স্বপ্নের পথে

 
 
   
 গতকাল সন্ধ্যার দিকে রাস্তার মোড়ে মুদির দোকানে গিয়েছিলাম। তো সেখানে সেলিমের সাথে দেখা। সে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত, বাংলাসাহিত্যে পিএইচডি করছে। পড়াশোনা করে ভালোই, আর সম্পর্কে আমার ছোটো ভাইয়ের মতো। সে এখন একটা স্কুলে বাংলা পড়ায়, আর বিগত দুই বছর ধরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক বার প্রিলি-রিটেন কোয়ালিফাই করে ভাইভাবোর্ডে আটকে গেছে, আরেক বার রিটেনে আটকেছে। সে এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে।
  
 যা-ই হোক, তার মূলকথা হলো, আমিও যেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য চেষ্টা শুরু করি, কারণ প্রভাষকের চাকরি কবে পাবো কবে পাবো না, কোন‌ও ঠিক নেই। রাস্তায় প্রায় ২০ মিনিটের মতো কথা বলল, আবার আমি বাসায় ফিরতেই ফোন করে অনেকটা সময় নিয়ে কথা বলল। সিলেবাস নিয়েও অনেক কথা বলল। সে আমার প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক বলেই অত কিছু বলেছে।
  
 সত্যি বলতে কী, আমি নিজেও একটু ভাবনায় পড়লাম। মস্তিষ্ক এক কথা বলে, আর হৃদয় বলে অন্য কথা। তারপর ভালো করে স্থিরমাথায় চিন্তা করতেই মনে হলো, বিগত প্রায় ৯ বছর ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর স্বপ্ন দেখি। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহিত্যের প্রতিই একনিষ্ঠ থেকেছি বরাবর, এটা জেনেও যে, আমার স্বপ্নের চাকরি পাওয়াটা সত্যিই অনেক কঠিন হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে সেরাদের সাথে চরম লড়াই হবে, কিন্তু সব জেনেও বাংলাসাহিত্যকে ছেড়ে দিতে পারিনি। তবে আজ কেন আমি বিচলিত বোধ করছি? একজন আমাকে ওর মতো করে বোঝাল, আর ওতেই আমি বিচলিত হয়ে যাচ্ছি! আমার এত বছরের সাধনা ওর কিছু কথাতেই মিথ্যে করে দেবো? ওর জীবন ওর, আমার জীবন আমার। দুজনের পথ এক‌ই হতে কেন হবে? পিচঢালা পথ মানেই কি মেঠোপথের চাইতে ভালো পথ---যে মেঠোপথেই হাঁটতে চায়, তার জন্যও? আমার কাছে, একটি পথের দাম ঠিক ততটাই, যতটা দাম আমি পথটিকে দিচ্ছি।
  
 আমার সবসময়ই মনে হতো, আমি পারব , নিশ্চয়ই পারব। অনেক আন্তরিকতার সাথে ভালোবেসে পড়তাম সাহিত্য। ভালো বই হাতে পেলে খিদে, ঘুম সব চলে যেত। অনেক ছোটোবেলা থেকে গল্পের বই পড়া শুরু হয়, বাবা কিনে দিয়েছিলেন রুশদেশের উপকথা ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাঘ-শিয়ালের মেলা। বই দুটো পড়তে পড়তে তখন প্রায় মুখস্থের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তারপর থেকে বাবা কোথাও বাইরে গেলেই, অন্য অনেক কিছু উপহারের সাথে আমার জন্য গোটা কয়েক গল্পের বই আসবে, এটাই যেন স্বাভাবিক নিয়ম ছিল। আরব্যরজনি, পঞ্চতন্ত্র, জাতকের কাহিনি, চাচা চৌধুরী-ফ্যান্টম-অরণ্যদেব-বিল্লু-পিংকি-শ্রীমতীজি-নন্টে ফন্টে-হাঁদা ভোঁদা- বাঁটুল দ্য গ্রেট-অগ্নিপুত্র অভয়সহ আর‌ও হরেক রকমের কমিকস, সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর...সব তো মনেও নেই আজ---ওসবে নাক ডুবিয়েই আমি বড়ো হয়েছি।
  
 বাবার ট্রাভেল-ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে আমার বইয়ের প্যাকেটটা নিয়েই টুক করে এককোণে লুকিয়ে পড়া, এটাই ছিলাম আমি। সবাই জানত, অন্যান্য উপহারে বিশেষ আগ্রহ কিছু কমই ছিল আমার। বাবা আমাকে জানতেন, বুঝতেন, শুধু একটু হাসতেন তাঁর এই বইপাগল ছেলেটিকে নিয়ে। কোন‌ও আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে প্রিয় বইটিকে বের করে ভিড় থেকে আলাদা হয়ে যেতাম। এটাই ছিল স্বভাব আমার, সবাই জানত।
  
 মনে পড়ে, কোন‌ও এক পুজোয় বাবাকে বলেছিলাম, বাবা, এবার পুজোয় আমাকে ড্রেস কিনে না দিয়ে সে টাকায় কিছু ব‌ই কিনে দাও। বাবা বলেছিলেন হেসে, ঠিক আছে, তোর লিস্টটা দে, সেগুলি কিনে দিই, আবার ড্রেস‌ও কিনে দিই। শুনে আমি চট করে বললাম, ও আচ্ছা, তোমার বাজেট যদি এই ব‌ইগুলি কেনার পর আর‌ও থাকে, তাহলে ওই বাড়তি টাকা দিয়েও আরও কিছু ব‌ই কিনে দিয়ো। আমার কাণ্ড দেখে সেদিন বাবা খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। এখন আমার বেহিসেবি ব‌ইকেনার সামর্থ্য আছে, কিন্তু ছোটোবেলার সেই হিসেবি কেনাকাটার উচ্ছ্বাসটুকু আর নেই।
  
 পরবর্তীতে জীবনে নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই সাহিত্যপ্রেমই যেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখল, সময়ে অসময়ে আশ্রয় দিল, অনেকটা যেন দিশা দেখতে পেয়েছিলাম পুরনো ভালোবাসার কাছে ফিরতে পেরে। তো আমার বিশ্বাস, যদি সঠিক সময়ে, সঠিক পথে, সঠিক প্রচেষ্টা আমি করতে পারি, তাহলে আমি নিশ্চয়ই আমার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারব। এখানে এই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে যদি একজনও পারে কাজটি করতে, তবে সেটা আমাকেই হতে হবে। আর আমি এত হিসেব বুঝি না, এক শান্তি বাদে আমার তেমন কোনও বিশেষ চাহিদা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। সুতরাং যদি আমি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়াতে পারি, তাতেও আমি ভীষণ খুশি হব। ছাত্রদের মধ্যে থাকব, সাহিত্যের মধ্যে থাকব, প্রতিদিন পড়ার মধ্যে থাকব---আমি এটাই চাই মন থেকে।
  
 সমস্ত রকমের শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, সিভিল সার্ভিস বা অন্যান্য পেশা সম্ভবত আমার জন্য নয়। আমার জায়গা একমাত্র ক্লাসরুম, আর একজন মনের মানুষের সাথে খুবই সাধারণভাবে জীবনটাকে উপভোগ করা আমার চাওয়া। প্রথমটি কায়ক্লেশে সম্ভব হলেও দ্বিতীয় ইচ্ছেটি সত্যি হ‌ওয়াটা ভীষণ ভীষণ ভীষণ কঠিন। আমার কথা পড়ে আপনার মনে হতে পারে, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশই তো আমি করতে পারব না হয়তো, অত কঠিন একটা পরীক্ষা! আপনি যা-ই বলুন না কেন, আমি সব মেনে নিতে রাজি। এই বিষয় নিয়ে আপনাকে বুঝিয়ে বা আপনার কথা বুঝে কালক্ষেপণ করা আমার জন্য বৃথা। যে জীবনে বাঁচতে আমি চাই-ই না, যে প্রতিযোগিতায় নামতে আমি চাই-ই না, সে জীবনে বা প্রতিযোগিতায় হার-জিতের কোন‌ও ব্যাপার অন্তত আমার ক্ষেত্রে নেই।
  
 আমি তো আমার ভালোবাসার জায়গা থেকে একচুলও নড়ব না। কিছুতেই না, কিছুতেই না! সাহিত্যকে ছাড়লে আমি বাঁচব না তো। তাই যা হওয়ার, ওটা দিয়েই হবে, আর না হলে আরও বেশি খুশি হব...শুধুই সাহিত্যের হব, শুধুই সাহিত্যিকের হব। কোন‌ও গ্রামে গিয়ে শিশুদের মানুষ করব, ঠিক যেরকমভাবে 'অগ্নীশ্বর' সিনেমাতে সব ছেড়েছুড়ে উত্তমকুমার গ্রামে চলে গিয়েছিলেন, আমিও সেইরকম একটা পরিণতি চাই---যেখানে কোনও ছোটো নিষ্পাপ শিশু আমার মৃত্যুর পর বুকের উপর একমুঠো শিউলি রাখবে, তার প্রিয় মানুষটার জন্য।
  
 চাওয়াগুলিকে যত কমিয়ে ফেলা যায়, জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বী তত‌ই কমে। আপনার চোখে আমি পরাজিত হতেই পারি, কিন্তু আমার চোখে আমি জয়ী হয়েই থাকতে চাই। আমার স্বপ্ন থেকে দূরে সরে, আপনার স্বপ্নে বেঁচে, জিতে গিয়েও-বা আমার কী লাভ হবে? সেই জিত যে আমার জন্য একটি ভুল জীবনের যাপন! আপনার ঝাঁ চকচকে নিউ ইয়র্কের রোদের তেজ কি আমার ছোট্ট ধূসর শহরের রোদের তেজের চাইতে বেশি? মানলাম, নাহয় বেশিই। কিন্তু সেই বেশি দিয়ে আমার কী হবে, যেই বেশিটা আমি চাই-ই না? এসব উত্তর সময়‌‌ই দিক!