স্বপ্ন মৃত্যুহীন

১৬ ডিসেম্বর ২০০৯। সন্ধ্যে ৬:৩০টা। এক ব্যবসায়ী ভাইয়ার বাসায় গেলাম। উনি বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করেন। আমি গিয়েছিলাম একটা ব্যবসার কথা বলতে আর শুনতে। মোবাইল কার্ডের। এই ব্যবসায় নাকি ভালো লাভ হয়। উনি চাচ্ছিলেন জয়েন্ট ভেনচারে কিছু একটা করতে। ওইসময়ে আমি আমার গিফটশপটা চালাচ্ছিলাম। আমার গিফটশপে যে বয়েসি কাস্টমার বেশি আসত, তাদের প্রায়ই মোবাইল কার্ড কিনতে হয়। তাই, ওই ব্যবসা করাটা আমার জন্য সহজ ছিল। উনার সাথে কথাবার্তাও অনেকদূর এগিয়ে গেল। উনার আরেকটা প্রস্তাব ছিল, যদি আমি নিজে কার্ড বিক্রি নাও করি, তবুও যাতে অন্তত ৮-১০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করি। উনি অন্য একটা ব্যবসায় টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছেন, তাই উনার কিছুটা ক্যাপিটাল ক্রাইসিস চলছিল। উনি বললেন, কার্ডের ব্যবসা থেকে আমার মাসিক রিটার্ন আসবে অন্তত ২%। আমি সেদিন কথা দিলাম না।

আমার দোভানার যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই বছরেই; ২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১:৩০টায়। মাত্র এক সপ্তাহের পরিকল্পনায় আমি ব্যবসাটা শুরু করেছিলাম। আগের রাতে আমরা না ঘুমিয়ে সারারাত ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দোকান সাজিয়েছি। পরদিন সবাইকে নিয়ে রঙবেরঙের ফিতা, বেলুন ইত্যাদি দিয়ে দোকান সাজিয়ে অনেক খাওয়াদাওয়া আর হইচই করে দোকান উদ্বোধন করেছিলাম। ফিতা কেটেছিলেন আমার মা।

কমপক্ষে প্রায় ৩৫০-৪০০ ভিন্ন-ভিন্ন রকমের গিফট আইটেম আমাদের কালেকশনে ছিল। (চট্টগ্রামের আর কোনও দোকানে গিফট আইটেমের এত বৈচিত্র্য ছিল বলে আমার জানা নেই।) সব আইটেমের কথা এখানে লেখা সম্ভব নয়; মনেও নেই। মাত্র কয়েকটার কথা বলছি। আমার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল প্রকৃতির। আমার ছোটোভাই বেশ কিছু আইটেমের কথা মনে করিয়ে দিল।

ম্যাজিক আইটেম। খুব সহজে দেখানো যায় এমন কিছু যাদু দেখানোর আইটেম ছিল অন্তত ২০-২৫ রকমের। দাম ৫ টাকা থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। সেগুলোর সোর্স খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের অনেক ম্যাজিশিয়ানের সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। ওদের খুঁজে-খুঁজে বের করা, কে কোন আইটেম সবচেয়ে কম পাইকারি দামে দেয়, সেটা আবিষ্কার করা সত্যিই খুব কঠিন ছিল। কাস্টমারদেরকে ওই আইটেমগুলো বিক্রি করার আগে ম্যাজিকটা দেখিয়ে মুগ্ধ করতে হত। খুব সাবধানে আর কৌশলে কাজটা করতে হত যাতে উনি ম্যাজিক ট্রিকটা ধরতে না পারেন। ট্রিক ধরে ফেলতে পারলে কেউই ম্যাজিকের প্রতি আকৃষ্ট হয় না, আর আমার জিনিসটাও বিক্রি হবে না। এসব করতে-করতে খুব দ্রুত ম্যাজিক দেখাতে শিখে গিয়েছিলাম। একটা ম্যাজিক পানির কল ছিল। কলের মুখ থেকে পানি পড়ত, মুখের পেছনে কোনও পাইপ ছিল না, মুখটা শূন্যে ভাসত। দেখলে মনে হত, শূন্য থেকে পানি পড়ছে। আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনকে কাজে লাগিয়ে ওটা বানানো। দড়ি, তাস, ম্যাচের বাক্স, বল, আর পয়সার যাদুগুলোতে হাত সাফাইয়ের অনেক ব্যাপার ছিল। ওসব কাজে তখন মহাওস্তাদ হয়ে উঠেছিলাম। (এবং এখন কিচ্ছু মনে নেই। সেসময় পয়সার লোভে মনে রাখতাম। দয়া করে কেউ আমাকে কোথাও ম্যাজিক দেখাতে বলবেন না।) ওরা মুগ্ধ হত, জিনিসটা কিনত, এরপর ট্রিকটা শিখে নেয়ার পর নিজের বোকামিতে হাহা করে হাসতে থাকত। বড় সুন্দর সেই দৃশ্য।

ফান আইটেম। এই আইটেম ছিল প্রায় ৩০-৩৫ রকমের। এসব আইটেম দিয়ে ইচ্ছেমত মজা করা যায়। কিছু-কিছু দিয়ে অন্যকে বুদ্ধির চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া যায়। যেমন, একটা ছিল শিক পাজল। ইস্পাতের তৈরি বিশেষ ধরনের দুইটা স্ট্রাকচারকে পরস্পরের সাথে বিশেষ কায়দায় আটকে দেয়া হত। খুব অভিনব উপায়ে সে দুটোকে আলাদা করতে হত। এটা দিয়ে কাউকে মুগ্ধ করে দেয়া ছিল খুব সহজ। আমরা স্ট্রাকচার দুটোকে আটকে দিতাম, কাস্টমারকে আলাদা করতে দিতাম, ওরা খুব চেষ্টা করেও যখন পারত না তখন ওদের সামনেই আমরা সেটা সলভ করে দিতাম ২ সেকেন্ডের মধ্যেই। মজার ব্যাপার হল, এই জিনিস সামনাসামনি দেখেও নিজে-নিজে সলভ করার বিদ্যেটা চটজলদি শিখে নেয়াটা কঠিন। এটা কিনে এটা দিয়ে অনেকেই বন্ধুদের সাথে অনেক বাজি জিতে নিয়েছিল। ডিম পরোটা থেকে মেয়েদের পটানো পর্যন্ত। দোকানে শক দেয়ার আইটেম ছিল অনেক রকমের। যেমন, চুইংগামের প্যাকেট থেকে চুইংগাম টানতে গেলে শক দিত। আমরা কাস্টমারের দিকে ‘কমপ্লিমেন্টারি চুইংগাম’য়ের খোলা প্যাকেট বাড়িয়ে দিতাম। ওরা টানতে গেলেই শক খেয়ে চিৎকার দিত। অনেকেই ব্যাপারটা আগে থেকেই একটু আঁচ করতে পেরে আমাদেরকেই টেনে দেখাতে বলত। আমরা শক খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এরকম পেন, মার্কার, ক্যালকুলেটর, টর্চ, চকোলেট বক্স ছিল। সেগুলো ওদের সামনেই ইউজ করে দাঁতে দাঁত চেপে হাসিমুখে শক সহ্য করতাম। ওরা দেখত, নিজেরা একই কাজটা করতে গিয়ে যখন শক খেত, তখন বন্ধুদের সাথে মজা করার জন্য ওটা কিনে নিয়ে যেত। অন্যদের সাথে মজা করার নেশা বড় নেশা। শক চুইংগাম টানলে কিন্ত চুইংগাম বের হয় না। আমরা টেনে ধরে রাখতাম, আর বলতাম, এটা টানলে কিছুই হয় না, আপনিও টানুন। ওরাও টানত, আর মহানন্দে শক খেয়ে লাফিয়ে উঠত। মানুষ এসব ক্ষেত্রে বোকা হতে পছন্দ করে, বিশেষ করে মেয়েরা। একটা আইটেম ছিল তেলাপোকা চুইংগাম। চুইংগামের খোলা প্যাকেট থেকে চুইংগাম টানলে হঠাৎ করে বিশ্রী একটা তেলাপোকা বের হয়ে আসত। আরেকটা ছিল টিকটিকির বাক্স। খুব সুন্দর একটা কাঠের বাক্স খুললেই গায়ের উপর টিকটিকি লাফিয়ে পড়ত। মেয়েরা এসব জিনিস জেনেশুনেও শুধু চিৎকার দেয়ার জন্য বারবার দেখত। মেয়েরা চিৎকারপ্রিয় প্রাণী। দোকানে গ্লাস ডোরে একটা সুন্দর কাঁচের বোর্ড ঝুলানো ছিল। সেখানের উপরে স্টিকি স্লিপে বড়-বড় করে ইংরেজিতে লেখা ছিল, “COMMENTS PLEASE!” পাশেই একটা মার্কার কাঠের হোল্ডারে আটকানো থাকত। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় আমরা কাস্টমারকে দোকান নিয়ে উনার ইম্প্রেশন বোর্ডটাতে লিখতে অনুরোধ করতাম। আর লিখতে গেলেই…….আওওও……!! এটাতে সবাই হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে খুব মজা পেত। এই বুদ্ধিটা আমার ছোটভাইয়ের। আরও ছিল ম্যাজিক কালি। আমরা কাস্টমার বুঝে উনার শাদা কাপড়ে কলম থেকে কালি ছুঁড়ে মারতাম। উনি, কী ব্যাপার? এটা কী করলেন? এইসব কথাবার্তা শেষ করার আগেই কালি উধাও! ভূতের বক্স ছিল। ওটা খুললেই বিকট চিৎকারে ভূত বেরিয়ে মুখের সামনে এসে লাফাতে থাকত। একটা রহস্যময় ধূসর রঙের বাক্স ছিল। সেটা খুললেই বাক্সের ভেতরে একটা রক্তাক্ত কাটা হাত কাঁপতে থাকত। এমন কাউকে দেখিনি যে বাক্সটা খোলার পর ভয়ে চিৎকার করে বাক্সটা হাত থেকে ফেলে দেয়নি। দোকানের উপরে অদৃশ্য অবস্থায় রক্তাক্ত কাটা খুলি ঝোলানো থাকত। ওগুলোতে সেন্সর বসানো ছিল। কাস্টমার এলে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমরা হাততালি দিতাম। তখনই হুট করে উপর থেকে উনার সামনে ভৌতিক চিৎকার করে করে নেমে আসত একেকটা রক্তাক্ত খুলি। কিছু ফ্লাওয়ার বক্স ছিল। বাইরে থেকে দেখতে রঙবেরঙের ফুলের মতন ওগুলো ছিল আসলে ফেসওয়াশ। কিছু ট্রান্সপারেন্ট কয়েন বক্স ছিল। সেগুলোতে পয়সা ফেললে পয়সাটা অদৃশ্য হয়ে যেত। কৌশল শিখিয়ে না দিলে পয়সাটা আর কিছুতেই খুঁজে বের করা যেত না। ছিল ম্যাজিক ট্রি, ম্যাজিক টিস্যু, ডাইনোসরের ডিম, পানিতে রেখে দিলে আকারে ৬০-৭০ গুণ বেড়ে যায় এমন কিছু প্রাণীর রেপ্লিকা। কিছু সাপ ছিল যেগুলো দেখতে অবিকল সত্যিকারের সাপের মতো, নড়েচড়েও ওরকম করে। মেয়েরা ভয় পেতে ভালোবাসে। সেটা ভূতেরই হোক, কিংবা সাপের। ওদের ভয় দেখাতে ছেলেরা সাপ কিনে নিয়ে যেত। আরও কী কী সব যেন ছিল। মনে নেই।

স্টেশনারিজ। দোভানাতে বেশকিছু আনকমন স্টেশনারি আইটেম পাওয়া যেত। পেন্সিল, ইরেজার সেট, শার্পনার, পেন, পেন্সিল বক্স, স্কেল, ইন্সট্রুমেন্ট বক্স সহ আরও অনেককিছু। আমরা বেছে-বেছে একটু ইউনিক আনকমন টাইপের জিনিসগুলো দোকানের জন্য কিনতাম। সেগুলোর কিছু-কিছু দেখতে এতই বৈচিত্র্যময় ছিল যে অনেকসময়ই চট করে ধরা যেত না, কোন জিনিসটা আসলে কী! ইরেজারকে মনে হত চকোলেট, শার্পনারকে খেলনার গাড়ি; এরকম আরও অনেককিছু। সেগুলি নিয়ে অনেকসময়ই বিভিন্ন মজার ঘটনার অবতারণা ঘটত। একদিনের ঘটনা শেয়ার করছি।

: বাইয়া, এটা কী?

: আপু, এটা ইরেজার।

: এ্যাঁ……কীইইইইই?

: ইরেজার, ইরেজার।

: অ আইচ্চা, ছকল্যাট?

: না না আপু, চকোলেট না, ইরেজার।

(পাশের মেয়েটিকে দেখলাম বলে দিচ্ছে, দূর বেডি, তুই ইরেজার ন ছিনস? ইব্যা একডইল্যা ছকল্যাট আরি! ইব্যারে ছকল্যাট ন খয়, ইরেজার খয় য্যা।)

: অ বুচ্চি। বাইয়া, এটা কী প্লেবারের? একানের বিতরে বাদাম আচে?

: ইয়ে আপু, এটা খাওয়া যায় না, এটা ইরেজার, মানে এটা দিয়ে পেন্সিলের দাগ মুছে, মানে এটা রাবার। এইবার বুঝতে পেরেছেন? (আল্লাহর কসম, আমি একটুও না হেসে ওর সাথে কথা বলেছি। কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট।)

: অঅঅ এবার বুচ্চি! এটা পুছনি আরি! আপনি পুছনিকে ইরেজার বললে আমি কিবাবে বুজব যে? হিহিহি……. আমাকে অ্যাক ফ্যাকেট দ্যান।

সেদিনের সেই অপরূপা তরুণী কাস্টমারটি দেখতে এতই সুন্দরী ছিল যে, ও মুখ না খুললে ওর প্রেমে পড়ে না যাওয়াটা বেশ কঠিন। যেমন সুন্দর চেহারা তেমন বিশ্রী কথা বলার ধরন।

হ্যান্ডিক্রাফট। সম্পূর্ণ দেশীয় চটের ওয়ালম্যাট থেকে শুরু করে মাটির ভাস্কর্য পর্যন্ত অনেককিছুই ছিল। এই আইটেমগুলো দামে সস্তা, নান্দনিকতায় দামি। কিছু-কিছু আইটেম এতই আকর্ষণীয়, দেখলেই ঘরে নিয়ে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। এই আইটেমের ক্ষেত্রে আমাদের কালেকশন আড়ংয়ের মতো অত ভালো ছিল না হয়তো, তবে অন্য যেকোনও দোকানের সাথে কম্পিটিশনে আসার মতো ছিল। বাঁশের আর কাঠের কলম, কাঠের পেন্সিল বক্স, ধাতু কাঠ বাঁশ কাপড় চটের জুয়েলারি বক্স, পেইন্টিং, দড়ির দোলনা, বিচিত্র নকশাকাটা কাঠের বালা, চায়নিজ পাখা, কাঠির শোপিস, কাঠ আর বাঁশের ট্রে, কাঠের আর মাটির পুতুল, হরেক রকমের পাটের পুতুল, খোদাইকরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি, চটের আর কাপড়ের ম্যানিব্যাগ, ঝোলানো ব্যাগ, রাখীবন্ধন, সমুদ্রকলি শিকা, কাঠের বাঁশের মাটির বিভিন্ন ধাতুর তৈরি অলংকার, বাঁশ তসর আর কাঠের মলাটদেয়া হ্যান্ডম্যাড কাগজের নোটবুক ……… আর ….. নাহ! আর মনে পড়ছে না!

ঝিনুক খুলে মুক্তো! আমাদের দোকানে পার্লসেট রাখতাম। কাস্টমারের সামনে পার্লসেটের বক্সটাকে প্যাকেট থেকে বের করতাম। বক্সের ভেতরে একজোড়া কানের পার্ল ইয়াররিং থাকত, একটা পার্ল ফিঙ্গাররিং থাকত, আর একটা নেকলেস থাকত যেটার খোপটা খালি। একটা আলাদা কৌটায় এয়ারটাইট অবস্থায় কিছু লিকুইড কেমিক্যালে ডুবানো একটা সত্যিকারের ঝিনুক রাখা থাকত। কৌটা খুলে ঝিনুকটা বের করে ছুরি কিংবা শক্ত ধাতব কিছু দিয়ে ঝিনুকের মুখটা খুলে নিতে হত। সেটা খুলতে পারলেই মুক্তো মিলবে। আমরা বলতাম, যেখানে ঝিনুকের চাষ হয় সেখান থেকে বিশেষ কায়দায় এই ঝিনুকটা সংগ্রহ করে এই কৌটোয় ভরে দেয়া হয়েছে। এর ভেতরের মুক্তোটা কী রঙের হবে সেটা কেউই জানে না। দেখুন, প্যাকেটের গায়ে ৪টা রঙ দেয়া আছে। গোলাপি, সাদা, নীল, পার্পল। গোলাপি ভালোবাসার প্রতীক। সাদা পবিত্রতার প্রতীক। নীল বিশ্বস্ততার প্রতীক। পার্পল আভিজাত্যের প্রতীক। আপনি ঝিনুকের কৌটা খোলার আগেই মনে মনে ভেবে নিন, আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে আপনি কোনভাবে কল্পনা করতে চাইছেন। এটা কিছুতেই কারওর সাথে শেয়ার করবেন না। এরপর কৌটা খুলুন। ছুরি দিয়ে ঝিনুকের শক্ত খোলসের মুখ দুটো আলাদা করে দিন। এরপর মুক্তোটা পেয়ে যাবেন। সেই মুক্তোটাকে নেকলেসের খোপে রেখে দিয়ে আটকে দেবেন, নিজ হাতে সেটা আপনার প্রিয়তমার গলায় পরিয়ে দেবেন। যদি আপনার কল্পনার রঙটা পেয়ে যান, তবে আপনার আশা পূর্ণ হবে, এরকম একটা মিথ প্রচলিত আছে। (অনেকেই আমাদের পরবর্তীতে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানিয়েছেন, উনার প্রিয়তমা যেমন, ঠিক তেমন রঙের মুক্তোটাই উনি পেয়েছেন। আমি জানি, ব্যাপারটা স্রেফ কাকতালীয়। মানুষ বিস্মিত হতে পছন্দ করে।)

পার্ল নিয়ে আমাদের অল্পবিস্তর পড়াশোনা ছিল। কাস্টমারদের যেকোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম। আমাদের এই গল্পটা বলার পর সেই পার্লসেট না কিনে কেউ ফিরত না। এই আইটেমটা ছিল আমাদের দোকানের সবচেয়ে বেশি বিক্রি-হওয়া আইটেমগুলোর একটি। আমরাই এটা বিক্রি করতাম। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, চট্টগ্রামের মার্কেটে আমরাই এটাকে পপুলার করি।

ওয়ালেট। খুব কম দামে খুব উন্নতমানের চামড়ার, পাটের, আর কাপড়ের ওয়ালেট ছিল। খুব স্টাইলিশ কিংবা ফর্মাল ওয়ালেট রাখতাম। আমরা খুঁজে-খুঁজে বের করেছিলাম কারা বিদেশে দেশীয় ওয়ালেট এক্সপোর্ট করে, কারা থাইল্যান্ড আর চায়না থেকে খুব ভালো মানের ওয়ালেট আনে। ব্যবসা করতে গিয়ে আমরা শিখেছি, ব্যবসায় লাভ করতে হয় জিনিস কেনার সময়, বেচার সময় নয়। আমরা যা যা বিক্রি করতাম, সেটা অন্য ব্যবসায়ীর পক্ষে আমাদের চাইতে কম দামে দেয়াটা কঠিন ছিল। কোয়ালিটির ব্যাপারে কখনওই কম্প্রোমাইজ করতাম না। সেই ২০০৯ সালে আমাদের কাছ থেকে কেনা ওয়ালেট অনেকেই এখনও ব্যবহার করছেন। (আমার ওয়ালে অনেকেই এখনও ধন্যবাদ জানিয়ে কমেন্ট করেন।)

লাইটার আর নাইফ। কোনওরকমের রাখঢাক না রেখেই বলছি, এটার কালেকশনে আমরাই সেরা ছিলাম, আমাদের ধারেকাছেও কেউ ছিল না। আমাদের কালেকশনের ১০%ও চট্টগ্রামে কারওর কাছে ছিল না। একেবারে বেকার থেকে অত্যন্ত শৌখিন মানুষদের জন্য বিভিন্ন দামের আইটেম ছিল। সুইস নাইফ, আর্মি নাইফ, পকেট নাইফ, মাল্টিপারপাস নাইফ, জিপ্পো লাইটার, কম্বো লাইটার (মানে, লাইটার কাম ওয়াচ, লাইটার কাম নাইফ ইত্যাদি) আরও কত বাহারি নামের কতকিছু। সিগারেট ফিল্টার, সিগারেট কেইস আর পাইপের হিউজ কালেকশন ছিল। খুব সফিস্টিকেটেড ফ্লেভারড হুঁকার সেট রাখতাম। এই জিনিস চট্টগ্রামে আর আর কোথাও পাওয়া যেত না। চট্টগ্রামে অ্যাশট্রে’র সবচাইতে বড় কালেকশনটা আমাদের ছিল; সাদামাটা মাটির থেকে শুরু করে একেবারে হাইলি সফিসটিকেটেড মেটালিক পর্যন্ত। ছোটো থেকে শুরু করে বিশাল বিশাল সোর্ড ছিল। একবার ডাকাতডাকাত চেহারার এক কাস্টমার এসে জিজ্ঞেস করেছিল, বস, এটাকে কিরিচ হিসেবে ইউজ করা যাবে? (পরে উনার কথাবার্তায় মনে হয়েছিল, লোকটা ডাকাতডাকাত চেহারার নন, আসলেই ডাকাত। আমাদের দোকান ছিল ফিক্সড প্রাইসের। প্রোডাক্টের গায়ে দাম লেখা থাকত। আমরা কৌশলে প্রাইসট্যাগটা তুলে ফেলে উনার কাছে দশগুণ বাড়িয়ে দাম বলে সেদিন সোর্ডটা আর বিক্রি করিনি।)

ক্যান্ডেল। বৈচিত্র্য আর সংখ্যা বিচারে দোভানায় ক্যান্ডেলের কালেকশন ছিল চট্টগ্রামের যেকোনও ভালো দোকানের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ। একেবারে সাধারণ বার্থডে ক্যান্ডেল থেকে শুরু করে সেন্টেড ক্যান্ডেল, মিউজিক ক্যান্ডেল, টুইস্টেড ক্যান্ডেল, ফ্লোটিং ক্যান্ডেল, ডান্সিং ক্যান্ডেল, পারফিউমড ক্যান্ডেল, ম্যাজিক ক্যান্ডেল, মিস্টিরিয়াস ক্যান্ডেল, স্পার্কলিং ক্যান্ডেল, লাইটিং ক্যান্ডেল, বিভিন্ন থিমবেইজড ক্যান্ডেল, জেল ক্যান্ডেল, ট্র্যাডিশনাল ক্যান্ডেল, অ্যান্টিক ক্যান্ডেল………কী ছিল না দোভানায়! বিচিত্র ধরনের ক্যান্ডেল স্ট্যান্ডও বিক্রি করতাম।

অর্নামেন্টস্ অ্যান্ড আদারস্। আমি সেসময় হাতে হ্যান্ডচেইন, রিস্টব্যান্ড, ব্রেসলেট পরতাম। এখনও মনে পড়ে, একবার মা আমার দামি ম্যাগনেট ইয়াররিংজোড়া জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সময় কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, এইসব জিনিস বস্তির ছেলেমেয়েদের কানে ভালো মানায়; কেউ কুড়িয়ে পেলে খুব খুশি হবে, বাবা। আমার আর কানে রিং পরা হয়নি। ম্যাচিং করে সানগ্লাস, জিন্স, টিশার্ট, স্নিকারস, বেল্ট, আংটি, হ্যান্ডচেইন — এসব পরে যখন আমার নিজের কোচিংয়ে পড়াতে যেতাম, তখন নিশ্চয়ই কোনও-কোনও গার্ডিয়ান ভাবতেন, এই অদ্ভুতদর্শন যুবাটি উনার ছেলে/ মেয়েকে কী শিখাইবেন! অনেকে এসে আমাকে বলতেন, আমি পলস্ কোচিং হোমের ডিরেক্টর স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি, উনাকে ডেকে দাও (আমাকে দেখে ‘দিন’ মুখে আসতো না হয়তো)। যাক সেকথা। দোভানাতেও আমি অর্নামেন্ট রাখতাম, খুব বেছে-বেছে; ছেলেদের, মেয়েদেরও। মেয়েদের অর্নামেন্ট কালেকশনের দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ না হলেও ছেলেদের অরনামেন্টের দিক থেকে চট্টগ্রামের যেকোনও বড় গিফটশপের চাইতে বেশি কিংবা একই ধরনের কালেকশন আমাদের ছিল। সেইসব ড্রাগন, স্কাল, ঈগল, ফ্যালকন মার্কা অরনামেন্টের কথা মনে হলে এখনও হাসি পায়। খুব রুচিসম্পন্ন আর স্টাইলিশ কিছু অর্নামেন্টও ছিল। ওগুলো দেখলে একেবারে গোবেচারাটাইপ ছেলেটারও অর্নামেন্ট পরতে ইচ্ছে করবে। স্টাইলিশ কাউবয় হ্যাট ছিল অন্তত ৭-৮ ডিজাইনের। লেডিস হ্যাট ছিল অনেক প্যাটার্নের। ছিল নকল হাতির দাঁতের অলংকার। না, ভুল হল। ওটা হবে, হাতির নকল দাঁতের অলংকার। নাকি, হাতির দাঁতের নকল অলংকার? হাতির দাঁতের, কিন্তু আসলে হাতির দাঁতের নয়, এরকমকিছু। নানা ব্র্যান্ডের পারফিউম, খুব মোলায়েম কিছু রুমাল, গর্জিয়াস টাইসেট, ক্যাজুয়াল আর ফর্মাল বেল্ট, এসবও রাখতাম।

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এরকম আরওকিছু আইটেমের কথা বলছি। দোকানে অ্যান্টিকসের কালেকশন ছিল। জলের দামে আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার বেচতাম। কিছু-কিছু জিনিস রাখতাম নিজে জেতার জন্য নয়, কাস্টমারকে জেতানোর জন্য। একটা কমদামের আইটেমে নিজে অল্প লাভ করে কাস্টমারের আস্থা অর্জন করতে পারলে একই কাস্টমারের কাছে অন্য বেশিদামের আইটেম বেশি লাভে বিক্রি করা সহজ। ওটাও ওরকম। ফ্লাওয়ার ভেইস ছিল। এথনিক, অ্যান্টিক ধাঁচের, থিমভিত্তিক ফ্লাওয়ার ভেইস চট্টগ্রামে আমরাই প্রথম আনি। এর বাইরেও বিচিত্র রকমের ভেইস আর ফ্লাওয়ার পট ছিল দোভানায়। ঘড়ির বিশাল কালেকশন ছিল। ওয়াল ক্লক, টেবল ক্লক, রিস্ট ওয়াচ (জেন্টস+লেডিস), পকেট ওয়াচ। খুব স্টাইলিশ ধরনের ঘড়ি রাখতাম। প্রতিবার জিনিস কালেকশন করার সময় আমরা পুরো চট্টগ্রাম চষে ফেলতাম। দেখতাম, কী ধরনের আইটেম কারওর কাছে নেই, কিন্তু আমরা আনলে চলবে, কাস্টমাররা পছন্দ করবে। মার্কেট সার্ভে করার জন্য আমাদের আলাদা বরাদ্দ ছিল। গ্লাস কোটস কালেকশনের ক্ষেত্রে রুচি, ধর্ম আর নান্দনিকতাকে মাথায় রাখতাম। রেডিয়াম স্টিকার থেকে শুরু করে রেডিয়াম স্ট্যাচুসহ বাচ্চাদের রেডিয়াম পাজলও রাখতাম। সিলভার, উডেন, ব্যাম্বু, মেটালিক, অ্যান্টিক, গ্লাস চাইমের অনেক কালেশন ছিল। এতো বেশি চাইম একসাথে আর কোনও দোকানে ছিল না, এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। দোকানের ভেতরেবাইরে স্মোকি ঝর্ণা, মিউজিক ঝর্ণা, টাচল্যাম্প, ফাইবার ল্যাম্প শোভা পেত। ভ্যারাইটি আর নাম্বারের দিক থেকে মগের কালেকশনে আমরাই প্রথম ছিলাম। মগ যে কত বিচিত্র কনসেপ্টের হতে পারে, সেটা দেখতেই অনেকে দোভানায় আসত। বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির আদুরে-আদুরে ফার ডলস ছিল। মেয়েরা এসেই ওগুলোকে জড়িয়ে ধরত। তখন বারবারই মনে হত, হায়! এই জীবনে পুতুলও হতে পারলাম না! এ ব্যর্থ জীবন রেখে কী হবে? ট্রাইবাল থিমের কিছু আইটেম ছিল। মেটালিক আর স্টোন স্ট্যাচু, অর্নামেন্ট, হ্যান্ডিক্রাফট, শোপিস, আরও কিছু জিনিস। আরেকটা কালেকশন ছিল দেখার মতো, সেটা হল ফটোফ্রেমের। বাঁশ থেকে শুরু করে স্টোন, বেত, ফাইবার, কাঠ। সবটাইপের ফটোফ্রেমই ছিল। কিডস কনস্ট্রাকশন কিট, পাজল সেট ছিল; রেডিয়ামের, কাঠের, প্লাস্টিকের, মেটালের। রুবিকস কিউব ছিল অন্তত ১২ ডিজাইনের। চেসবোর্ড ছিল; ম্যাগনেটের, কাঠের, গ্লাসের, প্লাস্টিকের। ডার্টবোর্ডের ভ্যারাইটি ছিল ৭-৮ রকমের। বাচ্চাদের খেলনা রাখতাম। সব ধরনের না, যেগুলো শুধু দোভানাতেই পাওয়া যাবে, সেগুলো। চাবির রিংয়ের কালেকশনে দোভানা ছিল শীর্ষে। ফটো অ্যালবাম ছিল, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল বিভিন্ন থিম নিয়ে, যা অন্য দোকানগুলোতে অত ছিল না। বিভিন্ন ওয়ালহ্যাঙ্গিং আইটেম দোকানে বিক্রির জন্য ঝোলানো ছিল। হোল্ডারের বড় কালেকশন ছিল। পেন হোল্ডার, টুথপিক হোল্ডার, কার্ড হোল্ডার। ওয়াটার ডলের শো ছিল দেখার মতো। সেগুলোর কয়েকটার ভেতরে মিউজিকের তালে-তালে নায়িকার হাত ধরে শাহরুখ-ঋত্বিক-সালমান-আমির নাচত। ছিল গহনার কৌটা, সিঁদুরের কৌটাও। পেপার ওয়েট, স্টিকার, আর্টিফিশিয়াল অ্যাকুরিয়াম, পারদের বিভিন্ন ধরনের শোপিসের, খুব বাছাই-করা ক্রোকারিজ, খানদানি কিছু টেবিল ক্লথ আর ম্যাট, গর্জিয়াস অফিস স্টেশনারি, টকিং প্যারট, ব্যাম্বু কোস্টার, কাঠের মিউজিক্যাল নাগরদোলা, পার্টি স্প্রে, কম্পাস, বাসা সাজানোর নানা আইটেম। এইসবকিছুতে দোকান বোঝাই ছিল। কিছু সেট বেচতাম। সিরামিকের সোপ সেট, বিভিন্ন ডিজাইনের সল্ট সেট, স্পাইস সেট, ওয়েডিং সেট। স্পোর্টসওয়্যার ছিল কিছু। আরেক ধরনের ইউনিক আইটেমের কথা বলি। আমরা বেছে বেছে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক কিছু গিফট আইটেম রাখতাম। এখনও মনে আছে, একবার একটা চার্চে আমরা অনেকগুলো ক্রাইস্ট আর মেরির স্ট্যাচু সাপ্লাই করেছিলাম। বিভিন্ন থিমের সিঙ্গেল আর ডুয়েট স্ট্যাচুর কালেকশন ছিল; কাঠের, মেটালের, স্টোনের, বাঁশের, ফাইবারের, প্লাস্টিকের, রেডিয়ামের, মাটির। ছিল শেভিং সেট, ম্যানিকিউর প্যাডিকিউর সেট।

দোকানে রেয়ার এবং ক্ল্যাসিক মুভি, মিউজিকের কালেকশন ছিল। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী টরেন্ট সাইট থেকে যেকোনো দুর্লভ মুভিও নামিয়ে সেটা ডিভিডি ডিস্কে রাইট করে বিক্রি করতাম। আমরা কাস্টমারদেরকে বলতাম, “দোভানাতে কোনও মুভি কিংবা মিউজিক না পেলে আর কোথাও পাবেন না।” এখন ভাবি, বড্ডো বাড়াবাড়ি করতাম সেসময়। দোকানে প্রায় সবসময়ই লো ভলিয়্যুমে ইন্সট্রুমেন্টাল চলত। আমরা নিজেরাই বিভিন্ন মেজাজের গান একসাথে করে হৃদয় ছুঁয়ে যায়, এমন নাম দিয়ে দিয়ে কিছু গানের রেডিমেড অ্যালবাম সিডি করে ডিসপ্লেতে রাখতাম। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এমন কিছু অ্যালবামের নাম বলছি। সাউন্ড অব সাইলেন্স। রিদম অব প্যারাডাইজ। এসেন্স অব সৌল। ভালোবাসার বারান্দায়। অনুভবের অন্তরালে। রবির সাথে। এসব গানের সিডি লাভের জন্য বেচতাম না। কাস্টমারদের কাছ থেকে বক্স আর সিডির দামটুকুই নিতাম। বিক্রির জন্য কিছু দুর্লভ পোস্টার ঝুলিয়ে রাখতাম। ওতে দোকানের শো হত। আমি খুব করে চাইতাম, যেন সেগুলো বিক্রি না হয়। এই সেকশন পুরোটাই ছিল বিজ্ঞাপনের জন্য; দোকানের কিংবা আমাদের রুচির। যে দামে কিনতাম, সে দামেই বেচতাম।

ডকুমেন্ট গিফটস। এটা সম্পূর্ণই আমার নিজের সৃষ্টি। অনেক রঙবেরঙের অফসেট পেপার আর রেশমি সুতোয় আমার নিজের আইডিয়া থেকে বানানো নানারকমের বুদ্ধিবৃত্তিক লেখা, কৌতুক, ধাঁধা, শিল্পসাহিত্য, চমকপ্রদ তথ্য, অংকের যাদু, বিখ্যাত ব্যক্তিদের মজার কাহিনী সহ আরও অনেক বৈচিত্র্যময় লেখায় বোঝাইকরা ডকুমেন্ট বানাতাম। এরপর সেগুলোকে আলাদা-আলাদা করে রঙিন ফিতে আর টুকরো কাগজে বাঁধাই করে দোকানে বেতের ট্রে’তে সাজিয়ে রাখতাম। লেখালেখি করতে ভালোবাসতাম। তাই, খুব ক্লান্তিকর হলেও এটা করতে খারাপ লাগত না। মানুষ সেই কাজটাতেই কম ক্লান্ত হয় যেটা করতে সে ভালোবাসে। কাজের ক্লান্তি আসে বিরক্তি আর অনাগ্রহ থেকে।

একটা বিশেষ বার্থডে আইটেমের কথা বলি। ওটা বানাতে আমার অনেক সময় যেত, খুব কষ্ট হত। ওটার নাম দিয়েছিলাম, Regalo Para Ti (রিগ্যালো প্যারা টি)। এই কথাটা স্প্যানিশ। এর অর্থ, তোমার জন্য উপহার। এটা বানানোর আগে আমি অন্তত ২০০ জনের সাথে কথা বলে জেনে নিয়েছিলাম, নিজের সম্পর্কে কী কী ধরনের তথ্য মানুষ জানতে চায়। নিজের নামের অর্থ, ব্যুৎপত্তি, ওই নামে বিখ্যাত কেউ আছেন কি না, ওই নামের মানুষ আর কোথায়-কোথায় আছে, বিভিন্ন ভাষায় ওই নাম দিয়ে মজার কোনও কিছু, নিজের জন্মতারিখের ইতিহাস, স্মরণীয় ঘটনা, ওইদিনে জন্মেছেন এমন বিখ্যাত মানুষ, ওই তারিখ নিয়ে অ্যাস্ট্রোলজির প্রায় সবকিছুই (রাশি, নক্ষত্র, রঙ, শুভ-অশুভ দিন-সংখ্যা, ওই রাশির বিখ্যাত মানুষ, প্রেম-ভালোবাসা, শক্তি-দুর্বলতা, ক্যারিয়ার, এরকম আরও অনেককিছু), নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রেখে বিভিন্ন মজার ঘটনা আর মনীষীদের কথা, ভালোবাসার সাতকাহন (যুগলদের ক্ষেত্রে), উনার পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে সবকিছু, উনি যে ধরনের মজা করতে পছন্দ করেন সে ধরনের কিছু মজার কথা, উনার অ্যাপিয়ারেন্সের সাথে মিলে যায় এমন কিছু মজার তথ্য, উনার পেশাগত অবস্থানের সাথে মিল রেখে নানা তথ্য, উনি যে ধরনের মানুষ পছন্দ করেন না সে ধরনের মানুষ নিয়ে কিছু কথা, উনি শুনতে পছন্দ করেন এরকম কিছু কথার সাথে মিলে এমনকিছু কথা, কাপলদের ক্ষেত্রে উনার প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমার বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশকিছু কথা। এবং এরকম আরও অসংখ্য তথ্যে ভরা একটা ছোটোখাটো এনসাইক্লোপেডিয়া। এটা ছিল প্রায় ৪০০-৪৫০ পৃষ্ঠার। এটার জন্য অন্তত এক সপ্তাহ আগে অর্ডার করতে হত। আমি রঙবেরঙের হ্যান্ডমেইড পেপারে লেখাগুলোকে প্রিন্ট করতাম। উপহারটা যিনি দিচ্ছেন, একেবেরে প্রথম পৃষ্ঠায় উনার নিজের কিছু কথা লেখা থাকত রঙধনু কালিতে, নিচের উনার স্বাক্ষর থাকত। এরপর ওগুলো বিভিন্ন বাহারি রঙের আর ডিজাইনের জরির রেশমি সুতো দিয়ে বাঁধাই করে একটা সুদৃশ্য বড় হ্যান্ডমেইড খামে রেখে মুখ বন্ধ করে দিতাম। এই হল রিগ্যালো প্যারা টি। এই জিনিসের প্যারা ছিল অতিব্যাপক! নেটে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতাম, শব্দ আর ভাষা নিয়ে খেলতে ভালোবাসতাম, লিখতে ভালোবাসতাম, মানুষকে বিস্মিত করতে ভালোবাসতাম। তাই রাত জেগে-জেগে অতো কষ্ট করে অতকিছু করতাম। এটা হাতে পাওয়ার পর উপহারদাতার খুশিখুশি বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখের দাম আমার কাছে অনেক! ওটা বানাতে কাগজ, ছাপানো, বাঁধাই, প্যাকেট এসবের যে খরচ লাগত, কাস্টমারদের কাছ থেকে ওইটুকুই শুধু নিতাম, আমার পরিশ্রমের মূল্য ছিল কাজটি করতে গিয়ে আমার অর্জিত জ্ঞান। এর বাইরে একটা বাড়তি পয়সাও নিতাম না। কোনও ধরনের আর্থিক লাভ ছাড়াই এই কাজটা করতাম দুটো কারণে। এক। দোকানের পরিচিতির জন্য। দুই। ভালো লাগত বলে। আর কিছুই না। এখন ভাবি, ওই পড়াশোনায়, পরিশ্রমে, লেখালেখিতে কি আমার কোনও লাভই হয়নি? জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা………….

আমাদের দোকানের বিসনেজ কার্ডটাও ছিল সংগ্রহে রাখার মত জিনিস। দুই ধরনের কার্ড বানিয়েছিলাম। একটায় ছিল সম্পূর্ণ হাতে তৈরি পুরু তুলোট অফহোয়াইট আর বাদামি রঙের মাঝামাঝি রঙের কাগজের উপরে লালচে সোনালি হরফে দোকানের নাম-ঠিকানা অ্যাম্বুশ করা। আরেকটায় ছিল খসখসে পুরু পিচব্ল্যাক হ্যান্ডমেইড কাগজের উপরে রুপোলি ফ্লুরোসেন্ট কালারের হরফে দোকানের নাম-ঠিকানা অ্যাম্বুশ করা। আমি দোভানার জন্য ট্যাগলাইন বানিয়েছিলাম, ‘. . . . . . . artistry in gifts’ বাংলায়, ‘. . . . . . . উপহারে শিল্পের ছোঁয়া’। দোকানের নিজস্ব প্যাড ছিল, ক্যাশমেমো ছিল। খুব দামি কাগজে ছাপানো আর্টিস্টিক খাম আর প্যাকেটও বানিয়েছিলাম। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে কাস্টমারদের জন্য, এমনকি ভিজিটরদের জন্যও চকোলেট, ফুল, ছোটোখাটো গিফট থাকত। যেমন ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যারাই দোকানে আসতেন, সবাইকে একটা করে লাল গোলাপ দিতাম। আমাদের প্ল্যান ছিল দোভানা আস্তেআস্তে চেইনশপ হবে, দোকানের ওয়েবসাইট বানানোর কাজও শুরু করেছিলাম। অনলাইনে উপহারের সচিত্র প্রোফাইল দেখে অর্ডার দেয়ার সুযোগ থাকবে, হোমডেলিভারির ব্যবস্থা থাকবে, এগুলোও আমাদের পরিকল্পনায় ছিল।

এই লেখাটা শুরু করেছিলাম মোবাইল কার্ডের বিসনেজ দিয়ে। সেটাতে ফিরে আসি। আমি সেদিন উনার প্রস্তাবে রাজি হইনি ২টা কারণে। এক। দোভানার ব্র্যান্ডভ্যালু ছিল অনেক বেশি। অনেকেই আমাদের দোকান দেখতে আসতেন। যারা একবার আসতেন, তারা পরবর্তীতে পরিচিত বন্ধুবান্ধবকে আমাদের দোকান দেখাতে নিয়ে আসতেন। চট্টগ্রাম শহরে দোভানা ছিল একটা ঘোরার মত জায়গা। ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গা থেকেও অনেকে আসতেন। কাস্টমারদের সাথে আমরা অনেক মজা করতাম। ওদেরকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করতাম। আমরা কাস্টমারদেরকে যতটুকু সম্মান করতাম, ভিজিটরদেরকেও ততটুকুই সম্মান করতাম। কাস্টমারদের কমন সাইকোলজি হল, ওদের নিজেদের পছন্দ কম থাকে, ওদেরকে দিয়ে পছন্দ করিয়ে নিতে হয়। এই কাজটা আমরা খুব ভালো পারতাম। শুধু আমাদের সাথে গল্প করতেও অনেকেই দোকানে আসতেন। আমরা চাইনি দোকানে মোবাইল কার্ড রেখে দোভানার স্ট্যাটাস কমাতে। ব্যবসায় লাভই শেষ কথা নয়। দুই। কার্ডের ব্যবসা থেকে যে মাসিক রিটার্নের কথা উনি বলেছিলেন, দোভানার মাসিক রিটার্ন ছিল তার তুলনায় কয়েকগুণ। আমরা আমাদের ব্যবসাকে ভালোবাসতাম। আমরা তাই সেই টাকাটা দিয়ে আরও নতুন-নতুন প্রোডাক্টের কালেকশন বাড়িয়েছিলাম। দোভানা, দোভানা হয়ে উঠেছিল সেই একটা সিদ্ধান্তের পরই।

আমার একটা অভ্যেস হল, আমার স্বপ্নরা বদলায়। আমার স্বপ্নের পালাবদল হয় খুব দ্রুত। আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলনার জিনিস হল আমার নিজের জীবনটা। একেবারে ছোটো-ছোটো ব্যাপারেও আমার অসীম মুগ্ধতা কাজ করে। আমার মাথায় যেটা একবার ঢুকে যায়, সেট হয়ে যায়, সেটা নিয়েই ভাবতে থাকি ভাবতেই থাকি, সেটাকে খুব আন্তরিকতার সাথে করতে থাকি। দোভানা আমার ব্রেইনচাইল্ড। দোভানা আমাদের রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কষ্ট করে গড়ে তোলা সন্তানের মত। দোভানার জন্ম হয়েছিল মাত্র ১ সপ্তাহের প্ল্যানে। দোভানার মৃত্যু হয়েছিল মাত্র ১ ঘণ্টার মোটিভেশনে। আমার দুই বন্ধু আমাকে বিসিএস’য়ের স্বপ্ন দেখাল, আমি আমার বন্ধুদের চাইতে প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময় পর অনার্স কমপ্লিট করলাম, দোভানাতে আসাযাওয়া প্রায় ছেড়েই দিলাম, সৌভাগ্যবশত সেসময় শেয়ার মার্কেটে অনেক বড় মার খেলাম, আমার কোচিং সেন্টারটাও বন্ধ করে দিলাম। অনেকের কাছে অনেক টাকা পেতাম, এখনও পাই; আমি জানি, ওদেরকে আমি চিরঋণী করে দিয়েছি। প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেলে সে ব্যথা ভোলা কঠিন, আর হাত থেকে নগদ টাকা চলে গেলে সে ব্যথা ভোলা রীতিমতো অসম্ভব। এতো ব্যথা বুকে নিয়ে আমাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে।

বাকিটা ইতিহাস। জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, আমরা কখনওই তা ভাবতেও পারি না৷

দোভানা এখন আর নেই। না, দোভানা’র মৃত্যু হয়নি—স্বপ্নের কখনও মৃত্যু হয় না, জন্মান্তর হয় মাত্র। স্বপ্ন একটা জীবন্ত সত্তা। প্রত্যেক স্বপ্নকেই তার আগের জন্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়।

পুনশ্চ। অনেকেই আমার কাছে ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন, ‘দোভানা’ মানে কী? তাদের বলছি, এটা একটা লিথুয়ানিয়ান শব্দ। ওই দেশে আদর করে মেয়েদের নাম রাখে দোভানা। এর মানে উপহার। (ওইসময়টাতে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ভাষা আর শব্দ নিয়ে খেলা। শব্দরা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। আমি ফেসবুকে ওদের নিয়ে ইচ্ছেমত খেলতে ভালোবাসতাম।) দোভানা ছিল চট্টগ্রামের চকবাজারের গুলজার টাওয়ারের দোতলায়। মুখোমুখি দুটো দোকান। আমাদের দোকানে একজন কর্মচারী ছিলেন; পীযূষদা। আমি, আমার ছোটোভাই, ওর বন্ধু আর পীযূষদা, আমরা এই ৪ জন মিলে দোকান চালাতাম।