ভাবতে ভাবতে লেখা

১. কেমন ধরনের মানুষ আপনার ভালো লাগে, কারও কী কী ভালো লাগে, এমন নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা, এমনকি অনুমান আপনি করতেই পারেন, কিন্তু সেই ফেইসবুকীয় ভালোলাগা কিংবা মন্দলাগা অনেক সময়ই বাস্তবের সাথে মোটেও মেলে না। মানে, ফেইসবুক দেখে আপনি যদি ধরেও নেন উনি আসলে বাস্তবে এরকম ওরকম, সেসবের তেমন কিছুই প্রকৃত অবস্থার সাথে মিলবে না।




যদি কেউ মদ খাওয়ার খারাপ দিকগুলি নিয়ে বলেন বা লেখেন, কিংবা সারাদিন ওই সম্পর্কিত ভিডিয়ো শেয়ার করতে থাকেন, তার মানে কোনওভাবেই এ নয় যে উনি নিজে মদ্যপান করেন না। কেউ কেউ নিজে মদ্যপান করেন বলেই সেই ব্যাপারটাকে আড়াল করতে এরকম কাজ করেন। আমি নিজে অনেক বাটপারকে দেখেছি ফেইসবুক ওয়ালে সারাক্ষণই ধর্মের বাণী প্রচার করতে। আমার টাকা মেরে দিয়েছে, এমন একজনকে প্রায়ই দেখি নীতিনৈতিকতা নিয়ে ফেইসবুক গরম করে তুলতে। ফেইসবুকে ভণ্ডের কোনও অভাব নেই। ফেইসবুক অ্যাকটিভিটিস দেখে কারও সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে আসা অসম্ভব।




এখনও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এই ফেইসবুক ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়। সত্যিই কিউট! তারা সবচাইতে সিরিয়াসলি নেয়, যারা ফেইসবুকে লেখালেখি করে, তাদেরকে। লেখাগুলিকে সেই ব্যক্তিমানুষের জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলা তো বেশিরভাগেরই স্বভাব! আমি দেখেছি, ফেইসবুকের লেখা দিয়ে এক শ্রেণীর মানুষের মগজ নিয়ে সূক্ষ্মভাবে খেলা যায়। তাদের মগজই যে তাদেরকে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করে খাওয়ানো হয়, সেটা তারা বোঝেই না। তবে, আমার মতে, তাদের মগজ নিয়ে খেলাই উচিত। যারা নিজেদের মগজ অন্যের হাতে তুলে দেয়, তাদের নিয়ে খেলার সুযোগ নেওয়াই উচিত, এবং এটা খুবই স্বাভাবিক।




২. আমরা মুখে মুখে জ্ঞানচর্চা কিংবা প্রকৃত শিক্ষার কথা অনেক বলে থাকি, কিন্তু শেষপর্যন্ত আমরা চেহারা আর বেশভূষাকেই গুরত্ব বেশি দিই। আমরা একটা ছোটো বাচ্চার সামনে যত না জ্ঞান, আদব কিংবা আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিয়ে কথা বলি, তার চেয়ে অনেক বেশি বলি জামাকাপড়ের কথা, বিলাসদ্রব্যের কথা। তাকে ক্রমাগত বোঝাতে থাকি, গায়ের রং ময়লা হলে বিয়ের বাজারে কী একটা বিরাট ঝামেলা কিংবা ক্লিনশেইভের চেয়ে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশি ‘হট’ লাগার ব্যাপারটা। এভাবেই বড়ো করতে করতে একটা বয়সের পরে এসে দেখি, আমার বাচ্চাটাও অন্য অনেকের মতনই ‘হাবিজাবি টাইপের’ হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেরাই তখন বলতে থাকি, আমার বাচ্চা এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন?




আমি নিজে যা আচরণ করি, আমার সন্তানের মধ্যে কোনও-না-কোনওভাবে সেটার প্রভাব পড়বেই। আমি নিজে সারাদিন হ্যান্ডসাম হওয়ার উপায় কিংবা গয়না নিয়ে কথা বললে আমার বাচ্চা তো আর রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন হবে না।




৩. একজন মানুষকে সঠিকভাবে চেনা যায়, সে যখন ক্রুদ্ধ বা ক্ষুধার্ত থাকে, সে সময়ে। খুব কৌশলী মানুষ এ দুই সময়ে বেশ সাবধানী থাকে।




৪. লক্ষ করলাম, এখনকার সবচেয়ে বড়ো সামাজিক ব্যাধি হচ্ছে ‘গিফট’। আপনার প্রিয় বন্ধুকে আপনি কত রকমের আর কত বেশি দামি গিফট দিচ্ছেন, সেটা দিয়ে তার প্রতি আপনার ভালোবাসা মাপা হয়। কিন্তু হতেই পারে প্রিয় মানুষের জন্মদিনের দিন আপনার হাতে কোনও টাকাই নেই। আবার কেউ কেউ তো আত্মীয়ের বিয়েশাদিতে যাবার জন্য নিজের স্বর্ণও বিক্রি করে দেয়! কারণ, বিয়ে কিংবা জন্মদিনের প্রোগ্রামে সবার সামনে গিফট না দেওয়াটা এখন সমাজের চোখে বিরাট এক গর্হিত অপরাধ!




আরে, ভালোবেসে কোনও গিফট তো যেকোনও সময়ই দেওয়া যায়। এর জন্য কোনও উপলক্ষ্য কেন লাগবে? কিংবা কাউকে ভালোবাসি বলেই তাকে গিফট দেবো না---ইচ্ছের এমন স্বাধীনতাটুকু না থাকলে সেখানে ভালোবাসাটাই তো অর্থহীন।




হাতে ওইদিন টাকা না থাকলে অন্য দিন কিছু কিনে দেওয়া নিশ্চয়ই যাবে! কী, যাবে না? উপহারের নামে নিজের আর অন্যের প্রতি এরকম মানসিক অত্যাচার আর কতদিন চলবে? যত বড়ো উপহার, তত বড়ো মানুষ---এই কালচারে বিশ্বাস করে যারা, তাদের মতো নির্বোধ আর হয় না।




কেউ কেউ তো হিসেব করেই অনুষ্ঠান করে যে, এত টাকা খরচ করলে এত টাকা উঠবে। কী অদ্ভুত একটা অসুস্থ চিন্তাধারা! বিশ-পঁচিশ বছর আগে নাকি বিয়ে-জন্মদিনে ভালো ভালো বই (সাধ্যে কুলায় এমন কিছু) গিফট দেওয়ার প্রচলন ছিল। সেই প্রথা আবার ফিরে আসবে, লোকদেখানো ভালোবাসার এরকম আজব প্রকাশের সমাপ্তি ঘটবে, সেই অপেক্ষা শুরু করলাম।




সবচাইতে ভালো হয়, কারও কাছ থেকেই কোনও উপহার প্রত্যাশা না করলে। এরকম প্রত্যাশা মানুষের আত্মসম্মানবোধ ক্রমশ কমিয়ে দেয়। উপহার প্রত্যাশা করে যারা অনুষ্ঠান করে, তাদের সাথে পথের ভিক্ষুকের মনোগত পার্থক্য তেমন নেই।




৫. আমরা বিজ্ঞানের যুগ বলে বাচ্চাকে জোর করে সায়েন্স পড়তে বাধ্য করছি যেন সে একজন স্টিফেন হকিং হতে পারে। অথচ, তার হয়তো রবীন্দ্রনাথ হবারই কথা ছিল। ভালো কথা, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিজ্ঞানচর্চায়ও বেশ দক্ষ ছিলেন। সায়েন্সের সাথে লিটারেচারের কোনও বিরোধ নেই কিন্তু! এটা মাথায় রেখে বাচ্চা মানুষ করতে পারলে আরও ভালো হয়।




৬. ‘রান্না’ এতটাই অসাধারণ শিল্প,...শুনেছি, একে নাকি সিনেমা বানানোর সাথে তুলনা করেছেন অনেকে। অথচ আমরা রান্নার দিকে না তাকিয়ে রান্নার পেছনের মানুষটির ‘লিঙ্গ’ নিয়ে মাথা ঘামাই। সে নারী, না কি পুরুষ, সেটা জানাই যেন বেশি জরুরি হয়ে ওঠে! ভালো রাঁধতে জানা কোনও মানুষ পুরুষ হলে তাকে আমরা বলি ‘পুরুষমানুষ আবার রান্নাঘরে কী করে!’ আর নারী হলে বলি, ‘ওহ্‌, এখনি রান্না শিখে ফেলেছ? পড়াশোনাটা আর তবে তোমায় দিয়ে হবে না!’




অথচ ‘রান্না’ নিজে এত বড়ো একটা শিল্প যে, সে নারীর হাতে তৈরি, না কি পুরুষের হাতে, তা নিয়ে একটা ভালো রান্নার নিজের কিছুই যায় আসে না। রান্নায় লিঙ্গপরিচয় জরুরি না, জরুরি হচ্ছে একজোড়া হাত আর রান্নার প্রতি অসীম ভালোবাসা।




৭. ‘মারা যাবার আগে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চাই।’ এক্সপেকটেশনের ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনও উদাহরণ আমি জানি না। হয়তো যে সন্তানের বিয়েরই আগ্রহ নেই, কিংবা বিয়ে করলেও সন্তান জন্ম দেওয়ার আগ্রহ নেই, সেই সন্তানের ঘাড়েও বাবা-মায়েরা ভালোবাসার দাবির নাম করে এক্সপেকটেশন চাপিয়ে দিয়েছেন, দেন। ওঁরা সন্তানদের যুগে যুগে বিয়ে নামের 'বিষ'টা হজম করতে বাধ্য করে গেছেন। আমাদের বাবা-মাকে তাঁদের বাবা-মায়েরা, তাঁদের বাবা-মাকে আবার তাঁদের বাবা-মায়েরা এই নিয়ম মানতে বাধ্য করে গেছেন যুগের পর যুগ।




অথচ নাতি-নাতনির মুখ না দেখলে কিছুই হয় না, বরং জোর করে মুখ দেখতে চাইলেই যা-কিছু খারাপ, তা-ই হয়। তবে, আশার কথা হচ্ছে, আমাদের প্রজন্ম থেকে এই নাতি-নাতনির এক্সপেকটেশনটা অনেকেই আর জিইয়ে রাখবেন বলে মনে হয় না।




বাবা-মায়ের এক্সপেকটেশন আর সমাজের সামনে ‘উর্বর’ হবার প্রমাণ দেওয়ার আবশ্যকতা না থাকলে, অনেকেই নিঃসন্তান থেকেই কাটিয়ে দিতেন। সন্তান বড়ো করাটা অনেক অর্থ- ও ঝক্কিসাপেক্ষ।




‘কেউ কোনও সমস্যা ছাড়া নিজের ইচ্ছেতে নিঃসন্তান কেন থাকবে!’ এরকম প্রশ্ন যদি আপনার মনে ঘুরপাক খায়, তাহলে আপনার উদ্দেশে কয়েকটা কথা আছে।




এক. বাবা-মা হওয়ার চিন্তা সব মানুষের কাছেই একমাত্র স্বর্গীয় চিন্তা না-ও হতে পারে। আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি যে ভাবনার পার্থক্যকে মেনে নিতে শেখার নামই মানুষ হওয়া। সন্তান জন্ম না দিতে চাওয়ার ব্যাপারটা কারও কারও কাছে খুবই স্বাভাবিক এবং স্বাচ্ছন্দ্যের। কারও কারও কাছে তো এই ব্যাপারটা জীবনের সবচেয়ে বড়ো ও যুক্তিসংগত একটা পিছুটান। অনেক দাম্পত্য সম্পর্কই ‘আটকে’ থাকে কেবল এই পিছুটানের কারণে। দুজন মানুষ অনেক ভালো থাকতে পারত যদি এই পিছুটানটা তাদের একধরনের অদৃশ্য বাধ্যতায় বেঁধে না রাখত। ডিভোর্স হয়ে যাবার পর আমি অনেককেই সুখী ও সফল মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দেখেছি।




দুই. ‘সন্তান নিজের বীর্যে সৃষ্ট কিংবা নিজের পেটেরই হতে হবে।’ এমন করে সবাই এখন আর ভাবে না। খোঁজ নিন, জানতে পারবেন। এসব শুনে আঁতকে উঠবেন না যেন! এই দুনিয়া আপনার বাপের সম্পত্তি নয় যে এখানে যারা থাকবে, তাদের সবাইকেই আপনার মনমতো ভেবেচিন্তে বাঁচতে হবে।




তিন. ‘আমরা দুজন থেকে তিনজন হব।’ এই ব্যাপারটা অনেকের কাছে শুধু সিনেমার গল্পেই সুন্দর মনে হয়, নিজেরা এরকম কিছু চায়ই না! ওদের নিয়ে আপনার কিছু বলার কেন থাকবে? আপনার মন চাইলে আপনি নিজের বাসায় কয়েকটা ফুটবল টিম বানান না, কে বারণ করেছে আপনাকে?




চার. সমাজকে ‘শারীরিক সক্ষমতার’ প্রমাণ না দেওয়ার মতন সাহস কিছু মানুষ অনেক আগেই অর্জন করে ফেলেছেন। সমাজকে কোনও কিছুরই প্রমাণ না দিতে চাওয়ার মানসিকতা যাদের আছে, তারাই জীবনটাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে।




আপনার চিন্তা, আপনার মত, আপনার পথ খুবই চমৎকার, ঠিক আমার চিন্তা-মত-পথের মতোই। যখন আপনি আমার আশেপাশে এসে আপনার পথে আমাকে টানতে চান, তখন আপনাকে দেখলে আমার চোখে ভাসে রাস্তার সেই ক্যানভাসারের মুখটা…আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের মলমখানা! কিংবা ওই যে টাইওয়ালা বিরক্তিকর ‘জেন্টলম্যান’দের একটা কোম্পানি ছিল না…ডেসটিনি টু-থাউজেন্ড লিমিটেড! মনে পড়ে? ওই যে নিজের পচা ফালতু কোম্পানিকে জোর করে হলেও বেচতে চাইত না কিছু ধান্দাবাজ পাবলিক? ওরা এবং আপনি জিনিস কিন্তু একই! জোর করে চাপিয়ে-দিতে-চাওয়া যেকোনও জিনিস দেখলেই কিন্তু দুইনাম্বার মনে হয়।




লোকে নিজের চমৎকার বউটির দিকে অন্যকে টানতে চায় না, কিন্তু নিজের 'সুচমৎকার' মত-পথের দিকে পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে টানতে চায়, যদিও দুই-ই একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ। যা-কিছু ব্যক্তিগত, তা-কিছু ব্যক্তিগতই থাকুক না---হোক তা বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস।




৮. কোনও গুণী এবং জনপ্রিয় মানুষকে অনেক নারীই নিজের প্রেমিক অথবা স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এদের কেউ কেউ তো পার্টনারের সাফল্য রীতিমতো নিজের গায়েই মেখে ফেলে! স্বামী সহযোগী অধ্যাপক হলে এইট-পাশ নিজে অধ্যাপক হয়ে বসে থাকে। অন্যদিকে, নারীরা ওরকম বৈশিষ্ট্যের কোনও বান্ধবীকে সহ্যই করতে পারে না, বান্ধবীর খ্যাতি অনেক নারীই সহনশীল মনে গ্রহণ করতে পারে না। বান্ধবীর অবস্থান থাকবে নিজের অবস্থানের নিচে, মেয়েরা এই নীতিতে বিশ্বাসী।




পুরুষদের বেলায় এই ঘটনার পুরো উলটোটা ঘটতে দেখা যায়। পুরুষেরা সাধারণত বহুকষ্টে বুদ্ধিমতী নারীকে মেনে নেয়, এই পর্যন্তই। খ্যাতি পেয়ে-যাওয়া প্রেমিকা কিংবা বউকে তারা গ্রহণ করতেই চায় না। আবার ওদিকে জনপ্রিয়তা পেয়ে-যাওয়া স্রেফ পরিচিত কোনও পুরুষকে অবলীলায় নিজের বন্ধু বানিয়ে দিতেও অনেক পুরুষের তেমন একটা সমস্যা হয় না।




৯. আমরা মনে করি, দর্শন মানে হচ্ছে, একটা বিষয়ে আমার চিন্তাই শেষকথা, এর পরে আর কিছুই নেই। অথচ দর্শনে শুরু কিংবা শেষ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। মোটকথা হচ্ছে, দর্শন মানে, যে সুড়ঙ্গপথে আমি যাত্রা শুরু করেছি, সে পথে আরও একশোটা ভিন্ন চিন্তাধারা থাকতে পারে, ওই একশো চিন্তার শাখা হয়তো আবার এক হাজার রকমের। এটা মেনে নিতে পারে না যে, তার দর্শন দর্শন নয়, গোঁয়ার্তুমি।




১০. মানুষ কোনওভাবেই তুলনা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না, ব্যাপারটা বাদ দিতে চাইলেও মনে মনে তুলনা চলতেই থাকে। সেই তুলনা সে করে হয় অন্য এক বা একাধিক মানুষের মধ্যে, নাহয় নিজের সাথে নির্দিষ্ট কারুর অথবা নিজের সাথে নিজের। মানুষ সাধারণত তুলনা করা একেবারে বাদ দিতে পারে না, যেটা পারে সেটা হচ্ছে তুলনা করা কমিয়ে দেওয়া। মানুষ তুলনায় যায়, আর নিজের কষ্ট বাড়ায়। নিজের যা আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে যারা, তারাই প্রকৃত সুখের দেখা পায়।




১১. আমার কাছে মনে হয়, ‘পারফেক্ট’ বলে পৃথিবীতে আসলে কিছুই নেই। ওটা অভিধানের একটা শব্দই মাত্র। তবে ‘পারফেক্টের কাছাকাছি’ বলে পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে, যেগুলির পারফেকশনের পরিমাণ ও মাত্রা নির্ভর করে একজন মানুষের দেখার চোখের উপরে।




১২. ছাত্রজীবনে টাকা গুনতে শেখা বেশিরভাগ মানুষই আর মানুষ হতে পারে না, হারিয়ে যায়। প্রায় ক্ষেত্রেই এর কারণটা হচ্ছে লোভ। ছাত্রজীবনে লোভ কী আর কীভাবেই-বা লোভমুক্ত থাকা যাবে, সেই ব্যাপারে সাধারণত আমাদের কোনও স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। ওই সময়ে কেউ কেউ বড়ো অঙ্কের টাকা কিংবা অন্য যেকোনও লোভের কাছে নিজের সমস্ত সম্ভাবনা আর সময়কে বিকিয়ে দেয়। আসলে ওই বয়সে খুব একটা শক্ত জীবনবোধও তৈরি হয় না। দেখা যায়, কেউ কেউ নিজের পড়া ফাঁকি দিয়ে টিউশনি করেই ছাত্রজীবনে লাখ টাকা আয় করে এবং ওখানেই থেমে যায়। অথচ, সে হয়তো পড়াশোনাটা ঠিক করে করলে আরও অনেক ভালো কিছু করতে পারত। ছাত্রজীবনে সাধারণত এটা অনেকেই বোঝে না। তবে টিউশনি জিনিসটা নিঃসন্দেহে দারুণ একটা ব্যাপার, যদি টিউশনি-করা ছাত্রটি বোঝে তাকে কখন কতটুকুতে থামতে হবে। পরিমিতিবোধ এক্ষেত্রে জরুরি।




টিউশনি কতটা দারুণ, বলি। স্টুডেন্ট পড়ানোই দুনিয়ার একমাত্র কাজ, যেখানে খালি চোখে দেখা যায় স্টুডেন্ট টাকা দিয়ে শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞানলাভ করছে অথচ এটা দেখা যায় না যে, শিক্ষক টাকা তো পাচ্ছেনই, পাশাপাশি স্টুডেন্টের পড়াশোনা এবং জীবন থেকে প্রতিনিয়ত কিছু-না-কিছু শিখেই যাচ্ছেন। হ্যাঁ, সত্যিই অনেক কিছু শেখা যায় স্টুডেন্টদের কাছ থেকে।




১৩. কোভিড-নাইনটিনের সময়ে বহু সম্ভাবনাময় মানুষ হতাশায় তলিয়ে গেছেন। বিভিন্ন গবেষণায় এ-ও বলা হয়েছে যে, ২০২০ সাল ছিল পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ অবধি আসা সবচাইতে জঘন্য বছর।




লকডাউনের সময়টা অনেকেই খুব বাজেভাবে নষ্ট করেছেন। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা এক্কেবারে অন্যরকম মনে হয়েছে। একদল মানুষ যেমন এই কঠিন সময়ে হারিয়ে গেছেন, আরেকটা দল তেমনি নিজেদের ভেতরকার সম্ভাবনাকে জাগ্রত করেছেন। কেউ একজন ছবি আঁকতে গিয়ে বৃদ্ধবয়সে এসে বুঝতে পেরেছেন যে ওটাই আসলে তাঁর প্যাশন, কিন্তু এটা ওটার চাপে তাঁর মধ্যে সুপ্ত-থাকা এই প্যাশনের কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। অনেকেই রান্না করতে করতে রান্নাঘরেই স্বর্গের স্বাদ পেয়েছেন, কেউ-বা নিজের তৈরি গয়নার মাঝে সবটুকু আনন্দ ঢেলে দিয়েছেন। খেয়াল করেছি, করোনা কিন্তু শুধু কেড়েই নেয়নি, আবিষ্কার করার অবারিত সুযোগও দিয়েছিল, যেই সুযোগটা সবাই ঠিক ধরতে পারেনি।




১৪. আপনি আপনার কোনও বন্ধুর ব্রেকআপের পরে কোনওভাবেই তাকে বাস্তবতা বোঝাতে পারবেন না। আপনাকে বন্ধুত্বরক্ষার খাতিরে তার মনের মতন করে কথা বলতে হবে। এমন সব কথাবার্তাও বলতে হবে, যেগুলি শুধু মিথ্যেই নয়, রীতিমতো প্রতারণা পক্ষে জলজ্যান্ত সাফাই!




ব্রেকআপের পরে সাধারণত সব মানুষই নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে চায়। কেউই স্বীকার করতে চায় না যে, ভুলটা দুজনেরই ছিল কিংবা তার একার ছিল। ‘যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।’ কিংবা ‘এখানে তোরও তো দোষ ছিল।’ টাইপের কথা আপনি যদি ব্রেকআপের পর আপনার বন্ধুকে বোঝাতে যান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি তার শত্রু হয়ে যাবেন। সে চাইবে তার প্রাক্তনকে নিয়ে তার বন্ধুটাও হাসিঠাট্টা করুক, উলটাপালটা মন্তব্য ছু্ড়ে দিক। আর বন্ধুর কাছ থেকে প্রত্যাশিত এরকম নোংরা আচরণকে আমরা বলি ‘বিপদে পাশে থাকা’। যে এসব বাজে কাজ করে পাশে থাকে, তাকে আমরা অনেকেই বলি ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’।




কোনও ভুল কাজে সমর্থন দেওয়া আর যেকোনও অহেতুক আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া মানুষটিকে যারা বেস্ট ফ্রেন্ড বলে, তারা নিজেরাই একটা সময় পরে আর বন্ধুত্বে বিশ্বাস করতে পারে না, এমনকি নিজেও কারও ভালো বন্ধু হতে পারে না।




প্রাক্তনকে নিয়ে যারা নিজেরা বাজে কথা বলতে পারে কিংবা অন্যকে বাজে কথা বলতে দেয়, তাদের ভালোবাসার শুদ্ধতা নিয়ে আমি সন্দিহান।




১৫. দাম্পত্য সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা যতটা দরকার, তার চাইতে বেশি দরকার স্বচ্ছতাকে মেনে নিতে পারার মতো মানসিকতা। স্বচ্ছতার মানেই হচ্ছে, সেখানে অপ্রীতিকর কিছু বিষয় সামনে চলে আসবে, আর যদি সেগুলি মেনে নিতে পারার মতো মানসিকতা তৈরি না হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই একটা সম্পর্কে শান্তিরক্ষার স্বার্থে স্বচ্ছতাটা আর থাকবে না। সত্য মেনে নিতে পারে না যে, মিথ্যার মধ্যে বাঁচাই তার একমাত্র নিয়তি। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়া বেশ কাজে দেয়। যদি ওরা দুজন পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, তবে তাদের মধ্যকার অনুভূতি ও সত্যের বিনিময়টা অনেক সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। ছাড় দিতে হয় দুজনকেই, মেনে ও মানিয়ে নিতে হয় দুজনকেই। দুজনের মধ্যেই তো সীমাবদ্ধতা থাকে, পাশাপাশি থাকতে চাইলে সেগুলিকে সহ্য করেই তো থাকতে হবে। 'সে কেন আমার মনের মতন নয়?' এরকম করে ভাববার আগে ভাবতে হবে, 'আমি নিজেই কি তার মনের মতন?' একজন মানুষকে সে যেমন, তেমন করে মেনে নিতে পারার মধ্যেই রয়েছে যেকোনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জাদু।