ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা: ১০৫

ভাবনা: সাতশো উনত্রিশ
...............................................................
এক। একটা ভয়ংকর সত্য হচ্ছে, অনেক জিনিয়াসই, তিনি যে একটা জিনিয়াস, তা তিনি নিজেই জানেন না। সেই না-জানার কারণটাও অনেকসময়ই মেয়েমানুষ। বহু দেখেছি, জিনিয়াসকে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গরুর মতন জীবনযাপন করানোর পেছনেও মেয়েমানুষের হাত থাকে।
হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, মেয়েরাও এমন প্রতিকূলতার শিকার হয়।
আমি নিজের চোখে খুব সম্ভবত একটা মেয়েকেও তার স্বামীর শখের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি। সেই শখ ছোটো হলেও না। তারা সবসময় এর বিপরীতেই থেকেছে। আর কোনও মেয়ে যদি তার পার্টনারকে নিজের মতন করে থাকতে দেয়, তাহলে মানুষ বলে, মেয়েটা কেয়ারলেস অথবা মেয়েটার প্রেম-পরকীয়া জাতীয় কিছু একটা আছে।
দুই। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হঠাৎ সতেরো বছরের কিশোরী মেয়েটির মনে হতে লাগল, ‘আচ্ছা, আমার তো বৃষ্টি ভালো লাগত না কখনওই, তবে আজ কেন হঠাৎ এই শিহরন?’
পাশের বাসার বিশ-একুশ বছরের পাগল ছেলেটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটির পাগলামো দেখতে লাগল, আর আপনমনেই নিজেকে বকা দিতে দিতে বলল, ‘আরে, ধুর! আমাকে পড়াশুনো বাদ দিয়ে এই মেয়ের পাগলামোই-বা কেন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হচ্ছে? কিন্ত দেখতে যে বড্ড ভালো লাগছে। ওর এমন বাচ্চাসুলভ আচরণ, বৃষ্টিতে ধুয়ে-যাওয়া চোখের আবছা কাজল, হাতের রিনরিনে চুড়ি আর ওই নূপুরজোড়ার নিক্বণ…!’
এইসব কেমন জানি বুকের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে যায়!
আসলে প্রেমগুলো হয়তো এভাবেই কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে হুটহাট করেই হয়ে যায়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে খেতে, কখনও লাইব্রেরিতে সবাই মিলে নোট লিখতে লিখতে, আবার কখনওবা টংয়ের দোকানে চেঁচামেচি করে চা খেতে খেতে। খুব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে, ডেইট-টাইম ফিক্স করে যেগুলো হয়, সেগুলো কেমন যেন কাগজ-কলমে লেখা অঙ্গীকারনামার মতো মনে হয়।
প্রেমের সাথে শুধুমাত্র বৃষ্টি, কাজল, চুড়ি, নূপুর, লুকিয়ে লুকিয়ে একজনের সাথে আরেকজনের দেখা-হওয়া, আপনমনে হাসা…এসবই যায়। অঙ্গীকার শব্দটি প্রেমের সাথে বড্ড বিশ্রী রকমের বেমানান!
তিন। তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে অন্য কোনও ধরনের কোন‌ও উন্নতি আমার হয়েছে কি না আমি জানি না, কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এমন উন্মাদ আমি কখন‌ওই ছিলাম না। এখন পুরোদস্তুর একটা ব্রেক-ফেইল গাড়ির মতো হয়ে গেছি, নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে। কখন কী বলি, কথার কোন‌ও আগামাথা তো নেই-ই, হুট করে কী এক একটা কথা মাথার ভেতরে এসে ঠোকরাতে থাকে, সেটাকে মুখে বলে না বের করা পর্যন্ত কোনও শান্তি নেই। আমি এখন যেইরকম ভাঙাচোরা অবস্থায় আছি, এটাকে ভালোবাসা বলে কি না, তা-ও জানি না আমি। অন্য সবাইকেই তো ভালোবাসার সম্পর্কে দেখি, তাদের মধ্যে কেউ আমার মতো এমন উন্মাদের মতো আচরণ তো করে না...আর আমি এমন উন্মাদ হলাম কবে থেকে! সব কিছুর যে একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে, সীমানা আছে, এটা তো আগে আমি খুব ভালো করেই জানতাম, তাহলে এখন এমন ওলটপালট আচরণ কোথা থেকে আসছে! ভালোবাসার জায়গায় ভালোবাসা, কাজের জায়গায় কাজ, কিন্তু এখন কোনটা কীসের জায়গা, এটাই মনে থাকে না, এখন সব জায়গাই একটা জায়গা হয়ে গেছে! আমি জানি, এমন করে করে আমি কেবল নিজেরই ক্ষতি করছি, আর কারুরই কিছু আসবে যাবে না এতে।
চার। প্রতিদিন একটু একটু করে এই যে আমি আপনার এই লেখকসত্তাকে ছাপিয়ে, এই ব্যক্তি আপনার প্রতি এমন ওতপ্রোতভাবে আপনি নামক নির্ভরশীলতায় আসক্ত হয়ে পড়ছি...এতটাও কি প্রয়োজন ছিল, বলুন তো?
আমার চারিদিকে এত আলো...তবুও যেন আপনি এলে আমি এক অদ্ভুত আপনার অনুপস্থিতির অন্ধকারাচ্ছন্নতায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে নতুন করে খুঁজে পাই...
কেন? বলুন তো? কী এমন মুগ্ধতায় পূর্ণ হয়ে আপনি আমার কাছে এসেছেন? এমন কী আছে আপনার যা আমাকে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে শুধুই আপনার সাথে খানিকটা আরও সময় থাকবার নেশায় সবসময় মাতাল করে রেখেছে? আমি কেন ইচ্ছাকৃত ভুলের বিনিময়ে শুধু আপনাকেই আমার শাস্তি হিসেবে এমন আঁকড়ে ধরে বাঁচার আাশায় সব ভুলতে বসেছি?
এতটা আপনিতে আসক্ত হয়ে যাবারও কি প্রয়োজন ছিল, বলুন তো? হাজার মানুষের ভিড়েও আপনি যখন পথের ও-প্রান্তে...তখন আমি কেবলই একদম একা!
পাঁচ। যদি কখনও এমন হয়, অন্য কোনও ভালোবাসার মানুষ তোমার জীবনে আসে, যদি তুমি তাকে অনেক ভালোবাসো, সেইদিনটা যদি আগামীকালও হয়, তা-ও আমি আমার স্রষ্টার কাছে মিনতি করব যেন যে করেই হোক, উনি আমাকে তুলে নেন, কারণ এমন দিন আমি দেখতে চাই না, এমন দিন মৃত্যুর চেয়ে কোনও অংশে কম কিছু না। তার চেয়ে বরং সেই দিন দেখার আগেই যদি স্রষ্টা আমাকে তুলে নেন, তাহলে আর যা-ই হোক, নিজের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসটুকু অটুট থাকবে তখনও। বিশ্বাস হারিয়ে বাঁচার চাইতে বিশ্বাস রেখেই মরে যাওয়া অনেক ভালো। ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব, এটা আমার মতো করে আর কেউ হয়তো জানে না। এজন্যই চাই, এই দিনটা আমার জীবন থাকতে না আসুক। আমি জানি না আমি কেন এমন করি, কীভাবে এমন হয়ে গেছি অথবা যাচ্ছি, কিন্তু আমি জানি, এর বেশি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না কোনও দিনই।



ভাবনা: সাতশো ত্রিশ
...............................................................
এক। জানো, আজকাল আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, তোমার অন্তরে একটা শিশু বাস করে, একটা সহজসরল কিশোর বাস করে, যে তার ছেলেবেলাটাকে বড্ড মিস করে, যে এখনও আগের মতোই ছোটো হয়ে থাকতে চায়, সহজ চোখে পৃথিবীটাকে দেখতে চায়, ফিরে ফিরেই যেতে চায় তার সেই শৈশব ও কৈশোরের স্কুল-পালানো চিরসবুজ দিনগুলিতে। সে প্রচুর বই পড়তে চায়, রাত জেগে প্রিয় গান শুনতে চায়, ছোটো ভাই-বোনদের সাথে প্রাণভরে খুনসুটি করতে চায়---ঠিক আগেরই মতো। সে অদম্য জেদকে শক্তি করে ফেলে অনন্য হতে চায় তার পছন্দের বিষয়গুলিতে। সে মানুষকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে জানে, কোনও বিশ্বাসঘাতকতার পরোয়া না করেই। সে ভালোবেসে তার প্রেমিকার জন্যে জীবনটা পর্যন্ত বাজি রাখতে জানে।
সে শুধু সকলকে ভালোবাসতেই ভালোবাসে। জাগতিক কোনও আপাত-লোভনীয় বস্তু তাকে কখনওই প্রলুব্ধ করতে পারেনি। আসলে সে তো হেলায় অগ্রাহ্য করে ওইসব সস্তা তথাকথিত চাওয়া-পাওয়াকে। সব্যসাচী অর্জুনের মতোই তার লক্ষ্য অব্যর্থ। সে সাংঘাতিকভাবে সৌন্দর্যের পিয়াসি, অনেকটা আমারই মতো। ভালো কিছুর, সেরা কিছুর প্রেমে পড়া তার পক্ষে নিশ্চিত বা অবশ্যম্ভাবী! নেতিবাচক সমালোচনা, নিন্দা, কুটিলতা, কপটতা, বিচার করার মানসিকতা বা হীনভাবনা উৎপন্ন করে যা-কিছু শব্দ, সেগুলি তার নিজস্ব অভিধানের বাইরেই থাকে সবসময়। সে চিরকালই দারুণ দারুণ সব শিল্পের প্রেমে পড়ে, ঠিক আমারই মনের মতো একটা মন নিয়ে বাঁচে সে। শিশুটা হৃদয়ে বাস করলেও প্রখর আত্মসম্মানবোধ নিয়ে সে ছাড়িয়ে যায় এক-একটা মাউন্ট এভারেস্ট!
তার অন্তরে রিনা ব্রাউন ও কৃষ্ণেন্দুরা সারাক্ষণই সুবাস ছড়ায়। সেই মানুষটার প্রেমে না পড়াই যে বিচিত্র ব্যাপার! অমন সুন্দর যার মন, অমন দুর্দান্ত যার ব্যক্তিত্ব, সে তো আমাকে ভাবিত করবেই, তাকে তো আমি ভালোবাসবই। এটাই আমার নিয়তি।
দুই। ভালোবাসা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলে ফেললে ভালোবাসার রঙ ধূসর হয়ে আসে। সেই ধূসর গালিচা ভেদ করে ভালোবাসার কাছে যাওয়া বড্ড কঠিন হয়ে পড়ে। একজন মানুষ যদি ভালোবাসার প্রতি প্রকৃতই শ্রদ্ধা অনুভব করে, তাহলে সেই ভালোবাসা তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে ফেলে আসে। সে মানুষটা একা একাই তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এই চড়ুইপাখির জীবনটাকে চুপ করে শেষ করে দিতে পারে চোখের পলকেই! কিন্তু সারাজীবনেও তেমন একজন মানুষকে পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য।
একটা পুরো জীবনই কেটে যেতে পারে এমন একজন ভালোবাসার মানুষের দেখা পেতে! আবার কখনও কখনও, এমনও হয়, সেই মানুষটিকে সে পায় ঠিকই, কিন্তু সময় থাকতে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, আর যখন বোঝে, অনেক পরে গিয়ে যখন সেই মানুষটির ভেতরের মানুষটিকে চেনে, তখন চাইলেও তেমন কিছুই করার উপায় আর থাকে না, অথবা হয়তো সে ভেতরে ভেতরে সেই সুযোগটুকু আবারও প্রার্থনা করে, কিন্তু সব কিছু কেমন চোখের পলকেই কেমন জানি বদলে যায়!
যখন মানুষ এমন কোনও মানুষকে তার জীবনে পায়, যাকে পেয়ে সে তার প্রতিটি মুহূর্তই ভুলে যায় কেবলই তাকে নিয়ে, হাজারো মুহূর্ত কেবল তাকে ভেবেই কেটে যায় হাসিমুখেই, তখন সেই মানুষটাকে কিছুতেই সে হারিয়ে ফেলতে চায় না। তাকে হারাবার ভয়, অস্থিরতা তাকে কখনও কখনও উন্মাদ করে তোলে, হঠাৎ তাকে এমন অবস্থায় দেখে তার ভালোবাসার মানুষটিরও মনে হতে পারে, এই মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছিলাম! কই, যাকে ভালোবেসে ছিলাম, সে এমন তো ছিল না! তবে কি সে এতদিন যা দেখিয়েছে, তার সবটুকুই ভান ছিল? এমন কখনও হয় না! হতে পারেই না!
মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের কাছে নিজেকে যতটা খুলে দিতে পারে, যতটা মেলে ধরতে পারে, ততটাই মুক্ত হয়ে ওঠে। ভালোবাসা আসলে চায় একটি খোলা আকাশ, কিন্তু যখন সেই আকাশটিও সংকীর্ণ হয়ে আসে, তখন সে ছটফট করতে থাকে বিশুদ্ধ বাতাসের খোঁজে, যেন একটা খাঁচায় বন্দি পাখি সে। যদিও তার উড়বার ডানা আছে, তবুও পাখনা মেলে ধরবার যে বিস্তৃত আকাশ তার ছিল একসময়, সেটিই যে আর নেই এখন!
হতে পারে, তুমি স্পর্শের বাইরে আছ, হয়তো তোমার শরীরের ঘ্রাণ আমি ভুলে গেছি, কিন্তু আমার প্রতিটি শিহরণে জীবন যেমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, তুমিও ঠিক তেমনিই আছ! আমার জীবন ছুঁয়ে তুমি থেকে গেছ, এটা জানিয়ে রাখলাম!
তিন। জানো, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার জানপাখিটাকে নিয়ে যদি কেউ টানাটানি করে, তাহলে তাকে গিয়ে একেবারে গুলি করে মেরে ফেলব। আমি এমন পাগল কী করে হয়ে গেলাম, জানি না এর কিছুই।
আমি জানি, আমি সব কিছু আগে আবেগ দিয়ে বিচার করি। কিন্তু আসলে সবসময় সব কিছুতেই অতিরিক্ত আবেগী হলে চলে না। আমি তোমাকে শুধু তোমার স্পর্শের জন্য কাছে চাই না, চাইওনি কখনও। আমি আগেও যখন তোমার কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তখনও কেবল তোমাকে একটু কাছে পাবো বলেই তোমার সব কথা মেনে নিয়ে তোমার কাছে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তোমার স্পর্শ আমাকে এক অন্য রকম অনুভূতি দিয়েছে, যা আমি কখনও এর আগে ফিল করিনি। কিন্তু আমি ওসব কিছুর জন্য তোমার কাছে আসিনি। আমি শুধু তোমাকে, তোমার ব্যক্তিসত্তাকে ভালোবেসে তোমার কাছে এসেছি। আর এজন্যই তোমার কাছে কাছে থাকার জন্য, তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্য, তোমার কণ্ঠটা একটুখানি শোনার জন্য এতটা উদ্গ্রিব হয়ে থাকি সবসময়।
আমি জানি না, আমার ব্যাপারে তোমার অনুভূতিগুলো কেমন, তোমার কাছে ভালোবাসা আসলে কী। কিন্তু আমার কাছে তোমার ভালোবাসার অর্থ হচ্ছে, তোমার সব কিছুই! এজন্য তোমাকে দেখার জন্য তোমার সব বিষয় নিয়ে এতটা ছেলেমানুষি করি। আমি জানি না দূরে থেকেও সারাজীবন কীভাবে ভালোবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু সেটা করার প্রয়োজন পড়লে আমি তা-ও করে নেবো, কেননা আমার এখন কোনও কিছুতেই কোনও অসুবিধা নেই। আমি সব কিছুর সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব। আমি জানি না, তোমার সাথে কবে দেখা হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না। আমি এসবের কিচ্ছু জানি না। আমি এখন থেকে তোমাকে কাছে পাবার জন্য এতটা অপেক্ষা করে থাকব না। যা হয় হোক, আমার কোনও অসুবিধা নেই। এমনকি আর কখনও দেখা না হলেও সমস্যা নেই।


ভাবনা: সাতশো একত্রিশ
...............................................................
এক। যে যা-ই বলুক না কেন, সাগরের গভীরতাতেই কিন্তু গভীর রাতে চাঁদের কলঙ্ক লুকায়। তখন সাগরের মহত্ত্বে চাঁদের প্রতিফলনকে অভূতপূর্ব সৌন্দর্য বলে সবাই আখ্যায়িত করে। এখানে চাঁদের অস্তিত্বে সাগরের গভীরতার ভূমিকাও কিছু কম নয়, বরং খানিকটা বেশিই! চাঁদ যদিও সাগরে জোয়ার ভাটা আনে, চাঁদকে চাঁদ করে রাখতে সাগরের কৃতিত্বও হেলাফেলা করার মতো নয় কোনও অংশেই।
তোমার আমার আগ্রহের জায়গাগুলিতে মিল না থাকলে বোধহয় এত কথা হতো না আমাদের। অবশ্য, আমি এদিক থেকে ব্লেসড। আমার চারপাশের মানুষ কেউ-না-কেউ সবসময়ই লেখালেখি করেছে। সেই হাইয়ার সেকেন্ডারি থেকেই দেখছি এমন। আমার কোনও-না-কোনও ফ্রেন্ড লেখালেখি করতই।
ওরা লেখালেখি করার ইনটেনশান নিয়েই তা করত। ভার্সিটিতে এসেও পেয়েছি ওরকম। বরং বেশিই পেয়েছি। হতে পারে, যারা লিখতে ভালোবাসে, আমি ওদের সাথেই মিশতাম। আমার পরিচিত, কাছের, চারপাশের অনেক মানুষই লেখালেখি করে। ভালো লাগে। আর আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ এই কারণে যে ওরা ওদের লেখা আমাকে পড়তে দিয়েছে সবসময়ই। সেই হাই স্কুল থেকে এমন হয়ে আসছে। এখনও হচ্ছে। সত্যিই, কিছু জিনিস ভাবলে খুবই অবাক লাগে। এবং, আমি যাদেরই লেখা পড়েছি, ভালো লেগেছে পড়তে। মনে হয়, সবাই-ই ভালো লেখে। এমনও হতে পারে, যারা ভালো লেখে, আমি বেছে বেছে ওদের লেখাই পড়েছি। এটাও আরেকটা ব্লেসিং।
তোমারও আগ্রহ রয়েছে সাহিত্যের প্রতি, কিংবা তুমি নিজে এত ভালো লেখো, এসব অবশ্য আমি তোমাকে ফেইসবুকে না খুঁজলে জানতেই পারতাম না। তবে কথা বলে মনে হয়েছিল, এতটা গুছিয়ে কথা যখন বলতে পারো যখন, তখন নিশ্চয়ই কিছু-না-কিছু ব্যাপার তো আছেই!
অবশ্য এসব ব্যাপার পারসন-টু-পারসন ভেরি করে। যার যে বিষয়ে ইন্টারেস্ট নেই, তার কাছে সে বিষয় মানেই অযথা সময় নষ্টকরার জিনিস। সবার তো আর সব বিষয়ে ভালোলাগা কাজ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে আমার যতদূর মনে হয়েছে, একজন শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব কখনওই শিল্পীমন চিনতে ভুল করে না, শিল্পকলাকে অবজ্ঞা করতে পারে না, সেটা তার সেইম ইন্টারেস্টের জায়গা হোক বা না হোক। এটা আমি তোমার ভেতরে দেখেছিলাম।
চারুকলার একজন স্কলার স্টুডেন্ট যে অকেজো নয়, বরং গড-গিফটেড, অসম্ভব রকমের প্রতিভাবান, সেটা তুমি বিশ্বাস করো বলেই ব্যাপারটা আমার কাছে আরও বেশি ভালো লেগেছে, যদিও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই, চারুকলায় পড়ার কোনও মানে হয় না। এটা একটা একজাম্পল দিলাম। এরকম আরও আছে। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের জাতীয় দায়িত্বের মধ্যে একটি হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেলে পড়া। কেউ ওসব না পড়লে যেন সে কোনও স্টুডেন্টের মধ্যেই পড়ে না! এখন তো আবার বিসিএস ট্রেন্ড চলছে। বিসিএস ক্যাডার হতে না পারলে এই পৃথিবীতে এসেই-বা কী লাভ হলো!---এরকমই মনে করছে অনেকে!
না, আমি তোমার প্রশংসা করছি না। এটা ভাববার দরকার নেই। কথায় কথায় বললাম এসব। তোমাকে দেখি আর ভাবি, এতটা পাগলাটে আবেগ নিয়ে লেখা মানুষটা বাস্তবে এরকম রষকষহীন জ্যান্ত রসায়ন, তা যদি কেউ জানত! আমি আসলেই এদিকটা জানতাম না। লেখক ব্যক্তিত্ব আর বাস্তবিক ব্যক্তিত্ব এতটা ডিফার করে, ভাবাই যায় না!
আগে ভাবতাম, কারও লেখা পড়ে, কথা শুনে, আলোচনা দেখে তার দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তাচেতনা থেকে মানুষটাকে কিছুটা নয়, বরং অনেকটাই বোঝা যায়। আজ বুঝি, কত বড়ো বোকা ছিলাম আমি!
তবে এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি, মেনে নিতে পারিনি, মানিয়েও নিতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি প্রাণপণে…আর কিছু না হোক, অন্তত মানিয়ে নেবার অভিনয়টা চালিয়ে যেতে। ভুল চিনেছিলাম বা জেনেছিলাম বা বুঝেছিলাম। ব্যাপারটা নেগেটিভ থেকে পজিটিভ ইস্যুতে আসার ক্ষেত্রে খুব ভালো কিছু হয়, কিন্তু পজিটিভ থেকে নেগেটিভ ইস্যুতে এলে ভালো কিছু হয় কি না জানা নেই। তবে প্রচণ্ড কষ্ট হয়, আমি আসলেই ভালো নেই।
ভালোবাসায় বড্ড বেশি অভ্যেস হয়ে গেছে। রীতিমতো নেশাখোরের মতো। নষ্ট আবেগের নেশায় মন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। অসহ্য হয়ে উঠেছে সব কিছু। অন্ধত্ব নেই, তবুও অবুঝ আবেগের একধরনের দাসত্ব হয়ে গেছে। এতটাও কি হবার দরকার ছিল, বলো?
রাগ লাগে মাঝে মাঝে। হেল্পলেসও লাগে মাঝে মাঝে। মন যদি বাস্তবতার প্রতিকূলে চলে, তবে তার চাইতে বেশি অসহায়ত্ব আর কোনও কিছুতেই হয় না। আমি অন্তত তা-ই বুঝেছি।
দুই। কেউ যখন তার নিজের সম্পর্কে অজানা কিছু অন্য কারও কাছ থেকে জানতে পারে, যা মৌলিক ও অভিনব কিছু, যা সে আগে কখনও জানতে পারেনি অন্য কারও কাছ থেকেই, তখন সে, হয় লেখা বা আলাপের মধ্যে, নাহয় কোথাও-না-কোথাও সে অনুভূতির প্রকাশ করে ফেলে, আর চারপাশের অনেকেই তা নিজের মধ্যে ধরে রেখে, ঠিক সেভাবে করেই নিজেকে পালটাতে চায়, একইভাবে ভালোবাসার চেষ্টা করে। এবং, পুরো ব্যাপারটাই একসময় খুব স্বাভাবিক কিছুই হয়ে যায়। এই যাত্রার সূচনাটা যেখানে, সেখানের দিকে সে তাকিয়ে থাকে পরম মমত্ববোধে ও ভালোবাসায়, এটাই স্বাভাবিক।
তিন। মৃত্যুচিন্তা এমনও হয়, যখন মৃত্যুটা নিজের ক্ষেত্রে হলেও, পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ সেটাকে পরমকাঙ্ক্ষিত বলেই মনে করে!
হতে পারে, সে মানুষটা আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি, দৃষ্টিগোচরভাবে সুখী; আবার এমন কোনও মানুষও হতে পারে, যে মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে অনেক বেশি, দৃষ্টিগোচরভাবে দুঃখী।
আবার এই মৃত্যুই যখন অন্যের ক্ষেত্রে হয়, তখন এই একই মৃত্যুকেই, এই মানুষগুলোই চরম অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করে!
না, আমি মৃত্যুর পক্ষপাতিত্ব করছি না। একেবারেই নয়! তবে, আসলে এভাবে মৃত্যুর দিকটা নিয়ে আগে ভাবিনি, কিংবা ভাবতে হয়ওনি।
কখনও মৃত্যু সর্বনাশা, কখনওবা আবার চিরমুক্তি বারতা!
মানুষ স্বার্থপর মৃত্যুর প্রতি, না কি মৃত্যুই স্বার্থপর খামখেয়ালি মানুষের প্রতি...তার সবটাই অজানা, পরিস্থিতিভেদে অবিবেচ্যও বটে!


ভাবনা: সাতশো বত্রিশ
...............................................................
এক। কারও জন্য কারও জীবন থেমে যায় না, থমকে যেতে পারে বড়োজোর, কিন্তু থেমে আসলে যায় না। জীবন ঠিকই তার আপনগতিতে এগিয়ে চলে। মানুষ যেখানে তার নিজের বাবা-মায়ের মৃত্যুশোকও সামলে নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেখানে অন্য যে-কোনও শোকই সে ঠিকই সামলে নিতে পারে।
লাইফ বা লাইফের সিচুয়েশনগুলি...কিছুই তো চেইন্জ করা যায় না। তাই লাইফ বা এই সিচুয়েশানগুলির খুঁত বের করে বা তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অভিযোগ করা বা অজুহাত দেখানোটা সময়-নষ্ট কিংবা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
লাইফ যেরকম, তাকে সেরকমভাবে যত তাড়াতাড়ি অ্যাকসেপ্ট করা যায়, ততই মঙ্গল, এবং তখন সেখানে চৌকস বুদ্ধিমত্তার নানামুখী প্রয়োগ ঘটানো যায়। অভিযোগ করে, অজুহাত দেখিয়ে বা লাইফের ভুল বের করতে গিয়ে বোকার মতো সময় নষ্ট না করে বরং ওই সময়টুকু, হাতের কাছের লাইফটা যেরকম, সেরকমভাবে অ্যাকসেপ্ট করে কী করে এটার সাথে অ্যাডজাস্ট করা যায়, সেটা নিয়ে ভাববার জন্য ব্যয় করলে, লাইফে আর কিছু হোক না হোক, প্রসপারিটি অন্তত পাওয়া যায়। আর শেষমেশ এই প্রসপারিটি, সাকসেসফুল ক্যারিয়ার---এটাই পাশে থাকে, যদি তাকে ঠিকঠাক গড়ে নেওয়া যায়, সেখানে অন্য কেউ বা কিছু থাকুক বা না থাকুক।
ভালো বা সাকসেসফুল ক্যারিয়ার বা ওয়েল-মেইটেইনড প্রপার লাইফ-স্ট্রাটেজি বরাবরই, তার সাথে অ্যাসোসিয়েটেড অনেক ভালো কিছু নিয়ে আসে। আর এর উলটো ব্যাপারটা কিছু উলটো ব্যাপারকেই অ্যাসোসিয়েশন দিয়ে নিয়ে আসে।
যার বা যেটার জন্য ক্যারিয়ার-ভাবনাকে বিসর্জন দিয়ে বর্তমানটা কাটাচ্ছি, দেখা যাবে, একসময় সে বা সেটা আমার ক্যারিয়ার-ব্যর্থতার দিকে আঙুল উঁচিয়ে আমাকে ছেড়েই চলে যাবে। ছেড়ে চলে গেলে, তখন যদি প্রসপারিটি বা ভালো ক্যারিয়ারটাও না থাকে, তাহলে পথের ভিখিরি হয়ে একা একা অতীত স্মৃতির কান্নামথিত রোমন্থন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। হারানোর আগে মানুষ এই সহজ সত্যটা বোঝে না।
দুই। জীবনটা যদি...না, 'জীবনটা যদি এমন হতো', ওরকম কিছু নয়, বরং জীবনটা এখন কেমন, সে-প্রসঙ্গে আসি।
জীবন...?
---অদ্ভুত কিছু ফিলোসফিক্যাল অবজারভেশনের কাঁধে ভর করে বয়ে-চলা একটা ভাসমান নাট্যমঞ্চ। জীবন নিয়ে এ ছাড়া আর কিছুই এই মুহূর্তে মাথায় এল না।
অবশ্য, অবজারভেশনে বয়ে চলে জীবন, না কি জীবনের প্রবাহমাত্রাই বরং নানান মাত্রা যোগ করে চলে অবজারভেশনে, এটা খানিকটা বিতর্কিত বিষয় বলেই মনে হয় আমার কাছে।
তবে, আমাকে যদি আমার জীবনটাকেই প্রেক্ষাপট হিসেবে বিবেচনা করে মতামত জানাতে বলা হয়, তবে আমি আমার এই ক্ষুদ্রজ্ঞানে যতটুকু বুঝি, তা কিছুটা এরকম:
জীবন যতটা না অভিজ্ঞতায় বা অবজারভেশনে চলে, তার চাইতে অনেক বেশি অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়ে দিয়ে চলে।
দর্শন তো জীবন থেকেই নেওয়া, আবার জীবন তো দর্শনেই চলমান...প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মুহূর্তে নতুন নতুন কিছু চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে---কখনও সেটা আনন্দের তো কখনওবা দুঃখের।
জীবনটা রংহীন। রঙের ছটা ছড়িয়ে ছড়িয়ে সেটাকে রঙিন করার দায়িত্বটা জীবনদাতার নয়, জীবনগ্রহীতার।
জীবনটাকে একটা গভীর নদী যদি বলি, তাহলে কেমন হয়? নদীতে যদি ভালো সাঁতারু হয়ে, ধৈর্য নিয়ে, সঠিক পরিকল্পনাকে সঙ্গী করে সাঁতারটা কেটে ফেলতে পারেন, তবে নদীর তলদেশের সৌন্দর্যও যেমনি উপভোগ করতে পারবেন, একইসাথে নদীর ওপারে স্বাভাবিক নিয়মেই পৌঁছেও যেতে পারবেন।
কিন্তু যদি এর উনিশ-বিশ হয়, তাহলে নদীর তলদেশটা আপনার কাছে সৌন্দর্য হয়ে ওঠার পরিবর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে, আর নদীর ওপারটা, ওপার হয়েই রয়ে যাবে। ওপারে দাঁড়িয়ে ছেড়ে-আসা পারটা কত দূরের দেখতে লাগে বা কেমন দেখতে লাগে, এসব কিছু বোঝার সুযোগটাই আর পাবেন না।
এজন্যেই তো সব কিছুই আপেক্ষিক!
একই তো নদী!
কারও কাছে তা অনাবিল সৌন্দর্যসৃষ্টি তো কারও কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী!
সবটাই শুধু নদীকে আয়ত্তে আনার সামর্থ্যের খেলা!
কী অদ্ভুত না ব্যাপারটা?
ভাবতেই অবাক লাগে, সত্যি!
(কী যে লিখলাম, নিজেই বুঝলাম না! একটুও যে ঠিকঠাক হয়নি, তা পাঠক হিসেবেই বেশ বুঝতে পারছি, লেখক হিসেবে না বুঝলেও! অনেক দিন লিখি না তো, তাই পারছিলাম না, পারছিও না। আরও তো তোমাকে মনে করে লিখিনি, এজন্য আরও কষ্ট হয়েছে লিখতে।
তবুও, তুমি কোনও-না-কোনও উপায়ে আমার লেখায় এসে যাবেই যাবে! এর মূল কারণ, তুমিই থেকে যাও লেখার কারণ হিসেবে, অনুষঙ্গ হিসেবে, অনুপ্রেরণা হিসেবে। কীভাবে যে চলে আসো তুমি, কিছু লিখতে গেলেই, কে জানে! এই রহস্যটা আজ অবধি বুঝতে পারলাম না।
আমি জানি, তুমি ব্যস্ত আছ। মেজাজও খারাপ হবে বা হয়ে গেছে তোমার। তাই আমার একটুখানি ব্যর্থ প্রচেষ্টা এই লেখাটি। তোমাকে রাগতে দেওয়া যাবে না, তাই মূলত আমার নিজের স্বার্থেই করেছি এ কাজটি। কারণ তুমি যে লেভেলের খাইস্টা, তার খোঁজ আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি! তুমি মেজাজ খারাপ করলে তো ঝাড়ি-ঝাড়া সবই আমার উপর দিয়েই যাবে। কারণ আমি সারাদিন-রাত তোমাকে জ্বালাব, তখন তো তুমি মেজাজ খারাপ থাকলে আমার উপর রেগে যাবে, আর খাইস্টামিও বেড়ে যাবে আমার খাইস্টাটার! তাই, এই লেখাটি তোমার জন্য ঘুস! আদুরে খাইস্টা পাখিটা আমার!)


ভাবনা: সাতশো তেত্রিশ
...............................................................
এক। তুমি জেনে রেখো, যখন সারা দিন পর তোমার আদরমাখা কণ্ঠ শুনি, তখন সারা দিনের সব কাজের ক্লান্তি নিমিষেই ফুরিয়ে যায়। আমি তোমার কাছ থেকে এতটুকুই চাই, এজন্যেই অপেক্ষা করে থাকি। তুমি হয়তো আমার সঙ্গে কখনও কখনও অনিচ্ছায়ও অনেক আদর নিয়ে ভালোভাবে কথা বলার চেষ্টা করো যেন আমি খুশি থাকি। কিন্তু ভেবে দেখো তো, আগে থেকে হাতে গুনে গুনে হিসেব করে সময় নিয়ে কি ভালোবাসা হয়? লাগবে না আমার ওরকম মেকি আচরণ!
আমাকে তুমি তোমার মতো করে ভালোবাসো, এইটুকুই চাই। আমাকে তুমি আমার মনমর্জি অনুযায়ী ভালোবাসা না দিলেও আমি মরে যাব না, কিন্তু সামান্যটুকু ভালোবাসা না দিলে বাঁচতে আমার খুব কষ্ট হবে। আমাকে আমার মনের মতো ভালোবাসা দাও বা না দাও, তোমার মনের মতো করে ভালোবাসতে অন্তত দিয়ো।
সকাল থেকে পাশের বাসার আন্টিটা কী জানি একটা ব্যাপার নিয়ে সমানে চেঁচিয়েই যাচ্ছেন! এমন চেঁচিয়ে কথা-বলা কোনও সুস্থ মানুষের কাজ না। আমি যদি এ জীবনে কখনও কোনও দিন তোমার সামনে চিৎকার করে, উচ্চস্বরে কথা বলি, সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সব শক্তি দিয়ে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিয়ো আমাকে। আগে চড় দেবে, পরে বলবে, কেন দিলে। এটা হচ্ছে তোমার কাছে আমার রিকোয়েস্ট। যে-কোনও ধরনের উলটাপালটা করলে সঙ্গে সঙ্গে পানিশমেন্ট দিয়ে দিতে হয়। কিছু মানুষ আছে, যারা পানিশমেন্ট না পেলে ভাবে, সে কোনও ভুল করছে না বা করেনি। ওদের জন্য পানিশমেন্টই ঠিক আছে।
দুই। আমি জানি, আমি কোনও কিছু দিয়ে তোমাকে আটকে রাখতে পারব না, যদি তুমি থাকতে না চাও। হ্যাঁ, তুমি চাইলেই অনেকের সাথেই শুতে পারো। সে বিষয়ে আমার কোনও অভিযোগ নেই। কেননা আমি তোমার শারীরিক চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। আমাকে হয়তো এতটা অধিকার তুমি দেবে না যে তোমার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়েও আমি হস্তক্ষেপ করব। আমি সেটা চাইছিও না। আর আমি যতটা এ বিষয়ে জেনেছি, বুঝেছি নিজেকে দিয়েও, সেটা হচ্ছে, মেয়েরা চাইলে সারাজীবন কারও সাথে না শুয়েও কাটিয়ে দিতে পারে, যদিও সেজন্য আমার নিজেকে খুব খুব শক্ত হতে হয়েছে।
অন্য মেয়েদের কথা আমি জানি না, অনেক সময় আমার এত বেশি খারাপ লাগত যে আমি কোনও কাজে মন লাগাতে পারতাম না, তা-ও মেনে নিয়েছি, কারণ এটা আমার সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল। ছেলেরা দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক ছাড়া থাকতে পারে না, এটা আমি স্বাভাবিকভাবেই নিই, এটা ছেলেদের হরমোনের দোষ হয়তো। যদিও তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে চাই না, চাই না এবং, অবশ্যই চাই না, তবুও আমি যদি সেজন্য আমার সিদ্ধান্ত তোমার উপর চাপিয়ে দিই, তাহলে আমি নিশ্চিত যে আমি ভুল করব।
আমি কখনও এই সিদ্ধান্ত তোমার উপর চাপিয়ে দেবো না যে তুমি অন্য কারও কাছে যেয়ো না। কারণ এটা তোমার জন্য অসম্ভব! হয়তো তুমি আমাকে ভালোবাসো বলে ব্যাপারটা লুকাবে। কিংবা তোমার ভুলেও কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হতেই পারে, পরিস্থিতির চাপেও অনেক কিছু হয়। আমার তোমার কাছে শুধু একটাই রিকোয়েস্ট, তুমি যদি অন্য কারও সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েও পড়ো, তারপরও প্লিজ প্লিজ কোনওভাবেই কখনও আমাকে তা বুঝতে দিয়ো না, কেননা আমি সজ্ঞানে এটি মেনে নিতে পারব না। ওরকম কিছু জানতে পারলে আমি কষ্টেই শেষ হয়ে যাব। আমার প্রতি, আমার ভালোবাসার প্রতি, অন্তত এটুকু শ্রদ্ধা সারাজীবন রেখো, কেমন? আই লাভ ইউ!
আমার দিক থেকে তোমাকে পরিষ্কার করে দেওয়াটা আমার কর্তব্য মনে হয়েছে বলেই এত কিছু বলেছি, পাখি। আমি তোমার প্রতি কোনও সন্দেহ অথবা দুশ্চিন্তা অথবা অন্য কোনও বাজে চিন্তা থেকে বলিনি এসব। আর আমি খুব ভালো করেই জানি, তোমার এসবের সময়ই নেই, তুমি যার তার সাথে শুতে চাও না। আমি তোমাকে সস্তা করিনি মোটেও। আমি জানি তুমি কী। আমাকে ভুল বুঝো না।
তিন। প্লিজ, তুমি তোমার কাজ করো। যা খুশি করো। আমাকে ফোন কোরো না। তুমি ফোন করলেও আমি এখন আর কথা বলতে পারব না। নরম মানুষদের প্রাপ্তিগুলো এমনই হয়। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না এই মুহূর্তে। মন দিয়ে ব্যস্ত থাকো তুমি।
আচ্ছা, তোমাকে কিছু কথা বলি? তুমি রেগে যাবে না তো? দেখো, আমি কিন্তু খুব ভালো করেই জানি, আমার চেহারা ভালো না, যাকে দেখলেই ভালোবাসাতে ইচ্ছে হয়, আদর করে কাছে টানতে ইচ্ছে হয়, এমন কিছু অন্তত না। আমি হচ্ছি, অভাবে কাজে লাগে, এমন কিছু। আমি হচ্ছি, গরীবের পানি-দেওয়া মরিচ-ভাত, যখন খাবার কিছুই ঘরে আর থাকে না, তখন বাধ্য হয়ে যা খেতে হয়, আমি তেমন কিছু। কিন্তু তুমি আজকাল যখন আমার সঙ্গে খুব ভালো করে, অনেক ভালোবাসা নিয়ে কথা বলো, তখন মনে হয়, না দেখেও তো কাউকে ভালোবাসাই যায়। কেননা সেখানে মনের যোগাযোগটা বেশি হয়, কিন্তু আমি এ-ও মানি, বাহ্যিক সৌন্দর্যর প্রয়োজনীয়তা আছে।
আসলে আমি আমার সব কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে নিজেকে সুন্দর রাখতে, নিজের শারীরিক সৌন্দর্যকে বাড়াতে কোনও কিছুই আমি কখনও করিনি। সে সময় সত্যিই আমার হয় না, কারণ রূপ নিয়ে পড়ে থাকলে আমার কাজগুলো কে করে দেবে, তুমিই বলো? আমি নিজে একা থাকলে, কাজগুলো নিজের মতো করে গুছিয়ে করলে, হয়তো এতটা কাজ আমাকে করতে হতো না, কিন্তু আমি পরিবারের সবার সাথে থাকি। এখানে চাইলেও কোনও কিছুই নিজের একার মনমতো গুছিয়ে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া সবাই গোছানো মানসিকতার হয়ও না, সেজন্য আমাকে অনেক অহেতুক কাজও করতে হয় খুব বিরক্তি সত্ত্বেও।
এত কিছুর পর নিজের জন্য আমার তেমন কিছু করে ওঠা হয় না। আমি তোমার গুরুত্ব পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি, আমি জানি না, সামনে থেকে দেখলে আমার প্রতি তোমার এই গুরুত্বগুলো এই ভালোবাসাগুলো, যা দিয়ে তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখো প্রতি মুহূর্তে, সেগুলো মন থেকে আর থাকবে কি না...কিন্তু আমি সেদিনও জোর করে আমার প্রতি তোমার অ্যাট্রাকশন চাই না। তুমি আমার কাছে থাকলে আমি তোমাকে যত বেশি ভালোবাসি, তুমি আমার থেকে দূরে থাকলে এই হারানোর ভয়টা আমাকে অবচেতন মনে যন্ত্রণা দেয়। তখন মনে হয়, এখন যেমন আছি, তার সব কিছুর চাইতে বরং একটু সুন্দরী হলে আমি তোমাকে আরও কিছুটা বেশি পেতাম। আমি সত্যিই খুব ভয় পাই তোমাকে নিয়ে!


ভাবনা: সাতশো চৌত্রিশ
...............................................................
এক। আমার কাছে, সাফল্য মানে কী, জানো?
আমার কাছে সাফল্যের অর্থ কেবলই তুমি। আমি আগে এমন করে ভাবতাম না। আমি ভাবতাম, বাসা থেকে যা করবে, তা-ই মেনে নিয়ে মানিয়ে নেব। এরই মধ্যে নিশ্চয়ই তুমি আমার মানিয়ে নেওয়ার গুণ সম্পর্কে জেনে গেছ, তাই না? তা না হলে পারতাম তোমার দেওয়া এত্ত কষ্ট সহ্য করেও তোমার সাথে থেকে যেতে?
আমার এখন খুব খুব অল্প চাওয়া জীবনের কাছে। তা হচ্ছে, তোমাকে নিয়ে ভালোথাকা। আমার বড়ো কোনও অ্যাম্বিশন নেই। তা ছাড়া তুমি তো জানোই, আমার পক্ষে কতটা সম্ভব। কোনও রকম একটা ছোট্ট চাকরি হলেই আমার চলে যাবে। তুমি শুধু থেকো পাশে...
আমার জীবনটা অনেক অনেক অনেক বেশি ছোট্ট পরিসরের। এখানে অনেক কিছু নেই, কিন্তু তারপরও আমি সুখে আছি। যদিও তুমি আমাকে একেবারেই সময়-টময় ঠিকঠাক দাও না, তা-ও ঠিক আছে! তুমি তো আমারই আছ, ওতেই আমি খুশি!
আমি তো সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছি সব কিছু। মুখের কথা বিশ্বাস করব, কিন্তু ভরসা করব না, তুমিও কোরো না। আমাকে তোমার জন্য যা যা করতে হবে, সেগুলো করলেই কেবল আমার উপর ভরসা রাখবে। বিশ্বাস জিনিসটা কথার জন্য, আর ভরসা জিনিসটা রাখার জন্য।
দুই। অ্যাই কুট্টুস, কী করো? আমার খোঁজ নাও না কেন, মেসেজ দাও না কেন, হুম্‌? দাঁড়াও, তোমাকে একটা কামড় দিব, ওয়েট!
আমি তোমাকে ভুল বুঝব, জ্বালাব, কষ্ট দিব। তোমার মাথাটা নষ্ট করব, তোমাকে পাগল করব, অস্থির করব, রাগাব...অ্যান্ড টু বি কনটিনিউড...।
তুমি আমার জ্বালানো সহ্য করবে, মাথা নষ্ট করলে আমাকে তুলে আছাড় মেরে ভর্তা বানাবে, আমি ভুল বুঝলে বিশ্লেষণের মাধ্যমে শুধরে দিবে, কষ্ট পেলে পালটা কষ্ট দিবে, তোমাকে অস্থির বানালে আমাকেও অস্থির করে দিবে, রাগালে আমাকেও রাগিয়ে দিবে...আর যদি চলে যেতে ইচ্ছে হয় আমার জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, তাহলে চলে যাবে, কিন্তু বেশি দূরে যাবে না...আমি যাতে ঝটপট খুঁজে বের করে এনে তোমাকে ধরে ইচ্ছামতো মারতে পারি!
তুমি যা দিয়েছ ভালোবেসে, তা রবে লুকানো,
হৃদয়ের দাম যায় না জেনো কখনও ফেরানো।
তিন। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ, গা ঘেঁষে থাকে যদিও,
তবু সবচে বেশি দূরত্বটা এদের মাঝেই!


বড়ো কষ্টেই আজ কষ্টটা সই!
সবারই ঘরে সুখ ঝরে না,
ঘরে কারওবা ঝরে এসিডবৃষ্টি!


নিজের ঘরের চালাটি খুলে,
দিই আজ অন্যেরে বলে,
যায় আমারই দুয়ার শূন্য হয়ে,
আর সে আমারই কাফন কাড়ে!


খুব বেশি কষ্ট থেকেই এসব কথা ঝরে।
চার। আমি তোমাকে জ্বালাই, জ্বালিয়েছি এবং আজীবন জ্বালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যতদিন এই দেহে প্রাণ আছে, আর এই মস্তিষ্ক নড়বড়ে না হচ্ছে, ততদিন জ্বালিয়েই যাব, ইনশাআল্লাহ। তুমি শান্তিতে থাকলে আমার কিছুতেই ভালো লাগে না, তোমার প্রেমে পড়ে যাবার পর থেকেই শান্তির মা-বাপ দুজনেই মরে গেছে। তা ছাড়া আমার মূল কাজই হচ্ছে, তোমাকে অশান্তিতে রাখা। আমার প্রাপ্য ভালোবাসায় যদি ঘাটতি পড়ে, তাহলে আমি আরও জ্বালাব। আরও এবং আরও জ্বালাব।
খেয়ে নিয়ো। সারাদিন কাজ করে করে অভুক্ত কাটিয়ে দিয়ো না।
পাঁচ। আচ্ছা, তুমি যে রেগে গেলে আমার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলো, আমার ওটাতে কোনও সমস্যা নেই, বরং আমার খুব ভালো লাগে এই ভেবে যে, তুমি আমাকে নিজের ভাবো দেখেই অত চিন্তা করে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করো না, অথবা তুমি জানো যে তুমি রাগ দেখালেও তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমবে না, এটা ভেবেই অমন করো। আমি চাই, তুমি এমনই থাকো। কিন্তু তুমি এক আমি ছাড়া আর কারও সাথে কি এভাবে রাগ দেখাও, এতটা নির্ভয়ে? কিংবা এতটা নিঃসংকোচে? যদি দেখাও, তাহলে আর কার কার সাথে দেখাও? আর যদি না দেখাও, তাহলে কী করে পারো না দেখিয়ে?
আম্মুর সাথে রাগ দেখানো কি খুব খারাপ? আমি আম্মুর সঙ্গে রাগ দেখাই, কিন্তু খুব কম। আসলে আম্মু আমাকে এমন কিছু বলে যে আমার ওই মুহূর্তে কীভাবে যেন মুখ ফসকে কিছু কথা বেরিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কখনও আব্বু-আম্মুর সাথে রাগ দেখাতে চাই না। তা ছাড়া আর কারও সাথেই আমি কখনও রাগ দেখাই না। কিন্তু এটা আমি কী করে কন্ট্রোল করব? অনেক দিন সচেতনভাবে ঠিক থাকি, হঠাৎ আবার কীভাবে যেন এমন করে বসি, কিন্তু পরে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।
আমার মন খুব খারাপ হয়ে যায় যখন এমন হয়, সেই কষ্ট থেকেই কথাগুলো লিখেছিলাম তোমাকে। যদিও কথাগুলো সত্যি, তা-ও তুমি কিছু মনে কোরো না, প্লিজ। আমি আসলে যখন ওদের সব কিছু করে দিয়েও নিজের স্পেসটুকু পাই না, তখন আমার মাথা ঠিক থাকে না। যে আমি তো ওদের যা যা দরকার, তার সবই করছি, তারপরও ওরা একটু আমাকে আমার মতো করে কেন বাঁচতে দেয় না? এটাই আমার একমাত্র কষ্ট! এ ছাড়া আমার কারও প্রতি কোনও অভিযোগ নেই।
ছয়। তোমার সমস্যা কী?
তুমি কী চাও আসলে? আমি দম আটকে মরে যাই, এটা?
তুমি জানো না যে আমি কষ্ট পাচ্ছি?
তুমি জানো না, আমি সারাক্ষণই তোমাকে মেসেজ না করে, কথা না বলে থাকতে পারি না?
তোমার সমস্যা কী?
তুমি জানো না, আমার কিছু ভালো লাগছে না?
আমি মেসেজ করিনি, তো তুমি খোঁজ নাওনি কেন?
তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, তা-ও আমাকেই কেন সব মেনে নিতে হবে?
ভালোবাসো না, তাহলে রেখে দিয়েছ কেন আমাকে? আমার কোনও দাম নাই তোমার কাছে?
আমি সারাক্ষণই যে সকাল থেকে, গতকাল থেকে, গত পরশু রাত-দিন থেকে একটা ঝড়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তোমার সেটা চোখে পড়ে না?
তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাও, তাই না?
মেরে ফেলতে চাইলে বলো, আমি প্রয়োজনে বিষ খাব, বিষ না পেলে আমি হারপিক খাব, তারপর যা হয় হবে। সমস্যা কী তোমার? তুমি কিছু বোঝো না? আজ পর্যন্ত আমি তোমার সাথে কথা না বলে থেকেছি কখনও, যখন থেকে রিলেশনে জড়িয়েছি? তোমাকে আর কী বলতে হবে? আর কত এভাবে কষ্ট দিতে থাকবে? আমার আর কী কী মেনে চলতে হবে, বলো? আমি সেটাই করব, বলো! দরকার পড়লে আমি রাস্তায় গিয়ে পড়ে থাকব, তা-ও বলো, তোমার জন্য আর কী কী ছাড় দিতে হবে? তুমি তো দিব্যি মজায় আছ, সারাদিন তুমি কাজকর্মও ঠিকভাবে করছ, সবই তোমার ঠিক চলছে। তাহলে আমাকে বলো, আমার কী করতে হবে, আমি সেটাই করে দিই তোমার জন্য!


ভাবনা: সাতশো পঁয়ত্রিশ
...............................................................
এক। আমার জীবন আর কখনও স্বাভাবিক হবে না। সবসময় ভেবে এসেছি একটা স্বাভাবিক সাধারণ সাদামাটা জীবনের কথা, কিন্তু এটা ছিল জীবনের কাছে চাওয়া আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল, সবচেয়ে বড়ো ভুল কিছু চেয়ে ফেলা। সবার জীবন স্বাভাবিক হয় না। সব কিছু ছেড়েছুড়ে কেবল শান্তির পেছনে ছোটা আমিই সব কিছু হারিয়েছি সবার আগে। এটা আর এমন গুরুত্বপূর্ণ কী!
একটা সময় ভাবতাম, আহা, একটা ছোট্ট ঘর হবে, নিজের একটা সংসার হবে। সারাজীবন আব্বু-আম্মুকে মারামারি আর ঝামেলা করতেই দেখেছি। বিষয়টা এমন যেন আব্বু-আম্মুর কোনও সন্তানই নেই। তাঁরা সারাক্ষণই একে অপরকে নিয়েই ঘরের ভেতর অশান্তি করে করে আজ পর্যন্তও থামলেন না। সেই থেকেই চিন্তা ছিল, একটা সংসার হবে আর সেই সংসারে কখনও আমার সন্তানকে এসব সহ্য করতে দেবো না। অনেক অনেক দিন গেছে, আব্বু-আম্মু অযথা সামান্য বিষয় নিয়ে ঝামেলা করতেন, তারপর ঝামেলা করে আব্বু বাইরে হোটেলে খেয়ে নিতেন, আর আম্মু নানুর বাড়ি চলে যেতেন। (নানুবাড়ি কাছেই, হেঁটে ৫ মিনিটের পথ।) আমরা তিন ভাই-বোন কী খেয়ে আছি, কীভাবে আছি, আব্বু-আম্মু কখনও এসব ভেবেও দেখতেন না। এমনকি অত অল্প বয়সে আব্বু-আম্মুর মারামারি দেখলে ভয়ে কাঁপতে থাকতাম। এতটাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম সেসময়।
আমার চাচা-ফুপুরা সবাই ঢাকায়। আশেপাশের চাচাত চাচা কিংবা দাদুরা এসে ঘরের বিষয় মীমাংসায় লেগে যেত। ঘরের জিনিস বাইরে চলে যেত, সবাই এসবে ভালোই মজা নিত। ভাবত, ওরা ভালো নেই...কী মজা, কী মজা! বাচ্চা তিনটা পথে পথে ঘুরে বেড়াবে, জীবনেও মানুষ হবে না, ওদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না...কী মজা, হুররেএএএ!
সেই থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কখনও কোনও ঝামেলাপূর্ণ সম্পর্কে জড়াব না। দরকার হয় তো, একেবারে সাদাসিধা একটা জীবন কাটাব, কিন্তু শান্তি নিয়ে কাটাব। হায়, তখন জানা ছিল না, ভাগ্য বলে কিছু আছে। যতই চেষ্টা করি না কেন, নির্দিষ্টের একছটাকও বেশি জুটবে না। সারাজীবনই এই ফ্যান্টাসিতে ছিলাম যে একদিন আমার নিজের একটা সংসার হবে, হবেই। সেদিন নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নেব! (যত ফালতু চিন্তা সব!) আমার নিজের মনের মতো একটা ঘর হবে, ছোটো হোক, তবুও অশান্তি থাকবে না।
বেশি চাইলে যা হয়! কিচ্ছু স্বাভাবিক হয় না, হবে না। বেঁচে থাকলে একটা ফালতু কল্পনায় দিন যাবে। আমার আর অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো নিজের একটা মানুষ থাকবে না, যাকে নিয়ে কোনও লুকোচুরি খেলতে হয় না। সবাই যখন নিজের সংসার সাজাবে, আমি তখন সব কিছু থেকে মুখ লুকিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচব। আমার পেটে কখনওই কোনও পুতুলের মতো মেয়ে আসবে না। আমিও মনভরে আমার বান্ধবীদের মতো নিজের বাচ্চাকে নিজের আদরযত্নে বড়ো হতে দেখতে পাবো না। আমার আর স্বাভাবিক কিছু হবে না। পাঁচ বছর অথবা দশ বছর পর যদি বেঁচে থাকি, তাহলে খুব বেশি হলে ছোট্ট একটা চাকরি করে কোনও রকমে দিন পার করব, নয়তো আব্বুর দেওয়া যেই ভাগের ঘরটা পাবো, সেখানে এসে উঠে ভাইয়ের ঘাড়ে, নয়তো সবার দানের উপর ভর করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাটিয়ে দেবো একা।
ঘরে মধ্যে মরে হয়তো কোনও একদিন পড়ে থাকব, দু-দিন কি তিন দিন পর কেউ একজন বিকট গন্ধে টের পাবে, তারপর গোসল হবে না, কোনও মতে জানাজা পড়িয়ে মাটি চাপা দিতে পারলেই আপদ বিদায়---যা এখনও হতে পারে। তাহলে এত চিন্তার আর কী আছে! হুহ্‌!
শোনো, আমি এখন মানসিকভাবে একটু অসুস্থ আছি। সুতরাং আমাকে একটু আমার উপর ছেড়ে দাও। সুস্থ হয়ে আমি দেখবে আবার সেই আগের মতো আচরণ করব। এই মুহূর্তটা শুধু সহ্য করো। কী আর করবে, পাগল তো আমি!
দুই। তুমি দেখো, প্লিজ, আমাকে সারাজীবনের জন্য তোমার কাছে নিয়ে নাও। আমি কথা দিচ্ছি, আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে রেখে দেবো।
দেখো, কী অদ্ভুতভাবে প্ল্যান করে আছি, কেউ একজন জীবনে আসবে আর তারপর থেকে সারাজীবন তার সাথেই কাটিয়ে দেবো! অথচ আগামী পাঁচ দিনেরই ঠিক নাই...এমন হতে পারে না? যাকে বিয়ে করলাম সারাজীবনের নিরাপত্তার জন্য, দেখা গেল, বিয়ের দুই মাস, এমনকি দুই দিন পরেই সে হয়তো মরে গেল কোনও কারণে, অথবা আমিই মরে গেলাম! হয় না এমন?
আমার এসব নিয়ে আর চিন্তার কিছুই নেই। কারণ আমি জানি, অন্তত এটুকু জেনে গেছি, আমি অন্য কারও সাথে আসলে থাকতে পারব না। আমি জানি, অন্য কোথাও গেলে আমার আবার সেখান থেকে ফেরত চলে আসতে হবে। আমি যা খুঁজছিলাম, আমি সেটা পেয়ে গেছি। আমি কেবল এতটুকুই চিন্তা করি, বাসা থেকে বের করে দিলে কী হবে। এ ছাড়া আর কোনও চিন্তা নেই। আমি জানি, ওরা কেউই আমার পাশে সারাজীবন থাকবে না। আব্বু আম্মু একসময় থাকবে না। আপু, ভাইয়া এখনই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আব্বু আম্মু চলে গেলে আপু আর ভাইয়া আমাকে সহ্য করবে বলে আমার মনে হয় না। যার আব্বু আম্মু নাই, তার কেউই নাই, তাকে সহ্য করারও কেউ নাই।
তিন। তুমি কি জানো, তুমি যখন আমাকে খুশি করার জন্য আমার সঙ্গে অনেক গল্প করো, অনেক দুষ্টুমি করো, অনেক হাসাও আমাকে, অনেক মজার মজার কথা শোনাও, অনেক মজা করো, তখন সেই মুহূর্তে সেই মুহূর্তগুলো আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে। তখন মনে হয়, ইসস্‌ প্রতিদিন ইচ্ছা করে ঝামেলা বাধিয়ে বসে থাকি যেন তুমি আমাকে ফোন করে করে পাগল করে দাও!
আমি তো তোমাকে কক্ষনো ছেড়ে যাব না, পাখি! কিন্তু আমার বাসা থেকে যদি আমাকে সহ্য করতে করতে একসময় হুট করে বের করে দেয়, সেদিন আমি কোথায় যাব? কে আমার পাশে সারাজীবন থাকবে? কেউ আমার দায়িত্ব নেবে না। আমার ভাই-বোন কারও ঘাড়েই আমি থাকতে চাই না, পারবও না। এ ছাড়া যদি আমি সম্পূর্ণ একা থাকি, তাহলে আমাকে দেখার আর কেউ নেই। আমি কতদিন একা থাকতে পারব?
একটা বিশ্বস্ত মানুষ সবারই দরকার বলে আমি মনে করি। অন্তত একটা দীর্ঘসময় পর গিয়ে হলেও কাউকে লাগে জীবনে। আর আমি বিয়েপাগল কখনও না, কিন্তু আমি সত্যিই এমন কাউকে সবসময় খুঁজেছি, যে আসলেই আমার কেয়ার করবে, যার কথা চোখ বন্ধ করেই আমি শুনব, মানব। কারণ আমি কারও কথা মানি না, আমি কাউকে কেয়ার করি না। তোমার কথা আমি মানতে পারি, তোমার কথা আমার মানতে ভালো লাগে, ইচ্ছে হয়।
চার। তোমার মন কেন বিষণ্ণ, সেটা জানার অধিকার যেমনি আমার নেই, তেমনি তোমার মন বিষণ্ণ, এটা জানারও অধিকার আমার নেই। আমাকে তোমার কোনও কিছুই জানিয়ো না। তুমি যা খুশি করো, পাখি। আমাকে সকল কিছু অথবা কোনও কিছুই না জানালেও চলবে। আমার কাছে তোমার কোনও কৈফিয়ত দিতে হবে না।
আমি আজকে থেকে তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আমি আর কখনও তোমার উপর রাগ করব না না না। কোনও কিছু নিয়েই অভিযোগ করব না, তুমি ফোন না দিলে, কথা না বললে, ভালো না বাসলে...তোমার যত যা করার যা খুশি যা যা করার তুমি করবে, আমি আর কখনও তোমাকে কোনও কিছুর জন্যই কিচ্ছু বলব না। তুমি আমার কাছে সম্পূর্ণ মুক্ত। আমার প্রতি তোমার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এমনকি ভালোবাসার জায়গা থেকেও না। একটা দায়বদ্ধতাবিহীন ভালোবাসার সম্পর্কে তুমি থাকতে পারলে আমি কেন পারব না?
আচ্ছা পাখি, তুমি যে বলো আমার অনেক চিন্তাভাবনা, আমার অনেক কিছুই তোমার সাথে মেলে, এটা কেন বলো? হ্যাঁ, আমি জানি, মেলে আর এটা আমাকে অথবা তোমাকে জোর করে করতে হয়নি। 'পরিপূরক' অর্থ তো একজনের অপূর্ণতা অন্যজনের মাধ্যমে পূরণ করা, কিন্তু জান, আমি তোমার জীবনে না থাকলেও তো তুমি পরিপূর্ণ! তোমার সাথে আমার তো কোনও কিছু নিয়েই বিরোধ হয় না, তাহলে কি সেটা পরিপূরক হয়?
তোমার সাথে আমার তো কখনও কোনও বিরোধ হবে না, কারণ আমি হয়তো তোমার কোনো কাজে কষ্ট পেতে পারি, কিন্তু বিরোধিতা তো করব না কখনও, তাহলে কী করে এই সম্পর্কটা পরিপূরক হয়? সব কিছুই যদি মিলে যায়, কিছুই যদি বিরোধী না হয়, তাহলে কি পরিপূরক হওয়া যায়? যদি যায়, তাহলে সেটা কেমন করে হয়?
যেখানে আলো থাকে, তার বিপরীতে তো অন্ধকার থাকে, এজন্যই আলো আর আঁধার একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু আমার সব কিছু তো তোমার সব কিছুর সাথে ভীষণভাবে সংযুক্ত, তাহলে কী করে আমরা পরস্পরের পরিপূরক হব?
একটা কথা। জানো, মানুষ মাত্রই অমানুষ! এটা কেন বললাম, জিজ্ঞেস কোরো না, প্লিজ!