স্বেচ্ছানশন—ধর্মে, কর্মে, মর্মে

গবেষণায় দেখা যায়, আমরা যতোটা শক্তি খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করি, তা যদি কিছুটা কম পরিমাণে গ্রহণ করি, তবে আমাদের সুস্থতা ও আয়ু বেড়ে যেতে পারে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। ইচ্ছে করে না খেয়ে এই কাজটি করা যায়। ধরে নিচ্ছি, এর নাম স্বেচ্ছানশন; অর্থাৎ, স্বেচ্ছায় অনশন, বা স্বেচ্ছায় না খেয়ে থাকা। ব্যাপারটি শারীরিক ও মানসিক দুই রকমেরই। (আমি এই লেখায় যে ধরনের স্বেচ্ছানশনে পানিও গ্রহণ করা যায় না, সেটিকে ‘নির্জলা স্বেচ্ছানশন’ লিখেছি, অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা লিখে দিয়েছি।) ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রধান বিশ্বধর্মগুলির মধ্যে একমাত্র শিখ ধর্ম ছাড়া অন্য সকল ধর্মেই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একবার খাওয়ার পর দীর্ঘ সময় না খেয়ে, কিংবা ক্ষুধার্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত না খেয়ে, কিংবা প্রতিবার খাওয়ার সময় যতটুকু দরকার তার চাইতে কমিয়ে খেয়েও এই কাজটি করা যায়। স্বেচ্ছানশন প্রক্রিয়ার নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে আমাদের ব্রেইনের ক্ষমতাকে অনেকাংশে বৃদ্ধি করা যায়। কিছু বিখ্যাত মানুষের মুখে স্বেচ্ছানশন নিয়ে শোনা যাক।

শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা বাড়াতে আমি প্রায়ই স্বেচ্ছানশন পালন করি। (-প্লেটো)

লোকে যা খায়, তার মাত্র একচতুর্থাংশ দিয়েই দিব্যি বেঁচে থাকে, বাড়তি তিনচতুর্থাংশের শাস্তি পেতে ডাক্তারবাড়ি দৌড়াতে হয়। (আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে মিশরের পিরামিডের গায়ে এই কথাটি খোদাই করে লেখা ছিল।)

স্বেচ্ছানশনের চাইতে বড় ওষুধ আর নেই—স্বেচ্ছানশন নিজেই বড় ডাক্তার। (পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রের তিনজন জনকের অন্যতম ফিলিপ্পাস প্যারাসেলসাসের কথা)

মার্ক টোয়েন বলতেন, সবচাইতে ভালো ডাক্তার আর ভালো ওষুধে যতোটা রোগ সারে তার চাইতে অনেক বেশি সারে স্বেচ্ছানশনে।

অ্যালঝেইমার্‌স ডিজিজ, হানটিংটন্‌স ডিজিজ বা পারকিনসন্‌স ডিজিজের মতো স্মৃতিনাশক ব্যাধিগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে স্বেচ্ছানশন সবচাইতে ভালো ওষুধ। আমেরিকান সাংবাদিক ও বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আপ্টন সিনক্লেয়ার ২৫০ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময়ব্যাপ্তিতে স্বেচ্ছানশন পালন করান। মাত্র ৬-৭ জন বাদে বাকি সবারই শারীরিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়। মাসে ৮ দিন যারা স্বেচ্ছানশন পালন করেন, তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হয়। David Zinczenko এবং Peter Moore এর লেখা বিখ্যাত বই The 8-Hour Diet আমাদের জানাচ্ছে: যা-ই খাই না কেন, দিনের ৮ ঘণ্টার মধ্যেই খাব, বাকি ১৬ ঘণ্টা কিছুই খাব না—এ নীতিতে চললে শারীরিক সুস্থতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে না খেয়ে থাকলে আমাদের ব্রেইন নির্দিষ্ট সময় পরপর খাদ্য গ্রহণ করার তাগিদ জানিয়ে সিগন্যাল পাঠায়। ওই সময় সে সিগন্যালকে পাত্তা না দিলে আমাদের ব্রেইন আমাদের ওরকম করেই অভ্যস্ত করে ফেলে, ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সহনশীলতা বেড়ে যায়। তখন নার্ভ সেলগুলি ডিএনএ মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে করে আমাদের শেখার ও মনের রাখার ক্ষমতা বাড়ে। “দিনে তিনবার আহার, সাথে হাল্কা জলখাবার তো আছেই!” আচ্ছা, এই নিয়মটি কোত্থেকে এল? নিয়ম তো আমরা বানাই বলেই নিয়ম! ধরুন, আপনি একদিন ব্রেকফাস্ট করলেন না, বা করতে পারলেন না। কী হবে? না খেয়ে থাকলেন দুএক বেলা। তখন? ফুড ইন্ডাস্ট্রি পয়সা হারাবে। লোকে যদি স্বেচ্ছানশন পালন করে, ব্যায়াম করে, তবে তাদের রোগব্যাধি কম হবে। এতে কী হবে? ওষুধ কোম্পানিগুলি পয়সা হারাবে। টিভিতে তাই বিজ্ঞাপন বাজছে: বেশি-বেশি খান।।…….(জলদি-জলদি মরুন।) সপ্তাহে আধবেলা, এরপর একদিন, এরপর দুইদিন, এরকম করে স্বেচ্ছানশন পালন করলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অনেক-অনেক বেড়ে যাবে।

মেডিক্যাল সায়েন্সে অটোফেজি (autophagy) বলে একটা কথা আছে। ওটা কী? গ্রিক auto মানে self, আর phagein মানে to eat; ফলে অটোফেজি মানে ‘নিজেকে খাওয়া’। এই তো, না? দেখা যাক। আমাদের দেহের পুরনো ভাঙা কোষগুলি যখন বুড়ো হয়ে যায়, আর কাজটাজ করতে পারে না, মানে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে না, তখন সত্যিই সেগুলি আর কোনও কাজে লাগে না। সেগুলিকে রেখে দেয়ার মানেই হল, সুস্থ কোষগুলির উপর বাড়তি চাপ দেয়া। এতে দেহের কর্মক্ষমতা কমে যায়। ধরুন, আপনার একটা গাড়ি আছে। সে গাড়ির সাথে অনেক মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। গাড়িটাতে চড়তে আপনার খুব ভালো লাগে। একদিন যখন গাড়িটা পুরনো হয়ে গেল—বারবার নষ্ট হয়ে যায়, ঠিকমতো চলে না, যেকোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসতে পারে—তখনও যদি সেটাকে আঁকড়ে ধরে রেখে দেন, তবে আপনার পকেট থেকে বেশ কিছু পয়সা খসবে; কাজের কাজ আর অন্য কিছুই হবে না। কী লাভ, বলুন তো? তার চাইতে বরং গাড়িটা কম দামে বেচে দিন, বেচা না গেলে ফেলে দিন, কিছু পয়সা বাঁচুক, দুর্ভোগ কমুক। একইভাবে আমাদের শরীরের কোষ পুরনো হয়ে গেলে, দুর্বল হয়ে গেলে, সেগুলিকে মরে যেতে দিতে হবে। যদি ওরা নিজ থেকে না মরে, তবে ওদের মৃত্যুর পাকা বন্দোবস্ত করে দিতে হবে। যতো দেরিতে মরবে, ওরা ততো বেশি আমাদের দেহে সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকবে।

আবার গাড়ির কথায় ফিরে আসি। সবসময়ই যে পুরো গাড়িটাই অকেজো হয়ে পড়ে, এমন কিন্তু নয়। কখনও-কখনও গাড়ির কোনও যন্ত্রাংশ, কিংবা ব্যাটারি বদলে নিলেই গাড়িটা ঠিকঠাক চলে। কোষের ক্ষেত্রেও তা-ই। অ্যাপোপটোসিস ঘটিয়ে, অর্থাৎ পুরো কোষটিকেই মেরে না ফেলে কোষের কিছু অংশ মেরামত করে দিলে কিংবা প্রতিস্থাপিত দিলেই হয়ে যায়। কোষের পুরনো অকেজো অংশকে বিনষ্ট করে দিয়ে নতুন কেজো অংশ সেখানে জায়গা করে নেয়। বাজে জিনিস মাত্রই দ্রুত বর্ধনশীল। কোষের পুরনো বাজে অংশকে সময়মত দূর না করলে সেই বাজে অংশের রাজত্বে ধীরে-ধীরে শরীর অকেজো হয়ে পড়ে। অকেজো কোষের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণটিকেই দূর করার এই প্রক্রিয়ার নামই অটোফেজি। এই প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যায়, শরীর নিজেকে মেরামত করার সুযোগ পায়। নোবেলজয়ী বেলজিয়ান জৈব-রসায়নবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডি দ্যুভে ১৯৬২ সালে এই শব্দটি আবিষ্কার করেন। কোন-কোন পদ্ধতিতে অটোফেজি কাজ করে, তা আবিষ্কারের জন্য ২০১৬ সালে জাপানি কোষবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি নোবেল জয় করেন।

অটোফেজি অনেক প্রক্রিয়ায়ই কাজ করে। শারীরিক পরিশ্রম ও হাঁটাচলা বাড়িয়ে, ব্যায়াম করে, খাদ্য গ্রহণ না করার দৈনিক সময়টা বাড়িয়ে, দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে, ইত্যাদি উপায়ে। সবচাইতে জনপ্রিয়টি হচ্ছে, শরীরকে পুষ্টি তথা খাদ্য সরবরাহ না করা। অটোফেজি যাতে ঠিকভাবে কাজ করে, সে জন্য ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা কোনও খাবার না খেয়ে থাকতে হয়; তবে খেয়াল রাখতে হবে, ওই ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। অটোফেজির এই প্রক্রিয়াটি স্বেচ্ছানশন, তবে কোনওভাবেই ‘ধর্মীয় স্বেচ্ছানশন’ কিংবা ‘ধর্মীয় নির্জলা স্বেচ্ছানশন’ নয়। আমরা যখন খাই তখন আমাদের শরীরে ইনসুলিন বৃদ্ধি পায়, গ্লুকাজন হ্রাস পায়; আমরা যখন না খেয়ে থাকি তখন আমাদের শরীরে গ্লুকাজন বৃদ্ধি পায়, ইনসুলিন হ্রাস পায়। গ্লুকাজন বেড়ে গেলেই অটোফেজি শুরু হয়ে যায়। স্বেচ্ছানশন অটোফেজি প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে। অটোফেজি অপ্রয়োজনীয় কোষকে বা কোষের নষ্ট অংশকে ধ্বংস করে দেয়। স্বেচ্ছানশন বৃদ্ধিকারক হরমোনকে উত্তেজিত করে, এর ফলে দেহ সুস্থ থাকে, শরীরে বয়সের ছাপ ও প্রভাব, দুইই দেরিতে আসে। অটোফেজি প্রক্রিয়া স্মৃতিধ্বংসকারী রোগ এবং ক্যান্সারের আশংকাকে হ্রাস করে। না খেয়ে থাকলে অটোফেজি শুরু হয়ে যায়, খাওয়ামাত্রই ইনসুলিন এসে অটোফেজিকে বন্ধ করে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শরীরকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৬ ঘণ্টা অটোফেজি প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখলে, অর্থাৎ একটানা ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলে অ্যালঝেইমার্‌স ডিজিজ, হানটিংটন্‌স ডিজিজ, পারকিনসন্‌স ডিজিজ, ক্যান্সার, আর্লি-এইজিং ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কম খাওয়ার চাইতে একটানা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা শরীরের জন্য অধিক উপকারী। প্রাচীন গ্রিসের মহান চিন্তাবিদরা দিনের পর দিন স্বেচ্ছানশন পালন করতেন—শরীরের ওজন কমাতে নয়, মনের ওজন বাড়াতে। লরা হিলেনব্র্যান্ডের Unbroken: An Olympian’s Journey from Airman to Castaway to Captive পড়ে দেখুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দিদের দিনের বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হত। দিনের পর দিন এমন অভ্যাসের ফলে বন্দিদের অনেকেরই মানসিক উৎকর্ষ বেড়ে যায়। কয়েকজন ছিলেন, যারা স্মৃতি থেকে পুরো একটা বই মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। কেউ-কেউ দুএকটা নতুন ভাষা শিখে ফেলেছিলেন। ওরা ধরেই নিয়েছিলেন, না খেয়ে থাকলে জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ে। অনেক জ্ঞানী মহাত্মার কথা আমরা জানি যাঁদের সারাজীবনই কাটাতে হয়েছে ক্ষুধাপীড়িত অবস্থায়। ভরা পেটে নয়, খালি পেটেই বুদ্ধি খেলে বেশি। যখন আমরা কোনওকিছুর জন্য ক্ষুধার্ত থাকি–ক্ষমতার জন্য, অর্থের জন্য, স্বীকৃতির জন্য, তখন আমাদের মানসিক ক্ষমতা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

সপ্তাহে অন্তত দুইদিন স্বেচ্ছানশনের ফলাফল হতে পারে বিস্ময়কর। ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ সীমিত করে রাখলে ব্রেইনের ক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। ২০১২ সালে বিবিসি’তে Eat Fast and Live Longer নামে একটা ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে একটা ডায়েট প্ল্যানের কথা বলা হয়েছে যেটার নাম দেয়া হয়েছে ৫:২ ডায়েট। সপ্তাহে ২ দিন (পরপর ২ দিন নয়) কেউ যদি ৫০০ ক্যালরির সমপরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে, তবে তার শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। এই ফলদায়ক ডায়েট প্ল্যানটি ইয়োরোপে খুব জনপ্রিয়। তবে কাজটি হুট করে করা কঠিন। কেউ যদি প্রতিদিন সিডেন্টারি লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়, এবং হঠাৎ করেই দিনে ৫ মাইল দৌড়ানো শুরু করে; কিংবা দিনে ৩ বেলা আহার, ২ বার জলখাবার খেয়ে অভ্যস্ত কেউ যদি হঠাৎই দুইদিন না খেয়ে থাকে, তবে তার শারীরিক ক্ষতি না হলেও মানসিকভাবে সে এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবে না। মানসিক অন্তঃদ্রোহ তাকে অসুস্থ করে দেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুরুতে সপ্তাহে একদিন করে স্বেচ্ছানশন পালন করলে মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা, খিটখিটে মেজাজ, ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলেও আস্তেআস্তে ব্যাপারটা সয়ে যায়, তখন মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়।

যে উৎসব অপ্রাসঙ্গিক, সে উৎসব কালের গর্ভে হারিয়ে যায়; যে গান আর শুনতে ইচ্ছে করে না, সে গানটাও একসময় হারায়; যা কখনও হারায় না, তা হল খাবার ও পানি। সবকিছুরই বিকল্প আছে, খাদ্য ও পানীয়র কোনও বিকল্প নেই। যদি আমরা নিজেদের এই দুটো জিনিস থেকে সরিয়ে রাখতে পারি, তবে আমরা এই দুটো প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাববোধকে সহ্য করতে শিখে যাবো। যার বিকল্প নেই, তাকে ছাড়া বাঁচতে শেখা অনেক বড় একটা কৃতিত্বের ব্যাপার। আমেরিকার লাকোতা জাতি সূর্যনৃত্য নামক একটা অনুষ্ঠান করে। সে অনুষ্ঠানে জুলাই মাসের তীব্র রোদের মধ্যে কোনওরূপ খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করে চারদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নৃত্য ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে নির্জলা স্বেচ্ছানশন পালন করে। ওদের দাবি, প্রথমদিনের পর থেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অনুভূতি ক্রমশ কমে যেতে-যেতে একসময় শূন্য হয়ে যায়। তখন ওরা নিজেদের পরম শক্তির একটা অংশ হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা মনে করে, আমাদের এই জীবন মূলত আমাদের ভাবনা ও অন্তর্নিহিত শক্তির অধীন। আমাদের সকল কষ্ট ও সুখ, দুইই আমাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শরীর ও আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে নিজের ভেতরের আমি’টাকে চেনা সহজ হয়ে ওঠে। নিজের ভেতরের জগতটাতে প্রবেশ করার জন্য নির্জলা স্বেচ্ছানশনের চাইতে শক্তিশালী উপায় আর নেই।

স্বেচ্ছানশন প্রার্থনার মতো। না খেয়ে থাকলে খাবার কেনার যে টাকাটা বেঁচে যায়, সেটা গরীবদের দিয়ে দিলে মনে শান্তি আসে। এসময় অন্যদের প্রতি রাগ বা ঈর্ষা কমে আসে। স্বেচ্ছানশন কেবল মুখের নয়—চোখের, কানের, পায়ের, হাতের, এবং শরীরের সব অঙ্গের। স্বেচ্ছানশনের সময় আমাদের হৃদয় সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। যখন আমরা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকি, তখন খাবারের প্রতি আমাদের লোভ বেড়ে যায়, খাবারের গন্ধ অপূর্ব মনে হয়, যেন এক কিলোমিটার দূর থেকেও বিস্কিট বানানোর দারুণ গন্ধ ভেসে আসে। স্বেচ্ছানশনের সময় টিভি রেডিওর শব্দ শুনতে ভালো লাগে না, কোনও কোলাহল বা কোন্দলের মধ্যে নিজেকে রাখতে ইচ্ছে করে না, নিবিষ্ট মনে প্রার্থনা করতেই বেশি ভালো লাগে। যারা অর্থের অভাবে না খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের কথা ভেবে আমাদের যা আছে তার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই। নিজের অবস্থানের কথা ভেবে এক ধরনের কৃতজ্ঞতাপূর্ণ ভালোলাগা কাজ করে। নিজেকে সকল অন্যায় প্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখা, নিজের পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, আত্মার উন্নয়ন সাধন, অসহায়দের সাহায্য করা—এগুলি হল স্বেচ্ছানশনের ভিত্তি। মানুষের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণের কথা ভেবেই বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন নির্দিষ্ট সময়ে স্বেচ্ছানশনের বিধান নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কেবল খাদ্য গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখার নাম স্বেচ্ছানশন নয়, অসংযত আচরণ ও বাক্য, ক্রোধ, মিথ্যা, ভুল প্রতিশ্রুতি, কাম, মোহ থেকে নিজেকে দূরে রাখাও এর অংশ।

খ্রিস্টান ধর্মে যিশু তাঁর অনুসারীদের বলছেন, “তোমরা উপবাসব্রত পালন কর। যখন তোমরা উপবাস করবে, তখন যেন তোমাদের চেহারা কিংবা আচরণ এমন বিকৃত না হয়, যে অন্যরা তোমাদের দেখে ভাবে, তোমরা কষ্টে আছ, কিংবা রেগে আছ। অমন কাজ করে ভণ্ডরা। তুমি যে কষ্টভোগ করছ নিজের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য, এই ব্যাপারটা কেবল ঈশ্বর জানুক, আর কেউ তা না জানুক। তোমাদের এমন সংযত ও বিনয়ী আচরণের পুরস্কার তোমরা যথাসময়ে ঠিকই পেয়ে যাবে।”

গোঁড়া খ্রিস্টানরা যে উপবাসব্রত পালন করেন, সে ব্রতে দুটো দিক আছে। শারীরিক ও আত্মিক। প্রথমত নিজেকে সকল ধরনের খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়; দ্বিতীয়ত নিজেকে সকল ধরনের খারাপ চিন্তা, ইচ্ছা ও কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল নিজেকে জয় করা, বস্তুগত সম্পদের মোহ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, ইন্দ্রিয়সুখের দুর্নিবার আকর্ষণকে নিজের ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাভূত করা। কোনও প্রকারের লোভ কিংবা পাপের কাছে যেন হৃদয় হেরে না যায়। নিজের শরীরের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আনার সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাস জীবনকে সহজ করে। যখন কারও মাথায় খাওয়ার ভাবনাটা থাকে না, তখন সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে। যদি আমরা আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলিকে হত্যা না করি, তবে তারা আমাদের হত্যা করবে। উপবাসব্রত পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলিকে হত্যা করি, মনকে সহজ ও হাল্কা করে দিই, যা আমাদের প্রার্থনাকে করে পরিপূর্ণ। প্রাচীন ল্যাটিন ভাষায় একটা কথা আছে: Plenus veter non studet libenter. এর অর্থ: ভরাপেটে শেখা যায় না। ঠিক একইভাবে, পেটুক লোক কখনও ভালো ইবাদত করতে পারে না। উপবাস আমাদের মস্তিষ্ককে শাণিত করে। দুঃখীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং ভুল কাজের জন্য অনুতপ্ত হওয়া—এই দুইয়ের চর্চায় আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা আসে। উপবাস এই কাজটিকে সহজ করে দেয়, এতে হৃদয় পবিত্র হয়। যে ব্যক্তি উপবাস পালন করে, কোনও খাবার গ্রহণ করে না, কিন্তু সমালোচনা ও নিন্দার মধ্য দিয়ে অন্য ব্যক্তির ক্ষতি করে, সে উপবাসে তার কোনও আত্মিক উন্নতি হয় না। খ্রিষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে, আসো, আমরা সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভ করার জন্য স্বেচ্ছানশন পালন করি। ক্ষুধার্তদের খাবার দিই, তৃষ্ণার্তদের তৃষ্ণা মেটাই। বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দিই, দূরের যারা তাদের আপন করে নিই, যারা অসুস্থ ও কষ্টে আছে তাদের দেখাশোনা করি। এমনি করেই আমাদের জীবনটা স্বর্গের উপহারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

আমাদের দেহ ও মন একে অন্যের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছানশন আমাদের শরীরকে পরিষ্কার করে, শরীরের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলি শরীর থেকে বের হয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধী একবার একটানা ৪০ দিন উপবাসব্রত পালন করেন। “আপনি কেন নিজেকে এমন করে কষ্ট দিলেন?” এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমরা আমাদের শরীরকে পরিষ্কার করতে পারি। কারণ, শরীরটা বাহ্যিক। কিন্তু মনকে কীভাবে পরিষ্কার করব? মন পরিষ্কার করাটা সবচাইতে জরুরি। মনকে পরিশুদ্ধ করতে যে উপায়গুলি আছে, সেগুলির মধ্যে স্বেচ্ছানশন পালন সবচাইতে ভালো।” যারা ইয়োগা বা ধ্যান চর্চা করেন, তাদের জন্য স্বেচ্ছানশন পালন খুব কাজের। এতে মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়, মনোযোগ বাড়ে, এবং চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। খেতে ইচ্ছে করবে, খাওয়া যাবে না; কথা বলতে ইচ্ছে করবে, কথা বলা যাবে না; ইন্দ্রিয়সুখে ভাসতে ইচ্ছে করবে, ভাসা যাবে না—নিজের মঙ্গলের জন্যই। এর নামই সংযম। অন্যকে নয়, নিজেকে জয় করাই জীবনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। নিজেকে কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে সেটা করা যায়। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট আমাদের শেখায়, “আর কিছু নয়, কেবল দয়ালু হওয়ার জন্যই আমাকে নির্দয় হতে হবে।” নিজের প্রতি সাময়িক নির্দয়তা আমাদের অসীম সুখের সন্ধান দেয়। কষ্ট দূর করার একমাত্র উপায়ই হল, আরও কষ্টের মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলা। না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীর খাদ্য পরিপাক করার কাজ থেকে মুক্তি পায়, ফলে শরীর তখন নিজেকে পরিষ্কার করার কাজে মন দেয়। স্বেচ্ছানশনের মাধ্যমে অব্যবহৃত, ক্ষয়িষ্ণু, পুরনো, নষ্ট কোষগুলি ভেঙে যায়, এর সাথে বিষাক্ত কোষকণিকাগুলিও শরীর থেকে দূর হয়ে যায়।

আমরা আমাদের মনকেও স্বেচ্ছানশনের মধ্য দিয়ে নিতে পারি। কীভাবে? মৌনতার মাধ্যমে, অর্থাৎ কারও সাথেই কোনও কথা না বলে। এসময় আমাদের মন কথোপকথনের ভার থেকে মুক্ত থাকে, অহেতুক বার্তা গ্রহণ করে নিজেকে বিক্ষিপ্ত করা থেকে মুক্তি পায়। মন তখন নিজের মধ্যে ডুবে যায়, নিজের সাথেই রাজ্যের গল্প করতে থাকে, নিজেকে চেনার সুযোগ পায়। এ পৃথিবীতে খুব কঠিন কাজগুলির একটি হল নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মৌনতার চর্চার ফলে আমাদের মনের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। জিভকে শাসন করার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে শাসনের মধ্যে রাখতে পারি। মৌনতার চর্চা কয়েক ধরনের হয়। কর্ণ মৌন প্রক্রিয়ায় কথা বলা যায় না, তবে লেখা, ইশারায় কিছু বলা, এসব করা যায়। বাহ্যিক সকল যোগাযোগ প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে সেটাকে বলা হয় কাষ্ঠ মৌন। মন থেকে ধীরে-ধীরে সমস্ত সংশয় দূর হয়ে যায়, বাহ্যিক পৃথিবীর নানান রহস্য মনের সামনে নিজেদের মেলে ধরতে থাকে—এই অবস্থাকে বলে সুষুপ্তি মৌন। যখন আমাদের মন থেকে আমরা সকল প্রকারের চিন্তাভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারি, তখন সে অবস্থাকে বলা হয় মহা মৌন। এটাই মৌনতার সর্বোচ্চ স্তর। সপ্তাহে একদিন মৌনতার চর্চা করলে জীবনের অনেক ভার থেকে নিজেকে হাল্কা করে দেয়া যায় এবং নিয়মিত এরূপ চর্চায় মন অনেকবেশি স্বতঃস্ফূর্ত ও নিখুঁত উপায়ে ভাবতে পারে। যদি চুপ করে থাকতে খুব কষ্ট হয়, মনের মধ্যে ক্ষোভ এসে জমে, বিষণ্ণতা ভর করে, তবে প্রথমদিকে পুরো দিন মৌন না থেকে আধদিন মৌন হয়ে থাকা যেতে পারে। এরূপ চর্চায় ৪-৫ মাসের মধ্যে খুব খিটখিটে মেজাজি লোকও খুব প্রসন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে যেতে পারেন। রাগ কমাতে চুপ করে থাকার কোনও বিকল্প নেই।

আমরা আমাদের শরীরকে যতো বেশি পরিপাক করার মহাভার থেকে মুক্তি দিতে পারব, ততো বেশি শারীরিকভাবে সুস্থ থাকব। জাপানের তিনজন ডাক্তার মিলে ৩৮০ জন মনোদৈহিক রোগীর উপর একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এই পরীক্ষায় যারা অংশ নেন, তাদের ৮৭%-ই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাদেরকে ১০ দিন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেয়া হয়। সেই ১০ দিন তাদেরকে আলাদা-আলাদা কক্ষে রাখা হয়। কক্ষের পরিবেশ ছিল খুবই ভালো, শান্ত, একেবারেই নিরিবিলি, প্রকৃতির কাছাকাছি। ডাক্তার ছাড়া আর কাউকেই তাদের সাথে দেখা করতে দেয়া হত না, তাদের কক্ষে সংবাদপত্র কিংবা সকল ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিষিদ্ধ করা হয়। রোগীরা যতক্ষণ জেগে থাকতেন, বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন চিন্তা, ধ্যান ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সময় কাটাতেন। তাদের দৈনিক অন্তত ১০ গ্লাস পানি খেতে দেয়া হত, এবং বিভিন্ন ভিটামিন ও অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ বিশেষ এক ধরনের দ্রবণ ৫০০ মিলিলিটার পরিমাণে খেতে দেয়া হত যা শরীরকে ঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে যথেষ্ট। ওই ১০ দিন তাদের পরিপাক যন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়া হয়েছিল। ১০ দিন পর ৫ দিন তাদের প্রথমে তরল খাবার, এরপর নরম খাবার, এরপর সাধারণ খাবার খেতে দেয়া হল। ১৫ দিন আগে তাদের শরীরের ও মনের অবস্থা যেমন ছিল তার সাথে ১৫ দিন পরের অবস্থা মিলিয়ে দেখা যায়, ২৪% রোগীর উন্নতি ছিল অসাধারণ মানের, ৬৩% ভালো মানের, এবং বাকি ১৩% রোগীর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি কাজ করেনি। এরূপ মানসিক ও শারীরিক উপবাস পদ্ধতি পরবর্তীতে ২৬২ জন রোগীর ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় যারা বিভিন্ন মানসিক ব্যাধিতে ভুগছিলেন। দেখা যায়, তাদের ৯১%-ই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন।

এখন একটা মজার আত্মশুদ্ধি পদ্ধতি নিয়ে লিখছি। এর নাম নাইকান। ‘নাইকান’ শব্দের অর্থ ‘ভেতরে দেখা’ বা ‘অন্তর্দর্শন’। একজন জাপানিজ ব্যবসায়ী ইয়োশিমতো ইশিন এই পদ্ধতির প্রবক্তা। এক অন্ধকার গুহায় খাদ্য, পানি, ঘুম ছাড়া কাটাতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজেকে এরূপ কষ্ট দেয়ার সময় নিজের অজ্ঞতা, ভুল, নিচুতার জন্য মনের মধ্যে অনুশোচনা কাজ করে। যে সকল যুবক অপরাধমূলক বা সামাজিক অনিষ্টকর বিভিন্ন ধরনের কাজের সাথে যুক্ত ছিল, তাদের মধ্যে নাইকানকে জনপ্রিয় করার জন্য তিনি পদ্ধতিটিকে একটু সহজ করে দেন। পরবর্তীতে এটি সাধারণ লোকজনের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নাইকান চর্চা তিনটি প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত:

আমি ‘ক’ থেকে কী পেয়েছি?

আমি ‘ক’-কে কী দিয়েছি?

আমি ‘ক’-কে কী কী ঝামেলা ও যন্ত্রণায় ফেলেছি?

“‘ক’ আমাকে কী কী ঝামেলা ও যন্ত্রণায় ফেলেছে?” চতুর্থ এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা নাইকানে নেই। নাইকান পদ্ধতিতে ধরেই নেয়া হয়েছে, আমরা সবাইই চতুর্থ প্রশ্নটি করতে ওস্তাদ। নিজের মধ্যে যখন ওই চতুর্থ প্রশ্নটি ঘুরপাক খেতে থাকে, তখনই যাবতীয় সমস্যার সূচনা ঘটে। তাই ওটা মাথা থেকে বাদ দিলেই মঙ্গল। সবচাইতে কঠিন নাইকান-এর স্থায়িত্ব এক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। নাইকান অনুসারীরা দাবি করেন, এটা চর্চার মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের ও তাদের সম্পর্ককে ভালোভাবে বুঝতে পারে। তারা প্রথম চর্চা শুরু করে তাদের মায়ের সাথে তাদের সম্পর্কের বিভিন্ন মাত্রা বিশ্লেষণ করে। অর্থাৎ, প্রথম ‘ক’ হচ্ছেন তাদের মা। আস্তে-আস্তে অন্যান্য সম্পর্ক নিয়েও তারা ওই প্রক্রিয়ায় ভাবতে থাকে। নাইকান সেশনের সময় সময়ে-সময়ে একজন এসে চর্চাকারীর আত্মোপলব্ধি জেনে নেন। জাপানে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, মাদকাসক্তি নিরাময়, কারাবন্দিদের পুনর্বাসন, ব্যবসা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মনোদৈহিক চিকিৎসায় নাইকান পদ্ধতি খুব জনপ্রিয়। জাপানে নাইকান সেন্টার আছে ৪০টি; জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতেও সেন্টার খোলা হয়েছে। আত্মসুখের বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও আত্ম-অনুসন্ধানই নাইকানের মূল দর্শন। যাদের পারিবারিক জীবন সুগঠিত নয়, তারাও নাইকান চর্চা করতে পারেন, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের প্রিয় কোনও মানুষের সম্পর্কে ওই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে নাইকান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। প্রাচীনকালে মরুভূমিতে যেসকল খ্রিষ্টান সাধক সাধনা করতেন, তাদের এবং জাপানিজ সামুরাইদের মধ্যে আত্ম-অনুসন্ধানের প্রথা জনপ্রিয় ছিল।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অনেক প্রাণীই না খেয়ে তাদের অনেক রোগ প্রাকৃতিক উপায়ে সারিয়ে ফেলে। সূর্যালোক, মুক্ত বাতাস, আর বিশ্রামের মাধ্যমে অনেক রোগের নিরাময় সম্ভব। আমরা প্রায়ই খাই অভ্যাসবশত, ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে খাওয়া খুব কমই হয়। ক্ষুধা না পেলেও যখন আমরা খাদ্য গ্রহণ করি, তখন এই বাড়তি খাবার আমাদের দেহে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। স্বেচ্ছানশনের মাধ্যমে অনেক রোগ সারিয়ে ফেলা যায়, কিংবা রোগের প্রকট ভাব কমিয়ে ফেলা যায়। আমরা যখনই আমাদের নিজেদের জোর করে খাওয়াই, শরীরের ক্ষুধা নয়, চোখের ক্ষুধায় খাবার গ্রহণ করি, তখনই তার একটা বিরূপ প্রভাব আমাদের শরীরে পড়ে। বাড়তি খাদ্য পরিপাক করতে গিয়ে আমাদের শরীর তার শক্তির অনেকটুকুই নিঃশেষ করে ফেলে, এর ফলে আমরা দুর্বল হয়ে পরি। পরিপাক যন্ত্রকে আমরা যতোই বাড়তি কাজের ভার থেকে বিশ্রাম দেবো, ততোই আমাদের শরীরে শক্তি জমা হয়ে থাকবে। এই শক্তি আমাদের শরীরকে পরিষ্কার করতে ও মানসিক অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলে, যারা স্বেচ্ছানশন পালন করে, তারা বেশিদিন বাঁচে, তাদের শরীর অন্যদের তুলনায় নীরোগ থাকে, তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। তবে স্বেচ্ছানশন পালন করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা ভালো।

হিন্দুরা বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনায় উপবাস পালন করে। দেবদেবী আসলে আলাদা কোনও সত্তা নয়, মানুষের মনের সুপ্ত চেতনায় যে শক্তির অধিষ্ঠান থাকে, মানুষ সে শক্তির কল্পনা করে কোনও এক দেবতা বা দেবীর মধ্যে, এবং তাঁকে তুষ্ট করতে উপবাসব্রত পালন করে। এতে করে মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজের মনের ওই নির্দিষ্ট প্রবৃত্তি-শক্তিকেই জাগিয়ে তোলে। যখন কেউ তার ক্ষমতার কোনও একটি বিশেষ অংশের উপর জোর দেয়, এবং সেটাকে আরও বৃদ্ধি করতে ক্রমাগত চেষ্টা করে যায়, তখন আস্তে-আস্তে তার ওই ক্ষমতাটি আপনিই বাড়তে থাকে। এই কাজটি বিশ্বাসীরা করে বিবিধ ধর্মীয় আচারবিধি পালন করার মাধ্যমে। একাদশী সহ ধর্মীয় আরও অনেক আচার পালন করতে হিন্দুরা বছরের বিভিন্ন দিনে উপবাসব্রত পালন করে, এর মধ্যে কোনকোনটি নির্জলা স্বেচ্ছানশন, সে ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা, বা ৩৬ ঘণ্টা জলপানও করা যায় না। ইসলাম ধর্মেও রোজা রাখার বিধান রয়েছে, যা নির্জলা স্বেচ্ছানশন। শরীর ও মনের উপর উপবাস কিংবা রোজার আশ্চর্য ফলাফল দেখা যায়।

অমাবস্যা ও পূর্ণিমার বিভিন্ন তিথির উপর ভিত্তি করে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে উপবাস পালন করার বিধান আছে। হিন্দু ধর্মে সোমবার শিবের, মঙ্গলবার গণেশের, বৃহস্পতিবার গুরু দত্তাত্রেয়ার (ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর-এর সম্মিলিত রূপ), শুক্রবার সন্তোষী মাতার, শনিবার হনুমান দেবতার উপাসনায় উপবাসব্রত পালিত হয়। যে যার ভক্ত, সে সেভাবেই উপবাসব্রত পালন করে। এছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে ও উদ্দেশ্যে অনেক ধরনের উপবাসব্রত পালনের বিধান শাস্ত্রে দেয়া আছে, যেগুলির বেশিরভাগই কালের বিবর্তনে ব্যস্ততার কারণে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সারাদিনে দুপুরে একবার আহার গ্রহণ করা হলে সেটার নাম একভুক্ত, রাতে একবার আহার গ্রহণ করলে তার নাম নক্তব্রত, সামান্য ফল খেয়ে (ততটুকু ফল, যতটুকু ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য যথেষ্ট নয়) কিংবা সম্পূর্ণ অনাহারে কাটালে তার নাম উপবাস। জৈন ধর্মে অহিংসা, মানবকল্যাণ, কিংবা মনের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মকুশলতা বৃদ্ধির জন্য এক দিন, এক সপ্তাহ, এক মাস, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত উপবাস পালন করার বিধান আছে; এই সময় দিনে দুইবার শুধু সিদ্ধ পানি পান করা যায়। আবার ওদের মধ্যে অনেকেই দিনে একবার রুটি, ভাত কিংবা ফল খেয়ে বাকি সময়টা উপবাস পালন করেন। তবে উপবাসব্রত পালনকালে কারও স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাকে সুস্থ করে তুলতে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানও জৈন ধর্মে বলা আছে। সংস্কৃত উপবাস শব্দটি উপ ও বাস—এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত। ‘উপ’ অর্থ কাছে, ‘বাস’ অর্থ অবস্থান করা। ‘উপবাস’ অর্থ ‘কাছে অবস্থান করা’; অর্থাৎ মানসিকভাবে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করাই হল উপবাস। যদি আমরা আমাদের নিজেদের কষ্ট দিই, তবে আমাদের পাপ অনেকটা কমে যায়, ঈশ্বরের শাস্তি আমরা নিজেরাই আমাদের দিয়ে দিই, ফলে আমরা আমাদের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। এতে আমাদের হৃদয় মন ও দেহের শক্তি অনেক বেড়ে যায়। বস্তুত ঈশ্বরকে তুষ্ট করা মানেই নিজেকে তুষ্ট করা। ঈশ্বরের অধিষ্ঠান তো নিজের মধ্যেই। যখন এই সত্যটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন আমাদের আত্মশক্তি ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ঋক্‌বেদে বলা হয়েছে, “আমাদের শরীরের জন্য যতটুকু খাবার দরকার, তার চাইতে বেশি খাবারের সংস্থান করার সামর্থ্য আমাদের দেয়া হয়েছে। অতএব, আমাদের দায়িত্ব, বাড়তি খাবার তাদের মুখে তুলে দেয়া, যাদের খাবারের সংস্থান করার সামর্থ্য নেই। এর অন্যথায় হলে বাড়তি খাবার আমাদের শরীরে বিষ হয়ে প্রবেশ করবে।” একাদশী ছাড়াও নবরাত্রি, শিবচতুর্দশী, মহাঅষ্টমী সহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে হিন্দুরা উপবাস পালন করে। আয়ুর্বেদেও বলা হয়, শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে এবং নির্দিষ্ট কিছু রোগের নিরাময় করতে স্বেচ্ছানশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রথমবার ১২-১২ ঘণ্টা, এরপর ক্রমান্বয়ে ১৫, ১৮, ২৪ ঘণ্টা উপবাস করে-করে অভ্যস্ত হতে হয়। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, স্বেচ্ছানশনের ফলে মানুষ মানসিক ও আত্মিক শক্তিলাভ করে। বেশিরভাগ রোগের উৎপত্তিই অতি-আহার থেকে, উপবাস আমাদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।

চান্দ্রবর্ষের ৯ম মাসে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এক মাস নির্জলা স্বেচ্ছানশন পালন করেন। এই ধর্মীয় অনুশাসনের নাম রমজান বা রোজা। রমজান শব্দটি এসেছে আরবি ramiḍa বা ar-ramaḍ থেকে, যার অর্থ তীব্র তাপ বা শুষ্কতা। কুরআনের সূরা আল-বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” অর্থাৎ, পূর্বের অন্যান্য ধর্মঐতিহ্যেও স্বেচ্ছানশনের বিধান ছিল। এই আয়াতে এটা স্পষ্ট, রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অবলম্বন করা; শুধু না খেয়ে, পানি পান না করে থাকলেই রোজা হয় না। তাকওয়া অবলম্বন করা কী? তাকওয়া অর্থ হচ্ছে বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার নাম তাকওয়া। একবার হযরত উবাই ইবনে কাব (রা)-কে ওমর (রা) তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, “হে ওমর (রা)! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কীভাবে চলতে হবে?” তিনি উত্তর দিলেন, “গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, এমন সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে।” হযরত উবাই ইবনে কাব (রা) বললেন, “এটাই তাকাওয়া।” পূর্বের সকল ধর্মের ও মতের শিক্ষা ও দর্শনকে ধারণ করে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। রোজার মাহাত্ম্য অতীতের সকল ধর্মদর্শনেও স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, আল্লাহ্‌ কেন চাইছেন আমরা না খেয়ে থাকি? খাদ্য ও পানীয় তো সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের ভোগের উদ্দেশ্যেই। তবে কেন আমাদের সেসব থেকে বিরত রাখা হচ্ছে? যখন আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ থাকে, তখন আমরা চাইলেই খাবার কিনে খেতে পারি, পছন্দমতো পানীয় গ্রহণ করতে পারি। বাতাসের সাগরে ডুবে থাকলে আমরা যেমন বাতাসের সৌন্দর্য ভুলে থাকি, তেমনি আল্লাহ্‌র সকল উপহার আমরা যখন প্রয়োজন তখনই সহজে পেয়ে গেলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলে যাই। এতে করে মনের মধ্যে অহমিকার জন্ম হয়, নিজের উপর অহেতুক কৃতিত্ব আরোপ করি, যা কিছু পাচ্ছি তা কিছুকে আমাদের প্রাপ্য ভেবে নিয়ে ভুল করি। একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, আমাদের জীবন ও আমাদের জীবনধারণের সকল উপকরণ, দুইই আমাদের উপর সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বেচ্ছানশন আমাদের নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে; এর ফলে আমরা আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টিকর্তার অবস্থান প্রকটভাবে অনুভব করি, এবং আত্মিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হই।

ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, রোজা রাখার সময়টাতে চারপাশের পৃথিবীটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যায়, যে দৃষ্টি সহনশীলতার, ক্ষমার, অনুগ্রহের, সহমর্মিতার, সংযমের, ন্যায়ের, আত্মনিয়ন্ত্রণের। সে সময় নিজের হৃদয়ের সাথে কথোপকথন চলতে থাকে। নিজের উপর বিশ্বাস দৃঢ় হয়। নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস স্থাপন মানেই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের উপর বিশ্বাস স্থাপন। রোজা হলো একটি অপ্রকাশ্য ইবাদত। তাই রোজা রেখে সেটা সকলের কাছে প্রকাশ করা, কিংবা অন্যের মত ও পছন্দের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ প্রদর্শন করা, নিজেকে ও অন্যকে বারবার ক্ষুধা ও তৃষ্ণার বার্তা স্মরণ করিয়ে দেয়া—এসব কাজ অবশ্য বর্জনীয়। রোজা মানুষের ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে। যারা একমাস ধরে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য, পানীয় ও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি থেকে দূরে থাকে, তারা অন্যের ধন-সম্পত্তির ব্যাপারে নিজের লোভ-লালসাকে দমন করার সক্ষমতা লাভ করে। রোজা মানুষকে উদার হতে শেখায়। যারা একমাস ধরে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে, তারা ক্ষুধার্তদের কষ্ট বুঝতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে ও সহানুভূতিশীল হয়। রোজা গুনাহ বা পাপবর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বেশীরভাগ পাপ উদরবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা থেকেই জন্ম নেয়। রোজা এই দুই প্রবৃত্তিকে দমনে রেখে সমাজে দুর্নীতি ও পাপ হ্রাস করে এবং আত্মোপলব্ধি বাড়ায়। যদি কেউ শারীরিক কারণে রোজা রাখতে অসমর্থ হয়, তবে রোজা রেখে ক্ষুধা সহ্য করার বদলে ক্ষুধার্তকে স্মরণ করে তাকে প্রতিটি রোজার পরিবর্তে প্রতিদিন একজন গরীবকে খাবার দিতে হবে। রোজার কাফফারা দিতে গিয়ে কেউ যদি একজনের বেশী মানুষকে খাবার দেয়, তাহলে তা বেশী কল্যাণকর। যদি সমাজের সবাইই এই ধর্মীয় বিধান মেনে চলত, তবে সমাজের অনেক মানুষই আর অভুক্ত থাকত না।

দ্বাদশ শতকের ইসলামী দার্শনিক আল-গাজ্জালি বলেছেন, “রোজা রাখার মানে শুধু অভুক্ত থাকা নয়—আমাদের মুখ, হাত, চোখ, কান, ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখা।” কেউ যদি আমাদের তার কদর্য কথা বা আচরণের তীব্র বাণে বিদ্ধ করেও, তবু আমাদের মৌন থাকতে হবে। রোজা শুধু শরীরের নয়, রোজা মনেরও। যারা কেবল শরীরে নয়, হৃদয়েও রোজা রাখতে পারে, তারাই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করে। যা কিছু মন্দ, অন্যায়, খারাপ, ক্ষতিকর তা কিছু থেকে নিজেকে নির্বাসিত করাই রোজার মূল অনুশাসন। জগতে পাপ করার আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ কমই আছে। তাই এই আনন্দ থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাধনা সহজ নয়। রোজার মাস ক্ষমার মাস, মানুষকে সেবা দেয়ার মাস, নিজের কাজের প্রতি আন্তরিক হওয়ার মাস। যে দরিদ্র মানুষটিকে সমাজের কেউই গুরুত্ব দেয় না, তাকেও প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন ও সাহায্য করা রোজার শিক্ষা। যে রোজা রাখে কিন্তু আচরণে সংযত হয় না, রোজার ফল সে কখনও পায় না। মহানবী প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। রোজার উপকারিতা আত্মিক ও শারীরিক। ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করে, সেই শ্রেষ্ঠ মুসলমান যে মানুষের চোখে শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন। রোজা মানুষকে মনুষ্যত্বের দীক্ষা দেয়, অতীত পাপকর্মের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ও অনুশোচনা করতে উৎসাহিত করে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা রোজার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা। এসময় যে খাদ্য আমার, যে পানীয় আমার, আমি নিজেই তা গ্রহণ করতে পারি না; রোজা আমাদের তা থেকে দূরে রাখে। অথচ যা কিছু আমার নয়, অন্য কারও, আমি কীভাবে তা গ্রহণ করি? রোজার মূল কথা নিজেকে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখা নয়, হৃদয়ের পরিশুদ্ধিই রোজার মূল কথা। যে খাবার আমাদের দেহকে পুষ্টি দেয়, সে খাবার গ্রহণ না করে যে খাবার আমাদের মনকে পুষ্টি দেয়, সে খাবার গ্রহণ করার শিক্ষাই রোজার শিক্ষা। বিভিন্ন ধর্মের প্রবক্তাগণও স্বেচ্ছানশনের মধ্য দিয়ে নিজেকে চেনার চেষ্টা করেছেন, এবং সেটার ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করেছেন।

বাহাই ধর্মেও স্বেচ্ছানশনের বিধান আছে। বাহাউল্লাহ্‌ বলেন, “স্বেচ্ছানশন হচ্ছে আত্মার অসুখ সারানোর ওষুধ।” খ্রিষ্টান, ইহুদি, হিন্দু, তাওয়িস্ট, মুসলিম এবং জৈন ধর্মের অনুসারীরা স্বেচ্ছানশন পালন করে থাকেন। স্বেচ্ছানশনের ফলে স্ট্রোক, ডায়বেটিস, অ্যালঝেইমার্‌স ডিজিজ, পারকিনসন্‌স ডিজিজ, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদির ঝুঁকি কমে। এই প্রক্রিয়া কোষের ডিএনএকে মেরামত করে, সুস্থ কোষের বৃদ্ধি বাড়ায়, অকেজো কোষ বা কোষের অংশকে ধ্বংস করে, ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করে, স্থূলতা ও উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। যারা নিয়মিত স্বেচ্ছানশন পালন করেন, তারা বুড়োন অন্যদের তুলনায় ধীরে। বাহাই ধর্ম বলে, যারা অসুস্থ তাদের জন্য এই উপবাস নিষেধ, কারণ এতে তারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। অসুস্থ, গর্ভবতী, যেসব মা শিশুকে স্তন্যপান করান, শ্রমিকশ্রেণী, যারা দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণ করছেন, এমন ব্যক্তি বাদে বাকি ১৫ থেকে ৭০ বছর বয়সি সকল বাহাই ধর্মানুসারী স্বেচ্ছানশন পালন করতে পারেন। বাহাই ধর্মে ১৯ দিন উপবাস পালন করার কথা বলা হয়েছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনও খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হয়। এসময় কোনও ধরনের জাগতিক আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাকে মনের মধ্যে স্থান দেয়া নিষেধ। আত্মিক বৃদ্ধিই বাহাই স্বেচ্ছানশনের মূল কথা। নিজেকে পরিমিতিবোধ ও শৃঙ্খলাবোধের মধ্যে রেখে সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়। আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহভাজন করে প্রস্তুত করা বাহাই উপবাসব্রত পালনের মূল দর্শন।

বৌদ্ধধর্মে স্বেচ্ছানশন পালনকে আত্মনিয়ন্ত্রণের একটা পদ্ধতি হিসেবে ধরা হয়। গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের দুপুরের পর কোনও খাদ্য গ্রহণ না করতে পরামর্শ দিতেন। প্রাথমিক অবস্থায় উপবাস আত্ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণ শেখায়। আমরা যদি একবেলা আহার গ্রহণ না করি, তবে আমরা বেঁচেযাওয়া খাবারটি যারা অর্থের অভাবে খেতে পায় না বা ঠিকমতো খেতে পায় না তাদের দিয়ে দিতে পারি। লিও তলস্তয় লিখেছেন, “একটা সুন্দর জীবন গঠন করতে চাইলে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ শিখতে হবে, আর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ শেখার প্রাথমিক ধাপই হল স্বেচ্ছানশন পালন।” সকল ইন্দ্রিয়বৃত্তিকে রুদ্ধ করে রাখার দীর্ঘচর্চার মাধ্যমে যুগে যুগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা অবিশ্বাস্য মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। গৌতম বুদ্ধ মন থেকে সকল আকাঙ্ক্ষা দূর করার ব্রতে দিনের পর দিন কঠোর উপবাস পালন করতে শুরু করেছিলেন। তিনি দেখলেন, এতে করে শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছে, তিনি তার পাকস্থলীতে হাত দিলে পেছনের মেরুদণ্ড স্পর্শ করা যাচ্ছে, মনের আকাঙ্ক্ষা কমে যাচ্ছে, তবে তা পুরোপুরি দূর হচ্ছে না। তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, আত্মজ্ঞান অর্জনের উপায় হচ্ছে অতিআহার ও অতিউপবাস, এই দুই থেকে নিজেকে মুক্ত করা। মনের শক্তি কখনও সহজ পথে বৃদ্ধি পায় না, কঠিন ও কঠোর পথেই এ শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব। স্বেচ্ছানশনের মাধ্যমে মনের শক্তি বৃদ্ধি পায়, আত্মসম্মানবোধ বাড়ে, প্রকৃতির ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দিকগুলির প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। নিজেকে অসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে নেয়ার দীক্ষা বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের দিতেন। তিনি এক ধরনের সাধনা করতেন যেখানে একটানা সাতদিন প্রতিদিন কেবল একটা কলা খেয়ে কিংবা সাতদিনের যেকোনও দিন একবেলা আহার করে ধ্যান করতে হত। এতে করে তাঁর শরীর শীর্ণ ও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধ বলতেন, যদি দুপুরের পর কেবল পানীয় ছাড়া আর অন্যকিছু খাওয়া না নয়, তবে আমরা অনেক রোগ, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারি, চিন্তা ও ধ্যানের মাধ্যমে নিজেদের মানসিক উৎকর্ষ সাধন করতে পারি।

ইংরেজি ‘fast’ কথাটি এসেছে হিব্রু শব্দ ‘sum’ থেকে, যার অর্থ ‘মুখকে ঢেকে রাখা’, কিংবা গ্রিক শব্দ ‘nesteuo’ থেকে যার অর্থ ‘বিরত থাকা’। খ্রিষ্টান ধর্মে বলা হয়েছে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে উপবাস পালন করলে ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। উপবাসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্থিব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে ঈশ্বরের আরাধনায় নিজেকে নিযুক্ত করা। শুধু খাদ্যই নয়, যেকোনও জিনিসকে যদি সাময়িকভাবে বর্জন করে আমরা ঈশ্বরের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে পারি, সেটাকেও খ্রিষ্টান ধর্মে উপবাস পালন বলা হয়েছে। নিজেকে কষ্ট দেয়া মুখ্য নয়, সে কষ্টের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ অনুভব করাই মুখ্য। অহংকারশূন্য হৃদয়ে দুর্বল ও অসহায়ের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেয়া, দরিদ্রকে সাহায্য করা, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র দেয়া, অন্যকে ক্ষমা করার দীক্ষা গ্রহণ স্বেচ্ছানশনের সময় অবশ্য কর্তব্য। উপবাস পালন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই, আমরা বড়ই ভঙ্গুর, আমাদের অস্তিত্ব পুরোপুরি নির্ভর করে বাহ্যিক বস্তুগত বিভিন্ন অনুষঙ্গের উপর। যিশু খ্রিস্টকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনার অনুসারীরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের তুলনায় কম উপবাস পালন করেন কেন?” তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “করে, কারণ এখনও আমি তাদের সাথে আছি।” এ কথাটির তাৎপর্য অনেক। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা উপবাস পালনের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দেন, কারণ উপবাস পালনের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন তারা তাঁর সান্নিধ্যেই ছিলেন, ফলে উপবাস পালনের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর তাগিদ তারা কখনওই অনুভব করেননি। যিশু বলতেন, প্রার্থনা ও ভালো কাজ করার গুরুত্ব যতোটা, স্বেচ্ছানশনের গুরুত্বও ঠিক ততোটা। স্বেচ্ছানশনের সময় আমরা যতক্ষণ জেগে থাকি, ততক্ষণই আমাদের প্রার্থনা করে, কাজ করে, পড়াশোনা করে কাটানো উচিত। এক লোক গর্ব করে বলেছিলেন, “আমি সপ্তাহে দুইদিন উপবাসব্রত পালন করি।” এই লোকের উপবাসব্রত পালন করার ফল কেবলই শারীরিক, মানসিকভাবে তার কোনও উন্নতি হবে না, কেননা তিনি তার এই ব্যাপারটা নিয়ে গর্ব করেছেন। উপবাসের মূল আত্মিক দর্শনই হল, অহংকারশূন্য হওয়া।

ঈশ্বর যখন আমাদের কোনও প্রার্থনা কবুল করেন না, তখন ভালো হয় যদি আমরা উপবাস পালনের মাধ্যমে প্রার্থনাটি আবার করি। প্রায়ই দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, আমাদের প্রার্থনাটি আদৌ আমাদের জন্য মঙ্গলকর কিনা; কিংবা কী কী করলে আমরা আমাদের অভিপ্রায় পূরণ করতে পারব, সে সব উপায় আমরা জেনে যাই। ফলে তখন আমাদের প্রার্থনাটি হয় বদলে যায় কিংবা আমরা সঠিক কাজের মাধ্যমে আমাদের প্রার্থনাটি পূর্ণ করতে পারি। স্বেচ্ছানশন পালন করার সময় যিশু খুবই চমৎকার একটা প্রার্থনা করতেন। (ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছি, ঠিক এই প্রার্থনাটিই করতে। আমি জানি না, বাবার প্রার্থনার ধরন কী করে যিশুর প্রার্থনার ধরনের সাথে মিলে গিয়েছিল।) প্রার্থনাটি হল: “হে ঈশ্বর! তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। তুমি তোমার ইচ্ছাই পূরণ কর। এতেই আমার ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে। এর বাইরে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।” খ্রিষ্টান ধর্মে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের আশায় উপবাস পালনের উদাহরণ আছে। ধর্মীয় কারণে হোক না হোক, মানবিক কারণেও যদি আমি যে খাবারটি খাই, তার অর্ধেকটা খেয়ে বাকি অর্ধেকটা কোনও অভুক্ত গরীব মানুষের সাথে ভাগাভাগি করি, তবে আমার খাওয়ার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এতে শারীরিক ও মানসিক দুই প্রকারের পরিতৃপ্তিই আসে। যদি ভাগ করে খাওয়া সম্ভব না হয়, তবে অর্ধেক খাবারের বাড়তি টাকাটা যদি কোনও নিরন্ন মানুষকে দিয়ে দিই, তবে ক্ষুধা নিবৃত্তির সাথে-সাথে আমাদের আত্মিক উন্নয়নও সম্ভব। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের যতটুকু খাবার প্রয়োজন, তার কমপক্ষে দ্বিগুণ খাবার আমরা গ্রহণ করি। যদি অর্ধেক খাবার কারও সাথে শেয়ার করে খাই, তবে বাড়তি খাবার আমাদের শরীরে যে ব্যাধি সৃষ্টি করে, তার হাত থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব।

স্বেচ্ছানশনের নিয়মিত চর্চায় আমরা আমাদের নিজেদের পাপ ও দোষত্রুটি থেকে দূরে রাখতে পারি। আমাদের দুর্বল দিকগুলি যখন আমাদের সামনে এসে যায়, তখন আমরা সেগুলিকে শক্তিতে পরিণত করতে পারি। আমরা আরও সহনশীল, নিরহংকার, কম স্বার্থপর, এবং অন্যদের চাহিদার প্রতিও মনোযোগী হয়ে উঠি। স্বেচ্ছানশন আমাদের কুৎসা রটনা ও সমালোচনা থেকে দূরে রাখে। স্বেচ্ছানশনের জন্য যতোটা শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন তার চাইতে বেশি প্রয়োজন মানসিক সক্ষমতা। অতীত পাপের জন্য অনুশোচনা ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে মনের শক্তি ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। যখন আমাদের মন আমাদের কথামতো চলতে শুরু করে, তখন আমাদের কাজগুলি সুন্দর হয়ে ওঠে। মন আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকার অর্থই হল, আমরা যতোটা খুশি যেভাবে খুশি যখন খুশি আমাদের কাজগুলি করতে পারব। এর চাইতে বড় সৌভাগ্য আর হয় না। স্বেচ্ছানশনের সময় আমরা আমাদের বদভ্যাসগুলি একেবারেই বাদ দিয়ে দিতে পারি, এর জন্য নিজের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। যে ব্যক্তি দিনের ১৪-১৬ ঘণ্টা ধূমপান না করে থাকতে পারে, সে বাকি ৮-১০ ঘণ্টাও ধূমপান না করে নিশ্চয়ই থাকতে পারে। এভাবে করে স্বেচ্ছানশনের মাধ্যমে যেকোনও বদভ্যাস থেকেই আমরা নিজেদের সরিয়ে আনতে পারি।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ৫৬তম পরিচ্ছেদে স্বেচ্ছানশন সম্পর্কে বলা হয়েছে।

যুধিষ্ঠির জানতে চাইছেন, আমরা দেখছি অনেকেই উপবাসব্রত পালন করছেন। শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দেরই এই ব্রত পালন করার অধিকারের কথা আমরা শুনেছি। তবে কি অন্য সকলেও এই ব্রত পালন করতে পারে? এই ব্রত পালন করতে কী হয়? বলা হয়, এর উপকারিতা অনেক। সেগুলি কী কী? কীভাবে উপবাস আমাদের মন থেকে পাপ দূর করে দেয়? কীভাবে উপবাস আমাদের ন্যায়ের পথে নিয়ে আসে? ব্রত পালন করার সময়ে আমাদের কী কী ত্যাগ করা উচিত?

ভীষ্ম বললেন, আমরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই উপবাসের উপকারিতার কথা শুনে আসছি। তবু আমি এই ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার করে বলতে ঋষি অঙ্গিরসকে অনুরোধ করছি।

ঋষি অঙ্গিরস উত্তর করলেন, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের জন্য ৩ রাত্রি উপবাসের বিধান আছে। বৈশ্য ও শূদ্ররাও এমন উপবাস পালন করতে পারেন, তবে এর মাধ্যমে তাদের জাতগত উত্তরণ অসম্ভব। উপবাস পালন করার সময় যার যেটা কাজ, সেটা ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এরপর তিনি চন্দ্রের বিভিন্ন অবস্থানের উপর ভিত্তি করে যে তিথিগুলি নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলিতে উপবাস ব্রত পালন করার উপকার নিয়ে বলেন। এছাড়াও বিভিন্ন বাংলা মাসে প্রতিদিনই শুধু একবেলা আহার করলে কোন মাসে ঈশ্বরের কোন আশীর্বাদ পাওয়া যায়, সেটা নিয়েও বলেন। তিনি আরও বলেন, বেদের চাইতে উত্তম শাস্ত্র নেই, মায়ের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই, ন্যায়পরায়ণতার চাইতে বড় অর্জন নেই, উপবাসের চাইতে বড় ব্রত নেই। মুনিঋষিরা অবিশ্বাস্য শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন উপবাস পালন করার মাধ্যমেই, যে এই ব্রত পালন করে তার মধ্যে জ্ঞানের চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত হয়।

বিবাহিতা ও অবিবাহিতা মহিলারা বিভিন্ন অভিলাষ পূরণের জন্য বিভিন্ন দেবদেবীর (গণেশ, শিব, কার্ত্তিক, পার্বতী, সন্তোষী, কালী ইত্যাদি) উপাসনা করেন ও উপবাস ব্রত পালন করেন। উপবাস পালন করার সময় দৈনন্দিন কাজে কোনও বিঘ্ন ঘটানো যাবে না, অন্যদের কোনও কাজে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না, উপবাস পালন করা নিয়ে বিন্দুমাত্রও অহংকার প্রদর্শন নিষেধ, বাড়তি আনুকূল্য বা সুবিধা দাবি করা যাবে না। প্রথম চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর মাকে একাদশী পালন করার জন্য অনুরোধ করেন। এর আগে একাদশী পালন করতেন সেসব নারী যাঁদের স্বামী নেই, এবং এটি পালন করাকে এক ধরনের শাস্তি হিসেবে গণ্য করা হত। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে মহাপ্রভুর ভক্তদের মধ্যে এ নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। মন্দিরে অনেক বেশি পরিমাণে প্রসাদ রান্না করা হত। যদি সবাই একাদশী উপবাসব্রত পালন করে, তবে তো প্রসাদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু বললেন, “আমরা উপবাস পালন করার সময়ে প্রসাদের প্রতি দণ্ডবৎ প্রণাম করে সম্মান দেখাব। এরপর ব্রত সমাপ্তান্তে সেই প্রসাদ গ্রহণ করব।” একাদশী অনেকেই পালন করেন, তবে অন্ধভাবে, এটি সম্পর্কে না জেনে। সুখের বিষয়, এর মাহাত্ম্য না জেনে পালন করলেও এর আত্মিক ও শারীরিক ফল ঠিকই পাওয়া যায়। একাদশী মানে চান্দ্র পঞ্জিকার প্রতি অর্ধমাসের ১১তম দিবস। সে হিসেবে প্রতি মাসে ২টা করে একাদশী পালন করা হয়। প্রথমটি শুক্লপক্ষে, দ্বিতীয়টি কৃষ্ণপক্ষে। আমাদের শরীর ও মনের উপর চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব বিবেচনা করে ধর্মে এই দুইটি দিনকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। শরীর ও মনের সুস্থতার উপর একাদশীর প্রভাব বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেও প্রমাণিত। উপবাস আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন সাধন করে। সহজ মার্গ পদ্ধতিতে যারা ধ্যান করতেন, তারা একাদশী পালনের অনেক দিবস নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যেগুলির মধ্যে একটি ছিল, যেদিন গুরু তাঁর শিষ্যদের শিক্ষাদান করবেন, সেদিন। কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তপ্রদান কিংবা জ্ঞানচর্চা করার সময়ও উপবাসব্রত পালনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে অনেক উপবাস পুরোপুরি নির্জলা পালন করা হলেও একাদশী পালন করা হয় সামান্য জলফল গ্রহণ করে কিংবা নির্জলা। নির্জলা অর্থ, কিছুই না খেয়ে, এমনকি জলপান না করে উপবাসব্রত পালন করা। নিয়মিত একাদশী পালন করলে শরীরে ইনসুলিনের ভারসাম্য ঠিক থাকে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে, দীর্ঘায়ু হওয়া যায়। একাদশী পালন দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তি দেয়। শরীর পরিষ্কার হয়, রক্তের দূষিত পদার্থ দূর হয়, কিডনি ও লিভারের কার্যকারিতা ঠিক থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান যা এখন গবেষণা করে উদ্ভাবন করেছে, আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বেই তা প্রাজ্ঞ বৈদিক ঋষিগণ আবিষ্কার করেছিলেন।

Edgar Ziegler তাঁর “Does the moon control your moods” শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, আমাদের শরীরে ও মনে চাঁদের হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব খুবই প্রকট। ভরা পূর্ণিমায় কিংবা গাঢ় অমাবস্যায় শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা দুর্বল মনস্তত্বের লোকেরা বেশি দুর্ভোগ পোহায়। Miami Police Department-এর এক রিপোর্টে দেখা গেছে, এ সময় শহরে খুনের সংখ্যাও বেড়ে যায়। পুলিশ এ সময় বাড়তি সতর্ক অবস্থান নেয়। স্থানীয় চার্চ শহরের অধিবাসীদের উক্ত দুইদিন উপবাস পালনের পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ উপবাস মানুষের মন ও শরীরকে সংযত করে, অপরাধ প্রবণতা কমায়। স্নায়ুবিজ্ঞানী Arnold Lieber-র গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে আমরা জানতে পেরেছি, একাদশী যদি নির্জলা পালন করা হয়, তবে পাকস্থলীতে কোনও খাদ্য বা পানি না থাকায় চান্দ্র আকর্ষণ উপবাসীদের কিডনি, লিভার, অন্ত্রাশয়ের উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না, ফলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও গ্লান্ডে হরমোনের সুস্থিতি বজায় থাকে। প্রতি মাসে দুইদিন সম্পূর্ণ নির্জলা একাদশী উপবাস পালনের ফলে বিষণ্ণতা, অস্থিরতা, নিদ্রাহীনতা, উচ্চ হৃদকম্পন, উচ্চ রক্তচাপ সহ নানাবিধ রোগ সেরে যায়। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ ঠিকভাবে কাজ করে, অকেজো ও পুরনো কোষের মৃত্যু হয়ে সজীব কোষের জন্ম হয়। সবচাইতে ভালো ফলাফল পেতে চাইলে পূর্ণিমার আগে (একাদশী) ও পূর্ণিমার দিনে; অমাবস্যার আগে (একাদশী) ও অমাবস্যার দিনে নির্জলা উপবাসব্রত পালন করা বিজ্ঞানসম্মত। মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এর ভূমিকা অসীম। একাদশীর সময় ক্রোধ, বিরক্তি, যৌনক্রিয়া, লোভ, শঠতা, অনিষ্টচিন্তা, অন্যায়, মিথ্যা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। উপবাসের মূল দর্শনই হল, নিজেকে ঈশ্বরচিন্তা, মানবকল্যাণ, সুন্দর কাজ, সংযত আচরণ ও কথার মধ্যে রাখা। এ সময় ভালো বই পড়লে, ভালো চিন্তা করলে, মানুষের সেবামূলক কাজ করলে আত্মা পরিশুদ্ধি লাভ করে।

উপবাস পালনের রীতি শিখ ধর্ম বাদে অন্য সকল ধর্মে থাকলেও এর আচরণপ্রথায় পার্থক্য রয়েছে। জৈন ধর্মের মূলভিত্তি হল অহিংসা। উপবাস পালনের সময় জৈন ধর্মের অনুসারীরা আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অহিংসার চর্চা করেন। শরীর ও মনের চাইতে আত্মার অবস্থান অনেক উপরে। সেই আত্মার উদ্বোধনই জৈন উপবাস তপস্যার মূলকথা। জৈনরা বিশ্বাস করে, তপস্যা করার সময়টাতে আমরা যে অন্য কাজটি করতে পারতাম (খাওয়া, রান্না করা, বাজার করা, ইত্যাদি) সে কাজটি করার সময়টা বেঁচে যায়। ওই বেঁচেযাওয়া বাড়তি সময়ে ধর্মগ্রন্থ ও অন্যান্য ভালো বই পাঠ, ধ্যান, আত্মউন্নয়ন, মানবসেবা, কিংবা অনুরূপ কোনও কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতে হবে। উপোস থেকে সারাদিন বিরক্তি ও ক্ষুধা নিয়ে ভাববার চাইতে উপবাস পালন না করাই ভালো। জৈন ধর্মে উপবাস পালনের সময় মৌন থাকার কথাও বলা হয়েছে। জৈন ধর্মে যে বিভিন্ন ধরনের উপবাস-অনুশাসনের কথা বলা আছে, সেগুলি নিয়ে বলছি:

দুইরাত একদিন (প্রায় ৩৬ ঘণ্টা) শুধু পানি গ্রহণ করে উপবাস পালন করতে হয়। চৌবিহার উপবাসের ক্ষেত্রে পানিও গ্রহণ করা যায় না। কোনওরূপ মসলা ব্যবহার না করে প্রস্তুতকৃত খাদ্য দিনে একবার গ্রহণ করে উপবাস পালন করাকে বলা হয় অ্যামবিল। একাসনা উপবাসে দৈনিক একবেলা খাওয়া যায়। সান্থারা উপবাসে আমৃত্যু উপবাস পালন করতে হয়। সান্থারা উপবাস জৈন ধর্মের খুব গোঁড়া মৌলবাদী কিছু অনুসারী ব্যতীত বাকিরা সমর্থন করেন না। পর্যুসনা উপবাসে আট দিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস পালন করতে হয়। এসময় আত্মনিরীক্ষণ, ধর্মীয় পুস্তকাদি পাঠ ও ক্ষমাশীলতার চর্চা করতে হয়। অতীত কাজের জন্য অনুশোচনা করে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। তবে জৈন ধর্মে উপবাস পালনের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এটা যার-যার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা। তারা বিশ্বাস করেন, যে যার কর্মফল অনুযায়ী পুরস্কৃত হবে কিংবা শাস্তিভোগ করবে। কারও উপর কোনওকিছু চাপিয়ে দেয়ার কোনও মানে নেই। জৈনরা বিশ্বাস করেন, যদি কাউকে কোনও ধর্মীয় আচার পালন করতে বাধ্য করা হয়, তবে এতে কোনও আত্মিক ফললাভ হয় না। তাছাড়া আত্মিক উন্নয়নসাধনের জন্য অন্য অনেক পন্থাই আছে, উপবাস পালন করার মাধ্যমেই তা করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। এমন উদার ধর্মদর্শন জৈনদের মধ্যে সহিষ্ণুতা বাড়িয়ে দিয়েছে। জৈনসমাজে দেখা যায়, যারা উপবাস পালন করতে পারেন না, তারা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে আংশিক উপবাস পালন করেন, অর্থাৎ কিছু-কিছু খাদ্য গ্রহণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখেন।

একবার এক শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, কঠোর ব্রত পালনের মাধ্যমে আত্মা কী লাভ করে?” মহাবীর ভগন্ত উত্তর দিলেন, “ব্রতের মাধ্যমে আমাদের আত্মা অতীতের সকল কর্মকে মুছে দেয়, এবং বিশুদ্ধতা লাভ করে। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ তপস্যার ফলস্বরূপ মানুষ নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে, নৈতিকভাবে ও মানসিকভাবে উন্নত করতে পারে।” জৈন উপবাসের মূলকথাই হল আত্মার সাথে কর্মের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, অর্থাৎ নিজেকে বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে আত্মাকে শক্তিশালী ও পবিত্র করা। Tattvarthasutra-তে বলা হয়েছে, “কঠোর ব্রত পালন শরীরকে অকালে জরাগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।” সকল প্রকারের জাগতিক লোভলালসা ও কামনাবাসনা থেকে নিজেকে ও নিজের ভাবনাকে দূরে রাখাই উপবাস ব্রত পালনের মূল দর্শন। উপবাসের পুরো প্রক্রিয়াটি যতোটা শারীরিক ততোধিক মানসিক। উপবাস মানেই নিজের আত্মার ঘরে বাস করা। শুধু না খেলেই হবে না, খাওয়ার ইচ্ছেটাকেও দূরে রাখতে হবে। সারাক্ষণই খাওয়ার ইচ্ছেকে জিইয়ে রেখে উপবাসের সাধনা হয় না। জৈনরা এমনটাই বিশ্বাস করেন। উপবাসের ফলে আত্মিক পরিশোধন, বোধন ও বৃদ্ধি সাধিত হয়। ক্রোধ, লোভ, প্রতারণা ও অহংকার থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্যই উপবাসের সৃষ্টি। আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে নিজের মন ও দেহের উপর এক ধরনের আধিপত্য স্থাপিত হয়।

যখন কেউ না খেয়ে থাকে, তখন তার পরিপাকযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যায়, কারণ পরিপাক করার মতো কোনওকিছু তো নেই। শরীরের মধ্যে সকল শক্তি সঞ্চিত অবস্থায় থাকে। এ শক্তি শরীর মেরামত করতে ও রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ব্যয়িত হয়। আমাদের শরীর তার নিজের মধ্যে গ্লুকোজ জমা করে রাখে যাতে না খেয়ে থাকার সময়টাতে আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল থাকে। যদি আমরা দিনে তিনবেলা করে খাদ্য গ্রহণ করি, তবে সে বাড়তি গ্লুকোজকে পোড়ানোর কোনও সুযোগ আমাদের অভ্যন্তরীণ পেশীসমূহ পায় না। ফলে বাড়তি গ্লুকোজ বাড়তি ঝামেলার সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা ও ধার্মিকরা অন্তত এক জায়গায় একমত, তা হল—উপবাস উপকারী। আয়ুর্বেদ বলে, গৃহীত খাদ্য ঠিকমতো পরিপাক না হওয়ায় ও বাড়তি খাদ্য গ্রহণ করায় আমাদের দেহে অধিবিষ বা টক্সিনের জন্ম হয়। এই টক্সিন রক্তের সাথে মিশে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পৌঁছে যায়। তখন সেসব অঙ্গে বিবিধ রোগের সৃষ্টি হয়। শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় অন্ত্র, তবে আমরা যদি খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত না থাকি, তবে সে খাদ্যকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জারিত করার কাজে অন্ত্র সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকে, ফলে টক্সিন বের করে দেয়ার সময়টুকু তার আর হয়ে ওঠে না। গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস মনে করেন, রোগের প্রাথমিক প্রতিবিধানের একটি হল উপবাস ব্রতপালন। যোগীদের দেখে কেন তাদের বয়স বোঝা যায় না? কেন তাদের শরীরে রোগশোক কম আক্রমণ করে? একটাই কারণ, খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ। বিখ্যাত পুষ্টিবিদ Marc Hellersteing গবেষণা করে দেখিয়েছেন, শরীরে বয়সের প্রভাব ও ছাপ কমাতে উপবাস খুবই উপকারী। উপবাসের ফলে শরীরের ত্বক সুন্দর হয়, চোখের দৃষ্টিশক্তি বাড়ে। Jens Kjeldsen-Kragh এর নেতৃত্বে একদল নরওজিয়ান গবেষক প্রমাণ করেছেন, ৭ থেকে ১০ দিন উপবাস পালন করলে বাতের প্রকোপ কমে যায়, তবে এসময় শুধু নিরামিষ খেতে হবে। বিভিন্ন মেয়াদি উপবাসের ফলে বাতজনিত ব্যাধি, উচ্চ রক্তচাপ, দুরারোগ্য শারীরিক প্রদাহ হ্রাস পায়।

ইহুদিধর্মমতে বিভিন্ন উপলক্ষে উপবাস পালন করা হয়:

অনুশোচনা; যেমন Yom Kippur

শোকপ্রকাশ; যেমন Tisha b’Av

স্মরণ; যেমন Ta’anit Esther

প্রার্থনা; যেমন খরা কাটানোর জন্য গণ-উপবাস

ধন্যবাদজ্ঞাপন; যেমন প্রথম সন্তানের জন্মগ্রহণ উপলক্ষে উপবাস

এছাড়াও আরও অনেক কারণেই উপবাস পালন করা হয়। ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, উপবাস পালনের মাধ্যমে তারা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন, তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ Torah এবং ইহুদি আইনবিধির প্রতি শ্রদ্ধা দেখান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে ওঠে, ইহুদি পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। উপবাস পালন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিষ্ঠা, অঙ্গীকার, ধর্মানুরাগ প্রতিষ্ঠিত করে। তবে বিভিন্ন ইহুদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একেক উপবাস পালনের তাৎপর্য একেক মাত্রার। উপবাস পালনের সময়কার পোশাকপরিচ্ছদ সম্পর্কেও নির্দেশনা দেয়া আছে। ইহুদিধর্মে Tisha b’Av ব্যতীত অন্যান্য উপবাস পালনের উপর কোনও বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। উপবাস পালনের সময় উষ্ণ জলে স্নান করা নিষেধ (তবে পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে ঈষৎ উষ্ণ জলে স্নান করা যেতে পারে), চুল কাটানো নিষেধ, আনন্দের সংগীত শোনা বারণ, নাচগানের পার্টিতে অংশগ্রহণ করা যাবে না, যা কিছু আমাদের সুখী ও খুশি করে তা কিছু কেনা যাবে না, কারও প্রতি ঔদ্ধত্য দেখানো যাবে না। যারা উপবাস পালন করছেন না তাদের প্রতি কোনওরূপ অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা ইহুদিধর্মে কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে। ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, উপবাস পালনের মাধ্যমে তাদের জাতিগত দুর্ভোগ দূর করে শান্তি আনা সম্ভব। ইহুদি ধর্মমতে উপবাস অর্থ সকল প্রকারের খাদ্য ও পানীয় থেকে পূর্ণ বিরতি। পূর্ণদিবস উপবাস হল, আগের দিন সূর্যাস্ত থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। এ উপবাসের পাশাপাশি কিছু গৌণ উপবাস আছে যেখানে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি উপবাস পালন করতে হয়। ইহুদিরা ব্যক্তিগত কারণে ও সম্প্রদায়ের মঙ্গলার্থে উপবাস করে থাকেন। ব্যক্তিগত উপবাস করা হয় পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। বিয়ের দিন বরকনে উপবাস করেন তাদের বিয়েটাকে পবিত্র করার জন্য। পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকদের মৃত্যুদিবসে (yahrzeit) শোকপালন করতেও উপবাস করা হয়। উপবাসের দিন পুরনো পাপকর্মের জন্য অনুতাপ করা হয়, ক্ষমা চাওয়া হয়। ইহুদিধর্মে সবচাইতে বিখ্যাত দিন হচ্ছে Yom Kippur, যেটাকে বলা হয় প্রায়শ্চিত্তের দিন। ইহুদি ধর্মমতে ওই দিন নিজেকে কষ্ট দেয়ার দিন। সেদিন খাওয়া, পান করা, গোসল করা, কোনওকিছু ধোয়া, যৌনকর্ম করা, চামড়ার বস্ত্র পরিধান করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। নিজের সকল অন্যায় অপরাধ স্বীকার করে অনুশোচনার মধ্য দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করে দিতে হয়। এতে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, আত্মিক উন্নতি ঘটে, কষ্টসহ্য করার ক্ষমতা বাড়ে, খারাপ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমালাভ করা যায়, আত্মমূল্যায়ন ও আত্মদর্শন প্রক্রিয়া সহজ হয়। উপবাস পালনকালে ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ করার বিধান আছে। Yom Kippur সকল প্রকারের খাদ্য ও পানীয় থেকে ২৪ ঘণ্টার বিরতি। এ সময় প্রার্থনা ও জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়। উপবাস ব্যক্তির ও সম্প্রদায়ের ক্ষালন প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত।

এখন দেখা যাক, শিখধর্মে উপবাস নিয়ে কী বলা হয়েছে। বিশ্বধর্মে শিখ মতবাদই বোধহয় একমাত্র মতবাদ যেখানে কেবল চিকিৎসার প্রয়োজনে ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রে উপবাস পালনকে উৎসাহিত করা হয়নি। শিখ গুরুরা বলেন, “উপবাসের বিন্দুমাত্রও আত্মিকলাভ নেই। না খেয়ে আত্মাকে কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে আত্মাকে উন্নত করা যায় না।” শিখদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রী গুরু গ্রন্থসাহেব আমাদের বলছেন, “যে খাদ্য গ্রহণ করে না, সে মূলত নিজেকে কষ্ট দেয়। আত্মিক উন্নতি করতে হলে গুরুর কাছ থেকে প্রকৃত জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে। নিজের আত্মাকে সন্তুষ্ট কর, সকল জীবের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। ওতেই হবে। আমাদের উপবাস পালন করতে হবে না; গুরু বাক্য মেনে চললে আর জীবের সেবা করলে এমনিতেই সৃষ্টিকর্তার কৃপালাভ করা যাবে। মাসের নবম দিনে একটাও মিথ্যা না বলার শপথ নাও, এতে তোমার যৌন আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ আর কামনা অনেকটাই কমে যাবে। দশম দিনে তোমার সকল রিপুকে সংযত করে রাখ। একাদশ দিনে সৃষ্টিকর্তার একক রূপকে উপাসনা কর। দ্বাদশ দিনে তোমার মন ও হৃদয়ের সকল যন্ত্রণা দূর হয়ে যাবে। তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে তোমার নিজের বশীভূত করে রাখ, তবেই আত্মিক আনন্দলাভ করা যাবে। লোকে যে শস্য ফলায়, সে শস্য থেকে সাময়িকভাবে নিজেকে দূরে রাখা মানেই ভণ্ডামি করা। ঈশ্বর যা দিয়েছেন আমাদের ভোগের জন্য, তাকে আমরা পরিমিত পরিমাণে ভোগ করব, যারা ভোগ করতে পারছে না, তাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেব, এতেই মঙ্গল নিহিত; তা থেকে নিজেকে জোর করে দূরে রেখে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করা যাবে না। ঈশ্বরের জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। যে পাথরের মূর্তির সামনে বসে কাঁদছ, ওটাকে নৈবেদ্য নিবেদন করছ, সে পাথর তোমাকে কী দেবে? এর চাইতে বরং একজন প্রকৃত জ্ঞানী সদ্গুরুর খোঁজ করো। ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন, তোমার হৃদয়ের ভেতরেই তাঁকে খুঁজে পাবে। তাঁর কাছে পৌঁছানোর রাস্তাটা তোমাকে বলে দিতে পারেন একজন সঠিক গুরু।” কিছু শিখ গুরুর বাণী পড়া যাক। ভাই গুরুদাস জি বলেছেন, “একাদশীতে উপবাস কিংবা মূর্তিপূজা করে মানুষ নিজেকে মায়ায় জড়িয়ে রাখে। গুরুর বাক্য অনুসরণ করা ছাড়া সর্বোত্তম সাধুসঙ্গও আত্মিক মুক্তি দিতে পারে না।” রেহাত্নামা ভাই দয়া সিং জি মনে করেন, “যে লোক গুরুকে অনুসরণ করে, সে কখনওই একাদশীতে উপবাস করে না।” প্রেম সুমরাগ সুন্দর একটা ভাবনা প্রকাশ করেছেন এই ভাবে: “শিখ ধর্মের অনুসারীরা এ ধরনের উপবাস করুক—অন্য নারীর দিকে কুদৃষ্টি দিয়ো না, তোমার হৃদয় যেন মিথ্যা না ভাবে, জিভ যেন মিথ্যা না বলে, খারাপ কাজের দিকে তোমার পা দুটো যেন না এগোয়।” শিখরা বিশ্বাস করেন, মানুষের মনের যা দরকার, তা হল জ্ঞান। এ জ্ঞান মহৎ মানুষ ও মহৎ গ্রন্থের বানীসমূহ অনুধ্যান করার মধ্য দিয়ে অর্জন করা যায়, এর জন্য নিজেকে উপবাসের মাধ্যমে অত্যাচার করা নিরর্থক। গুরু গ্রন্থসাহেবে বলা হয়েছে, “আমি কোনও ধরনের উপবাস ব্রত পালন করি না, আমি রমজান মাসেও রোজা রাখি না। আমি শুধু তাঁরই সেবা করি, যিনি আমাকে জীবনের শেষ দিবসে রক্ষা করবেন।” যদি উপবাস পালন করতে চান, তবে আপনার প্রতিদিনের কাজ ও অঙ্গীকারগুলিকে শুদ্ধ রাখুন, সৎ আন্তরিক উপায়ে কাজ করুন, আপনার কামনাবাসনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখুন, আপনার অবস্থান থেকে মানুষের মঙ্গল কীভাবে করা যায় সেটা উপলব্ধি করতে ধ্যান করুন, নিজেকে ষড়রিপুর হাত থেকে বাঁচিয়ে চলুন। এটাই সর্বোৎকৃষ্ট উপবাস। না খেয়ে তৃষ্ণা না মিটিয়ে নিজের আত্মাকে কষ্ট দিয়ে জীব ও জগতের কোনও ধরনের মঙ্গলসাধন করা অসম্ভব। শিখরা এমনটাই বিশ্বাস করেন।

চীনের সবচাইতে জনপ্রিয় দর্শন তাওইজম উপবাস পালনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। শরীরকে পরিষ্কার ও আত্মাকে পবিত্র রাখতে আপনার ধর্মীয় আচারের মধ্যে উপবাস পালনকে অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে—তাওইজম এমনটা বিশ্বাস করে। প্রাচীন চীনে বহুকাল পূর্বেও উপবাস পালনের বিধান ছিল। The Book of Changes দাবি করে, উপবাস হচ্ছে অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে নিবারণমূলক ব্যবস্থা এবং নিজেকে পুরোপুরি সংশোধন করার একটি রাস্তা। Mencius বইতে লেখা আছে, এমনকি একজন দুর্জনও যতক্ষণ উপবাস পালন করেন, ততক্ষণ সে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকে। Book of Rites-এর বিভিন্ন পরিচ্ছেদে উপবাস পালনের গুরুত্ব নিয়ে বলা হয়েছে। সেখানে আছে, “উপবাসের সময় আমরা আত্মা ও প্রেতাত্মার সাথে নিজেদের একীভূত করি। এ সময় আমরা সকল অশুভ শক্তির হাত থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি এবং কামনা ও অহেতুক শখ পূরণের প্রবৃত্তি থেকে সরে আসি। ভালো হয়, যদি সে সময় আমরা কোনও গান না শুনি, কোনকিছু নিয়ে নিজেদের উদ্বিগ্ন করে না রাখি। এদিকওদিক ভ্রমণ না করে এক জায়গায় বসে নিবিষ্ট হৃদয়ে প্রার্থনা করলে উপবাসের ফললাভ হয়।” প্রায় ২৪ শতাব্দী প্রাচীন তাওইজম বলে, “তাও শিখতে হলে প্রথমেই উপবাস পালন করতে হবে। এভাবে আপনি আপনার দেহকে বাহ্যিকভাবে পরিষ্কার রাখতে পারবেন এবং নিজের মনকে অভ্যন্তরীণভাবে শূন্য ও আদিম অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবেন। ক্রমশ আপনি ও তাও একই সত্তায় পরিণত হবেন। দীর্ঘ সময় ধরে উপবাস ব্রত পালন করলে আপনি খুব চমৎকারভাবে কোনও বিধান লঙ্ঘন না করেই তাওইজমের সাথে নিজের আত্মাকে একীভূত করে ফেলতে সক্ষম হবেন।” কেউ যদি উপবাস পালন করার সময়ে সিদ্ধিকাঠি (এক ধরনের চৈনিক ধর্মীয় ধূপকাঠি বিশেষ) পোড়ায়, এবং ধর্মীয় গ্রন্থাদি সুর করে পাঠ করে, তবে সে অনেক গুণ ও মেধার অধিকারী হয়, ফলে সে অমিত সৌভাগ্য লাভ করে। এ ছাড়াও উপবাস ব্রত পালন করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশ ও দেশের মানুষ রক্ষা পায়, রাষ্ট্রের বিবিধ কল্যাণ হয়, লোকে দুর্ভাগ্যকে এড়াতে পারে। The Collected Annotations of the Book of Salvation-এ এমনটাই বলা হয়েছে। তাওইজম বলে, সাধনার জন্য নিজেকে তৈরি করতে উপবাস জরুরি। তুমি কী বলছ, তা নিয়ে সতর্ক হও। তুমি কী করছ, তা সম্পর্কে বিচক্ষণ হও যাতে ভুল না করো। বিখ্যাত চৈনিক পণ্ডিত Zhang Yuchu তাঁর Ten Daoist Commandments বইতে লিখেছেন, “যে ব্যক্তি তাও চর্চা করতে চায়, তাকে অবশ্যই পরিচ্ছন্ন দেহ ও পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হওয়ার লক্ষ্যে উপবাস পালন করতে হবে, তাওইজিমের বইগুলি পড়তে হবে এবং বইয়ের শিক্ষা হৃদয়ে সবসময়ই ধারণ করতে হবে। এর মাধ্যমে সে জ্ঞানের উচ্চস্তরে প্রবেশ করবে। যখন কেউ তাওইজমের গ্রন্থসমূহ সরবে পাঠ করে, তখন তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে। পৃথিবী তার জন্য নিরাপদ ও আনন্দময় বাসস্থান হয়ে ওঠে।” সাধারণত তাও মতবাদের অনুসারীরা চান্দ্রমাসের প্রথম ও পঞ্চদশ দিনে উপবাস পালন করেন। সে দুইদিন উপবাসের পর নিরামিষ খেতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান ও তাও মতবাদের গুরুস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের জন্মদিনেও উপবাস পালন করা হয়। যারা চাষাবাদ করেন, তারা ফসল বোনার ও কাটার সময় সৌভাগ্যের আশায় উপবাস পালন করেন। শরীর ও মনকে সুস্থসবল রাখতে তাওইজিম উপবাস পালন করা ও নিরামিষ খাওয়ার পরামর্শ দেয়।

স্বেচ্ছানশনে অনাগ্রহ থাকলে অন্য একটা কাজ করা যায়। প্রতি ৪০ থেকে ৪৮ দিনে অন্তত ৪ দিন আমাদের শরীরে কোনও খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। সে ৪ দিন কিছুই না খেয়ে থাকলে শরীর ভালো থাকে। কুকুর ও বেড়াল কোনও-কোনও দিন কিছুই খায় না। সে দিনগুলিতে হয়তো ওদের খেতে ইচ্ছে করে না। আমাদেরও এমন হয়। খেয়াল করলে দেখব, প্রতি ১১ থেকে ১৪ দিনে একদিন আমাদের খেতে ইচ্ছে করে না। খুব ভালো হয়, সে দিন কিছুই না খেলে। যে দিন আমরা কিছুই খাব না, সে দিন শরীর নিজেকে পরিষ্কার করবে। শরীরে খাদ্য প্রবেশ করলে পরিপাকযন্ত্র সচল হয়ে ওঠে। এতে আমরা যে বাড়তি খাবারটা খাই, সেটা আর বর্জ্য পদার্থ হয়ে জমতে পারে না; প্রয়োজনের তুলনায় বেশি যে ক্যালরি গ্রহণ করি, তা শরীরে যথাযথভাবে সঞ্চিত হতে পারে না। প্রতি দুই সপ্তাহে একদিন সত্যিই কিছু খাওয়ার প্রয়োজন নেই। এতে শরীর সুস্থ থাকে, শরীর বর্জ্য ও দূষিত পদার্থ অপসারণের সুযোগ পায়। শূন্য পাকস্থলী বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধন করে—আধুনিক বিজ্ঞান তা-ই বলে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমি না খেয়ে আছি। আমি ক্লান্ত, ঘুমিয়ে পড়তে পারলে বেঁচে যেতাম। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। জলের তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। না খেয়ে আছি বলে কাজে মন বসাতে পারছি না। না খেয়ে আছি, মাথাটা এমনিতেই গরম, কথাবার্তা হিসেব করে বলুন।—এ জাতীয় দুর্বল অসহায় ভাবনা ও অভিব্যক্তি স্বেচ্ছানশনের শারীরিক ও মানসিক তাৎপর্যকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। স্বেচ্ছানশন ভাঙতে হবে যতোটা না খেলেই নয় ততোটা হাল্কা খাবার গ্রহণ করে। স্বেচ্ছানশন ভঙ্গ মানে সারাদিনের না-খাওয়া পরিমাণ খাবার দিয়ে তৎক্ষণাৎ পাকস্থলী ভর্তি করে ফেলা নয়।

খ্রিষ্টান ধর্মে penance নামে একটা রীতি আছে, যার বাংলা প্রায়শ্চিত্ত। অন্যান্য ধর্মেও এই বিষয়টি সমর্থন করে। প্রায়শ্চিত্ত কী? প্রায়শ্চিত্ত হল, নিজের মধ্যে পুরনো ‘আমি’টাকে সংস্কার কিংবা ধ্বংস করে নতুন ‘আমি’কে প্রতিষ্ঠিত করার একটা প্রক্রিয়া। যে সকল পাপ বা ভুল কাজের কারণে আমি নিজেকে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছি, আমার ঘুমিয়ে-পড়া হৃদয় আমাকে অন্ধ করে রেখেছে, সে সকল পাপ বা ভুল কাজের শাস্তিটা নিজেই নিজেকে দেয়াই হল প্রায়শ্চিত্ত। আমার যা করতে ইচ্ছে করছে, তা-ই যদি করে যাই, তবে আমি কীভাবে আমার বর্তমানটাকে বদলাতে পারব? আমার যা করতে ইচ্ছে করছে না, যা কিছু আমার জন্য কঠোর, তা কিছুকে যদি বরাবরের মতোই এড়িয়ে চলি, তবে প্রকৃতপক্ষে আমি নিজেকে প্রশ্রয় দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছি না। নিজেকে শাস্তি বা কষ্ট না দিলে নিজের পাপ ও ভুলগুলিকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। বর্তমান কষ্ট কমানোর একমাত্র উপায়ই হল বর্তমান কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়া। প্রত্যেক মানুষই নিজেকে ভালোবাসে। তাই নিজেকে কষ্টে রাখতে কেউই চায় না। ফলে আমরা যতো বেশি নিজেকে কষ্টে রাখব, ততো বেশি সে কষ্ট দূর করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হব। এই প্রস্তুতিই আমাদের কাজগুলিকে যথাযথ ও সুন্দর করে। এই মুহূর্তে আমাদের যা করতে ইচ্ছে করছে, তা যদি আমরা নিজেদের করতে না দিই, তবে আমাদের মনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। প্রায়শ্চিত্ত করার উপায়গুলির মধ্যে স্বেচ্ছানশন শ্রেষ্ঠ। কারণ, খাদ্য গ্রহণের কোনও বিকল্প নেই। তা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা খুব সহজ নয়। এ এক কঠোর ইবাদত। কষ্ট ভোগ ব্যতীত কোনও ইবাদত পূর্ণ হয়। যে ইবাদত আয়েশের, সে ইবাদত অসম্পূর্ণ।

পাপ এবং ভুল করার সুখের চাইতে বড় সুখ আর হয় না। এই সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখাও স্বেচ্ছানশনের অন্তর্ভুক্ত। অনশন মানে কেবল দেহকে খাদ্য গ্রহণ থেকে দূরে রাখা নয়, মনকে সুখমুখোশ থেকে দূরে সরিয়ে রাখাও স্বেচ্ছানশন, অর্থাৎ মন যা চায় মনকে তা-ই করতে দেয়া যাবে না, কখনও-কখনও মনকে অনশনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সবসময়ই মনের কথা শুনতেই হবে কেন? আমরা নিজেরা একটা টার্গেট ঠিক করতে পারি। এই যেমন আগামী ১ সপ্তাহ আমি অমুক-অমুক কাজটা করব না। কেমন কাজ? রেগে যাব না, কারও নিন্দা করব না, কাউকে অহেতুক ঘৃণা করব না, কারও সম্পর্কে একটাও বাজে কথা বলব না, কাউকেই জাজ্ করব না, কোনওকিছুতেই হতাশ হব না, কোনওকিছু নিয়ে অভিযোগ করব না, কারও উপর কোনও ব্যাপারেই প্রতিশোধ নেব না, যতোটা খেতে ইচ্ছে করে তার অর্ধেক পরিমাণের বেশি খাব না, কোনও অর্জন নিয়েই অহংকার করব না, যতো ইচ্ছেই করুক ফেসবুকে আসব না, টিভি দেখব না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে মোবাইল ফোনটা হাতে নেব না, সকালে মোবাইলের অ্যালার্মটা বেজে ওঠার পর তা বন্ধ করব না, মদ-সিগারেট ছোঁব না, যা খেতে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি তা খাব না, দামি পোশাক পরব না, গরম লাগলেও ফ্যানটা ছাড়ব না, নরম বিছানায় শোব না। এমন আরও অনেককিছুই জীবন থেকে বাদ দেয়া যায়। এছাড়াও অন্তত এক সপ্তাহ এমন অনেক কাজই করা যায়, যেগুলি কখনও করা হয়ে ওঠে না, তবে করলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। এই যেমন, চকোলেট/ মিষ্টি না খাওয়া, পরিবারকে একটু বেশি সময় দেয়া, মা-বাবা’র পাশে বসে গল্প করা, প্রতিদিন কারও না কারও মন ভালো করে দেয়া, প্রার্থনায় একটু বেশি সময় দেয়া, যে কাজটা অনেকদিন ধরেই ফেলে রেখেছি সে কাজটা শেষ করে ফেলা, ভালো কিছু বই পড়ে ফেলা, প্রতিদিন ৩০ মিনিট মৌন হয়ে থাকা, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেয়া, বেঁধেদেয়া সময়ের আগে কাজ শেষ করা, মনের উন্নয়ন ঘটায় এমন অডিও শোনা, ভিডিও দেখা, বই/ আর্টিকেল পড়া, সারাদিনে কী কী ঘটল তা ঘুমাতে যাওয়ার আগে কাগজে লিখে ফেলা, কারও সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করা, গল্প করার সময় স্বামীকে কথা বলতে দেয়া, স্ত্রী যা বলে তা শোনার আগেই অগ্রাহ্য না করা, প্রতিদিন কী কী করতে হবে তা একটা কাগজে লিখে রাতে শুতে যাওয়ার আগে মিলিয়ে নেয়া কয়টা কাজ শেষ করতে পেরেছি, বাবা-মা পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা অন্য যে কেউই, যার ইতিবাচক প্রভাব আপনার জীবনে আছে, তাকে ফোন করে তার খোঁজখবর নেয়া, খাওয়ার সময় যিনি রেঁধেছেন তাকে ধন্যবাদ দেয়া, এক টুকরোও ফাস্ট ফুড না খাওয়া, প্রতিদিন হাঁটতে যাওয়া কিংবা হাল্কা ব্যায়াম করা, ঘরের টুকিটাকি কাজ নিজেই করে ফেলা, একটাও অশ্লীল/ বাজে শব্দ মুখ দিয়ে বের না করা, বাজে আড্ডা না দেয়া, প্রতিদিনই একটা ভালো বইয়ের অন্তত ৩০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলা, কারও সাথেই উচ্চস্বরে কথা না বলা, কোনও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের লাইফ স্টাইলের ইতিবাচক দিকগুলি অনুসরণ করা, রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে খাবারের পুরোটা না খেয়ে কিছু খাবার প্যাকেটে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় গরীব কাউকে দিয়ে দেয়া, নিজের কাজগুলি কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই করে ফেলা (কাজের বুয়া রাখা মানেই তার বেতনের ‘সমপরিমাণ’ কাজ সুদেআসলে আদায় করে নিতে হবে, এমন নয়। কাজের বুয়া আছে—এই ব্যাপারটার শারীরিক শান্তির চাইতে মানসিক স্বস্তির দিকটা বুঝতে পারলে ওই প্রবণতা অনেকটাই চলে যায়), যারা আমার ক্ষতি করে তাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করা, যারা আমার সাথে বাজে ব্যবহার করে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, কারও মনে কষ্ট দিয়ে কথা না বলা, যতো শারীরিক কষ্টই হোক কাজ শেষ না করে কাজ করা বন্ধ করে না দেয়া। এমন অনেক কাজই করা যায় মানসিক স্বেচ্ছানশনের উপায় হিসেবে।

নিজের উপর রাগ আর অভিমান খুবই কাজের জিনিস। বর্তমানের ‘আমি’কে অসীম কষ্ট দেয়ার মধ্যে ভবিষ্যতের মঙ্গল নিহিত। নিজেকে কষ্ট দেয়া ছাড়া নিজেকে চেনা যায় না। শারীরিক স্বেচ্ছানশনের মূল দর্শন হল, না খেয়ে থাকার কষ্ট যে কী, সেটা না খেয়ে থাকা ছাড়া বোঝা অসম্ভব বিধায় নিজেকে তা বোঝানোর জন্য সেটার মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। মানুষ অন্যের হৃদয়ে ছোরা চালিয়ে আনন্দ পায়। হায়, নিজের হৃদয়ে ছুরি চালিয়ে যে অনির্বচনীয় সুখ পাওয়া যায়, তার খোঁজ ওরা কখনও পেল না। মানুষ খেয়েই মরে। না খেয়ে কেউ অতো মরে না। যদি তা-ই হত, তবে মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ-লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যেত। স্বেচ্ছানশনের সময় সুন্দর-সুন্দর ভাবনা মাথায় আসে। যারা বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক কারণে কষ্টে আছে, তাদের কষ্টটা একটু হলেও মাথায় আসে। কষ্ট অনুভব করা ছাড়া মানুষ হওয়া অসম্ভব। জীবনে কিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভালো। স্বেচ্ছানশন অন্যকে সম্মান করতে শেখায়। অন্য মানুষের প্রতি সম্মানবোধ যত বাড়ে, ততই নিজের ব্যক্তিত্ব উন্নত হয়। এর ফলে আত্মসম্মানবোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এই তিনটি যার মধ্যে যত বেশি, সে তত বেশি শক্তিশালী মানুষ। ধর্মীয় কারণে স্বেচ্ছানশন পালন করেন যারা, তাদের মানসিক শক্তি অনেক-অনেক বেড়ে যায়। মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যায় গায়ের শক্তিতে নয়, মনের শক্তিতে। স্বেচ্ছানশনের ফলে রাগ কমে। কখনও-কখনও অভিমান বাড়ে। ঔদ্ধত্য কমে। উদ্ধত হওয়া মূলত নিজের দুর্বলতাগুলিকে ঢাকার একটা টেকনিক। কোনও ঘিলুহীন বেয়াদব জীবনে কোনও কিছু করতে পেরেছে—আমি আমার জীবনে কখনও এমনটা দেখিনি। প্রতিদিনের কাজকর্মের গুণগত মান বাড়ে। লোকের সাথে ব্যবহার আরও ভালো হয়। উপবাসযাপন মানুষকে সংযত করে। এটার একটা প্রতিফলন প্রতিদিনের কাজেকর্মে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। অন্যের অনুভূতির সাথে একাত্মবোধ তৈরি হয়। ইংরেজিতে এটাকে empathy বলে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের চাওয়া এবং না-চাওয়াগুলি কমবেশি একইরকমের। সবসময়ই খাবার আর পানীয় নিয়ে মেতে থাকলে এটা নিয়ে ভাববার সময় হয় না। মানুষ চেনার সাধনা অন্য যেকোনও সাধনার তুলনায় কঠোর ও মহৎ। নেত্রকোনার বাউল রশিদ উদ্দিনের গানে বড় সুন্দর ভাষায় মানুষের এমন আদর ও কদরের কথা এসেছে:

মানুষ ধর, মানুষ ভজ,

শুন বলি রে পাগল মন

মানুষের ভিতরে মানুষ

করিতেছে বিরাজন।

মানুষ কি আর এমনি বটে,

যার কারণে জগত রটে

ওই যে পঞ্চভূতের ঘাটে,

খেলিতেছে নিরাঞ্জন।

স্বেচ্ছানশন আমাদের সে মহাসাধনার পথে এগোতে সাহায্য করে।