হৃদয় খুঁড়ে

১। পৃথিবীতে সেই দুজন মানুষ সবচেয়ে সৌভাগ্যবান, যারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসে। এদের সংখ্যাটা এত কম যে অনায়াসেই হাতে গুনে ফেলা যাবে। আর বাকি সবার ভালোবাসা ‘এ ওকে, ও তাকে, সে আবার অন্য কাউকে’ এই চেইনেই আজীবন ঘুরতে থাকে। পৃথিবীতে যত মিথ্যে আছে, তার অর্ধেকই লুকিয়ে আছে ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এই বাক্যটির মধ্যে।


২। কোনও মানুষ একা থাকাকালীন কী কী করে সময় কাটায়, সেটাই ঠিক করে দেয় তার সামনের অবস্থান। মানুষ যখন নষ্ট হবার সমস্ত সুযোগ সামনে পেয়েও তা হেলায় নষ্ট করে, তখন থেকেই সে তার স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে থাকে। নষ্ট হবার মোহ সামলাতে না পারা---এটি তুচ্ছ লোকদের সবচাইতে বড়ো বৈশিষ্ট্য।


৩। দুনিয়াতে বেশিরভাগ মানুষের দেখবার চোখ আর ভাববার মাথা একইরকম। বেশিরভাগই মানুষই আলাদা কিছু দেখা বা ভাববার কথাও মাথায় আনতে পারে না। আপনার ভাবনা বা দেখবার চোখটা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হলে, যে যা-ই কিছু বলুক না কেন, কষ্ট পাবেন না, ওটা আপনার জন্য খুব ভালো কোনও ইঙ্গিতও হতে পারে! সকল অসাধারণত্বকেই প্রাথমিক পর্যায়ে সব সময়ই বিদ্রূপ, তাচ্ছিল্য, অবিশ্বাস সহ্য করতে হয়েছে।


৪। যে-কোনও সম্পর্ক ভালোবাসা ছাড়াও দিব্যি টিকিয়ে রাখা সম্ভব, কিন্তু দুজনের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ আর বিশ্বাস না থাকলে সেটা টেকানো প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। সম্পর্কে ভাঙন ধরে ভালোবাসার অভাবে নয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের অভাবে। আর-একটি ব্যাপার সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে জরুরি, তা হলো, পরস্পরের ভুলগুলিকে মেনে নেবার ক্ষমতা।


৫। কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসার প্রথম ধাপই হচ্ছে, নিজেকে বার বার হারিয়ে ফেলা আর নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করা। পরের ধাপটি, সেইসব অনুভূতির পথে হাঁটা, যেগুলো প্রতিমুহূর্তে আমাদের অবাক করে তুলে, আর প্রতিদিনই নতুন সব ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, এমনকি মানসিক বয়সটাও বাড়িয়ে দেয় অনেক ক্ষেত্রেই। যে ভালোবাসায় দুইজনেরই মনের বয়স বাড়ে না, সে ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে কম।


৬। একই পথের ব্যস্ত তিনজন মানুষ। একজন পায়ে হেঁটে, একজন রিকশায়, অন্যজন প্রাইভেটকারে। এদের প্রত্যেকেরই একে অন্যের প্রতি ধারণা থাকে যে, ‘ওর জীবন আমার জীবনের চেয়ে বেশি সুখের।’ অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনজনের ধারণাই ভুল! যার দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের নিজের জায়গা নিয়ে খুশি না, প্রায় সময়ই দেখা যায়, সেও তার নিজের জায়গা নিয়ে খুশি না আমাদের দিকে তাকিয়ে।


৭। যেখানে মেসেজের কত সেকেন্ড পরে রিপ্লাই দেওয়া হলো, ফোনটা দিনে কতবার করা হলো, মেসেজ দিনে কতবার পাঠানো হলো, এসবের উপর ভিত্তি করে একজন মানুষের জীবনে আপনার প্রায়োরিটি ঠিক করা হয়, সেই সম্পর্কে আদৌ আপনি থাকবেন কি না, তা নিয়ে সময় থাকতেই অন্তত সতেরো বার ভেবে দেখুন। যে ভালোবাসা কেবলই হাজিরার উপর টিকে থাকে, সেটি ভালোবাসা যতটা, তার চাইতে অনেক বেশি একধরনের দায়।


৮। যাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করবেন, তার ভালো গুণ আর খারাপ ‘গুণ’ দুটোর সাথেই সমানভাবে বন্ধুত্ব করতে জানতে হবে। যদি না জানেন, তবে দেখবেন, আপনি নিজের অজান্তেই তার ভালো গুণ ও ভালো অভিনয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছেন।


৯। শুধু ফ্লেক্সিলোড আর নোট ফটোকপি করে দেওয়ার জন্যও অনেক ছেলে নিজের অজান্তেই ভার্সিটিতে চার বছর খণ্ডকালীন প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করে যায়। ইদানীং অবশ্য এই চরিত্রে মেয়েরাও ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে। এমন প্রয়োজনের প্রেমের কাছে প্রেমের প্রয়োজন অতি সামান্য।


১০। আপনি যেসব ‘পাড়াত’ কিংবা ‘বানাত’ ছেলে-মেয়েদের ভাই বোন বলেই মনে করেন, তাদেরকে নিরালায় একটু সুযোগ দিয়েই দেখুন না তারা আসলেই কতটা ভাই কিংবা কতটা বোন! মানুষকে চিনতে হয় আলোতে নয়, অন্ধকারে। আলো নিভে যাবার পরেও যে মানুষকে আপনার মানুষ মনে হয়, সে-ই আপনার জন্য প্রকৃত মানুষ।


১১। কখনও কখনও, শুধু কিছু সময়ের একটা চাহনিই, এক দশক একসাথে থাকবার চেয়েও বেশি কাজে দিতে পারে। মানুষ সারাজীবনই মাত্র একটা আন্তরিক চাহনির তৃষ্ণায় মরে যায়। এই ব্যাপারটা সে-ই বুঝবে, যে এমন একটা চাহনির পাবার তৃষ্ণায় পাগল হয়ে আছে বহু বহু দিন ধরে। চাইলেই অমন একটা চাহনি ছুড়ে দেওয়া যায় না, যাকে দিচ্ছেন, সে যদি সত্যিই তৃষ্ণার্ত হয়, তবে সে সবই বুঝতে পারে। আর যদি আপনি তাকে বোকা বানাতে সক্ষম হন, তবে আপনিও জেনে রাখুন, দিনের শেষে আপনি একজন প্রতারক।


১২। যে ঠিকঠাক প্রশংসা করে, তাকে সময়ের প্রয়োজনে যেতে দিলেও, যে ঠিকঠাক ভুলটা ধরিয়ে দেয়, তাকে জোর করে হলেও জীবনে ধরে রাখুন। তবে হ্যাঁ, যে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার ছলে নিন্দা করে বা ঘৃণা করে বা নিজের শ্রেষ্ঠতা জাহির করে আপনাকে ছোটো করার অভিপ্রায়ে, তেমন কাউকে নিজের জীবনের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবেন না। জীবনে যত অল্প মানুষকে জায়গা দেবেন, তত বেশি ভালো থাকবেন।


১৩। আমাদের বাবা-মায়েরা বেশিরভাগ সময়ই সেইসব পেশা আমাদের জন্য ঠিক মনে করেন, যেইসব পেশায় তাঁরা একসময় নিজেদেরকে কল্পনা করতেন। মানুষ তার প্রিয় মানুষের জন্য সেই স্বপ্নটিই দেখে, যে স্বপ্নটি পূরণে সে নিজে ব্যর্থ হয়েছে।


১৪। মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করাটা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। এটাকে নেশা বললেও বোধহয় ভুল হবে না। যে অন্যের কাছ টাকা ধার নিয়ে চলতে অভ্যস্ত, তার চাইতে নির্লজ্জ প্রতারক এই দুনিয়ায় আর হয় না। ওরকম একটা জীবন কাটানোর চাইতে বরং আত্মহত্যা করে পৃথিবীকে কিছুটা হলেও জঞ্জালমুক্ত করাই অধিক গৌরবের।


১৫। আপনার আত্মীয়স্বজন কিংবা বাবা-মা সেই ছেলে বা মেয়েকে মন থেকে সেরা বলে স্বীকৃতি দেন, যেই স্বভাবের বা গুণের মানুষকে তাঁরা তাঁদের নিজেদের জোয়ান বয়স থাকলে বিয়ে করতে নির্দ্বিধায় রাজি হতেন! মানুষ সাধারণত যেমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়, তেমন কাউকে জীবনে পায় না। তাই সে আজীবনই তেমন কাউকেই খুঁজে বেড়ায় মনে মনে, পেয়েও যায় কখনও কখনও। তবে তখন তো আর কিছু করার থাকে না, তেমন কারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা বাদে!


১৬। যদি কেউ আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে, তবে সে ভালোটা এইজন্য বাসে না যে আপনাকে তার প্রয়োজন, ভালোটা সে এইজন্যই বাসে যে আপনার প্রয়োজনটাই তার কাছে অধিক প্রয়োজনীয়। আমি দেখেছি, মানুষ যে কাউকে ছেড়ে যেতে পারে না ছেড়ে যাবার শত কারণ থাকা সত্ত্বেও, এর পেছনের রহস্যটা হলো, সে জানে, ছেড়ে চলে গেলে তাকে ছাড়া চলতে ওই মানুষটির অনেক কষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে সে নিজের দিকটা নিয়ে অত ভাবে না। বোধহয়, একেই ভালোবাসা বলে।


১৭। খুব কাছের কাউকে সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও যোগাযোগ না করে তিন মাস আনফলো করে রাখুন, নিশ্চিত থাকুন, মানুষটাকে আপনি নব্বই ভাগই ভুলে যাবেন। আর মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় মাস করলে, দেখবেন, তার নামটাও মনে করতে আপনার কষ্ট হবে। এর অর্থ কী দাঁড়াল? যাদের আমরা আমাদের জীবনে ‘কাছের কেউ’ ভাবি, তারা বেশিরভাগই আমাদের জীবনে ‘কেউই না’।


১৮। খুব ছোটোবেলার বন্ধুবান্ধবের আমাদের প্রতি দাবিটা একটু বেশিই থাকে। তাই কোনও ভুল কিংবা নেগেটিভ চিন্তা, যা ওরা সবাই পছন্দ করছে, তা বাদ দিয়ে আপনি অন্য কিছু করার কথা ভাবলেও, দেখবেন, আপনার বেশিরভাগ বন্ধুই আপনাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে চাইবে না, কাজটা করতে দেবে না, এমনকি সেটা যদি কোনও মহৎ কাজ হয়, তবুও না! কেন, জানেন? সহজ হিসেব---কেউই চাইবে না তার দল ছুটে যাক!


১৯। নিজের অবস্থানে আপনি সেরা হয়ে গেলে, হাতেগোনা কয়েকজন বাদে আপনার সাথে বড়ো কোনও শত্রুতাপূর্ণ আচরণটা আপনার খুব কাছের বন্ধুটিই সবার আগে করবে! আপনার সকল সাফল্য সহ্য ও উদ্‌যাপন করতে পারে যে, এক সে বাদে আর কেউই আপনার প্রকৃত বন্ধু নয়। মনে মনে বাকিদের বাতিলের খাতায় রেখে দিন। বিশ্বাস করুন, ওদের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে আপনার জীবনে কিছুই এসে যাবে না।


২০। মানুষের সবচেয়ে ভয়ানক অসুখগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার-করা অসুখের নাম হচ্ছে: প্রত্যাশা। ধরুন, আপনার বয়সকালে এবং বিপদের সময়ে কোনও অল্পবয়স্ক আত্মীয়, যার বয়সের তুলনায় আপনার বয়স তখন দ্বিগুণ, আপনাকে তার একটা কিডনি দিয়ে সাহায্য করল। এরপর, সেই মানুষটি ধরেই নেবে, আপনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও প্রতিদানে তাকে একটি কিডনি দিয়েই সাহায্য করে যেতে বাধ্য! সে এটাও মনে রাখবে না যে, যে-কোনও বয়সে যে-কোনও কিছু দিয়ে সাহায্য করা সম্ভব না। একইভাবে, আপনার প্রিয় মানুষটি যখন এতটাই অসুস্থ বা ঝামেলায় আছে বা বিষণ্ণ হয়ে আছে যে, আপনার সাথে কথাবলার মতো অবস্থায় সে নেই, কিংবা এমনিই তার কারও সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তখনও যদি সম্পর্কটি নষ্ট করার পেছনে আপনার মনের মধ্যে প্রধান যুক্তিটি থাকে---‘কেন সে আমায় সময় দিল না? দরকার হলে সে মৃত্যুশয্যায় পড়ে থাকুক, তা-ও, মরতে মরতে হলেও আমাকে তার সময় দিতেই হবে প্রভুভক্ত কুকুরের মতো!’, তবে আমি বলব, আপনার মতো নিষ্ঠুর, অবিবেচক কারও সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারটা নিয়ে তার আরও একবার ভাবা উচিত।