আয়নাঘর

ভালোবাসার মানুষটি নিজের একটি আয়নাঘর। যে আয়নায় নিজেকে সম্পূর্ণ দেখা যায়, যে আয়নায় নিজের অস্তিত্বের কিছুই আড়াল থাকে না। ভালোবাসার মানুষ এমন একটি নির্ভার জায়গা, যেখানে নিজেকে সবটুকু ঢেলে দিয়ে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়ানো যায়। আমরা যেমন আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের স্বরূপ স্পষ্ট দেখতে পাই, ভালোবাসার মানুষটিও আমাদের নিজস্ব ঘরের সে আয়নার মতোই, যে আয়নায় নিজের অবয়ব অবিকল প্রতিফলিত হয়।


ভালোবাসার দুটি আত্মাই আসলে একে অপরের কাছে আয়নার মতো। যদি কোনও কারণে সেই আয়নাটি ভেঙে যায়, তখন সেখানে দুজনের কাউকেই আর দেখা যায় না। আয়নায় যেমন আমাদের শরীরের সকল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দাগও চোখ এড়ায় না, তেমনি ভালোবাসার মানুষের কাছের আমাদের কিছুই অপ্রকাশ্য, অজানা থাকে না। নিজেকে জানাবার ও বোঝাবার সীমাবদ্ধতায় কখনও ভালোবাসা থাকে না। যে ভালোবাসার সম্পর্কে দুজনের কেউই একে অপরের আয়না হতে জানে না, সেখানে তারা কখনও আত্মার বন্ধনে থাকে না, তারা কেবলই সাময়িক বোঝাপড়ার একটা সম্পর্কে লিপ্ত হয়, আর যখন কেউ কারও বোঝাপড়ার জায়গায় আঘাত করে, তখন দুজনের পথ আলাদা হয়ে যায়।


আমাদের আত্মার মানুষটি যখন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা তার মাধ্যমে নিজেকে চিনতে পারি, ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজেকে আরও স্বচ্ছভাবে দেখতে পারি, আমাদের যে বিষয়গুলো আমাদের অজানা, সে বিষয়গুলো আমাদের ভালোবাসার আয়নায় দেখতে পারি। এমনি করেই আমাদের ভালোবাসা আমাদের নিজেদেরকে জানতে শেখায়। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, তখন আমরা আমাদের সব কিছু সেই মানুষটির কাছে মেলে ধরি, আমরা নিজের সাথে ঠিক যেমন, আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছেও ঠিক তেমন হয়েই ধরা দিই।


যে আয়নায় নিজেকে দেখা যায় না, সেটি কখনও আয়না হতে পারে না। যে ভালোবাসায় আমরা নিজেকে দেখি না, সেটি কখনও ভালোবাসা হয় না। আমাদের চিন্তা, আমাদের অভ্যাস, আমাদের আচার-আচরণ, আমাদের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, আমাদের ভালো কি খারাপ সব দিকই, যা যতটুকু আমরা জানি, তার সবই ভালোবাসার মানুষটির সামনে মেলে ধরি, যাতে করে আমরা তার মাঝে নিজেকে দেখতে পাই। এর ফলে আমাদের সাথে সব থেকে বড়ো যে বিষয়টি ঘটে, সেটি হচ্ছে, আমাদেরকে আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনও কিছুই মুখে বলে বলে প্রকাশ করতে হয় না, আমাদের ভালোবাসার মানুষ নিজ থেকে আপনাআপনিই আমাদের সব কিছু জেনে যায়। ভালোবাসার মানুষটির কাছে আমাদের কোনও ব্যাখ্যা দিতে হয় না। আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদের অন্তরের একান্ত স্বরূপটাই হয়ে ওঠে।


অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে আমরা আসলে সেটিই, ঠিক যেমনটি আমাদের ভালোবাসার মানুষ। কেননা ভালোবাসা প্রথমে আত্মার সাথে আত্মার মিলনে হয়ে থাকে, যে দুইটি আত্মা মোটামুটি একই প্রকৃতির। যে ভালোবাসায় বাহ্যিক অবয়ব আগে আসে এবং আত্মা পরে, সেই ভালোবাসা একটা সময় দুজনের কাছেই বোঝা হয়ে ওঠে। অনেক ভালোবাসার সম্পর্কই ভেঙে যায়, কারণ সেখানে আত্মার অমিল পরে গিয়ে একটা সময় ধরা পড়ে। যদি আমাদের ভালোবাসা আত্মার ঘর থেকে শুরু হয়, সেটি ভেঙে যাবার আর কোনও প্রশ্নই থাকে না, কেননা আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার কোনও বিনাশ নেই। আত্মার এই অবিনাশিতার ব্যাপারটি দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়---মৃত্যুর আগে ও পরে। মৃত্যুর আগে আত্মার অবিনাশী সত্তার অর্থ হলো, একজন মানুষ আদতে ঠিক তেমনই, যেমনটি তার অভ্যন্তরের সত্তাটি। ভেতরের মানুষটি কখনও বদলায় না, তার উপরে নানান সময়ে নানান প্রলেপ পড়ে মাত্র। উপযুক্ত পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পর্যায়ে ঠিকই তা বেরিয়ে আসে নিজস্ব রূপে। সেই সত্তাটিই হচ্ছে আত্মা।


ভালোবাসা এমন একটি আয়না, যে আয়নার মধ্যে ও সামনে ভালোবাসার দুজন মানুষ থাকে এবং একই ক্ষেত্র থেকে, একই চোখে ওরা একে অপরকে দেখে। আয়নায় যেমন আমরা নিজেকে দেখতে যাই, আমাদের ভালোবাসার মানুষটির কাছেও আমরা নিজেকে দেখতে যাই। সে আয়নায় আমরা যতটা প্রকাশ্য হই, আমাদের ভালোবাসা ঠিক ততটাই স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। দুটি আত্মা যখন ভালোবাসায় একাত্ম হয়, তখন তাদের মাঝে আর কোনও পর্দা থাকে না, তখন দুটি মানুষ তাদের সকল গুণাগুণ নিয়ে একটি আত্মার একটি মানুষে পরিণত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভালোবাসার একই আত্মা হয়ে উঠতে না পারি, ততক্ষণ ভালোবাসা কখনও পরিপূর্ণতা পায় না।


আত্মার মিলনেই ভালোবাসার প্রকৃতরূপ প্রকাশ্য হয়, আর সেটি হবার একমাত্র পথই হচ্ছে নিজের কাছে, নিজের সাথে আমরা নিজেরা যেমন, আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছেও হুবহু তেমনি করেই মেলে ধরা। আমাদের নিজেদের সম্পর্কে নিজেদেরই জানার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা নিজের বিষয়ে যা-কিছুই জানি, আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছেও একেবারে সেভাবেই প্রকাশ্য হওয়াই ভালোবাসার মূল রীতি, নীতি, ধর্ম।


ভালোবাসা কোনও উদ্দেশ্য অথবা গন্তব্য নয়, ভালোবাসা একটি প্রতিবিম্ব, একটি মাধ্যম, যে মাধ্যমে আমাদের স্বরূপ প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যা-কিছু নিজেদের মাঝে থাকা সত্ত্বেও দেখতে পাই না, আমাদের ভালোবাসার মানুষ সেটি আমাদের সামনে তুলে ধরে। ভালোবাসার আলোয় আলোকিত দুটি আত্মা কখনও আলাদা হয়ে বাঁচতে পারে না। ভালোবাসা আমাদের আশ্রয়, ভালোবাসা আমাদের জীবনেরই ছায়া। ভালোবাসা বটবৃক্ষের মতো আমাদেরকে সকল দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। ভালোবাসা আমাদের সকল শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়। ভালোবাসা আমাদের জীবনকে নতুন এক অর্থ প্রদান করে।


ভালোবাসায় ডুবতে ডুবতে একসময় মনে হয়, আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদেরই আর-এক রূপ মাত্র। যে রূপ দুটি শরীরের লেপটে থেকে আলাদা বিচরণ করে, কিন্তু যার মূল এক। ভালোবাসা যেমন প্রাকৃতিক, আমাদের আত্মা - হৃদয় যেমন প্রাকৃতিক, আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছেও ঠিক তেমনই প্রাকৃতিক। আমরা সমগ্র অখণ্ড প্রকৃতির কিছু অংশমাত্র। প্রকৃতির মতোই ভালোবাসায় কোনও কৃত্রিমতার স্থান নেই, প্রয়োজনও নেই। সকল কৃত্রিমতাকে ঝেড়ে ফেলে চির প্রকৃত আদিম দুটি হৃদয়ে এক হয়ে বাস করে যে ভালোবাসা, সেটিই সত্যিকারের ভালোবাসা।


যখন দুটি ভালোবাসার মানুষ একে অপরের আয়না হয়ে থাকে, তখন তাদের মাঝে কোনও সন্দেহ, ভুল বোঝাবুঝি, কৃত্রিমতা, অহমবোধ (ইগো) বলে কিছুই আর থাকে না। ভালোবাসার মানুষটিও নিজের অংশ এবং অঙ্গ হয়ে যায়। ভালোবাসার বোধের কাছে পৃথিবীর সকল বোধই সামান্য এবং তুচ্ছ। ভালোবাসার আয়নাটি দুটি ভালোবাসার মানুষের কাছে একটি উন্মুক্ত আয়না, যেখানে কাউকে কিছু প্রশ্ন করে জানবার প্রয়োজন পড়ে না, কেবল তার সান্নিধ্যে থেকেই সব উত্তর প্রকাশ পায়। যে আয়না ভালোবাসার মানুষকে প্রশ্ন ছুড়ে বাঁচে, সে আয়নায় নিজেকে আসলে দেখা যায় না, সে আয়নায় অন্য কারও অবয়ব নিশ্চয়ই ভেসে ওঠে, সে আয়নায় একই অবয়বে ভিন্ন কোনও সত্তাই বাস করে। আর যে আয়নায় একই অবয়বে ভিন্ন কোনও সত্তাকে দেখা যায়, সে আয়নাকে না রাখলেও চলে, কেননা সেখানে ভালোবাসা থাকে না, মুখোশের আড়ালে ভিন্ন দুটি পথের মানুষ কেবলই এক হয়ে থাকার অভিনয় করে যায়।


যে আয়নায় নিজেকে দেখা যায় না, সেটি না-থাকলেও আমাদের কিছুই তেমন এসে যায় না, সেটির অনুপস্থিতি আমাদের মাঝে কোনও আঘাত বা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। এমনকি এমন কিছু আমাদের জীবন থেকে সরে গেলেও আমরা কখনও সেই অনুপস্থিতি টেরই পাই না। যার অস্তিত্ব আমাদের মাঝে কখনওই ছিল না, অথবা যখন আমাদের শূন্যতা কারও আসাতেও পূর্ণতা পায়নি, তখন সে অবস্থায় সেটি আর যা-ই হোক, ভালোবাসা কিছুতেই নয়। ভালোবাসা দুটি ভিন্ন অবয়বের একই প্রকৃতির আত্মার বাসস্থান---যেখানে একজনের কষ্ট অন্যজনের আঘাতে পরিণত হয়, একজনের প্রাপ্তি অন্যের মাঝে আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। এজন্য যখনই আমরা কোনও কারণে নিজের থেকে আলাদা হতে থাকি, তখনই আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের কাছে যাই, কেননা আমরা জানি, আমাদের ভালোবাসাই আমাদেরকে আবার নিজের কাছে নিয়ে আসে। তখন আমরা ভাবি, আমাদের ভালোবাসার মানুষটিই আমাদের সকল শক্তির উৎস, কিন্তু আসলে আমাদের সকল শক্তি আমাদের ভেতরেই আছে---হয়তো সাময়িক সুপ্ত অবস্থায়, আমাদের ভালোবাসার মানুষটি আমাদের আয়নাঘর হয়ে সেই অভ্যন্তরীণ অমিত শক্তিকে দেখতে সাহায্য করে কেবল।