২৭ বছর বয়সে

২৭ বছর বয়সে যখন হন্যে হয়ে ব্যাংকে চাকরি খুঁজছেন, তখন আপনারই বয়েসি কেউ একজন সেই ব্যাংকেরই ম্যানেজার হয়ে বসে আছেন। আপনার ক্যারিয়ার যখন শুরুই হয়নি, তখন কেউ কেউ নিজের টাকায় কেনা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে আপনার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছেন। কর্পোরেটে যে সবসময় চেহারা দেখে প্রমোশন দেয়, তা নয়। দিন বদলাচ্ছে, সাথে কনসেপ্টগুলিও বদলে যাচ্ছে। শুধু বেতন পাওয়ার জন্য কাজ করে গেলে শুধু বেতনই পাবেন। কথা হলো, কেন এমন হয়? সবচাইতে ভালোটি সবচাইতে ভালোভাবে করে কীভাবে? কিছু ব্যাপার এক্ষেত্রে কাজ করে। দু-একটি বলছি।

প্রথমেই আসে পরিশ্রমের ব্যাপারটা। যারা আপনার চাইতে এগিয়ে, তারা আপনার চাইতে বেশি পরিশ্রমী। এটা মেনে নিন। ঘুমোনোর আনন্দ আর ভোর দেখার আনন্দ একসাথে পাওয়া যায় না। শুধু পরিশ্রম করলেই সব হয় না। তা-ই যদি হতো, তবে গাধা হতো বনের রাজা। শুধু পরিশ্রম করা নয়, এর পুরস্কার পাওয়াটাই বড়ো কথা। অনলি ইয়োর রেজাল্টস আর রিওয়ার্ডেড, নট ইয়োর এফর্টস। আপনি এক্সট্রা আওয়ার না খাটলে এক্সট্রা মাইল এগিয়ে থাকবেন কীভাবে? সবার দিনই তো ২৪ ঘণ্টায়। আমার বন্ধুকে দেখেছি, অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে রাত জেগে আউটসোর্সিং করে। রাত জাগার বাড়তি সুবিধা সে তো পাবেই!

আপনি বাড়তি কী করলেন, সেটাই ঠিক করে দেবে, আপনি বাড়তি কী পাবেন। ভিন্ন কিছু করতে না পারলে আপনি ভিন্ন কিছু পাবেন না। বিল গেটস রাতারাতি বিল গেটস হননি। শুধু ভার্সিটি ড্রপআউট হলেই স্টিভ জবস কিংবা জুকারবার্গ হওয়া যায় না। আমার মতো অনার্সে ২.৭৪ সিজিপিএ পেলেই বিসিএস আর আইবিএ ভর্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে যাওয়া যাবে না।

‘আউটলায়ার্স’ বইটি পড়ে দেখুন। বড়ো মানুষের বড়ো প্রস্তুতি থাকে। নজরুলের প্রবন্ধগুলি পড়লে বুঝতে পারবেন, উনি কতটা স্বশিক্ষিত ছিলেন। শুধু রুটির দোকানে চাকরিতেই নজরুল হয় না। কিংবা স্কুল-কলেজে না গেলেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাওয়া যাবে না। সবাই তো আর বই-বাঁধাইয়ের দোকানে চাকরি করে মাইকেল ফ্যারাডে হতে পারে না, বেশিরভাগই তো সারাজীবন বই বাঁধাই করেই কাটিয়ে দেয়।

স্টুডেন্টলাইফে কে কী বলল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমাদের ব্যাচে যে ছেলেটা প্রোগ্রামিং করতেই পারত না, সে এখন একটা সফটওয়্যার ফার্মের মালিক। যাকে নিয়ে কেউ কোনওদিন স্বপ্ন দেখেনি, সে এখন হাজার হাজার মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। ক্যারিয়ার নিয়ে যার তেমন কোনও ভাবনা ছিল না, সে-ই সবার আগে পিএইচডি করতে আমেরিকায় গেছে। সব পরীক্ষায় মহাউৎসাহে ফেল-করা ছেলেটি এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। আপনি কী পারেন বা কী পারেন না, এটা অন্য কাউকে ঠিক করে দিতে দেবেন না।

পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাননি? প্রাইভেটে পড়ছেন? কিংবা ন্যাশনাল ভার্সিটিতে? সবাই বলছে, আপনার লাইফটা শেষ? আমি বলি, আরে! আপনার লাইফ তো এখনও শুরুই হয়নি। আপনি কতদূর যাবেন, এটা ঠিক করে দেওয়ার অন্যরা কে? লাইফটা কি ওদের নাকি? আপনাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে কেন? কিংবা ডাক্তারি পাশ করে কেন ডাক্তারিই করতে হবে? আমার পরিচিত এক ডাক্তার ফটোগ্রাফি করে মাসে আয় করে ৬-৭ লাখ টাকা। যেখানেই পড়াশোনা করুন না কেন, আপনার এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে পুরোপুরিই আপনার নিজের উপর।

শুধু ‘ওহ শিট!’, ‘সরি, বেইবি!’, চ্যাটিং-ডেটিং দিয়ে জীবন চলবে না। আপনি যার উপর ডিপেনডেন্ট, তাকে বাদ দিয়ে নিজের অবস্থানটা কল্পনা করে দেখুন। যে গাড়িটি করে ভার্সিটিতে আসেন, ঘোরাঘুরি করেন, সেটি কি আপনার নিজের টাকায় কেনা? ওটা নিয়ে ভাব দেখান কোন আক্কেলে? একদিন আপনাকে পৃথিবীর পথে নামতে হবে। তখন আপনাকে যা যা করতে হবে, সেসব কাজ এখনই করা শুরু করুন। জীবনে বড়ো হতে হলে কিছু ভালো বই পড়তে হয়, কিছু ভালো মুভি দেখতে হয়, কিছু ভালো মিউজিক শুনতে হয়, কিছু ভালো জায়গায় ঘুরতে হয়, কিছু ভালো মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, কিছু ভালো কাজ করতে হয়।

জীবনটা শুধু হাহাহিহি করে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। একদিন যখন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, তখন দেখবেন, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। স্কিল ডেভেলাপমেন্টের জন্য সময় দিতে হয়। এসব একদিনে কিংবা রাতারাতি হয় না। “আপনার মতো করে লিখতে হলে আমাকে কী করতে হবে?” “আমি আপনার মতো রেজাল্ট করতে চাই। আমাকে কী করতে হবে?” এসব আমি প্রায়ই শুনি। আমি বলি, “অসম্ভব পরিশ্রম করতে হবে। নো শর্টকাটস। সরি!” রিপ্লাই আসে, “কিন্তু পড়তে যে ভালো লাগে না। কী করা যায়?” এর উত্তরটা একটু ভিন্নভাবে দিই। আপনি যখন স্কুল-কলেজে পড়তেন, তখন যে সময়ে আপনার ফার্স্টবয় বন্ধুটি পড়ার টেবিলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত, সে সময়ে আপনি গার্লস স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এখন সময় এসেছে, ও ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আপনি পড়ার টেবিলে বসে থাকবেন।

জীবনটাকে যে সময়ে চাবুক মারতে হয়, সে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করলে, যে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করার কথা, সে সময়ে জীবনটাকে উপভোগ করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক। এটা মেনে নিন। মেনে নিতে না পারলে ঘুরে দাঁড়ান। এখনই সময়!

বড়ো হতে হলে বড়ো মানুষের সাথে মিশতে হয়, চলতে হয়, ওঁদের কথা শুনতে হয়। এক্ষেত্রে ভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধু নির্বাচনটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সাবকনশাস মাইন্ড আপনাকে আপনার বন্ধুদের কাজ দ্বারা প্রভাবিত করে। আমরা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই আমাদের চাইতে ইনফেরিয়র লোকজনের সাথে ওঠা-বসা করি, কারণ তখন আমরা নিজেদেরকে সুপিরিয়র ভাবতে পারি। এ ব্যাপারটা সুইসাইডাল। আশেপাশে কাউকেই বড়ো হতে না দেখলে বড়ো হওয়ার ইচ্ছেটা জাগে না।

আরেকটা ভুল অনেকে করেন। সেটি হলো, ধনীঘরের সন্তানদের সাথে মিশে নিজেকে ধনী ভাবতে শুরু করা। মানুষ তার বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়। উজাড় বনে তো শেয়ালই রাজা হয়। আপনি কি শেয়ালরাজা হতে চান, না কি সিংহরাজা হতে চান, সেটি আগে ঠিক করুন।

বিনীত হতে জানাটা মস্ত বড়ো একটা আর্ট। যাঁরা অনার্সে পড়ছেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই এটার অভাব রয়েছে। এখনও আপনার অহংকার করার মতো কিছুই নেই, পৃথিবীর কাছে আপনি একজন নোবডি মাত্র। বিনয় ছাড়া শেখা যায় না। গুরুর কাছ থেকে শিখতে হয় গুরুর পায়ের কাছে বসে। আজকাল শিক্ষকরাও সম্মানিত হওয়ার চেষ্টা করেন না, স্টুডেন্টরাও সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে। আপনি মেনে নিন, আপনি ছোটো। এই মাইন্ডসেটটাই আপনাকে এগিয়ে রাখবে। বড়ো মানুষকে অসম্মান করার মধ্যে কোনও গৌরব নেই। নিজের প্রয়োজনেই মানুষকে সম্মান করুন।

পুনশ্চ।

(এখন পর্যন্ত এটিই আমার সবচাইতে জনপ্রিয় লেখা। লেখাটিকে সেভ করার সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ফেসবুক গ্রুপে, পেইজে, ওয়ালে, পোস্টে এতে অগণিত লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার যুক্ত হয়েছে। লেখাটি এ পর্যন্ত পঠিত হয়েছে অন্তত ৪০-৫০ লক্ষ বার। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে লেখাটি ফটোকপি করে বিতরণ করা হয়েছে। আমার যত লেখা চুরি করে লোকে নিজের নামে চালিয়েছে, সেগুলির মধ্যে সর্বাধিক বার চুরি হয়েছে এ লেখাটিই। অনেকেই নিজের নামে এই লেখা বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ, এমনকী জাতীয় দৈনিকেও প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। কুম্ভিলকদের জন্য শুভকামনা রইল।

বন্ধুদের অনুরোধে লেখাটিকে শিরোনাম দিয়ে রেখে দিলাম। হয়তো কারও কারও কাজে লেগে যাবে। আমার অসংখ্য লেখাই তো হারিয়ে গেছে। লেখাটি আমার আনস্মার্ট কিপ্যাড মোবাইলে টাইপ করে করে অফিসে বসে তাড়াহুড়োয় লেখা। পিএটিসি’তে ট্রেনিং-এর অংশ হিসেবে আমরা কিছু প্রশিক্ষণার্থী এক সরকারি দপ্তরে ভিজিটে গিয়েছিলাম। সেখানকার দপ্তরপ্রধান কোথায় কখন কীভাবে হাতি মেরেছেন, ঘোড়া মেরেছেন, দেশোদ্ধার করে ফেলেছেন এসব চাপাবাজি শুরু করলে সবাই খুব মনযোগী শ্রোতার মতো একমনে শোনার অভিনয় করছিল, আর আমি আমার মোবাইলের কিপ্যাডে নিচের লেখাটি লিখেছিলাম। লিখতে সময় লেগেছিল ২০-২৫ মিনিটের মতো। (উনি দু-এক বার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি অন্য কোনও কাজে বিজি?” “না স্যার, আমি আপনার কথার চুম্বকঅংশগুলি মোবাইলে টাইপ করে নিচ্ছি।” আমার দয়ালু সহকর্মীরাও আমার সমর্থনে কথা বলেছিলেন। “জি স্যার, এটা ওঁর একটা অভ্যেস। কোনও স্পিচ ভালো লাগলে উনি সেটা লিখে রাখেন।” শুনে স্যারের সে কী হাসি! “হে হে…আরে নাহ্‌! আমি এমন কী আর বলছি! তবু আপনার ভালো লাগলে আপনি লিখে রাখতে পারেন।” “থ্যাংকয়্যু, স্যার!” এরপর খেয়াল করলাম, স্যারের কথাগুলি আরও বিরক্তিকর হয়ে গেল! একেবারে রোবটের মতো মাপা মাপা কথাবার্তা!)

বাসায় বসে সময় নিয়ে ল্যাপটপে লিখতে পারলে হয়তো আরও বড়ো আর ভালো কিছু লিখতে পারতাম। আমি ভাবতেও পারিনি যে লেখাটি এত বেশি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে! বন্ধুদের সাড়া পেয়ে এখন মনে হচ্ছে, লেখাটি অতটা তাড়াহুড়োয় লেখা ঠিক হয়নি, আরেকটু সময় নিয়ে লিখলে ভালো হতো।

সেদিন অফিসে বসে লেখাটি লিখেই পোস্ট করে দিয়েছিলাম। আমার মূল পোস্টটির লিংক নিচে দিলাম। পোস্টটিতে গিয়ে ওখানকার কমেন্টগুলি থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারবেন।

https://www.facebook.com/sushanta.iba/posts/10153205370883771

(আমার আগের আইডি’টা এখন আর নেই। কিছু অসুস্থ বিকৃত মানসিকতার ঈর্ষান্ধ মানুষ ওই আইডি’টার বিরুদ্ধে মিথ্যে রিপোর্ট করে সেটিকে বন্ধ করে দিয়েছেন। সে আইডি’তে অন্তত সাড়ে চার-শো নোট ছিল, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট ছিল, কয়েক হাজার ছবি ছিল, প্রায় আড়াই লাখ ফলোয়ার ছিল। কাজটি করে ওঁরা অনেক শান্তি পেয়েছেন এবং এই ‘ভালো কাজ’টির মাধ্যমে মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে স্বর্গযাত্রার টিকিটটাও কনফার্ম করে ফেলেছেন!))

লেখাটির অডিয়ো-ক্লিপ নিয়ে কিছু কথা বলি। আরজে সালমানের কণ্ঠে যে অডিয়ো-ক্লিপগুলি আছে, সেগুলির মধ্যে এই লেখার ক্লিপটিই এখন পর্যন্ত সবচাইতে বেশি বার শোনা হয়েছে। ক্লিপটিতে সালমান ভাই আমার লেখাটিকে খুব চমৎকার করে পড়েছেন।

ক্লিপটি শুনুন, সবার সাথে শেয়ার করুন। অনেকেই আমাকে বলেছেন, যখন পড়তে ইচ্ছে করে না, ঘুম পায়, থেমে যেতে ইচ্ছে করে, তখন আরজে সালমানের কণ্ঠে এই কথাগুলি শুনলে শরীর-মনের সব জড়তা কাটিয়ে উঠে আবারও শুরু করা যায়! এই শুরু করাটাই তো বড়ো কথা!

লিংকটা দিয়ে দিলাম…