবতে পারেন, কেমন করে ভাবতাম একসময়! এখন আর ওরকম কিছু মাথায় আসে না। আমি জানি, আমাকে কিছু কথা বলতে হবে। আমি এও জানি, আমি যা বলবো, যেভাবে বলবো, লোকে সেটা পছন্দ করবে, কারণ আমি এমনকিছু বলবো না যা লোকের পছন্দ হবে না। হয়তোবা আমি জানিই যে, আমি যা বলছি, তার সবই বাজে, লোকে আমার কথা শুনে খুবই বিরক্ত হচ্ছে, আমি এতোটাই বাজেভাবে বলছি যে আমার এখুনিই কথা বলা বন্ধ করে স্টেজ থেকে নেমে যাওয়া উচিত। অথচ, আমি বলেই যাচ্ছি বলেই যাচ্ছি, কারণ আমি জানি আমি যা যা উল্টাপাল্টা ভাবছি, তার একটিও ঠিক নয়। আমি যা বলছি, যেভাবে বলছি, যতটুকু বলছি, তার উপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে, আমার শ্রোতারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করুক না করুক, আমার বক্তব্যকে পছন্দ করছে, এবং পছন্দ করছে বলেই এখনো শুনে যাচ্ছে। এই আত্মবিশ্বাসটা খুব জরুরি। এর ফলে নিজের প্রতি আর শ্রোতাদের প্রতি সম্মান অনেক বেড়ে যায়। একবার এক অনুষ্ঠানে সাড়ে ৫ হাজার লোকের সামনে দাঁড়িয়ে ৬-৭ ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। অনেকেই বসার জায়গা না পেয়ে পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি জানতাম, কেউ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে না, কেউ আমার কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছে না, আমি কারো সময় নষ্ট করছি না। যদি আমার স্পিচে কারো আপত্তি থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সে এতক্ষণ সময় ধরে আমার বক্‌বক্‌ শুনত না। তাহলে আমার কথা বলতে সমস্যাটা কোথায়? আর যদি আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কেউ আমার কথা শুনতে থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে নির্বোধ। নির্বোধের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার তো কোনো মানেই হয় না।

আপনি আসলে কী, আর আপনাকে দেখলে কী মনে হয়—এ দুটো ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন। লোকে আপনার সম্পর্কে মন্তব্য করে আপনাকে দেখলে তাদের মাথায় আপনার সম্পর্কে কী ধারণা কাজ করে, তার উপর। আপনি নিজে তো জানেন, আপনি আসলে কী, তারা আপনাকে নিয়ে যা ভাবছে, সেটা তো তাদের ব্যাপার। ওতে আপনার কী এসে যায়? লোকের মতামতকে সঠিক পথে পরিচালনার মহান দায়িত্বটা তো আর কেউ আপনাকে দেয়নি, তাই না? ভাবুক না ওরা ওদের মতো করে! ওতে যদি ওরা একটু শান্তি পায়, অসুবিধাটা কোথায়? আপনার ধারণা, আপনি যখন অন্যদের সম্পর্কে ভাবেন কিংবা বলেন, তখন ওদের ভালোটাই দেখেন; আর অন্যরা যখন আপনার সম্পর্কে বলেন বা ভাবেন, তখন আপনার বাজে দিকটাই ওদের চোখে পড়ে। কেন আপনার এরকম মনে হয়, জানেন? কারণ, আপনার ধারণা, আপনি ওদের চাইতে ভালো। এই ধারণার কারণে অন্যের সম্পর্কে আপনি এমন-এমন ধারণা মনের মধ্যে গেঁথে বসে থাকেন, যেগুলি আদৌ সত্যি নয়। পৃথিবীর সবাইই কিন্তু আপনাকে কুৎসিত ভাবে না, বাজে মনে করে না, আপনাকে নিয়ে খারাপ কথা বলে না। আপনার মনের কল্পিত ভয়ই আপনাকে শেষ করে দিচ্ছে। বাঘ এমনিতেই যথেষ্ট ভয়ংকর একটা প্রাণী, কল্পনার রঙ মিশিয়ে তাকে আরো ভয়ংকর বানিয়ে আপনার বাড়তি কী লাভটা হচ্ছে?

চার্লস ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদ নিয়ে এতোটাই অস্বস্তিতে ছিলেন যে, উনি ঠিক করতে পারছিলেন না, ওই তত্ত্বটি আদৌ কি প্রকাশ করা উচিত কিনা। কিন্তু নিজের সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ অস্বস্তির চাইতে বড় ছিল বলেই আমরা আজ ডারউইনের তত্ত্ব সম্পর্কে জানি। কম্পিউটার সম্পর্কে যখন কেউ তেমন একটা জানতোই না, সেসময়, কম্পিউটারের পেছনে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে লোকে কী ভাববে, এটা মাথায় নিয়ে বসে থাকলে বিল গেটস্ বিল গেটস্ হতে পারতেন না, বরং বসে-বসে এই ক্লান্তিকর লেখাটি লিখতেন আপনাদের কিছু সময় চুরি করার জন্য! “আপনি কী করেন?” “আমি মিউজিক কম্পোজ করি।” এটা বলার মতো কোনো ক্যারিয়ার হল? এরকম করে ভাবলে বিটোফেন হয়তো ভালো মাইনের চাকরি জোটাতে পারতেন, তবে গ্রেট হতে পারতেন না। কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আপনার সবচাইতে সেরা কাজটিও অপছন্দ করার জন্য হাঁ করে বসে আছে। কিন্তু এর জন্য কি আপনি দায়ী? আপনি কি সে ব্যক্তিকে আপনার সমালোচনা করার জন্য মাইনে দেবেন কথা দিয়েছিলেন কখনো? নেই কাজ তো খৈ ভাজ! কিন্তু যে বেচারা কাজের অভাবে বেকার, সে খৈ ভাজার প্রয়োজনীয় উপকরণ ধান কিনবেটা কীকরে? টাকার অভাবে সে বেচারা খৈ’টাও ভাজতে পারে না। অগত্যা, কী আর করা! মনের দুঃখে সে আপনার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে শুরু করে। ওর এই কাজটি আপনি চাইলেই করতে পারবেন না। কারণ, কারো চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে চাইলে তো আপনাকে প্রথমেই তার চৌদ্দ গুষ্ঠির খোঁজখবর নিতে হবে। অতো সময় কোথায় আপনার? আপনি তো আর বেকার না। কিছু লোক চাকরি না পেয়ে বেকার, কিছু লোক চাকরি পেয়েছে বলে বেকার। বড়ই বিচিত্র মানুষের চরিত্র!

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আমরা কেউই এমন বিশেষ কেউ নই যে, অন্যরা আমাদের নিয়ে ভাবার জন্য অনেক সময় দিয়ে দেবে। হাত বাড়ালেই তো সময় কাটানোর জন্য স্মার্টফোন পাওয়া যায়, আমাদের মধ্যে এমন কী আছে যা স্মার্টফোনের চাইতেও মজার? বিজ্ঞান দাবি করছে, প্রতিদিন একজন মানুষের মাথায় ৫০ হাজারেরও বেশি চিন্তা খেলা করে। এর মানে হল, কেউ যদি আমাদের নিয়ে দিনে ১০ বারও চিন্তা করে, সেটা তার প্রাত্যাহিক মোট ভাবনার মাত্র ০.০২%। প্রায় প্রত্যেকেই এমন একটা পৃথিবীতে বাস করে যেখানে চারিদিকে কেবল ইগো’র রাজত্ব। সে রাজ্যে আছে—আমি, আমার, আমাকে। সেখানে আপনার অস্তিত্বটা কোথায়, বলুনতো? নেহায়ত যদি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে নাড়া দেয়ার মতো কিছু না করে থাকেন, তবে আপনাকে নিয়ে সময় দেয়ার মতো সময় দেয়ার জন্য কেউই বসে নেই। যখন গান শেষ হওয়ার পর শ্রোতারা হাততালি দেয়, তখন তাদের মধ্যে কতজন গান ভালো লাগে বলে তালি দেয়? বেশিরভাগই তালি দেয় সবাই তালি দেয় বলেই। সবাই তালি দিচ্ছে, সে তালি না দিলে দেখতে খারাপ দেখায় না? আর সবাই তালি দিচ্ছেই যখন, তখন নিশ্চয়ই গানটা তালি পাওয়ার মতোই কিছু একটা ছিল! লোকের নিজস্ব মতামত প্রায়ই ধার-করা মতামত।

একই ব্যক্তি ভিন্ন দুই রকম পরিস্থিতিতে একই ঘটনায় ভিন্ন দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এমন প্রতিক্রিয়ার দুই পয়সারও কি দাম আছে? কাউকে কোনো একটা ঘটনা জাজ্ করতে বলে দেখুন, সে কী কাণ্ডটা করে! সে দেখবে, তার আশেপাশের সবাই ঘটনাটিকে কীভাবে দেখছে। এরপর দেখবে, ঘটনাটিকে কীভাবে নিলে সবাই তাকে বাহবা দেবে, কিংবা তার ভাবনাটা সবার কাছে জনপ্রিয় হবে। বেশিরভাগই লোকেরই নিজস্ব মতামত বলে আসলে কিছু নেই। তাই ওদের কথা বা ধারণাকে পাত্তা দেয়ারও তেমন কিছু নেই। আপনি যা বিশ্বাস করেন, যা ঠিক বলে মনে করেন, সেটাকেই অকপটভাবে তুলে ধরুন, এবং শেষ পর্যন্ত সেটাতেই স্থির থাকুন। দেখবেন, যারা আড়ালে আপনার সম্পর্কে নানান কথা ছড়ায়, ওরাও একদিন আপনাকে সম্মান করতে শুরু করবে। আর যদি তা নাও করে, তাতেও কিছু এসে যায় না। যাকে সবাই পছন্দ করে, তার চাইতে যাকে তার পরিবারের লোকজন আর কিছু প্রকৃত বন্ধুবান্ধব পছন্দ করে, সে বেশি সৌভাগ্যবান। যথেষ্ট সময় নিয়ে খুব ভালো করে ভেবে দেখুনতো, আপনার বিপদের সময়ে কে কে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছে কিংবা দাঁড়াবে? আপনি যেদিন বিপদে পড়বেন, সেদিন দেখবেন, এতদিন ধরে ভুল মানুষগুলিকেই ঠিক মানুষ মনে করে ওদের পেছনে অহেতুকই অর্থ, সময়, চিন্তা নষ্ট করে এসেছেন। আপনার বিপদের সময় হাতেগোনা দুএকজন আন্তরিকভাবে আপনার পাশে আছে, আপনি যতো বাজে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, এরা কোনো অবস্থাতেই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। জীবনে চলার পথে একমাত্র তাদের মতামতকেই গুরুত্ব দিন। এর বাইরে আর কোনো ব্যক্তিকেই আপনার জীবনে তেমন কোনো কাজে লাগবে না। তাদের মতামতকে হাসিমুখে এক কান দিয়ে শুনে অট্টহাসিমুখে অন্য কান দিয়ে বের করে দিন।

একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা কী কী জিনিস অপছন্দ করি, একটা কাগজে লিখে ফেলা যাক। কোন-কোন ব্যাপারে আমাদের অস্বস্তি হয়, লিখে ফেলি। ধরুন, শীতকালে বরফশীতল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করার ভাবলেই আপনি ভয়ে আঁতকে ওঠেন। কাগজে লিখে ফেলুন, ‘ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা।’ লেখা শেষ? বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকুন। কাজটা একবার করুন, দুইবার করুন, তিনবার করুন। এরপর দেখবেন, আস্তে-আস্তে আপনার ভয়টা চলে যাচ্ছে। ভয়ের জিনিস ততোটাই ভয়ের, আমরা সেটাকে যতোটা ভয়ের মনে করি। ভয় আর অস্বস্তিকে জয় করতে শিখুন, নিজেকে নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে আনুন, দেখবেন, লোকের কটু কথা আপনাকে আপনার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে পারবে না। কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন? সেখানে যদি আপনার কোনো পরিচিত লোকজন থাকে, তাদেরকে অতো ঢাকঢোল পিটিয়ে জড়ো করার কোনো মানে নেই। নিজেই নিজের বুদ্ধিতে নিজের মতো করে ঘুরে বেড়ান। দুপুরের আর রাতের খাবারটা নিজের টাকায় খান, নিজের টাকা খরচ করে চলুন। দেখবেন, আপনার জীবনের উপর মাতব্বরি করার লোক কমে গেছে, কিংবা থাকলেও তাদেরকে আপনি পাত্তাই দিচ্ছেন না।

ছোটবেলা থেকে মানুষ যতোটা আদর পেয়ে বড় হয়, বড় হওয়ার পর সে তার আশেপাশের লোকজনকে ততোটা আদরে রাখার চেষ্টা করে। তবে সবাইকে সমান আদরে রাখতে গেলেই আসল বিপত্তিটা শুরু হয়। কেউ কারো কথা কতটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে বা করে না, তা নির্ভর করে মূলত ওই দুইজনের মধ্যকার সম্পর্কের উপর। কাদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত? নিজের জীবনসঙ্গী, বাবা-মা, সন্তান, খুব কাছের বন্ধুবান্ধব বাদে তিন ধরনের মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমার কাছে মনে হয়: যারা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। যাদের মতামতকে গ্রহণ করাটা আপনার চাকরি বা ব্যবসার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা অবস্থানে, বুদ্ধিতে বা যোগ্যতায় আপনার সমকক্ষ। এর বাইরে আর কাউকেই আপনার জীবন সম্পর্কে মাস্টারি করতে না দেয়াই ভালো। সব আত্মীয়স্বজনকেই আপনার বা আপনার পরিবার সম্পর্কে মন্তব্য করতে বা সিদ্ধান্ত দিতে দেবেন না। ওদের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা কম বুঝে বেশি কথা বলে; আবার অনেকে আছে যারা আপনার বা আপনার পরিবারের ভালো চায় না, কিন্তু যেহেতু আপনার আত্মীয়, সেহেতু অন্য সবাই তার কথা শুনে ভাববে, আপনার ভালোর জন্যই সে কথাটা বলছে। জীবনে ভালো থাকতে চাইলে এরকম আত্মীয়স্বজনের মতামতকে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও অমান্য করুন। আপনার সম্পর্কে আপনার জীবনসঙ্গী, বাবা-মা, সন্তান, কিছু প্রকৃত বন্ধুবান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের মতামত গ্রহণ করে জীবনে চলার কিছু স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে নিন। সেসব স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে ভিন্ন কোনো মতামতকে গ্রহণ করার আগে ভালোভাবে যাচাই করে নিন। আর যাচাই করার সময় না থাকলে আপনার নিজের বুদ্ধি আর বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নিন।

আপনি বাইরে বের হচ্ছেন না আপনার শার্টে একটা ঝোলের দাগ আছে বলে? হাসছেন না আপনার সামনের দুটো দাঁত উঁচু বলে? মুখ বন্ধ করে আছেন সুন্দর করে কথা বলতে পারেন না বলে? লোকের সমালোচনা গ্রহণ করে চুপচাপ বসে থাকলে কি ঝোলের দাগটা আপনিই উঠে যাবে? উঁচু দাঁত হুট্ করে নিচু হয়ে যাবে? হঠাৎই সুন্দর করে কথা বলতে শুরু করে দেবেন? কেন নিজেকে নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আটকে রেখে দিচ্ছেন ভয়ের রূপকল্পনার শৃঙ্খলে? আপনার কি ধারণা যারা আপনাকে হুজুর-হুজুর করে, তারা সত্যিই আপনার অগোচরে আপনার সম্পর্কে কোনো বাজে কথা বলে না, কিংবা কোনোদিনই বলবে না? আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না, এই আপাত অনুগত মানুষগুলিই আপনার কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে! এটাই স্বাভাবিক। আপনার মতো সততা বা অকপটতা হয়তো সবার মধ্যে নেই। সব মানুষই যদি একই রকম করেই ভাবত, তবে তো মানবজাতি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। যদি বেশিরভাগ লোকই আপনার কাজ পছন্দ না করে, তাহলে এমনও তো হতে পারে, আপনি এমনকিছু করছেন, যা কেউই কোনোদিন করেনি। যদি অনেক লোক আপনার পেছনে লাগে, তবে আপনি একদিক দিয়ে ভীষণ ভাগ্যবান, তা হল: আপনি আপনার চিন্তাভাবনা আর কাজের মাধ্যমে একটা বিশাল লাইনের অনেক সামনে অবস্থান করছেন, পেছনে ফিরলেই অনেক মানুষকে দেখছেন যারা আপনার অবস্থানে আসার জন্য অপেক্ষা করছে, চেষ্টা করছে এবং এখনো আপনার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি বলে সমানে চিৎকার চ্যাঁচামেচি করেই যাচ্ছে। আপনার পেছনে কথা বলার লোক বেশি, এর মানেই হল, আপনি ওদের চাইতে এগিয়ে গেছেন, ওরা ওদের অবস্থানে, মানে পেছনে থেকে আবোলতাবোল বকছে।

ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথের সময়ে ফেসবুক ছিল না। যদি থাকত, তবে তিনি গীতাঞ্জলি লিখে ফেসবুক পোস্ট করতেন আর অমনিই কয়েক গীতাঞ্জলি সমান উল্টাপাল্টা কমেন্ট আসতে থাকত, সেসব কমেন্ট পড়ে উনার মাথা যেত বিগড়ে, রাগ করে হয়তো আর কিছুই লিখতেন না, আর আমরা উনার সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হতাম। ক্রিকেটাররা যখন মাঠে খেলতে নামেন, তখন তাদের খেলা মনমতো না হলে গ্যালারিতে বসে-বসে দর্শকরা যে কী পরিমাণ আজেবাজে কথা ছুঁড়ে দিতে থাকে ওদের উদ্দেশ্যে, তা নিয়ে যদি বিন্দুমাত্রও তারা ভাবতেন, তবে খেলা ফেলে দৌড়ে মাঠ থেকে পালিয়ে বাঁচতেন! লোকে ফেসবুকের অনেক পোস্টই না পড়ে, না বুঝে বেশ বিজ্ঞের মতো কমেন্ট করে বসে, যেন কিছু একটা লিখে নিজের গর্দভ সত্তাটাকে টেনে বাইরে এনে সবাইকে না দেখালে নিজের কাছেই কেমন জানি খারাপ-খারাপ লাগে। ওরকম সস্তা লোকের ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্যে কী এসে যায়? রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি প্রত্যেকটা কুকুরের ঘেউয়ের একটা করে প্রত্যুত্তর দিই, তবে তো সারাজীবনই রাস্তায় থাকতে হবে, রাস্তা আর ফুরোবে না। কুকুরেরই বা কী দোষ? ঈশ্বর তো আর কুকুরকে হ্যালো বলার ক্ষমতা দেননি যে কুকুর আপনাকে দেখলে হ্যালো বলে সম্বোধন করবে, তাই কুকুর আপনাকে দেখলে বাধ্য হয়ে ঘেউ বলে। কিন্তু আপনি তো ঘেউ বলে উত্তর দেয়ার প্রাণী নন। আর কুকুরকে প্রত্যুত্তর দিতে গেলে হ্যালো বললে কোনো কাজ হবে না, ঘেউই বলতে হবে। এতে আপনার সম্মান বাড়ুক কমুক, কুকুর কিন্তু ভীষণ খুশি হয়।